তারপর?
‘অপুর সংসারে’র শেষ দৃশ্যে হারিয়ে-পাওয়া ছেলে কাজলকে ঘাড়ে চাপিয়ে নদীর পাড় ধরে হাঁটা ধরেছিল অপু। কাজল না হয় ‘অচেনা’ বাবার জন্য ব্যাকুল ছিল। কিন্তু অপু? ঘর ভেসে গেছে। উড়নচণ্ডী জীবন। চালচুলো চাকরিবাকরি কিছু নেই। একরত্তি কাজলকে নিয়ে কোথায় ভিড়বে অপুর তরী?
বিভূতিভূষণ এর উত্তর লিখে গেছিলেন। ‘অপরাজিত’ উপন্যাসেই তার বিশদ সম্প্রসারণ ছিল। সত্যজিৎ অবশ্য অতকিছুর মধ্যে অপুকে জড়াতে চাননি। জড়ালেন তরুণ চলচ্চিত্র পরিচালক শুভ্রজিৎ মিত্র। তৈরি হল ‘অভিযাত্রিক’। তাঁর অসাধারণ চিত্রনাট্য থেকে শুভ্রজিৎ বাদ দিলেন না বিভূতিভূষণকেও। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ালেন সত্যজিৎকেও। বছর দুয়েক আগে ‘অভিযাত্রিকে’র কাজ সারা হয়েছিল। দেশবিদেশের গুচ্ছের ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে মন-কেমন-করার পসরা ফিরি করার পর এই ঝিম ধরা শীতের বেলায় সাড়ম্বরে শুভমুক্তি হল। ৩ ডিসেম্বর থেকে কলকাতার সিনেমায়-মাল্টিপ্লেক্সে দেখানো হচ্ছে ঘণ্টা দুয়েকের এই ছায়াছবি। পরদিন সন্ধেয় মোটের ওপর ভরে থাকা নন্দনের ব্যালকনিতে বসে ‘অভিযাত্রিক’ দেখে মনে হল বুদ্ধদেব বসুর কথাটা সর্বাংশে ঠিক নয়। অন্তত বাঙালির বেলায় তাঁর ওই কথাটা খাটে না।
কী কথা? বুদ্ধদেব লিখেছিলেন, ‘অতীতের রোমন্থন অকৃতীর লক্ষণ।’ কথাটার মধ্যে এক আঁটি বিছুটিপাতা লুকোনো আছে। ঘষে গেলে জ্বলুনি হয়। আমাদের ইদানীংকালের নাগরিক শিল্পচর্চা যে অসহায়তা নিয়ে ‘ভদ্রলোক’ কালচারের অস্তাচলের মহিমা গায়, তাতে মনে হতেই পারে, যে সিকি শতক আগে রোমন্থন নিয়ে যে ফোড়ন কেটেছিলেন তপন রায়চৌধুরী (‘রোমন্থন বা ভীমরতিপ্রাপ্তের পরচরিতচর্চা’), সেটা দিন কে দিন সত্যি হয়ে উঠছে। সত্যজিতের জন্মশতবর্ষ এসে হিসেব গুলিয়ে দিয়েছে। প্রত্যক্ষে হোক বা পরোক্ষে, নয় নয় করে চারটে ছায়াছবির বিষয় সত্যজিৎ। ‘অভিযাত্রিক’ এই তালিকায় সবার আগে এল। এবং আমাদের মন ভরে গেল।
কার মন কেন ভরে উঠবে, তার কোনও পাইকারি প্রেসক্রিপশন নেই। তবু যাঁরাই ‘অভিযাত্রিক’ দেখতে যাচ্ছেন, তাঁরাই আনমনা হয়ে বেরিয়ে আসছেন এবং দিনের পর দিন ধরে ওই ভালোলাগাটুকু ভেতরে ভেতরে লালন করতে চাইছেন। এর প্রধান কারণ নস্ট্যালজিয়া। সেপিয়া না হোক, সাদা-কালোই সই। তাতেই ‘অভিযাত্রিক’ তুলেছেন চিত্রগ্রাহক।
‘অভিযাত্রিকে’র পালা পড়েছে ১৯৪০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ের কলকাতায়। শুধু কলকাতা বললে ভুল হবে– কাশীতে, নিশ্চিন্দিপুরে এবং অসমে। এ কলকাতা কোন কলকাতা? এ কলকাতায় পাঞ্জাবির পকেটে রিভলবার নিয়ে বিপ্লবের মহড়া করেন তরুণের দল। এ কলকাতার সঙ্গে হাওড়াকে জুড়ে দেয় নতুন প্রযুক্তির ক্যান্টিলিভার ব্রিজ। এ কলকাতায় গাঁটের কড়ি খরচা করে উপন্যাস বের করে ষষ্ঠ জর্জের মার্কালাগানো কড়কড়ে নোটে ১০০ টাকা রয়্যালটি পেয়ে বর্তে যায় অপু।
তা বলে কলকাতা ‘অভিযাত্রিকে’র নায়ক নয়। এমনকি কাশী-নিশ্চিন্দিপুরও নয়। ‘অভিযাত্রিক’ আদ্যোপান্ত অপুর। এই অপু (অর্জুন চক্রবর্তী) একেবারে সত্যজিতের আদলে গড়া এমনটাও নয়। দিশি রাজার এস্টেটে বড়ো চাকরি পেয়ে কাজলকে (আয়ুষ্মান মুখোপাধ্যায়) নিয়ে ট্রেনের ফার্স্ট ক্লাসে চেপে যেতে যেতে অপুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল লীলার (অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়)। লীলার সাবপ্লট খুবই যত্ন নিয়ে সাজিয়েছিলেন বিভূতিভূষণ। সত্যজিৎ বাদ দিয়েছিলেন। অপুর মনোজীবনের এই শূন্যতা কড়ায়গণ্ডায় উশুল করে দিলেন শুভ্রজিৎ।
অর্জুনের পাশে অর্পিতাকে মানাল না। অর্জুনের নিচু চাবির অভিনয়ের পাশে খামোখা হাঁকপাক করতে গিয়ে আরও বেমানান হয়ে গেলেন অর্পিতা। তবু ‘পথের পাঁচালী’র তারসানাইয়ের অনুসরণে লীলার হাহাকারের মুহূর্তে সেতারে ঝংকার তুললেন ‘অভিযাত্রিকে’র সংগীত পরিচালক বিক্রম ঘোষ। এ ছায়াছবি শুরুই হয়েছিল অনুষ্কাশঙ্করের সেতারে তাঁর বাবা রবিশঙ্করের ‘পথের পাঁচালী’ থিমের এক পুনর্নির্মাণ দিয়ে। বিক্রমের তুখোড় সংগীতবোধ সারা ‘অভিযাত্রিক’ জুড়ে স্মৃতিবাহী নকশিকাঁথা বুনে চলল। সিনেমা অফ সত্যজিৎ রায়ে যাঁর অবগাহন যত বেশি, তত নাড়া খেলেন তিনি।
অপুর পেছন পেছন আমাদের যেখানে যেখানে নিয়ে গেলেন শুভ্রজিৎ, সেখানেই রঙিন সুতোর ফোঁড় উঠল। লীলার খেই ধরে অপুর ভেতর অচরিতার্থতার এক অচিন নকশা বোনা হয়ে গেল মণিকর্ণিকা ঘাটে। কাশীর টানে আরও একবার ‘অপরাজিত’র লোকেশনগুলোতে আমাদের ঘুরিয়ে আনলেন শুভ্রজিৎ। শট সিলেকশনেও সুব্রত মৈত্রের সিনেম্যাটোগ্রাফিকে নজরানা দিতে দিতে এগোনোয় আমাদের মনের মধ্যে সমান্তরাল আরও এক দর্শন চলতে থাকল। মধুর ভাণ্ডারকরের প্রযোজক সংস্থা যেমন রসিক তেমন দরাজ। তাঁদের সৌজন্যে এক চিলতে সব ক্যামিওতে নজর কাড়লেন তনুশ্রীশঙ্কর, রূপাঞ্জনা মৈত্ররা।
কলকাতা ‘পরিচ্ছেদে’ (এভাবেই ‘অভিযাত্রিকে’র চার অধ্যায়কে চিনিয়ে দিয়েছেন নির্দেশক) বইয়ের ব্যাপারী হয়ে দুই পৃথিবীর মিসিং লিঙ্ক হয়ে মন ভোলালেন বরুণ চন্দ। নিশ্চিন্দিপুরে পাওয়া গেল সোহাগ সেন, শ্রীলেখা বসু, বিশ্বনাথ বসুদের। ‘পথের পাঁচালী’র স্মৃতি উথলে দিয়ে হরিহরের ভেঙে পড়া বাড়িতে কাজলকে নিয়ে গেল অপু। যে বাড়ির সঙ্গে আড়াআড়ি ‘পথের পাঁচালী’র ড্রামাটিক টেনশনের উৎস, সেই পরিবারটির সঙ্গে ফের মাখামাখি হল অপুর। দুর্গাপুজোর মণ্ডপে বৈষ্ণব ঘরানার কীর্তন গৈ-গেরামের সমন্বয়ের জীবনকে চেনাল।
কাস্টিং ডিরেক্টর সোহাগকে কাশীর এক চিলতে দৃশ্যে চিনিয়ে দিয়েছিলেন শুভ্রজিৎ – নিশ্চিন্দিপুরের বড়দি হিসেবে। পরে তাঁকে দিয়ে ইন্দির ঠাকরুনের গাওয়া ঘুমপাড়ানি গানের স্মৃতি তাজা করিয়ে নিলেন। চল্লিশ দশকের নিশ্চিন্দিপুরকে চেনানোর জন্য যদ্দূর বুঝছি টাকির আশেপাশে যেতে হয়েছিল ‘অভিযাত্রিক’ টিমকে। কাশবন ইত্যাদি হল। কিন্তু ট্রেনগাড়ির বিস্ময় তো মুছে গেছে কবে! কী করবেন নির্দেশক? আকাশপথে উড়িয়ে দিলেন সাঁজোয়া বিমানের ঝাঁক। হোয়াট অ্যান আইডিয়া! কতক জানা, কতক অজানা সুতোর টানে আমাদের নস্ট্যালজিয়াকে মধুর করে তুললেন শুভ্রজিৎ।
‘অভিযাত্রিকে’র পালা পড়েছে ১৯৪০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ের কলকাতায়। শুধু কলকাতা বললে ভুল হবে– কাশীতে, নিশ্চিন্দিপুরে এবং অসমে। এ কলকাতা কোন কলকাতা? এ কলকাতায় পাঞ্জাবির পকেটে রিভলবার নিয়ে বিপ্লবের মহড়া করেন তরুণের দল। এ কলকাতার সঙ্গে হাওড়াকে জুড়ে দেয় নতুন প্রযুক্তির ক্যান্টিলিভার ব্রিজ।
ওস্তাদের মার দিলেন শঙ্করের (সব্যসাচী চক্রবর্তী) সঙ্গে অপুর ছোটি সি মুলাকাত ঘটিয়ে দিয়ে। ‘চাঁদের পাহাড়ে’র শঙ্করের সঙ্গে অপুর দেখা হবার কোনও সূত্র বিভূতিভূষণ দিয়ে যাননি। দিল সমকালীনতা। এইটুকু ধরতাই নিয়ে কামাল করলেন শুভ্রজিৎ। গ্লোবট্রটার বাঙালির প্রোটোটাইপে গেঁথে নিলেন দু’জনকে। নিয়ে গেলেন সারনাথের প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের জমিতে। উত্তর-পূর্ব ভারতের উজানি পাহাড়ে। এই সবকিছুর মধ্যে না-থেকেও আমাদের মনে উঁকি মেরে গেলেন ‘আগন্তুক’-এর মনোমোহন। গ্রামের শেকড় তুলে নগরে এসে পড়া বাঙালি কীভাবে বিশ্বনাগরিক হয়ে উঠল, তার প্রতীক হয়ে উঠল অপু।
সিনেম্যাটিক জায়গা থেকে দুটো মোক্ষম চাল দিয়েছেন নির্দেশক। এক, অপর্ণাকে (দিতিপ্রিয়া রায়) বারে বারে অপুর পাশে এনেছেন। দুজনের নির্বাক সংলাপ গড়ে তুলেছেন। দিতিপ্রিয়ার মুখে একটা কথাও নেই, তবু ওই আঁখির তারা কত কথা বলে গেছে ‘অভিযাত্রিক’ জুড়ে। দুই, বাপ-বেটার এমন যুগলবন্দি আমাদের দেখাননি সত্যজিৎ। দেখিয়েছিলেন তাঁর গুরু ভিত্তোরিয়া দি সিকা। ‘বাইসিকল থিফ’-এর এবার পঁচাত্তর বছর হল। মা-হারা ছেলের জন্য বাবার দরদ, তাকে নিজের করে নেবার আকুতি, তাকে ছেড়ে যাবার কুহক টান – এ সব দিয়ে এক নিটোল সম্পর্ক গড়ে দিলেন নির্দেশক। সব্যসাচী-অর্জুনের রসায়নও আমাদের মনে থেকে গেল। কাজলের ভূমিকায় ছোট্ট আয়ুষ্মান এমনিতে সাদামাটা। কিন্তু মানিয়ে গেল।
লাস্ট, বাট সার্টেনলি নট দ্য লিস্ট, এ ছবির অপুর ভূমিকায় অর্জুন চক্রবর্তী। সোহাগ সেনের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। বলছিলেন, অর্জুনের মধ্যে একটা ভালনারেবিলিটি আছে, আর সেটার জন্যই তাঁকে বেছেছিলেন তিনি। রাইট চয়েস। প্রথমত, দড়কচা মেরে যাওয়া কাউকে দিয়ে এটা করালে অনেক ধরনের অসুবিধে হত। দ্বিতীয়ত, অর্জুন অতি সংবেদনশীল অভিনেতা। ‘অভিযাত্রিক’-এর স্থিতধী মেজাজের সঙ্গে মানানসই। তাঁর চোখের অভিব্যক্তিতে যে গভীর অনুসন্ধান আছে, সেটাই এ ছায়াছবির আসলি চিজ। সেটাকে একবারের জন্যও আলগা হতে দেননি অর্জুন। সব্যসাচী-অর্জুনের মধ্যে দিয়ে যে ওয়ান্ডারলুস্তকে ফেরাতে চেয়েছিলেন নির্দেশক, তার ষোলোকলা পূর্ণ হয়েছে।
তাই একবার-দুবার নয়, বারেবারে নিজেকে ও নিজেদের ফিরে দেখার দোর হাট করে খুলে দিয়েছে ‘অভিযাত্রিক’।
অংশুমান ভৌমিকের জন্ম ১৯৭৫-এ কলকাতায়। ছেলেবেলা কাটিয়েছেন মামারবাড়ি নবদ্বীপে। গত চার দশক কলকাতার বাসিন্দা বা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরিজির এমএ হলেও বাবার 'দেশ' বরিশাল আর মায়ের 'দেশ' নদিয়ার মধ্যে দোদুল্যমান তাঁর অস্তিত্ব। পেশায় শিক্ষক, নেশায় কালচারাল কমেন্টেটর। বাংলা ও ইংরেজিতে লেখালেখি করছেন দু'দশকের বেশি। দেশবিদেশ থেকে প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা বারো। 'দ্য টেলিগ্রাফ' ও কৃত্তিবাস-এর নাট্যসমালোচক হিসেবে ইদানীং থিতু।