লেক রোডের বাড়িতে সন্ধ্যে ঘনিয়ে এসেছে। বাইরে বিরামহীন বৃষ্টি। একা বসে পরীক্ষার খাতা দেখে যাচ্ছি।
হঠাৎই বসার ঘরের দরজায় ঘন্টির আওয়াজ। ম্যাজিক আই দিয়ে দেখে আগন্তুককে চেনা ঠেকল না। জিজ্ঞেস করলাম কে। মৃদুস্বরে উত্তর এল ‘শংকরবাবুর সঙ্গে দেখা করতে চাই। আমি ভবানী চৌধুরী।’  আমি বাক। কালবিলম্ব না করে দরজা খুলে দিলাম। বাইরে দাঁড়িয়ে স্টেটসম্যান কাগজের নামজাদা রিপোর্টার ভবানীবাবু। পরনে আধময়লা গেরুয়া পাঞ্জাবি আর পাজামা। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ। হাতে ছাতা। বৃষ্টিতে ভিজে চুপচুপে। বললেন, ‘জানি শংকরবাবু  এ সময়ে বাড়ি থাকেন না। আমি কিছু কাগজপত্র দিয়ে চলে যাব। আজ আর ঢুকব না।’ আরও বললেন রোববার সকালের দিকে একবার আসবেন। আমার কোনও  অনুরোধ না শুনে কাগজপত্র আমার হাতে দিয়ে দ্রুত চলে গেলেন।

এই ভবানী চৌধুরীকে আমি প্রথম দেখেছিলাম মহাকরণের প্রেস কর্নারে। আমি তখন সবে হাতে কলমে রিপোর্টারি শিখছি। দৈনিক বসুমতীতে শিক্ষানবিশ। স্টেটসম্যান কাগজের অন্য সব অতি স্মার্ট, হুশহাশ ইংরেজি-বলা রিপোর্টারদের চেয়ে একেবারে অন্যরকম ছিলেন ভবানীবাবু। হালকা রঙের হাফহাতা বুশ শার্ট আর ট্রাউজারস পরে আসতেন। সাদাসিধে চেহারা। অত্যন্ত ভদ্র, বিনয়ী, শান্ত স্বভাবের মানুষ। কথা বলতেন খুব নিচু গলায়। প্রয়োজনে অবশ্য চমৎকার ইংরেজি বলতে শুনেছি ওঁকে। রিপোর্টার হিসেবে বেশ নামডাক তখন। 

মহাকরণ থেকে ফেরার পথে আমরা বন্ধুবান্ধবরা যখন কেসি দাসের দোকানে বসে চা-শিঙাড়া খেতাম, ভবানীবাবু তখন পকেট থেকে মোড়কে রাখা দুটো থিন অ্যারারুট বিস্কুট বের করে চায়ের সঙ্গে খেতেন। বলতেন, আমার ভাজাভুজি সহ্য হয় না। খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে অত্যন্ত সাবধানী ছিলেন। একবার ওঁদের কাগজের অসাংবাদিক কর্মীরা তাঁদের ন্যায্য বেতনের দাবিতে ধর্মঘট শুরু করলে, ভবানীবাবু ছিলেন একমাত্র সাংবাদিক, যিনি প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়ে ওঁদের সঙ্গে পথে নেমেছিলেন। 

স্টেটসম্যান কাগজের অন্য সব অতি স্মার্ট, হুশহাশ ইংরেজি-বলা রিপোর্টারদের চেয়ে একেবারে অন্যরকম ছিলেন ভবানীবাবু। হালকা রঙের হাফহাতা বুশ শার্ট আর ট্রাউজারস পরে আসতেন। সাদাসিধে চেহারা। অত্যন্ত ভদ্র, বিনয়ী, শান্ত স্বভাবের মানুষ। কথা বলতেন খুব নিচু গলায়।

মাঝখানে বেশ কয়েক বছর অতিবাহিত হয়েছে। সাংবাদিকতার পাট চুকিয়ে স্কুলে পড়াচ্ছি। সাংবাদিক শংকর ঘোষের ঘরণী হয়েছি। হঠাৎই একদিন স্বামীর কাছে খবর পেলাম ভবানীবাবু চাকরি ছেড়ে সক্রিয়ভাবে নকশালবাড়ি আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। এমনকী পরিবার, বাড়িঘর ছেড়ে কোথায় চলে গেছেন। কেউ তাঁর কোনও খবর জানে না। মনখারাপ হয়েছিল শুনে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। শংকরের কাছে কখনও শুনেছি ভবানীবাবু গ্রামেগঞ্জে কৃষক শ্রমিকদের সঙ্গে কাজ করছেন, আবার কখনও কানে এসেছে পুলিসের তাড়া খেয়ে এগ্রাম ওগ্রাম তিনি পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।  

Naxalbari
ভবানীবাবু গ্রামাঞ্চলে নকশাল আন্দোলনের কথা বলতেন। ছবি সৌজন্য – thewire.com

সেদিন  ভবানীবাবুকে দেখে বারবার সেসব কথাই মনে পড়ে যাচ্ছিল। রাতে শংকর বাড়ি ফিরলে জানালাম সব কথা। কাগজপত্র দিলাম। উনি খুঁটিয়ে সব খবর নিলেন। কথা মতো রোববার ভবানীবাবু এলেনও। সেদিন তাড়াহুড়োতে অতটা বুঝিনি। ওই দিন বুঝলাম ওঁর শরীর একেবারে ভেঙে গেছে। বললেন খাওয়াদাওয়ার ঠিক নেই। বেশ কিছুদিন যাবৎ রক্ত আমাশায় ভুগছেন। চা আর বিস্কুট খেলেন শুধু। অনেকক্ষণ দুই বন্ধু কথা বললেন। সবই গ্রামাঞ্চলে নকশাল আন্দোলনের কথা। বাড়িতে এক বোতল হরলিক্স ছিল। দিতে চাইলাম। বললেন, কমরেডদের সঙ্গে থাকেন। আলাদা করে নিজে খাওয়া সম্ভব নয়। আমি একটু জোর করছিলাম। কিন্তু শংকর বারণ করলেন। এরপর থেকে প্রায়ই রোববার সকালে ভবানীবাবু চলে আসতেন। এক তাড়া কাগজ দিতেন। লিবারেশন,দেশব্রতীর কপিও থাকত তার মধ্যে। চা বিস্কুট খেয়ে শংকরের সঙ্গে দীর্ঘ সময় কথা বলে চলে যেতেন। সাতের দশকে তখন জোরকদমে নকশাল আন্দোলনে জড়িত সন্দেহে এলোপাথাড়ি ধরপাকড় চলছে। পুলিসের কড়া নজরদারি চতুর্দিকে। কবে ভবানীবাবুও ধরা পড়ে যান এই ভয়ে থাকতাম আমরা! 

চারু মজুমদারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী সরোজ দত্ত, যিনি সম্পর্কে শংকরের মামা হতেন, তিনিও  আসতেন আমাদের বাড়িতে। রাতের অন্ধকারে আসতেন, ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই চলে যেতেন। প্রথম থেকেই শংকরের নির্দেশ ছিল, এসব কথা কারও সঙ্গে আলোচনা না করার। ভবানীবাবুর ক্ষেত্রেও সে কথাই মেনে চলেছি। শংকরের মুখে শুনেছি, ছোটখাটো সাংবাদিক জমায়েতে পুলিসের বড় কর্তারা ঠারেঠোরে একাধিকবার বলার চেষ্টা করেছেন যে বেশ কিছু নকশাল নেতার সঙ্গে কোনও কোনও সাংবাদিকের যে যোগাযোগ আছে, সে কথা তাঁদের কাছে অজ্ঞাত নয়। এসব কারণে ওঁদের আসার ব্যাপারটা গোপন না রেখে উপায় ছিল না। একবার তো মুশকিলে পড়ে গিয়েছিলাম। এক রোববার বসার ঘরে বসে শংকর আর ভবানীবাবু গভীর আলোচনায় মগ্ন। হঠাৎই দরজায় ঘন্টি। চায়ের কাপ নিয়ে দুই বন্ধু তড়িঘড়ি ভিতরের ঘরে। দরজা খুলে দেখি এক সাংবাদিক বন্ধু। নিরুপায় আমি। সেদিন দরজা থেকেই তাঁকে বিদায় করতে হয়েছিল।     

অনেকক্ষণ দুই বন্ধু কথা বললেন। সবই গ্রামাঞ্চলে নকশাল আন্দোলনের কথা। বাড়িতে এক বোতল হরলিক্স ছিল। দিতে চাইলাম। বললেন, কমরেডদের সঙ্গে থাকেন। আলাদা করে নিজে খাওয়া সম্ভব নয়। আমি একটু জোর করছিলাম। কিন্তু শংকর বারণ করলেন।

এখনও মনে পড়ে ৭১ সালের অগস্ট মাসের সেই দিনটির কথা। আমি স্কুলে যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছি। শংকর কাগজ পড়ছেন। হঠাৎ ভবানীবাবু এসে হাজির। বললেন, ‘খারাপ খবর শংকরবাবু। পার্টি সূত্রে জানা গেছে, আপনার সরোজমামাকে পুলিস গ্রেপ্তার করেছে কিন্তু সেকথা স্বীকার করছে না। ওঁদের আশঙ্কা ওঁরা হত্যা করেছে সরোজ দত্তকে! আপনি খোঁজ নিন।’ 

Naxalbari
ছবি সৌজন্য – redspark.com

আমরা হতবাক। এ সপ্তাহে আসেননি সরোজমামা। সেটা নিয়ে চিন্তা করিনি। কারণ অনেক সময়ে আমাদের লেক রোডের বাড়ি না-এসে উনি যেতেন রাজা বসন্ত রায় রোডে এক স্নেহাস্পদ  অধ্যাপকের বাড়ি। খোঁজ করতে জানা গেল ভবানীবাবুর খবর সত্যি। শংকর ঘোষ, বরুণ সেনগুপ্ত অনেক চেষ্টা করেছিলেন এ ঘটনার তদন্তের জন্য। কিছু লাভ হয়নি। সরোজমামাকে হারালাম। পুলিসের উপদ্রবে ভবানীবাবুকে শহর ছাড়তে হল এবার। আমাদের বাড়িতে আসা-যাওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। মাসে বড় জোর একবার আসতে পারতেন, তাও রাতের অন্ধকারে। তাতেও শেষ রক্ষা হল না। ধরা পড়ে গেলেন পুলিসের হাতে। বন্দি থাকলেন কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেলে। 

 দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকার আর এক সাংবাদিক সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ও ছিলেন ভবানীবাবুর অনুজ সহকর্মী। তিনিও চাকরি ছেড়ে নকশাল আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। কলকাতার আশপাশের গ্রামে ভবানীবাবু যখন দরিদ্র কৃষক কমরেডদের কুটিরে আত্মগোপন করে কাজ করছিলেন, তখন সুমন্তও তাঁর সঙ্গে ছিলেন প্রায় একই সময়ে তিনিও গ্রেপ্তার হন। তবে সুমন্ত বন্দি ছিলেন বর্ধমান জেলে। কিছুদিন পরে সুমন্ত জামিনে ছাড়া পেলেও ভবানীবাবু দীর্ঘদিন আটক ছিলেন। শেষমেশ যখন মুক্তি পেলেন তখন তিনি খুবই অসুস্থ। ওই সময়ে আমাদের সপ্তপর্ণীর বাড়িতেও এসেছেন কয়েকবার।  বলেছিলেন, ক্যান্সার ধরা  পড়েছে। কিছুদিন বাদে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন খবর পেয়ে শংকর আ বরুণ সেনগুপ্ত  ছুটে গিয়েছিলেন বন্ধুকে দেখতে কিন্তু দেখা হয়নি। ততক্ষণে কোন এক অচিন দেশের উদ্দেশে লম্বা পাড়ি দিয়ে ফেলেছেন ভবানী চৌধুরী।

পেশা শুরু হয়েছিল সাংবাদিকতা দিয়ে। পরে নামী ইস্কুলের বাচ্চাদের দিদিমণি। কিন্তু লেখা চলল। তার সঙ্গে রাঁধা আর গাড়ি চালানো, এ দুটোই আমার ভালবাসা। প্রথম ভালবাসার ফসল তিনটি ব‌ই। নানা রাজ্যের অন্নব্যঞ্জন, মছলিশ আর ভোজনবিলাসে কলকাতা।

14 Responses

  1. কতো নতুন তথ্য জানলাম । এরকম কতো ভবানী চৌধূরী হারিয়ে গেছেন বিস্মৃতির অতলে তার ইয়ত্তা নেই ।
    ভালো লাগল ।
    এই রকম নতুন নতুন অজানা তথ্য সমৃদ্ধ লেখা চাই ।

  2. বৌদির যে কোনও লেখারই আমি গুণগ্রাহী. অনেক অনুজ সাংবাদিক হিসেবে শঙ্করদার সঙ্গে কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছে. বৌদি অবশ্যই শঙ্করদা নন, কিন্তু সেই অন্তর্ভেদী দৃষ্টিভঙ্গির কিছুটা আদল যেন পেলাম. আরও এইরকম নস্টালজিয়া সমৃদ্ধ লেখা চাই

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *