গ্রীষ্ম, ২০১৭। আজকাল’ খবরের কাগজের তখনকার রবিবাসর সম্পাদক শৌণক লাহিড়ী জিজ্ঞেস করলেন, শারদ সংখ্যার জন্যে শর্মিলা ঠাকুরের চলচ্চিত্র জীবন নিয়ে একটা দীর্ঘ লেখা লিখতে রাজি কিনা। রাজি তো মহানন্দে, কিন্তু যোগাযোগ? কিছুতেই যখন কিছু হচ্ছে না, তখন সেতু বাঁধলেন বন্ধু মলয় গঙ্গোপাধ্যায়, কলকাতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুদ্রক। যোগাযোগ করিয়ে দিলেন কলকাতায় শর্মিলা ঠাকুরের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ পরিবারটির সঙ্গে। ফলে শর্মিলা ঠাকুরকে যখন ফোনে ধরলাম, তিনি আমার পরিচয় এবং উদ্দেশ্য জানেন। সম্মতি অবশ্য পাওয়া গেল দীর্ঘ কথোপকথনের পর। “আমি কিন্তু আগে পড়ব কী লিখেছেন, তারপর ছাপার অনুমতি।”

তাহলে তো আরও ভালো। বলুন, কবে থেকে একটানা অন্তত দিন দশেক সময় দিতে পারবেন? সেই মতো দিল্লি পৌঁছই।

“দশ দিন! এখন তো পারব না। সামনের সপ্তাহেই লন্ডন যাচ্ছি।” বললেন শর্মিলা ঠাকুর, সত্যজিৎ রায়ের সৃর্যালোক থেকে শক্তি সামন্তের চন্দ্রালোকে যিনি স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেরিয়েছেন, তার সঙ্গে ভারতীয় ক্রিকেট টিমের সবচেয়ে বর্ণময় অধিনায়ক এক অক্সফোর্ড ব্লুয়ের গৃহিণী এবং নবাবের প্যেয়ারি বেগম। পুত্র, পুত্রবধূ, কন্যা সকলেই রুপোলি আকাশের নক্ষত্র।

“এখানকার গ্রীষ্ম-বর্ষা আমি সাধারণত লন্ডনের বাড়িতে কাটিয়ে ফিরি।”

তাই হল। তিনি দেশে ফিরলেন শ্রাবণ শেষে। ফিরেই অবশ্য রাজি হলেন মুখোমুখি বসতে। টানা সাক্ষাৎকার এবং পরবর্তী অনুমোদন পর্বের শেষে লেখা যখন প্রস্তুত হল, শৌণক তখন পাগলপারা, কারণ অন্য সব লেখাই জমা পড়ে গেছে এবং শারদ সংখ্যা তখন ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই ছোট সে তরী! সুতরাং,অনেকখানিই না-বলা রয়ে গিয়েছিল সে যাত্রা।

এবার সবটা মিলিয়ে নতুন করে তৈরি হল বাংলালাইভের জন্য। নাম থাকল, মনে, রেখে দেব’, যা তর্কসাপেক্ষে শর্মিলা ঠাকুরের সবচেয়ে বিখ্যাত সংলাপ।

Sharmila Tagore
ঠাকুরবাড়ির ছোট্ট স্কুলপড়ুয়া মেয়ে আচমকা একদিন হয়ে গেলেন সত্যজিতের ছবির নায়িকা। ছবি সৌজন্য – filmistaan.org

কেউ ভাবতে পেরেছিল, ভারতীয় চলচ্চিত্রের এক উদাসীন সম্রাজ্ঞীর জন্যে আসন সাজাচ্ছে সেই বিকেল?
সেটা ১৯৫৮। ত্রয়োদশী রিঙ্কুকে সঙ্গে নিয়ে সেদিন সত্যজিৎ রায়ের বাড়িতে এসেছেন গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পৌত্র গীতীন্দ্রনাথ এবং তাঁর স্ত্রী ইরা। পথের পাঁচালী’ (১৯৫৫), ‘অপরাজিত’-র (১৯৫৬) দীপ্যমান পরিচালক তখন থাকেন লেক অ্যাভিনিউতে।
পরশপাথর’ (১৯৫৮) আর জলসাঘর’-ও (১৯৫৮) ততদিনে শেষ, ‘অপুর সংসার’-এর (১৯৫৯) অপর্ণা খুঁজতে খুঁজতে তিনি হয়রান। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েও লাভ হয়নি। হঠাৎই তাঁর কানে এসেছে প্রায়-প্রতিবেশী এবং পূর্বপরিচিত ইরা ও গীতীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ডায়োসেশনে পড়া জ্যেষ্ঠ কন্যাটির কথা। ফোন করে গীতীন্দ্রনাথকে অনুরোধ করেছিলেন সত্যজিৎ, যদি রিঙ্কু, মানে শর্মিলাকে নিয়ে ঠাকুর-দম্পতি একবার লেক অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে আসেন।
কন্যাকে দেখামাত্রই সেদিন পছন্দ হয়েছিল পরিচালকের এবং বাকিটা ইতিহাস। এক অভিনেত্রীর তারকা হয়ে ওঠার মতো নিয়মিত ঘটনা নয়
, নিজের শর্তে দেশের চলচ্চিত্র জগৎ শাসনের এক অনন্য ইতিহাস।

Sharmila Tagore
নিজের শর্তে শাসন করেছেন ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাস। ছবি – লেখকের সংগ্রহ

সংলাপ পছন্দ না হওয়ায় হিন্দি ছবির সুপ্রতিষ্ঠিত পরিচালকের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তর্ক করেছেন। প্রত্যাখ্যান করেছেন একের পর এক ছবিতে অভিনয়ের প্রস্তাব। ফ্ল্যাট ভাড়া করে মায়ের সঙ্গে থাকাটাই যখন হিন্দি ছবির নায়িকাদের রীতি, তখন একা একাই থেকেছেন বম্বের নামীদামি হোটেলে। ধূমপান বা মদ্যপানের জন্যে কোনও আড়াল খোঁজেননি কখনও। পটৌডির নবাবের সঙ্গে প্রণয়-পর্বে বিদেশে শ্যুটিং চলার সময় ইউনিটকে কিছু না জানিয়ে থাকার জায়গা পাল্টে ফেলেছেন। গোটা ইউনিট কথা বলা বন্ধ করে দিলেও তোয়াক্কা না-করে ভ্রমণ-সূচি নিজের প্রয়োজন মত বদলে নিয়ে একেবারে শ্যুটিংয়ের নির্ধারিত দিনে লেবাননের মত অচেনা দেশের হোটেলে সরাসরি হাজির হয়েছেন।

ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ইডেন গার্ডেন টেস্ট দেখতে আসার জন্যে ধর্মেন্দ্রকে রাজি করিয়ে রাতভর শ্যুটিং করে বম্বে থেকে কলকাতার প্লেন ধরেছেন।  মানিকদা ডেকেছেন, যেতেই হবেবলে রাজেশ খন্নার সঙ্গে বিখ্যাত গানের দৃশ্য পরিচালককে আলাদা আলাদা নিতে বাধ্য করেছেন। অনায়াসে বলতে পারেন, পদ্মভূষণ-এর মত দুর্লভ রাষ্ট্রীয় সম্মান সাজিয়ে তো রাখিনি, কোথাও একটা আছে।কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতি তোলপাড় করে কানে বাজতে থাকে অদিতি চরিত্রে শর্মিলা ঠাকুরের মুখে নায়ক’-এর সেই অমোঘ সংলাপ – “মনে, রেখে দেব।মনে আর রেখে দেব-র মধ্যে অতি-সংক্ষিপ্ত যে বিরতির জন্যে কালজয়ী এবং সম্ভবত শর্মিলা ঠাকুরের বিখ্যাততম হয়ে আছে ওই সংলাপটি, লিখতে গিয়ে একটি কমা-চিহ্ন ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প খুঁজে পেলাম না।

***

সহ-অভিনেতা হিসেবে উত্তমকুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, রবি ঘোষের মত বাঙালি থেকে শুরু করে শশী কাপুর, ধর্মেন্দ্র, সঞ্জীবকুমার, রাজেশ খন্নার মত তারকাদের কেমন দেখেছেন, সে বিষয়ে কথা বলেছেন কোনও রাখঢাক না রেখে। এসবের সঙ্গেই বলেছেন তাঁর শাশুড়ি, ভূপালের নবাব বেগম সাজিদা সুলতানের কথা, যিনি বিয়ের পর শর্মিলার নতুন নাম দিয়েছিলেন আয়েশা সুলতানা। শাশুড়ির রাজকীয় আদবকায়দার কথা বলতে বলতেই জানিয়েছেন, “প্রিভি পার্স বাতিল হওয়ার পর ভূপালের রাজপ্রাসাদ ছেড়ে মস্ত লেকের ধারে ২৫ একর, মানে ৭৫ বিঘে জমির ওপর ছোটবাড়িতে থাকতে শুরু করেন আম্মা (এই নামেই শাশুড়িকে ডাকতেন তিনি)। তিনি যেমন নিজের জাগুয়ার গাড়ির মেরামতির ব্যপারটা অনেক সময়েই মেকানিকদের চেয়ে ভালো বুঝতেন, তেমনই ভেঙে যাওয়া ঝাড়বাতির টুকরো জুড়ে জুড়ে নতুন ঝাড়বাতি তৈরিতেও তাঁর উৎসাহ কম ছিল না।৭৫ বছরের সুদীর্ঘ জীবনের পরতে পরতে বিন্যস্ত এই সব গল্প শর্মিলা ঠাকুর শুনিয়ে চলেন এক স্বভাব-বেগবতী ঝর্ণার মত।

কিন্তু সেখানেও কী আসমান-জমিন বৈপরীত্য! কথকের আসনে তাঁকে বসানো সহজসাধ্য নয়, একটানা লম্বা সময় আদায় তো অসম্ভব। কিন্তু কথা যখন বলেন, তখন সহজ এবং অকপট। সেই স্বতঃস্ফূর্ততায় ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসে তাঁর শীতল আভিজাত্যের বরফ দেওয়াল। র‍্যয়না বীতি যায়ে… রাত বাড়তে থাকে। আর যাবতীয় গ্ল্যামার-দ্যুতির আড়াল থেকে বেরিয়ে আসেন মানুষ শর্মিলা। কাশ্মীর কি কলি’-র ‘চম্পা’র সেই ‘চাঁদ সা রোশন চেহরা’ পেরিয়ে তিনি কখন যেন হয়ে ওঠেন আবিষ্কার’-এর ‘মানসী’, আর আমাদের কানে বাজতে থাকে ‘হসনে কী চাহ নে কিতনা মুঝে রুলায়া হ্যায়।’ তাঁর চোখে দেখতে থাকি সেই মর্মস্পর্শী গভীরতা। তীক্ষ্ণ বুদ্ধি এবং গভীর উপলব্ধির সেই আশ্চর্য মিশেল।

Sharmila Tagore
দেশের সব খবর তাঁর নখদর্পণে। কিন্তু মুখ খুললেই যে বিতর্ক! তাই কথা বাড়াতে চান না। ছবি – লেখকের সংগ্রহ

সাম্প্রতিককালে উত্তরপ্রদেশের দাদরিতে বাড়িতে গরুর মাংস রাখার অভিযোগে মহম্মদ আখলাককে পিটিয়ে খুন করার নিন্দেয় সরব হয়েছিলেন শর্মিলা, তুলেছিলেন অসহিষ্ণুতার অভিযোগ। তার জন্যে ইন্টারনেটে, সমাজ মাধ্যমের নানা ফোরামে কুৎসার বন্যা বয়ে গিয়েছিল তাঁর বিরুদ্ধে। চলচ্চিত্র শিল্পের পুরনো বন্ধুরা প্রায় কেউই তখন প্রকাশ্যে পাশে এসে দাঁড়াননি। সেই অভিমানে তিনি আজও ব্যথিত। কোনও বিতর্কিত বিষয়ে প্রশ্ন করলেই বলেন, “থাক না। প্রত্যক্ষ রাজনীতি না করেও খবরের কাগজে মুখ খুলে রাজনৈতিক বিদ্বেষের শিকার হতে কার আর ভালো লাগে?” অথচ, দেশের রাজনীতির খবরাখবর রাখেন খুঁটিয়ে। সমাজে, প্রশাসনে, রাজনীতিতে অসহিষ্ণুতা যত বাড়ে, ততই বিচলিত হন তিনি। প্রকাশ্য বিবৃতি দেন না, মিছিলে হাঁটেন না, অতি ঘনিষ্ঠরাই শুধু জানতে পারে তাঁর ব্যথা।

টানা কয়েক দিনের সাক্ষাৎকার পর্ব শেষ করে ফিরে আসার পর তাই একটু ধন্দই লাগে মাঝেমধ্যে। ওটা কি ছিল দক্ষিণ দিল্লির অতি-অভিজাত পাড়া বসন্ত বিহারে যামিনী রায়, অঞ্জলি এলা মেনন, পরেশ মাইতি-শোভিত পরিপাটি সাজানো বাড়ি? নাকি, সত্যজিৎ রায়ের  ছবির সেট? যাঁর সঙ্গে কথা হল পরপর কয়েক দিন, তিনিই বা কে? বাস্তবের শর্মিলা ঠাকুর? নাকি, মানিক-ছবির অন্তর্নিহিত বিবেক? অন্তরঙ্গ আলাপচারিতার সূত্র ধরে এখানে একটু চেনা, একটু বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে ষাট এবং সত্তর দশকে একই সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের সমান্তরাল ছবির অভিনেত্রী এবং হিন্দি ফিল্মের দুনিয়ার সবচেয়ে দামি নায়িকার আসনে কায়েম হয়ে রাজত্ব চালানো শর্মিলা ঠাকুরকে।                                                                                                                                                                                           (চলবে)

আদতে ছিলেন সাংবাদিক, তারপর কর্পোরেট কর্তা। অবসরের পর শান্তিনিকেতনে বসে লেখাজোকায় মন দিয়েছেন। বেশ কিছু প্রবন্ধ আর গল্প লিখেছেন আজকাল, অনুষ্টুপ আর হরপ্পা-য়। প্রথম উপন্যাস 'গোলকিপার' প্রকাশিত হয়েছে বাংলালাইভে। আপাতত ডুবে রয়েছেন ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসে। আজকালের রবিবাসর ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত হচ্ছে তাঁর ধারাবাহিক রচনা - সিনেমাতলার বাঙালি।

7 Responses

  1. প্রিয় ধ্রুব, লেখার মুখবন্ধ যদি এই হয়, তবে আসল লেখাটি যে কোন উচ্চতা স্পর্শ করবে, তা মোটামুটি আন্দাজ করতে চেষ্টা করছি। অপেক্ষায় রইলাম পরের লেখাগুলির জন্য। ভালো থেক, সাবধানে থেকো। হবে

  2. মনে পড়ে গেল আজকাল শারদীয় সংখ্যায় লেখার সময় তোমার তন্নিষ্ঠ তথ্য সন্ধান। শুধু নায়িকার কথার ওপর নির্ভর না করে তার সঙ্গে সব কিছু মিলিয়ে দেখার।
    আর গদ্যের কথা কি আর বলি, এমন স্বাদু গদ্য , সত্যি বলছি বাংলায় খুব কমই পড়ি।
    অপেক্ষায় রইলাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *