প্রবাসের পটভূমিকায় লিখিত বলে উপন্যাসে ইংরিজি সংলাপ ও শব্দের বহুল ব্যবহার রয়েছে। 

আগের পর্ব পড়তে: [] [] [] [] [] [] [] [] [] [১০] [১১] [১২] [১৩] [১৪] [১৫] [১৬] [১৭] [১৮]

(৩২)

অনেকদিন বাদে পুরনো ছবির অ্যালবামগুলো বের করেছে সীমন্তিনী৷ বেশিরভাগই অরুণাভদের ফিলাডেলফিয়ার বাড়িতে ছিল৷ রোহিণীর উপর ভার ছিল বই, ছবি এসব ঝাড়াই বাছাই করে যা ফেলবার ফেলে দিয়ে বাকি লেক্সিংটনের বাড়িতে নিয়ে আসার৷ রোহিণী আবার কোনওকিছু ফেলতে পারে না৷ ঝাড়াই বাছাই করে পুরনো বইগুলোর অধিকাংশই চলে গেছে ইউপেনের আর্কিটেকচার বিভাগীয় লাইব্রেরিতে, জ্যোতির্ময় সেনের নামাঙ্কিত কালেকশনে৷ কিছু সাহিত্য, দর্শনের বই, জ্যোতির্ময়ের ব্যবহৃত দু-একটা অ্যান্টিক ফার্নিচার একটা ইউ হল ভাড়া করে রণো আর রোহিণী নিয়ে এসেছে এ বাড়ি৷ আর এসেছে পুরনো ছবির অ্যালবামগুলো৷

খান কুড়ি বড় বড় অ্যালবাম সযত্নে রক্ষা করেছিলেন অরুণলেখা৷ কাপড়ে জড়িয়ে কাপড়ের ভাঁজে ভাঁজে কীটনাশক রেখে৷ কয়েকমাস আগে ছবিগুলো এ বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে বটে, কিন্তু সেগুলো উল্টে পাল্টে দেখার সময় কারোরই হয়নি৷ রোহিনী নিজের পড়ানোর পাশাপাশি ইদানীং গবেষণা করে। বেশ কিছু নতুন তথ্য জোগাড় করেছে ও৷ অরুণাভর পিসি আলোলিকা সেনের সঙ্গেও চিঠিতে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে৷ রণোর অবশ্য এসব বিষয়ে কোনও উৎসাহ নেই৷ নিজের কাজ এবং কর্মজগতের বাইরে পারিবারিক ইতিহাস এবং পুরনো সময়কে ধরতে চাওয়া ওর প্রায়োরিটি লিস্টের মধ্যেই নেই৷ অ্যালবামগুলো আসার পর থেকেই যত্ন করে এ বাড়ির স্টাডিতে রাখা আছে, সীমন্তিনীর কলকাতার বাড়ির কিছু পুরনো অ্যালবামের সঙ্গে৷ আজ বহুদিন বাদে ফাঁকা দুপুরটা ভরানোর জন্য সীমন্তিনী অ্যালবামগুলো নিয়ে বসেছে৷ এমনিতে সারাদিন ঘরের টুকিটাকি কাজ সারতে সারতেই ওর সময় কেটে যায়৷ তারপরও সময় কিছু অবশিষ্ট থাকলে নেটফ্লিক্স থেকে বেছে বেছে পছন্দমত সিনেমা কি জনপ্রিয় টিভি সিরিজ দেখে ও৷ কিন্তু ইদানীং ওর নানা সমস্যা হয়৷ কখনও কখনও গাঢ় হতাশার গভীর অন্ধকারে ডুবে যেতে থাকে ও৷ এদেশে মনের সমস্যার জন্যও লোকে নিয়মিত কাউন্সেলিং করায়৷ কাউন্সেলর ওকে বুঝিয়েছে ওর পুরনো কোনও ট্রমা মধ্যবয়সে আবার সারফেস করতে চাইছে৷ ‘তুমি খুলে না বললে আমি তো তোমাকে কোনও সাহায্য করতে পারব না৷ মেডিকেল সেন্টারের যুবক কাউন্সেলর জন প্রায় রণোর বয়সী৷ দেখে অন্তত সেরকমই মনে হয়েছিল সীমন্তিনীর৷ ফেরার পথে অরুণাভ জিজ্ঞেস করেছিল— সেদিনের কাউন্সেলিং সেশন কেমন হল? 

‘জন আমাকে মন খোলসা করতে বলেছে৷ বলেছে ওর কাছে ফ্র্যাঙ্কলি কথা না বললে আমি যেন প্রিয় কোনও বন্ধু-আত্মীয় কারোও সঙ্গে কথা বলি, অন্ততঃ নিজের সঙ্গে৷ আমাকে ডায়েরি লিখতে বলল৷ সেটা নাকি থেরাপির কাজ করবে কিছুটা হলেও৷’

অ্যালবামগুলো আসার পর থেকেই যত্ন করে এ বাড়ির স্টাডিতে রাখা আছে, সীমন্তিনীর কলকাতার বাড়ির কিছু পুরনো অ্যালবামের সঙ্গে৷ আজ বহুদিন বাদে ফাঁকা দুপুরটা ভরানোর জন্য সীমন্তিনী অ্যালবামগুলো নিয়ে বসেছে৷ এমনিতে সারাদিন ঘরের টুকিটাকি কাজ সারতে সারতেই ওর সময় কেটে যায়৷ তারপরও সময় কিছু অবশিষ্ট থাকলে নেটফ্লিক্স থেকে বেছে বেছে পছন্দমত সিনেমা কি জনপ্রিয় টিভি সিরিজ দেখে ও৷ কিন্তু ইদানীং ওর নানা সমস্যা হয়৷ কখনও কখনও গাঢ় হতাশার গভীর অন্ধকারে ডুবে যেতে থাকে ও৷

শুনতে শুনতে অরুণাভর ভুরুটা কুঁচকে যাচ্ছিল৷ সীমন্তিনীর জন্য কী করলে তাকে একটু মানসিক স্বস্তিতে রাখা যায়, সে বিষয়ে চেষ্টার অন্ত নেই অরুণাভর৷ বস্টন কমন্‌সে অনেকদিন পর ওরা বসেছিল দুজন৷ আগে বিয়ের পর এসে সীমন্তিনী খুব ঘুরত এইসব জায়গা দিয়ে৷ পায়ে হেঁটে বস্টনের চৌহদ্দি চষে ফেলতে চাইত সে৷ অরুণাভ যখন সময় পেত তখন ঘুরে বেড়াত সীমন্তিনীর সঙ্গে৷ সীমন্তিনীর সঙ্গে ওর কলকাতায় কাকতালীয়ভাবে হঠাৎ দেখা, তুমুল প্রেম আর বিয়ের মধ্যে ব্যবধান মাত্র এক মাসের৷ একমাসের মধ্যে কতটুকুই বা চেনা সম্ভব পরস্পরকে৷ আসল চেনা হয়েছিল বিয়ের পর একবছর ধরে, একটু একটু করে৷ ফিলিতে অরুণাভরা উইকেন্ডগুলোতে থাকত৷ সেখানেও ওরা হেঁটে বেড়াত প্রচুর৷ থার্টিয়েথ স্ট্রিট স্টেশন থেকে স্কুকিলের পাড় ধরে চলে যেত বহুদূর, কখনও কখনও পায়ে হেঁটে পৌঁছত ডেলাওয়্যারের ধারে৷ সপ্তাহান্ত কাটিয়ে আবার বস্টনে ফিরত ভাড়া করা ছোট্ট বাসায়৷ সারা সপ্তাহটা অরুণাভ ব্যস্ত থাকত কাজ নিয়ে, আর সীমন্তিনী বেরিয়ে পড়ত শহর চিনতে৷ পরে রোহিণী অনেকবার অবাক হয়েছে বস্টন-কেমব্রিজ অঞ্চল সীমন্তিনী এত ভাল চেনে দেখে৷

‘মাম্মা! ইউ আর অ্যামেজিং৷ ইউ ক্যান বি আ ভেরি গুড ট্যুরিস্ট গাইড হিয়ার৷’ ও বলেছিল, সীমন্তিনী যখন বস্টন কমন্স-এর পূর্ব কোনায় একটা পিৎজারিয়ার হদিশ নির্ভুলভাবে বলে দিয়েছিল, তখন৷

‘আসলে, অনেকদিন থেকেছি তো এখানে৷ অনেকদিন পরে হলেও একটা জায়গায় এলে তার চারদিকের ছোট ছোট ন্যুক অ্যান্ড কর্নারগুলো মেমারিতে ফ্ল্যাশ করে যায়৷’

woman with photo album
আজ বহুদিন বাদে ফাঁকা দুপুরটা ভরানোর জন্য সীমন্তিনী অ্যালবামগুলো নিয়ে বসেছে

ছবির অ্যালবামগুলো দেখতে দেখতে ঠিক সেইরকমই হচ্ছিল ওর৷ ওদের ছোটবেলায় অত ছবি তোলা হত না৷ সীমন্তিনীর বাবার একটা আশাহি পেনট্যাক্স ক্যামেরা ছিল৷ ইংল্যান্ড থেকে অম্বিকা সখ করে কিনে এনেছিলেন৷ ওর ছোটবেলার সব ছবি সেই ক্যামেরাতেই তোলা৷ ঠাম্মার সঙ্গে, বাবার সঙ্গে বালিকা সীমন্তিনীর সাদা-কালো ছবি৷ তিন বছর বয়স থেকে প্রতিটি জন্মদিনে মেয়ের ছবি তুলে রাখতেন অম্বিকা৷ প্রতি জন্মদিনে কেকের উপর মোমবাতির সংখ্যা বাড়ত৷ স্কুলের বন্ধুরা এসে হৈ হৈ করত৷ সেই বন্ধুদের ছবিও ধরা রয়েছে অ্যালবামে৷ এলাহি খাবারের আয়োজন হত৷ ওইদিন ওয়ালডর্ফ থেকে খাবার আসত নিমন্ত্রিত বন্ধুদের জন্য৷ ঠাকুমা পায়েস রাঁধতেন৷ সীমন্তিনীর ছোটবেলার ছবিগুলোর ঠিক উল্টো ছবি ধরা আছে অরুণাভদের ছবিগুলোয়৷ পারিবারিক আনন্দের ছবি৷ একসঙ্গে বেড়াতে যাওয়ার ছবি৷ কেমব্রিজে বরফে ঢাকা রাস্তায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন জ্যোতির্ময়, কাঁধে ছোট্ট বাবাই৷ পাশে শাড়ি আর ওভারকোট পরা অরুণলেখা৷

ছবিগুলো আস্তে আস্তে লাল হয়ে যাচ্ছে৷ কালের অলঙ্ঘ্য হাতে জীর্ণ প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের ছবিগুলো৷ এদেশে পুরনো ছবিরও বাজার আছে৷ এমন অনেক দোকান আছে যেখানে পুরনো ফটোগ্রাফ বিক্রি হয়৷ অজানা মানুষদের ছবি৷ সাদা-কালো সময়ের স্থির চিত্র৷ সীমন্তিনীর একবার মনে হল কী হবে আর এসব ছবি নিয়ে? এখন ও বা অরুণাভ তাও চিনতে পারছে ছবির চরিত্রগুলোকে৷ আরও পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গেলে আর কেউই কেয়ার করবে না ছবির মানুষদের জানার জন্য৷

সীমন্তিনীর বাবার একটা আশাহি পেনট্যাক্স ক্যামেরা ছিল৷ ইংল্যান্ড থেকে অম্বিকা সখ করে কিনে এনেছিলেন৷ ওর ছোটবেলার সব ছবি সেই ক্যামেরাতেই তোলা৷ ঠাম্মার সঙ্গে, বাবার সঙ্গে বালিকা সীমন্তিনীর সাদা-কালো ছবি৷ তিন বছর বয়স থেকে প্রতিটি জন্মদিনে মেয়ের ছবি তুলে রাখতেন অম্বিকা৷ প্রতি জন্মদিনে কেকের উপর মোমবাতির সংখ্যা বাড়ত৷ স্কুলের বন্ধুরা এসে হৈ হৈ করত৷ সেই বন্ধুদের ছবিও ধরা রয়েছে অ্যালবামে৷ এলাহি খাবারের আয়োজন হত৷ ওইদিন ওয়ালডর্ফ থেকে খাবার আসত নিমন্ত্রিত বন্ধুদের জন্য৷ ঠাকুমা পায়েস রাঁধতেন৷ 

আরও পুরনো ছবিও আছে৷ সম্ভবতঃ অরুণাভ যেখানে জন্মেছিল— সেই দমদমের বাড়ির মানুষদের ছবি৷ সীমন্তিনীর চেনা চেনা লাগছে ছবিতে হাসিমুখে দাঁড়ানো মানুষগুলোকে৷ একটা ছবি স্টুডিওতে গিয়ে তোলা৷ স্বামী-স্ত্রী আর তাঁদের চার ছেলেমেয়ে৷ স্টুডিওর জবরজং লাল ভেলভেটের চেয়ারে মায়ের পাশে দুই মেয়ে৷ বাবা কিশোর বড়ো ছেলেকে নিয়ে পিছনে দাঁড়িয়ে আর সদ্য জন্মানো বাচ্চাটি মায়ের কোলে৷ পিছনে লেখা মেমারি স্টুডিও, দমদম, ১৯৫০৷ সবার হাসি হাসি মুখ৷ কোলের শিশুটি শুধু অপলক বিস্ময়ে স্টুডিওর ক্যামেরার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে৷ স্বাধীনতার ঠিক পরে পরেই দমদমে স্টুডিওতে গিয়ে এ ছবি তোলাবার দরকার ছিল এই পরিবারটির? নাকি নিছক আনন্দেই ছবি তোলা হয়েছিল— ঠিক বুঝতে পারল না সীমন্তিনী৷ পুরনো ছবি আরও কিছু রয়েছে৷ কারা সেখানে বসে বা দাঁড়িয়ে কিছুতেই বুঝতে পারছে না সীমন্তিনী৷

দুপুর গড়িয়ে চলেছে বিকেলের দিকে ছবি দেখতে দেখতে৷ ফিলাডেলফিয়ার বাড়িতে তোলা দুটো ছবি খুব মন দিয়ে দেখছে সীমন্তিনী৷ জ্যোতির্ময় আর অরুণলেখার বাড়িতে বাঙালি গ্যাদারিং-এর ছবি৷ ছবিতে সব মহিলারা পাশাপাশি সহাস্যমুখে সোফায় বসে আর তাঁদের স্বামী বা পুরুষ সঙ্গীটি ঠিক তাঁদের পিছনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে৷ ছবির ডানপাশে কোনায় একটা সোফার হাতলে বসে যে মেয়েটি, অন্যদের থেকে সে সব ব্যাপারেই অনেক আলাদা৷ অন্যান্য সব গোলগাল হাসিখুশি স্থূলকায়া মহিলাদের পাশে বৃন্দার শার্প ফিচারস্‌, ঠোঁটের কোণে চিলতে বিদ্রূপাত্মক হাসি, আর অসামান্য ব্যক্তিত্বের ছটা যেন ছবির মধ্যেও সেল্ফ-এভিডেন্ট৷ বৃন্দার ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে তরুণ অরুণাভ৷ বছর সতেরো-আঠারোর তরুণ৷ অল্প অল্প দাড়ি আর ব্যাকব্রাশ করা লম্বা চুলের অরুণাভকে হঠাৎ দেখলে বিটনিক প্রভাবে আচ্ছন্ন এক তরুণ বলে মনে হয়৷ ১৯৭৯ কি ৮০ সালে তোলা বোধহয় গ্রুপ ফটোটা৷ অরুণাভর চেহারায় একটা ঝকঝকে ভাব৷ যে চেহারা রণোর মধ্যেও বাবার থেকে এসেছে৷ আরেকটা ছবিতে শুধুই বৃন্দা আর অরুণাভ৷ বৃন্দা রাজহংসীর মতো ঘাড় ঘুড়িয়ে একটু মুখ উঁচু করে অরুণাভকে কী বলছে, আর অরুণাভ একটু ঝুঁকে হাসিমুখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে৷ সীমন্তিনীর মনে পড়ল ও বিয়ে হয়ে আসার পর একদিন অরুণলেখা এইসব ছবি সস্নেহে দেখাচ্ছিলেন সীমন্তিনীকে, ‘এই যে মামণি, দ্যাখ এ হল বৃন্দা৷ খুব ধনী একজন আমেরিকানকে বিয়ে করেছে৷ দমদমে আমার শাশুড়ি যখন মোহনানন্দজীর কাছে দীক্ষা নিলেন, তখন আমাদের বাড়িতে এসে গান গেয়েছিল ও মোহনানন্দজীর দলের সঙ্গে৷ কতটুকু বা বয়স তখন ওর৷ খুব ভালবাসি আমরা ওকে৷ তোমার শ্বশুর তো নিজের বোনের মতো দেখেন ওকে৷ বৃন্দা তো এখন ক্যালিফোর্নিয়ায় থাকে৷ দিন-রাত এখানে ওখানে বক্তৃতা দিয়ে বেড়ায়৷ তোমাদের রিসেপশনেও আসতে পারল না৷ কী একটা কনফারেন্স পড়ে গেল বলে৷ নয়ত দেখতে হৈ চৈ করে ও একাই মাতিয়ে রাখত৷’ শতমুখে বৃন্দার কথা বলছিলেন অরুণলেখা৷ হ্যাঁ, হুঁ বলে কোনওরকমে শুনেছিল সীমন্তিনী৷ বলতে পারেনি বৃন্দা ওর নিজের মাসি৷ জ্যোতির্ময় আর অরুণলেখা বরাবর জেনে এসেছেন সীমন্তিনী শৈশবে মাতৃহারা৷ সীমন্তিনীর ইদানীং মনে হয় – ওর মায়ের পুরো গল্পটা যদি জানতেন ওর শ্বশুর-শাশুড়ি, তবে কী প্রতিক্রিয়া হত ওঁদের? বিয়ের পর শুনেছিল জ্যোতির্ময়ের দুই বোন আছে৷ দিল্লির বোনের পরিবারের সঙ্গে তাও যোগাযোগ ছিল৷ সেই বোনের ছেলে একবার এসে ওঁদের ফিলাডেলফিয়ার বাড়িতে কয়েকদিন ছিল৷ কিন্তু শ্বশুরমশায়ের ছোট বোন যে শান্তিনিকেতনে থাকেন, সে গল্প ও কখনও শোনেনি ওঁদের থেকে৷ জ্যোতির্ময় খুব স্বল্পভাষী মানুষ ছিলেন, কারও নিন্দা সোচ্চারে করেছেন কখনও এমন মনে পড়ে না সীমন্তিনীর৷ অরুণলেখা শান্তিনিকেতনে ওঁদের বড় হওয়ার গল্প করতেন মাঝে মাঝে৷ তখন দুই ননদের কথাও উল্লেখ করতেন— হাসি আর খুশি বলে৷ কৌতূহলী হয়ে সীমন্তিনী একবার অরুণাভকে জিজ্ঞাসা করেছিল তোমার বড়পিসির ফ্যামিলি তো দিল্লিতে থাকে, কিন্তু ছোটপিসির ফ্যামিলি? অরুণাভ বলেছিল, ‘প্রোবাবলি সি ইজ স্টিল ইন শান্তিনিকেতন৷ আই ডোন্ট নো ফর সিওর৷’

‘তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ নেই কেন?’ সীমন্তিনীর বেশ আশ্চর্য লেগেছিল৷

‘প্রোবাবলি সাম ফ্যামিলি ম্যাটারর্স৷ আই ডোন্ট নো দ্য ডিটেলস্‌৷’ এই জবাবেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল৷

Old vintage album
ছবিগুলো আস্তে আস্তে লাল হয়ে যাচ্ছে

এই সেদিন রোহিণীর কাছ থেকে ও জানতে পারল আসল সত্যটা কী! একজন অসমবয়সী অন্ত্যজ ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্ক আছে জেনে জ্যোতির্ময় চিরদিনের মতো ত্যাগ করেছিলেন ছোট বোনটিকে৷ তার চিরপরিচিত, অতিপ্রিয় মানুষ জ্যোতির্ময় সেনের চরিত্রের একটা নতুন দিক খুলে গেছে সীমন্তিনীর কাছে৷ এখন মনে হচ্ছে ওর জীবনের রূঢ় সত্যগুলো ভাগ্যিস জানতেন না জ্যোতির্ময় বা অরুণলেখা৷ অরুণাভ প্রথম থেকে ওকে প্রোটেক্ট করেছিল৷ স্পষ্ট করে বলে দিয়েছিল কী কী জানানো চলবে না৷ অরুণাভকে তখন প্রায় চেনেই না সীমন্তিনী৷ একজন প্রায় অচেনা যুবকের সঙ্গে সে যে কিছুই না ভেবেচিন্তে পৃথিবীর অন্য এক গোলার্ধে, অন্য এক মহাদেশে পাড়ি দেয়, তার মধ্যে একটা বিশাল ঝুঁকি ছিল৷ সেই ঝুঁকি নেওয়াটা এতদিন পরে প্রায় অবিশ্বাস্য ঠেকে তার কাছে৷ ভাগ্যিস আজ কেউ বাড়িতে নেই৷ রণো আর রোহিণী এখন ক্যালিফোর্নিয়ায়৷ অরুণাভ একটা কনফারেন্সে দু’দিনের জন্য গেছে ফ্লোরিডা৷ অরুণলেখাকে খাইয়ে দিয়ে নিজেও খেয়ে শুয়ে পড়েছে ওঁর অ্যাটেন্ডেন্ট৷ আজকের সন্ধে আর রাতটা পুরোটাই সীমন্তিনীর নিজের৷ অন্যদিন হলে সন্ধেয় খাবার পর ও নিজের ঘরের টেলিভিশনে পছন্দমত সিনেমা কি শো চালিয়ে দেয়৷ নিজের অতীত, বর্তমান সম্পর্কে যত কম ভাবা যায়৷

অরুণাভকে তখন প্রায় চেনেই না সীমন্তিনী৷ একজন প্রায় অচেনা যুবকের সঙ্গে সে যে কিছুই না ভেবেচিন্তে পৃথিবীর অন্য এক গোলার্ধে, অন্য এক মহাদেশে পাড়ি দেয়, তার মধ্যে একটা বিশাল ঝুঁকি ছিল৷ সেই ঝুঁকি নেওয়াটা এতদিন পরে প্রায় অবিশ্বাস্য ঠেকে তার কাছে৷

অতীতের কাছ থেকে পালাতে চেয়েছিল সীমন্তিনী৷ যত দূর যাওয়া যায়৷ পালাতে পারল কি? আজ একত্রিশ বছর পেরিয়ে গিয়েও তবে দুঃসহ অতীত কেন হানা দেয় ওর স্বপ্নে-জাগরণে? কেন বারবার আক্রমণ করে ক্ষতবিক্ষত করে ওর বেঁচে থাকার সুখটুকুকে৷ ঠিকই বলেছে জন— ‘তোমাকে তোমার অতীতের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে৷ পালালে চলবে না৷ অতীতের তুমিটাকে অ্যাভয়েড করলে বর্তমানের ভিতটাও নড়বড়ে হয়ে যাবে তোমার৷ ফেস্‌ ইয়োরসেল্ফ৷’ বেশ একটা মোটিভেট করার ভঙ্গিতে বলেছিল জন, ওর কাউন্সেলর৷ ‘তুমি নিশ্চয়ই এখন থেকেই ওষুধের উপর পুরো নির্ভরশীল হয়ে যেতে চাও না৷ ওষুধ তোমার ডিপ্রেসন সাময়িকভাবে সারাবে, এজি নার্ভগুলো স্যুদ করবে, ঘুমোতে সাহায্য করবে৷ কিন্তু ভিতরের প্রশান্তি তোমাকে নিজেকেই খুঁজে পেতে হবে৷ রণোও ঠিক একইরকম ম্যাচিওর৷ একটা প্রাজ্ঞ ভঙ্গি আছে এই প্রজন্মের কথার মধ্যে৷ যে কোনও জিনিসকে যুক্তি দিয়ে, সহমর্মিতা দিয়ে বুঝিয়ে দেয় চমৎকার করে৷ সীমন্তিনী আজ ঘুমের ওষুধ খেল না৷ ওষুধটা খেলেই ও মড়ার মতো ঘুমোতে থাকে৷ চিন্তা জড়িয়ে আসে৷ আজ খেয়ে নিয়ে জানলার পাশে রকিং চেয়ারে আধশোয়া হল ও৷ আজ সারারাত নিজের সঙ্গে কাটাবে ও৷ পুরনো স্মৃতিগুলো বন্ধ কৌটোর ঢাকা খুলে নেড়েচেড়ে দেখবে৷ আজ স্মৃতির পাতা উল্টে দেখার রাত৷

***

রবি মেননকে প্রথম ও দেখে কলেজ ফেস্টে৷ রবি ইন্টার-কলেজ ফেস্টে ওর কলেজের ছেলেমেয়েদের নিয়ে এসেছিল সীমন্তিনীদের কলেজে৷ পঁচাশি সালের শেষ নাকি ছিয়াশির গোড়ায়! রবি কলেজে পড়াত৷ ওর হাবেভাবে আচারে-আচরণে অধ্যাপকসুলভ গাম্ভীর্য ছিল না। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে খুব সহজে মিশে যেত ও৷ প্রথমদিন রবি কলেজের গেট পেরিয়ে এক ঝাঁক ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে ঢুকে পড়েছিল ওদের চত্বরে৷ সীমন্তিনী আরও অনেকের সঙ্গে ছিল রিসেপশনের দায়িত্বে৷ প্রত্যেক কলেজ-টিম এলে নাম লিখে, কে কী নিয়ে পার্টিসিপেট করবে তা আর একবার মিলিয়ে নেওয়া৷ সীমন্তিনীরা পোর্টিকোতে চেয়ার টেবিল পেতে খুব ব্যস্তভাবে সেই কাজটা করছিল৷ কলেজ ভিড়ে ভিড়াক্কার৷ কলেজে সবে ফার্স্ট ইয়ার তখন৷ মাথা ঝুঁকিয়ে কোনও একজন পার্টিসিপেন্টের নাম খোঁজার চেষ্টা করছিল ও৷ হঠাৎ শুনল… একটা গলা বলছে— ‘ম্যাডাম, উই হ্যাভ কাম অল দ্য ওয়ে ফ্রম আওয়ার কলেজ টু ইউ৷ প্লিজ অ্যালাউ আস টু ইন্ট্রোডিউজ আওয়ারসেলভস্‌৷’ সেই গলায় একটা মেকি গাম্ভীর্য আর একটু পেট্রনেজও মিশে ছিল কি? সীমন্তিনী মাথা তুলে দেখেছিল, ব্যারিটোন গলার অধিকারী এক ছোটখাটো চেহারার যুবক, ঘন কোঁকড়া কালো চুল আর সরু গোঁফের ফাঁকে চিলতে হাসি— যা ওর অস্বস্তি বাড়িয়ে দেয়৷ ‘স্যার, প্লিজ বিয়ার উইথ আস ফর এ কাপল অফ মিনিটস্‌, উই উইল কাম ব্যাক টু ইউ৷’ সবার নাম, কোন বিভাগ— এলোকিউশন, না ডিবেট, না গান, সব মিলিয়ে নেবার পর বাকি থেকে গেছিল যুবক নিজেই৷

‘অ্যান্ড ইউ স্যার?’ প্রশ্নটা আপনিই বেরিয়েছিল সীমন্তিনীর মুখ থেকে৷ ‘হোয়াট ইজ ইয়োর এরিয়া অফ পার্টিসিপেশন?’

অতীতের কাছ থেকে পালাতে চেয়েছিল সীমন্তিনী

দাঁড়িয়ে থাকা ছাত্রদের মধ্যে একটা গুঞ্জন, চাপা হাস্যরোল৷ ‘হি ইজ আওয়ার প্রফেসর’ বলেছিল কেউ৷ খুব মজা হচ্ছে এমনভাবে ঈষৎ হেসে ও হাতটা বাড়িয়ে দিয়েছিল সীমন্তিনীর দিকে৷

‘দিজ ইজ রবি মেনন৷ আই অ্যাম স্টিল লার্নিং দ্য বিউটি অফ দ্য ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ৷ সো ইউ মে কল মি এ স্টুডেন্ট অ্যাস ওয়েল৷ ইয়োর গুড নেম প্লিজ৷’

সীমন্তিনীর হাতটা যেন প্রয়োজনের চেয়ে একটু বেশি সময় ধরে রেখেছিল রবি৷ সীমন্তিনীর প্রবল অস্বস্তি হচ্ছিল৷ তার আগে ও কোনও পুরুষকে সেভাবে স্পর্শ করেনি কখনও৷ সেবার দুদিন কাছ থেকে দেখেছিল রবিকে৷ ছাত্রদের মহলে ইনস্ট্যান্ট হিট রবির অনুরাগী ভক্তের অভাব ছিল না৷ চোখে মুখে চৌখস, চাইলেই অজস্র কবির যুৎসই উদ্ধৃতি ঠোঁটের ডগায়৷ যাওয়ার দিন রবি ওর নাম-ঠিকানা লেখা একটা কাগজ গুঁজে দিয়ে গেছিল ওর হাতে৷ বলেছিল কখনও ইচ্ছে হলে ফোন কোরো৷ আই অ্যাম অলওয়েজ ওপেন টু ডিসকাস এনিথিং অন আর্থ৷ অ্যান্ড আই ওয়ান্ট টু রিড সামওয়ান লাইক ইউ অ্যাজ অ্যান ওপেন বুক৷ সেই শুরু৷ রবি জানত ফোনটা আসবেই৷ শুধু সময়ের অপেক্ষা৷ বেশি দিন কাটেনি৷ ফেস্ট শেষ হবার তিনদিনের মাথায় সন্ধেবেলা ও ফোন করেছিল রবিকে৷

‘হ্যালো, দিজ ইজ সীমন্তিনী৷’ দ্বিধাজড়িত কণ্ঠস্বর৷

ওপ্রান্ত থেকে হাসির শব্দ ‘হ্যালো মাই ডিয়ার! আই ওয়াজ ওয়েটিং ফর ইয়োর ফোন কল৷ এত দেরি করলে কেন ফোন করতে? বেশি দেরি করলে আমি ভুলে যেতাম তোমাকে৷’ সহজ অনায়াস বাংলা বলল ও৷ সাত-আটটা ভাষায় ঝরঝর করে কথা বলতে পারত৷

সীমন্তিনীর হাতটা যেন প্রয়োজনের চেয়ে একটু বেশি সময় ধরে রেখেছিল রবি৷ সীমন্তিনীর প্রবল অস্বস্তি হচ্ছিল৷ তার আগে ও কোনও পুরুষকে সেভাবে স্পর্শ করেনি কখনও৷ সেবার দুদিন কাছ থেকে দেখেছিল রবিকে৷ ছাত্রদের মহলে ইনস্ট্যান্ট হিট রবির অনুরাগী ভক্তের অভাব ছিল না৷ চোখে মুখে চৌখস, চাইলেই অজস্র কবির যুৎসই উদ্ধৃতি ঠোঁটের ডগায়৷ যাওয়ার দিন রবি ওর নাম-ঠিকানা লেখা একটা কাগজ গুঁজে দিয়ে গেছিল ওর হাতে৷

ফোনেই কথা হয়েছিল কোথায় দেখা হবে৷ সীমন্তিনীর ফোন নম্বরও নিয়েছিল ও৷ ভবিতব্যের মতো সেই দেখা হওয়া৷ একদিন৷ তারপর রোজ৷ কলেজে ক্লাস করতে করতে ঘণ্টা, মিনিট গুণে চলেছে সীমন্তিনী৷ কতক্ষণে যে রবির সঙ্গে দেখা হবে! রবির কোনও তাড়া ছিল না৷ রবি জানত মাছ বঁড়শি গিলেছে৷ এবার ছিপ দিয়ে খেলিয়ে খেলিয়ে তাকে ডাঙায় তুলতে হবে৷ রবি শুধু ইংরেজির অধ্যাপকই নয়, ও নিজেও কবিতা লিখত ইংরেজি ভাষায়৷ ইংরেজির ছাত্রীর কাছে প্রেমে পড়ার পক্ষে আদর্শ পুরুষ ছিল রবি মেনন৷ অম্বিকা কখনও মেয়ের উপর কোনও নিষেধাজ্ঞা জারি করেননি৷ তবে সীমন্তিনীর সঙ্গে চলনদার হিসেবে সব সময় একটি গাড়ি ও ড্রাইভার মজুত করে রেখেছিলেন৷

বেশ কয়েক সন্ধ্যায় কফি এবং স্ন্যাক্সের পর রবি প্রস্তাব দেয়, ‘এভাবে আর ভালো লাগছে না৷ হোয়াই ডোন্ট ইউ কাম টু মাই প্লেস, টু হ্যাভ সাম আস টাইম দেয়ার? অবশ্য তোমার যদি আপত্তি না থাকে৷’

আপত্তি দূরে থাক, সীমন্তিনী নিজেও যেন পা বাড়িয়েই ছিল৷ বাড়িতে গেলে শারীরিক ঘনিষ্ঠতা অবধারিত৷ কিন্তু সে তো আঠেরো বছরের মেয়ে৷ যা করছে জেনে বুঝেই করছে৷ রবি তো তাকে জোর করেনি? বরং সম্মতি চেয়েছে৷

ঢাকুরিয়া লেকের পাশের দিকে একটা রাস্তায় রবির এক কামরার ফ্ল্যাট৷ সীমন্তিনীরা লেকের ধারে গাড়ি থামিয়ে ড্রাইভারকে বলত অপেক্ষা করতে৷ ওরা লেকে যাওয়ার অছিলায় পাশের রাস্তার শর্টকাট দিয়ে পৌঁছে যেত ফ্ল্যাটে৷ ফ্ল্যাটের নিভৃতিতে রবির সঙ্গে মিলিত হত সীমন্তিনী৷

‘এতে কোনও দোষ নেই৷ উই লাভ ইচ আদার৷ ভালবাসার মধ্যে শরীর তো আসবেই৷’

রবি অধ্যাপকের দক্ষতায় বোঝাত ওকে৷ প্রায় নিত্যদিনের সেই খেলার শেষে নিখুঁতভাবে সাজসজ্জা করে সীমন্তিনী আবার বেরিয়ে পড়ত রবির ছোট্ট ডেরা থেকে, যাকে রবি নাম দিয়েছিল ‘মাই ডেন’৷ রবিই অভিজ্ঞ শিক্ষকের মতো তাকে শরীরের কৃৎ-কৌশল শেখাত৷ সীমন্তিনীর কোনও প্রশ্ন জাগেনি৷ কখনও মনে হয়নি রবি শরীরের খেলায় এত দক্ষ হল কী করে! মনে হতে একটু বেশি দেরি হল, যখন ও আবিষ্কার করল ওর ঋতুচক্র থেমে গেছে৷

তখন একদিন উদ্‌ভ্রান্তের মতো বাস ধরে রবির ফ্ল্যাটে পৌঁছল ও৷

‘রবি, টেল মি, ওয়াজ দেয়ার সামওয়ান বিফোর মি?’

রবি দু’মুহূর্ত চুপ করে ছিল৷ ওর পরনে স্যান্ডো গেঞ্জি আর হাফ প্যান্ট৷ ‘কী জানতে চাও বল?’ ওর ভাবলেশহীন মুখ প্রতিপ্রশ্ন করেছিল৷

‘ইজ দেয়ার সাম আদার উওম্যান রবি?’ সীমন্তিনীর গলা চড়ছিল৷

‘আঃ! ডোন্ট শাউট৷ লোকে শুনতে পাবে৷ অফকোর্স দেয়ার ওয়্যার আদার উইমেন৷ দেয়ার স্টিল ইজ ওয়ান৷ মাই ওয়াইফ৷’

ঘরের মধ্যে হঠাৎ বজ্রপাত হলেও এর চেয়ে বেশি চমকাত না সীমন্তিনী৷

‘হোয়াট? ইয়োর ওয়াইফ? ইউ আর ম্যারেড? তুমি বলনি কেন?’ সীমন্তিনী যেন দুঃস্বপ্নের মধ্যে দিয়ে চলেছে৷

‘বিকজ ইউ হ্যাভ নট আস্কড্‌ মি৷’

‘তুমি যে বলেছিলে ক্রিমের অ্যাডে আমাকে মডেল হতে দেখে তোমার মনে হয়েছিল— ইউ ওয়ান্টেড টু মিট মি, তখনও তুমি ম্যারেড অ্যান্ড ইউ হ্যাড আ ওয়াইফ?’ যন্ত্রচালিতের মতো প্রশ্ন করেই সীমন্তিনী বুঝতে পারছিল কী বোকার মতো প্রশ্ন করছে ও, অফ কোর্স হি ওয়াজ৷ হি ওয়াজ ম্যারেড অল অ্যালং৷

‘বাড়িতে তোমার বউকেও ঠকাচ্ছিলে, আর আমাকেও!

‘কাম অন! আমি তোমাকেও ভালবাসি৷ দুজনকেই ভালবাসা যায় একই সঙ্গে৷ ভালবাসলে শরীরে কোনও পাপ নেই৷’

‘রবি, হোয়াট উইল হ্যাপেন টু আওয়ার চাইল্ড?’

যেন মেলোড্রামার নায়িকার মতো সংলাপ বলছে, এমনই শুনিয়েছিল কথাটা নিজের কানে৷

‘আই উইল টেক কেয়ার অফ ইট৷’ রবির কথা কি সেই মুহূর্তে আশ্বস্ত করেছিল ওকে? রবি আর দেরি করেনি৷ দ্রুতগতিতে সব ব্যবস্থা করে পরদিনই ওকে নিয়ে গেছিল শহরের একটি চালু ক্লিনিকে৷

‘ইউ হ্যাভ টু অ্যাবোর্ট দ্য বেবি৷’ ইস্পাত কঠিন ব্যারিটোনে বলেছিল রবি৷

affection
সীমন্তিনীর হাতটা যেন প্রয়োজনের চেয়ে একটু বেশি সময় ধরে রেখেছিল রবি

এক ঘণ্টার মধ্যে হয়ে গেছিল যন্ত্রণাদায়ক প্রসেসটা৷ দুই পায়ের ফাঁক দিয়ে একটা নরম রক্তমাংসের ডেলাকে বার করে আনার প্রসেস৷ খাতায় কলমে ক্লিনিকের রেকর্ডে সই করতে হয়েছিল ওদের ডাক্তার ভাস্কর মেনন এবং অমৃতা হিসাবে৷ যাওয়ার পথেই রবি বলেছিল, ওখানে একটা নাম সই করতে হবে৷ কী নাম লিখবে ভেবে রেখো৷ ভাস্কর, রবির সিনোনিম বলে রবির মাথায় ছিল নামটা৷

সীমন্তিনীকে জিজ্ঞেস করায় ও পরিষ্কার অক্ষরে লিখেছিল অমৃতা। ‘ন জায়তে মৃয়তে বা কদাচিন্ নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ/ অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরাণো ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে৷ অম্বিকা অনেক সময় বলতেন স্তোত্রটা৷ তাই অমৃতা নামটা মনে হয়েছিল৷ নাঃ! ক্লিনিকের লোকেরা কোনও ডকুমেন্ট দেখতে চায়নি৷ সারা শহরে, সারা দেশে অসংখ্য ক্লিনিকে কত নরনারী খালাশ করতে আসছে গর্ভের মধ্যে সঞ্চার হওয়া রক্তপিণ্ড৷ টাকা মিটিয়ে কাজ হাসিল করে ফিরে যাচ্ছে৷ নামে কি বা এসে যায়৷ যন্ত্রণাময় গর্ভপাত পর্ব শেষ হলে গ্লাভ্‌স্‌ খুলে ডাক্তারটি বলেছিলেন, ‘ফার্স্ট প্রেগনেন্সি অনেকে এম.টি.পি. করতে চায় না৷ অনেক সময় আনাড়ি হাতে গণ্ডগোল হয়৷ তবে আমি যেমন করে দিলাম, ইন ফিউচার অসুবিধে হবে বলে মনে হয় না।’ আত্মতুষ্ট একটা হাসি হেসেছিলেন ভদ্রলোক৷

‘কীসের অসুবিধে?’ সীমন্তিনী জিজ্ঞেস করেছিল৷

‘মানে ইন ফিউচার কনসিভ্‌ করতে প্রবলেম হবে না— সেটাই বলছেন আর কি৷’ রবি বলেছিল৷

সীমন্তিনী বোবা চোখে তাকিয়েছিল বাইরের দিকে৷ একটা ট্যাক্সিতে চেপে ওকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়েছিল রবি৷ স্নেহার্দ্রস্বরে ব্যারিটোন গলায় বলেছিল, ‘কয়েকদিন ভালো করে বিশ্রাম নাও৷ সব ঠিক হয়ে যাবে৷ আমি খবর নেব ঠিক সময়ে৷’ ট্যাক্সিটা চলে গেছিল লেক প্লেসের দিকে৷

নাঃ! ক্লিনিকের লোকেরা কোনও ডকুমেন্ট দেখতে চায়নি৷ সারা শহরে, সারা দেশে অসংখ্য ক্লিনিকে কত নরনারী খালাশ করতে আসছে গর্ভের মধ্যে সঞ্চার হওয়া রক্তপিণ্ড৷ টাকা মিটিয়ে কাজ হাসিল করে ফিরে যাচ্ছে৷ নামে কি বা এসে যায়৷

সীমন্তিনী খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাড়ি ফিরেছিল৷ কয়েকটা সিঁড়ি উঠতে হাঁপাচ্ছিল৷ দেহটাকে টেনে খাটে নিয়ে ফেলেছিল কোনওমতে৷ নাঃ, কোনও অসুবিধা ঘটেনি৷ শুধু কিছুদিন বাদে প্রচণ্ড পেটব্যথা আর রক্তপাত হয়েছিল দু’দিন ধরে৷ ফোনের আশায় থেকে থেকে একদিন ফোন করেছিল রবিকে পাঁচ-ছ’বার৷ একই উত্তর পেয়েছিল— দিজ নাম্বার ডাসনট এগজিস্ট৷ একটু সুস্থ হয়ে রবির ডেরায় হানা দিয়েছিল ও৷ বাড়িতে তালা ঝোলানো৷ বেল দিয়েছিল পাশের ফ্ল্যাটে৷ পাশের ফ্ল্যাট থেকে এক মধ্যবয়সী ভদ্রমহিলা উঁকি দিয়ে একটু কৌতূহলী চোখে তাকিয়েছিলেন৷ ‘ও, বন্ধু বুঝি! না৷ ও তো কয়েকদিন আগে চলে গেল খুব তাড়াহুড়ো করে৷ কোথায় যাচ্ছে বলে যায়নি কিছু?’ শেষের প্রশ্নটা সীমন্তিনীকেই৷ ও রবির কলেজে গেছিল শেষ চেষ্টা করতে৷ সেখানে গেটের মুখেই শুনেছিল রবিস্যার হঠাৎ ট্রান্সফার নিয়ে দেশের মিশনারী কলেজে চলে গেছে৷ এত তাড়াহুড়ো যে কেন করল? এক প্রবীণ অধ্যাপক চিন্তিত মুখে বলেছিলেন, ‘কী না কী দেশে হঠাৎ স্ত্রী অসুস্থ হয়েছে৷ হি হ্যাড নো আদার অল্টারনেটিভ বাট টু গো— বলল তো৷’ নাঃ আর কোথাও যায়নি সীমন্তিনী৷ বাড়ি ফিরে এসেছিল৷

Sad barefoot walking
সীমন্তিনী খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাড়ি ফিরেছিল৷

তখন সন্ধে হব হব৷ ও লক্ষ করছিল, বাবা আজ অনেক আগে বাড়ি চলে এসেছে৷ স্টাডিতে ডিমার দিয়ে মৃদু আলো জ্বলছে৷ দুই হাত মাথায় দিয়ে টেবিলে কনুই রেখে বসে বাবা গভীর চিন্তামগ্ন৷

‘বাবা!’

অম্বিকা দু’চোখ খুলে তাকিয়েছিলেন৷ চোখে যেন সর্বস্বান্ত হয়ে যাওয়া মানুষের দৃষ্টি৷ তখনই নজরে পড়েছিল অ্যাবর্শন ক্লিনিকের রিপোর্টগুলো বাবার সেক্রেটারিয়েট টেবিলে রাখা৷

‘এস বোস৷’ বাবা খুব ক্লান্ত গলায় বলেছিল৷ বাবার জন্য হঠাৎ খুব কষ্ট হচ্ছিল সীমন্তিনীর৷ কেন বুঝতে পারেনি ও৷

‘আজ তোমার কলেজ থেকে আমার চেম্বারে ফোন করেছিল৷ তুমি নাকি পনেরো দিন হয়ে গেল কলেজে যাও না! দ্য টিচার্স আর অল ভেরি ওয়ারিড অ্যাবাউট ইউ৷ কিছুদিন ধরে তোমার নাকি পড়াশোনায় মন নেই! ওঁরা বলছিলেন৷ আই ওয়েন্ট টু মিট দেম৷ আমি তাই ভাবলাম তোমাকেই জিজ্ঞেস করব কী হয়েছে৷ আমি ফিরে এসে তোমার ঘরে গেলাম৷ ইউ ওয়্যার নট দেয়ার৷ তখন এই কাগজগুলো পেলাম৷’

সীমন্তিনীর মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেছিল৷ অম্বিকা লক্ষ করেছিলেন বোধহয় সেটা৷ উনি আস্তে আস্তে চেয়ার ছেড়ে উঠে ওর কাছে গেলেন৷ ওর মাথাটা দু’হাতে জড়িয়ে ধরলেন৷ কয়েক মিনিটের নিস্তব্ধতা৷ তারপর প্রায় ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করেছিলেন অম্বিকা, ‘কী হয়েছে মা গো? আমার বলনি কেন?’

সব বলেছিল সীমন্তিনী৷ রবির সঙ্গে প্রেম এবং তার পরিণতি৷ সব শুনে ব্যথাতুর মুখে অম্বিকা বলেছিলেন— আমাকে বলতে পারতে, এত যে কষ্ট পেয়েছ, পাচ্ছ৷

‘মেয়েরা তো মাকে সব বলে৷ আমার তো মা নেই৷ তোমাকে আমি বলতে পারিনি বাবা…’ কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল সীমন্তিনী৷

অম্বিকা আবারও কিছুক্ষণ মুখ নীচু করে স্তব্ধ হয়ে ছিলেন৷ তারপর মুখ তুলে বলেছিলেন, ‘তোমাকে আমি দুবছর বয়স থেকে তিলে তিলে বড় করেছি৷ মা-বাবা দুজনে মিলে যা যা করণীয়, সব একা হাতে করতে চেয়েছি৷ তার মধ্যে আমার নিজের কাছেও নিজের একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল৷ ভেবেছিলাম, তোমার প্রতি মা আর বাবার যৌথ কর্তব্য করতে আমি পুরোপুরি সাকসেসফুল৷ কিন্তু এখন দেখছি, না, আমি আসলে হেরে গেছি৷ তোমার মা থাকলে হয়তো এত বড় ঘটনা ঘটত না৷ ইন আ ওয়ে, আমি হেরে গেছি৷’

সীমন্তিনীর পরে মনে হয়েছিল বাবাকে ওর বলা উচিত ছিল— না বাবা, তুমি হেরে যাওনি৷ আমি তোমাকে হারতে দেব না৷ আমি সবসময় তোমার পাশে থাকব৷ না, এত কথা কুড়ি-একুশ বছরের সেই মেয়েটার মাথায় যোগায়নি৷ সীমন্তিনী শুধু নিজের কষ্টে বুঁদ হয়ে ছিল৷

আরও অনেকক্ষণ বাদে অম্বিকা বলেছিলেন, ‘দেখবে সব কষ্টই ফেড করে যায়৷ মৃত্যুশোকও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফিকে হয়ে আসে৷ এই যে দু’বছর আগে তোমার ঠাকুমা চলে গেলেন, এখন আর তেমন তীব্র কষ্ট পাও কি? এরকমই হয়৷’ অম্বিকা একটানা কথা বলছিলেন৷ স্বগতোক্তির মত৷ তবে, অম্বিকা কী যেন ভাবছিলেন, ‘মৃত্যুশোক ছাড়াও তো মানুষের জীবনে আরও অনেকরকম দুঃখকষ্ট থাকে৷ অনেকসময় বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো সেইসব আঘাত এসে পড়ে৷ তোমার জীবনের এই ঘটনাটার মতো৷ মানুষ তা থেকে শিক্ষা নেয়, আবার ঘুরে দাঁড়ায়৷ সামনে চলার শক্তি পায়৷ ইউ হ্যাভ টু মুভ অন৷ পরে দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে৷ শুধু একটা তিরতিরে গ্লানিবোধ থেকে যায়, থেকে যাবে৷ মাঝে মাঝে জানান দেবে৷ ওইটুকুই৷’

কীসের কথা বলছিলেন অম্বিকা স্পষ্ট বুঝতে পারেনি সেদিন সীমন্তিনী৷ ওর শুধু মনে হয়েছিল, বাবা ভিতরে ভিতরে নিজেরই কোনও কষ্টের সঙ্গে যুঝছেন, লড়াই করছেন৷

‘কী করবে এবার?’ অম্বিকা খুব আলতো করে জিজ্ঞেস করেছিলেন৷

সীমন্তিনী দেখতে পাচ্ছিল সেদিনের সেই মেয়েটা উনিশ বছরের তীব্র অভিমান, অপমান আর কষ্টে মাখামাখি হয়ে ফুঁপিয়ে উঠছে৷ কেঁদে কেঁদে চোখ দুটো লাল— ‘আমি জানি না, আমি আর কিছু ভাবতে পারছি না৷ তুমি বলে দাও বাবা, আমি কী করব?’

Woman crying
শুধু একটা তিরতিরে গ্লানিবোধ থেকে যায়, থেকে যাবে

অম্বিকার চোখ আবার আর্দ্র হয়ে উঠছে৷ অকালে মা-হারা মেয়েটার জন্য৷ ভাবছেন আর কথা বলছেন অম্বিকা— থিংকিং অ্যালাউড৷ ‘আমি তো তোমাকে বা তোমার মা-কে কোনওদিন কোনও বিষয়ে বাধা দিইনি, স্বাধীনভাবে জীবনযাপনে। আমার পরামর্শ যদি শোনো, তবে কিছুদিন বাড়িতে বিশ্রাম নাও৷ একটু শক্ত হয়ে নাও শরীরে আর মনে৷ তারপর লেখাপড়াটা কন্টিনিউ কর৷ গ্র্যাজুয়েশনের পর তুমি চাইলে আমি তোমার বিদেশে পড়ার ব্যবস্থা করে দেব৷ আর এখন কলেজের প্রিন্সিপ্যালকে চিঠি দেব, যাতে তুমি আরও দিনকয়েক ছুটি পাও৷ আর তারপর…’ অম্বিকা আবার ভাবছেন, কথা হাতড়াচ্ছেন, ‘…দেখ, তোমার জীবন কীভাবে বাঁক নেয়? জীবনের কথা কেউ বলতে পারে না৷ তুমি ভাবলে এক, হল আরেক৷ ওই যে কথায় বলে না, ম্যান প্রোপোজেস, গড ডিসপোজেস৷ আমি এত নেগেটিভ ভাবতে চাই না৷ তবে ভবানীপুরের মানুষ তো৷ দেবীর ক্ষেত্র এই জায়গা৷ অঘটন-ঘটন পটীয়সী দেবী কখন অলক্ষ্যে মুচকি হাসবেন আর কী ঘটে যাবে কেউ জানি না আমরা৷ আমি শুধু বিশ্বাস করি একজন মানুষের জীবন পুরোটাই নিরেট দুঃখ দিয়ে গড়া হতে পারে না৷ চক্রবৎ পরিবর্তন্তে দুঃখানি চ সুখানি চ৷ দুঃখের কোটা শেষ হলে আনন্দও আসবে৷ ইউ হ্যাভ টু ওয়েট৷ ধৈর্য্য ধর, অপেক্ষা কর৷’

(৩৩)

সীমন্তিনী সামলে উঠেছিল৷ অম্বিকা চিঠি দিয়েছিলেন কলেজে— শুধু অভিভাবক হিসেবে নয়, ডাক্তার হিসেবেও৷ পি.জি. হাসপাতালের সুপারিন্টেন্ডিং ডাক্তারের সেই চিঠিতে সীমন্তিনীর জটিল অসুস্থতা এমন চমৎকার করে ব্যাখ্যা করা ছিল যে অধ্যাপিকারা ও বিষয়ে একটি কথাও বলেননি৷ একুশ বছরের জন্মদিনটা একটু বেশি ঘটা করেই পালন করেছিলেন অম্বিকা৷ ক্লাশশুদ্ধ মেয়ে, অধ্যাপিকারাও কেউ কেউ নিমন্ত্রিত ছিলেন৷ একুশটা মোমবাতি সাজিয়ে বিশাল একটা কেক কেটেছিল সীমন্তিনী৷ পার্ট টু পরীক্ষা হয়ে রেজাল্ট বেরিয়ে গেছে তখন৷ খুব একটা আহামরি হয়নি৷ হাই সেকেন্ড ক্লাস পেয়ে উতরে গেছিল সীমন্তিনী৷ অম্বিকা আগে থেকেই বলেছিলেন ‘দিজ ইজ দ্য লাস্ট  টাইম৷ একুশ বছর হয়ে যাওয়া মানে তুমি প্রাপ্তবয়স্কা হয়ে গেলে৷ অ্যাডাল্ট৷ একুশ বছরের জন্মদিনে ক্যান্ডল সাজিয়ে যে ছবিটা তুললে, ওটাই তোমার শেষ জন্মদিন সেলিব্রেট করা৷’

‘আচ্ছা, না হয় নাই করলে বার্থডে সেলিব্রেট, কিন্তু প্লিজ ডোন্ট সাউন্ড সো ওমিনাস্‌৷’ সীমন্তিনী হেসে বলেছিল৷

‘না, তা নয়, তবে প্রিমনিশন হয় তো৷ আমার কেন জানি না মনে হচ্ছে, এবার থেকে তুমি আমার সেই ছোট্ট মেয়ে থাকবে না৷ অন্যভাবে বাঁক নেবে তোমার জীবন৷ দ্যাট উইল বি এ চেঞ্জ ফর দ্য বেটার৷’ অম্বিকা বলেছিলেন৷

একুশ বছরের জন্মদিনটা একটু বেশি ঘটা করেই পালন করেছিলেন অম্বিকা৷ ক্লাশশুদ্ধ মেয়ে, অধ্যাপিকারাও কেউ কেউ নিমন্ত্রিত ছিলেন৷ একুশটা মোমবাতি সাজিয়ে বিশাল একটা কেক কেটেছিল সীমন্তিনী৷ পার্ট টু পরীক্ষা হয়ে রেজাল্ট বেরিয়ে গেছে তখন৷ খুব একটা আহামরি হয়নি৷ হাই সেকেন্ড ক্লাস পেয়ে উতরে গেছিল সীমন্তিনী৷

জন্মদিনের হুল্লোড়ের পর সবাই যখন চলে গেছে, অম্বিকা তখন মেয়েকে ডেকেছিলেন, ‘তুমি এখন কী করবে?’

‘নাথিং মাচ৷ কেন যেমন এমএ-তে ভর্তি হয়েছি, সেটাই করব৷’ 

‘না, না, আমি সেকথা বলছি না, রাতে তুমি কি এখনই শুয়ে পড়বে?’ সীমন্তিনী একটু অবাক হয়েছিল৷ মুখে বলেছিল, ‘আই ওয়াজ প্ল্যানিং টু ওপেন দ্য গিফটস্‌৷ ওগুলো একটু দেখব ভাবছিলাম৷’

‘ওসব পরে হবে৷ তুমি ছাদে আসবে একবার? আমার কয়েকটা কথা ছিল৷’

সীমন্তিনী মুখের মেক-আপ তুলে ড্রেস চেঞ্জ করে ব্রাশ করে নিয়েছিল চটপট৷ মনের মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা? কী বলবেন বাবা? হঠাৎ কি বাবা ওর হায়ার স্টাডিজের জন্য ব্যবস্থা করে ফেলেছেন কোথাও? নাকি ভালো কোনও পাত্র পেয়ে বিয়ের কথা ভাবছেন? বাবা তো ওকে গোপন করে এসব করে ফেলবেন না৷ তাহলে কী? রাত পোশাকের উপর একটা হাউসকোট চাপিয়ে ঠিক পনেরো মিনিট পরে ছাদে পৌঁছেছিল ও৷ অম্বিকার পরনে ড্রেসিং গাউন৷ ছাদের একদিকে একটা চিলেকোঠা ঘর৷ সেখান থেকে তেরছা হয়ে একটা চিলতে আলো এসে পড়ছে ঘরের কোণটায়৷ অম্বিকার মুখের অবয়ব আবছাভাবে দেখতে পাচ্ছে সীমন্তিনী৷

‘বোস৷’ একটু থেমেছিলেন অম্বিকা৷ যেন ভাবছিলেন কীভাবে শুরু করা যায়৷ সীমন্তিনী উল্টোদিকের চেয়ারে বসে নীরব জিজ্ঞাসা নিয়ে তাকিয়ে আছে৷

একটু বাদে অম্বিকা আবার বলেছিলেন, ‘আজ যা বলছি, সেটা তোমার কাছে সম্পূর্ণ নতুন একটা সত্য৷ এতদিন এই সত্যটা বলিনি, কারণ সত্য বড় নির্মম৷ ইউ ওয়্যার এ চাইল্ড আনটিল ভেরি রিসেন্টলি৷ কয়েকমাস ধরেই তোমাকে বলব বলে ভাবছিলাম৷ কবে বলা যায় এরকম একটা অপার্চুন মোমেন্ট খুঁজছিলাম৷ আজকে বোধহয় সেই সময়টা এসেছে৷’

আবার একটু থামলেন অম্বিকা৷ মুখটা একটু নীচু, মাটির দিকে৷ সীমন্তিনী আর ধৈর্য্য ধরতে পারছে না৷ একটা অদ্ভুত স্নায়ুর চাপ ভিতর থেকে ওকে কুরে কুরে খাচ্ছে৷

‘হোয়াট ইজ ইট বাবা?’ খুব মৃদুস্বরে বলছে ও৷ যেন মৃত্যু পরোয়ানা এসে গেছে৷ এবার শুধু মুহূর্ত গোনা চরম ক্ষণটির জন্য৷

‘ইটস্‌ অ্যাবাউট ইওর মাদার৷’

একুশটা মোমবাতি সাজিয়ে বিশাল একটা কেক কেটেছিল সীমন্তিনী

ভিতরে ভিতরে থর থর করে কাঁপছিল ও৷ 

জানত৷ জানত সীমন্তিনী— গোটা জীবন ধরে৷ ছোট থেকে বড় হয়ে ওঠবার পুরো সময় জুড়ে জানত এমন কোনও আদিম ভয়ঙ্কর কুয়াশা আছে যা একটু দূরে ওৎ পেতে বসে আছে ওকে গ্রাস করার জন্য৷ অদূরে বসা বাবার মুখ আস্তে আস্তে ঢেকে যাচ্ছে কুয়াশার ঘেরাটোপে৷

‘তোমার মার ব্রেন টিউমার হয়নি৷ ইট্‌স্‌ আ লাই আই ইনভেন্টেড… ফর য়্যু৷ সো দ্যাট য়্যু ডোন্ট হ্যাভ আ উন্ডেড চাইল্ডহুড৷ আসলে তোমার মা…’ একটু কাঁপছে অম্বিকার গলাটা, ‘তোমার মা আমাদের ফেলে একজনের সঙ্গে চলে গিয়েছিল৷’

একটু আগের তারা ভরা আকাশ আর মাথার উপর দেখতে পাচ্ছে না একুশ বছরের সীমন্তিনী৷ কুয়াশা ভিড় করেছে, ঘন হয়ে ঘিরতে আসছে ওকে৷ প্রবল শক্তিতে কুয়াশা ঠেলতে ঠেলতে সীমন্তিনী ফিস্‌ফিস্‌ করে বলছে ‘কিন্তু তুমি তো মার সঙ্গে গিয়েছিলে ইংল্যান্ডে, যেখানে মা’র ব্রেন সার্জারি হয়েছিল৷

কুয়াশার ওপার থেকে দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে অম্বিকার৷ ‘দ্যাট ওয়াজ অ্যান আইওয়াশ টু কনভিন্স পিপল্‌ অ্যারাউন্ড হিয়ার৷ আমি তোমার মা’র সঙ্গে গিয়েছিলাম টু সি হার অফ৷ লন্ডনে একটা হোটেলে উঠে একমাস ছিলাম আমি৷ ফোন করে বাড়িতে তোমার ঠাকুমাকে খবর দিতাম— তোমার মায়ের কাল্পনিক অসুস্থতা আর সার্জারির৷ এখানে আত্মীয়-বন্ধুরা মানসিকভাবে প্রিপেয়ার্ড হত— রাধিকার কঠিন অসুস্থতার বিষয়ে৷ জানত ও আর থাকবে না৷ ও ততদিনে ওর নতুন প্রেমিকের সংসারে থিতু হয়েছিল৷

‘মা আমাকে ছেড়ে চলে গেছিল? নিজের ইচ্ছেয়? আমাকে নিয়ে যেতে চায়নি একবারও?’

কুয়াশার মধ্যে বসে অম্বিকা৷ ‘তোমার তখন দু বছর বয়স৷ ইউ ওয়্যার ডিয়ার টু হার৷ তোমাকে সে ভালবাসত না তেমন নয়৷ এই শর্তটা আমিই দিয়েছিলাম৷ আইদার ইউ লিভ হিম অর ইউ লিভ ইওর ডটার৷ ইউ হ্যাভ টু চুজ৷ ইউ ক্যানট গো অ্যাওয়ে উইথ এভরিথিং৷ তোমাকেও নিয়ে নিলে আমার আর কী থাকত বল?’

লন্ডনে একটা হোটেলে উঠে একমাস ছিলাম আমি৷ ফোন করে বাড়িতে তোমার ঠাকুমাকে খবর দিতাম— তোমার মায়ের কাল্পনিক অসুস্থতা আর সার্জারির৷ এখানে আত্মীয়-বন্ধুরা মানসিকভাবে প্রিপেয়ার্ড হত— রাধিকার কঠিন অসুস্থতার বিষয়ে৷ জানত ও আর থাকবে না৷

গলা ধরে আসছে অম্বিকার৷ উনিশ বছর আগের সেই ভয়ঙ্কর রাত্রির জন্য কষ্ট হচ্ছে সীমন্তিনীর, যে রাতে নতুন প্রেমের জন্য তার মাকে ছাড়তে হচ্ছে নিজের শিশুকন্যার সত্ব৷ সেই রাত, যে রাতে তার যুবক বাবা বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে তার নবলব্ধ উপলব্ধিতে যে একদা ভালবেসে কাছে আসা তার নারীটির কাছে আর পুরনো প্রেমের কোনও মূল্য নেই। নতুন প্রেমিকের জন্য সে এমনকি তার শিশু সন্তানকেও চিরতরে হারাতে প্রস্তুত৷ সেই রাত, যে রাতে এক লহমায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে একদা রচিত হওয়া যৌথ জীবনের আশ্রয়৷

‘আমি তোমার মাকে দোষ দিইনি৷ আজও দিই না৷ সে দ্বিচারণা করেছিল— বহুদিন এর জন্য মনে একটা অভিমান ছিল৷ আজ আর অভিমান নেই৷ একটা গ্লানিবোধ আছে৷ আমি চেষ্টা করি সচেতনভাবে সেই গ্লানিকে দূরে রাখতে৷ সেই কষ্টের ভিতর আচ্ছন্ন হয়ে না যেতে৷ এই উনিশ বছর ধরে আমি বহু চেষ্টা করেছি৷ আমার একরত্তি মেয়েটার মুখ চেয়ে স্বাভাবিক থাকার জন্য লড়াই করেছি৷ আর কীই বা আমি করতে পারতাম বল! তুমি হয়তো মাঝে মাঝে রাগ করেছ৷ ঠাকুমাকে কমপ্লেন করেছ— আমি কোনও পার্টিতে যাই না, সোস্যালাইজ করি না, কোনও ক্লাব মেম্বারশিপ নেই আমার— এসবের জন্য৷ কিন্তু মা, মানুষের বাঁকা কথা, তির্যক হাসিকে, ব্যান্টারকে আমি বড় ভয় পাই৷ রাধিকা যখন চলে গেল, তখন ওর নতুন প্রেমের কথা নিয়ে ফিস্‌ফিস্‌ শুরু হয়েছিল৷ কয়েকজন আকারে ইঙ্গিতে আমাকে বলেছিল কথাটা আমার রিয়্যাকশন দেখার জন্য৷ একটা অভিজাত ক্লাবের পার্টিতে এক বন্ধুস্থানীয় ব্যক্তি হেসে হেসে বলেছিল, আই ওয়ান্ডার হোয়াটস্‌ দ্য ফিলিং অফ বিয়িং কাকোল্‌ড্‌৷ চুপ করে থাকতে পারিনি আর। তখন একদিন রাধিকাকে জিজ্ঞেস করি, আমি যা শুনছি সত্যি কি না৷ তারপর বাধ্য করি দ্রুত ডিসিশন নিতে৷ ওর মধ্যেও অনেক দোটানা ছিল৷ বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক সমাজে অনেক মশলা যোগায়৷ বাইরের লোকের ডেলি লাইফের বোরডম্‌ কাটিয়ে মশলা মুড়ির মতো জিভের স্বাদ ফেরায়৷ কিন্তু যে মেয়েটি তার স্বামীর সঙ্গে প্রতারণা করছে, নতুন প্রেমের তাড়নায় ভেসে যাচ্ছে চেনা চৌহদ্দি থেকে দূরে, তারও তো নিজস্ব কিছু টানাপোড়েন থাকে৷ রাধিকার পক্ষেও এইসব কিছু ওন আপ করা, অ্যাডমিট করা সহজ ছিল না৷ প্রথমে চায়ওনি অ্যাডমিট করতে৷ পরে বুঝল এভাবে দু-নৌকোয় পা দিয়ে চলা যায় না, চলা উচিত নয়৷ তখন ও সরে যাবার সিদ্ধান্ত নিল— আমাদের জীবন থেকে৷ ইট ওয়াজ হার ডিসিশন৷ আই রেসপেক্ট হার ফর টেকিং দ্যাট ব্রেভ ডিসিশন৷’

telephone booth
ফোন করে বাড়িতে তোমার ঠাকুমাকে খবর দিতাম

কুয়াশা সম্পূর্ণ গ্রাস করেছে একুশ বছরের জন্মদিনের রাতকে৷ কুয়াশায় আচ্ছন্ন সীমন্তিনী খুঁজে চলেছে খড়কুটো, ঘরহারা পক্ষীশাবক যেমন নতুন বাসা বানানোর আকাঙ্ক্ষায় কুটোর সন্ধান করে৷

‘সি ওয়াজ নট প্রেগন্যান্ট?’ ভিতর থেকে অন্য কেউ বলে, তাতে কি বা এসে যায়৷

‘সি ওয়াজ৷ দ্যাট ওয়াজ নট এ লাই৷ ইট ওয়াজ দ্য আদার ম্যানস্‌ চাইল্ড৷’

কে ছিল লোকটা— জানতে ইচ্ছে করে সীমন্তিনীর৷ যে আর পাঁচটা সাধারণ সুখ-দুঃখে ভরা মা-বাবা আর সন্তানের চেনা ছকটা উল্টে দিয়ে ওদের ধূ ধূ মরুভূমির মধ্যে দাঁড় করিয়ে দিয়ে গেল৷ দু’বছর বয়সে শেষ দেখা অচেনা মাকে নয়, সেই অচেনা লোকটাকে দেখতে হঠাৎ ইচ্ছে হয় ওর৷

‘অম্বিকা কি থট রিডিং জানেন? উনি বলেন, ‘আমারই চেনা বন্ধুস্থানীয় ছিল ডেভিড৷ কলকাতা নিয়ে ডকুমেন্টারি করতে এসেছিল৷ আমিই আলাপ করিয়ে দিই রাধিকার সঙ্গে৷ তবে রাধিকা নিজে ভেসে না গেলে, তার সাধ্য কী ছিল তাকে জোর করার?’

‘ওরা কি এখনও ইংল্যান্ডে থাকে? ওদের বাচ্চা?’ কুয়াশায় সম্পূর্ণ আক্রান্ত হওয়ার আগে কোনওমতে কথাগুলো বলে সীমন্তিনী৷ কুয়াশাকে ঠেলে সরিয়ে দিতে চায় দু’হাতে৷ 

কুয়াশার ভিতর থেকে বাবার গলা শুনতে পায় সে৷ সত্যি, না স্বপ্ন? এসব কি সত্যি ঘটছে, নাকি প্রলম্বিত এক স্বপ্ন দেখছে সে ছাদে বসে?

‘এই প্রশ্নের কোনও উত্তর আমার কাছে নেই৷ আমি রাধিকাকে ওর যাবতীয় জিনিসপত্র সহ কিংসক্রস স্টেশনের সামনে নামিয়ে দিয়েছিলাম৷ তারপর থেকে এই কুড়ি বছরে আমাদের কখনও যোগাযোগ হয়নি৷ উই প্রমিসড্‌ ইচ আদার নট টু গেট ইন টাচ উইথ ইচ আদার ইন এনি সারকামস্টানসেস্‌৷ সেই প্রমিস আমরা দুজনেই রেখেছি৷ এবার এসব শোনার পর তুমি যদি কখনও তোমার মা’র কাছে যেতে চাও, ইউ আর ফ্রি টু ডু দ্যাট৷ কিন্তু কোথায় তোমার মা থাকে, সে খবর তোমাকেই বার করতে হবে৷ ওয়ান পার্সন ক্যান হেল্প ইউ উইথ দ্যাট৷ বৃন্দা৷ তোমার মাসি। তোমার মা যে ইংল্যান্ড চলে গেছিল, আমি ছাড়া একমাত্র বৃন্দাই জানত৷ বৃন্দা আর রাধিকার বাবাও জানতেন হয়ত৷ এ বিষয়ে তাঁর মতামত কী আমি জানার দরকার বলে মনে করিনি৷ তবে রাধিকা বৃন্দাকে সবটাই বলেছিল৷ যতদূর জানি ওদের যোগাযোগ ছিল৷ তোমার মার সঙ্গে সব সম্পর্ক ত্যাগ করেছি বলে বৃন্দার সঙ্গেও আর কোনও যোগাযোগ ছিল না আমার৷ শুনেছি ও আমেরিকা চলে গেছিল৷ বৃন্দা এখন কোথায় থাকে, তাও আমি জানি না৷ ইউ হ্যাভ টু ফাইন্ড ইট ইওরসেল্ফ৷’

কুয়াশা ভেদ করে এগিয়ে আসে সীমন্তিনী৷ বাবার কোলের কাছটিতে৷ ঠিক ছোটবেলার মতো৷ ঝুঁকে পড়ে দু-হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরে বাবাকে৷ বাবার কপালে আলতো করে একটা চুমু খায়৷ বলে ‘আই ডোন্ট নিড্‌ টু৷ আমি কোনওদিন বৃন্দাকে খুঁজব না৷ রাধিকাকেও নয়৷ কুড়ি বছর আগে মা আমাদের ফেলে চলে গিয়েছিল৷ ইট ওয়াজ হার ডিসিশন টু লিভ আস, টু শান আস ফরএভার ফ্রম হার লাইফ৷ এত বছর ধরে আমি এইভাবেই বড় হয়েছি, আই অ্যাম নাও ইউজড্‌ টু হার অ্যাবসেন্স৷ মা কেমন ছিল বাইশ বছর অবধি যখন বোঝার সুযোগ হয়নি, তখন বাকি দিনগুলো মাকে না খুঁজলেও আমার চলবে৷ দিজ ইজ আ প্রমিস টু ইউ৷ অ্যান্ড আই উইল নেভার ব্রেক দিস৷ যদি কখনও দুর্বল হয়ে যাই, প্লিজ হেল্প মি টু কিপ মাই প্রমিস টু ইউ৷’

***

এক অনন্ত কুয়াশাচ্ছন্ন রাতের মধ্যে দিয়ে চলছিল সীমন্তিনী৷ কতদিন, কত রাত কেটেছিল এভাবে এখন আর হিসেব করতে পারে না ও৷ ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস করত কলের পুতুলের মতো৷ পড়াশোনায় কনসেনট্রেট করতে পারত না৷ যখনই ইচ্ছে হত, ক্লাশ না করে ও চলে যেত পার্কস্ট্রিটে৷ ট্রিংকাসে গিয়ে একা একা একটা ড্রিংক নিয়ে বসে থাকত৷ ঢাকুরিয়া লেকের ধারে গাড়ি পার্ক করে একা একা সূর্যাস্ত দেখত৷ দূর থেকে লক্ষ করত রোল্যান্ড রোডের বাড়িটা— রাধিকা আর বৃন্দার একদা বাসস্থান৷ কুড়ি বছর আগের বিট্রেয়ালের গল্প, এক বছরের কম আগের অন্য এক বিট্রেয়ালের স্মৃতিতে মিশে দগদগে ঘায়ের মতো হয়ে থাকত মন৷

একদিন বেশ সন্ধে হয়ে গিয়েছিল বাড়ি ফিরতে৷ বেল বাজাবার পর দরজা খুলে দিলে সাধারণতঃ সিঁড়ি দিয়ে নিজের ঘরেই চলে যাওয়া অভ্যেস ওর৷ সেদিন দেখেছিল নীচে বৈঠকখানা ঘরে আলো জ্বলছে৷ ভিতরে গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে ৷ অম্বিকার সঙ্গে মার্কিনি ইংরিজি আর ভাঙা ভাঙা বাংলা মিশিয়ে কথা বলছে কেউ৷ সিঁড়ির মুখে সীমন্তিনীর পায়ের শব্দ শুনে অম্বিকা হেঁকে বলেছিলেন, ‘মা গো! শুনে যেও একবার৷’

ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস করত কলের পুতুলের মতো৷ পড়াশোনায় কনসেনট্রেট করতে পারত না৷ যখনই ইচ্ছে হত, ক্লাশ না করে ও চলে যেত পার্কস্ট্রিটে৷ ট্রিংকাসে গিয়ে একা একা একটা ড্রিংক নিয়ে বসে থাকত৷ ঢাকুরিয়া লেকের ধারে গাড়ি পার্ক করে একা একা সূর্যাস্ত দেখত৷ দূর থেকে লক্ষ করত রোল্যান্ড রোডের বাড়িটা— রাধিকা আর বৃন্দার একদা বাসস্থান৷

ওদের বাড়িতে বাইরের লোক প্রায় কেউ আসেই না৷ অম্বিকার একমাত্র দিদি বহুদিন হল বিয়ে হয়ে ম্যাড্রাসে৷ পিসি আর তার ছেলেমেয়ের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ হয় কালেভদ্রে৷ কুড়ি বছর ধরে অম্বিকা নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার পর বন্ধুবান্ধব প্রায় নেই৷ আগে দূর সম্পর্কের যেকটি আত্মীয় দেখা করতে আসত, সীমন্তিনীর ঠাকুমা দু’বছর আগে মারা যাবার পর তারাও আসে না৷ বন্ধুবান্ধব বলতে শুধু সীমন্তিনীর কলেজ-ইউনিভার্সিটির বন্ধুবান্ধব, যারা মাঝেমধ্যে এ বাড়িতে আসে৷

অম্বিকা চাকরি জীবনের শেষ প্রান্তে৷ বাড়ির নীচের তলার একটি ঘর চেম্বার৷ সেখানে ডাক্তারি জিনিসপত্র ছাড়াও ডাক্তারিবিদ্যার বিভিন্ন বই সাজানো, যা একদা বিলেতে এম.আর.সি.পি. পড়তে গিয়ে অম্বিকা কিনেছিলেন৷ ডাক্তার হিসেবে অম্বিকার খুব নাম-যশ ছিল৷ সেদিন শনিবার৷ অম্বিকার চেম্বার বন্ধ৷ শনি রবিবার অম্বিকা রোগী দেখেন না৷ তিনি মেয়ের সঙ্গে সময় কাটান৷ বাবার ডাকে ঘরের দরজায় এসে সীমন্তিনী একটু থমকাল, কারণ ঘরের মধ্যে যে যুবকটি বসে আছে তাকে ও খুব সম্প্রতি কোথায় যেন দেখেছে৷ অম্বিকা বললেন, ‘এস মা, বোসো৷ আলাপ করিয়ে দিই৷ ওর নাম অরুণাভ৷ অরুণাভ সেন৷ গতকাল ভোরে এখানে এসে পৌঁছেছে৷ কলকাতা দেখতে এসেছে অরুণাভ— অনেক বছর বাদে, তাই না অরুণাভ?

‘অরুণাভ, মিট মাই ডটার সীমন্তিনী৷ লেডি ব্রেবোর্ণ থেকে ইংলিশে গ্র্যাজুয়েশনের পর এখন মাস্টার্স করছে৷’

ততক্ষণে সীমন্তিনী বুঝতে পেরে গেছে এই ছেলেটিকে ও আগে কোথায় দেখেছে৷ গতকাল স্কাইরুমে বসে ছিল ও আরও দু’টি শ্বেতাঙ্গ ছেলের সঙ্গে৷ ঠিক সেই মুহূর্তে অরুণাভর মুখেও আলো জ্বলে উঠল— ‘আই হ্যাভ সিন ইউ সামহোয়্যার৷’

‘স্কাইরুম! আই ওয়াজ দেয়ার ইয়েস্টার্ডে ইভনিং।’

‘দ্যাটস্‌ রাইট৷ আই ওয়াজ দেয়ার উইথ টু অফ মাই ফ্রেন্ডস।’

পার্কস্ট্রিটেই একটা হোটেলে উঠেছিল অরুণাভ৷ শুনে প্রচণ্ড আপত্তি করেছিলেন অম্বিকা৷

‘এতদিন পরে শহর দেখতে এসেছ তুমি৷ হতে পারে আত্মীয়স্বজন নেই এখানে, তা বলে নির্বান্ধব হোটেলে উঠবে? তা কী করে হয়?’ অরুণাভ রাজি হয়েছিল৷ দুই বন্ধু এসেছিল তিনদিনের ঝটিকা সফরে৷ অরুণাভর ওপেন টিকেট৷ সে যাত্রা আরও দিন দশেক থাকার কথা ওর৷ দু’দিন বাদে বন্ধুরা চলে গেলে অম্বিকার পীড়াপীড়িতে ও মালপত্র নিয়ে এসে উঠেছিল সীমন্তিনীদের বাড়ি৷ সীমন্তিনীদের বাড়িতে অঢেল জায়গা৷ গেস্টরুম ছাড়াও ঠাকুমার ঘরটা খালিই পড়ে আছে দু’বছর ধরে৷ সীমন্তিনীদের বাড়িতে তখন রান্নার চামেলি মাসি, ড্রাইভার লাল্টুদা ছাড়াও আর তিন-চারজন ঘরদোর সামলাবার লোক৷ সবাই অরুণাভকে পেয়ে খুব খুশি হয়েছিল৷ অম্বিকা অনেকদিন বাদে সত্যিকারের আনন্দ পেয়েছিলেন৷ একজন কথা বলার লোক৷ শৈশব থেকে ইংল্যান্ড-আমেরিকায় বড় হলেও বাবা-মায়ের শিক্ষায় সাহিত্য, সংস্কৃতি, স্পোর্টস সব বিষয় নিয়ে আগ্রহ ছিল অরুণাভর৷ ডাক্তারি পড়া শেষ করে ও তখন ইন্টার্ন হিসেবে কাজ শুরু করেছে ম্যাস জেনারেল হসপিটালে৷ সীমন্তিনী বরং খুব বেশি কথা বলত না ওর সঙ্গে৷ ও শুধু বুঝতে পারত অরুণাভ খুব আগ্রহ নিয়ে লক্ষ করছে ওকে৷ ওর চোখের মুগ্ধতাকে আবার আস্তে আস্তে উপভোগ করছিল সীমন্তিনী৷ অরুণাভর লম্বা পেটানো চেহারা, গালে উস্কো-খুস্কো দাড়ি, স্বপ্নালু চোখ, মাথার চুলগুলো কাঁধ অবধি৷ মাঝে মাঝে অস্থিরভাবে চুলগুলোর মধ্যে আঙুল চালানো ওর প্রিয় অভ্যাস৷ অনেকদিন বাদে সীমন্তিনীর সকাল সন্ধেগুলো ঝলমলে হয়ে উঠেছিল৷ কিন্তু ওর মধ্যে একটা চাপা অসহিষ্ণুতা কাজ করত কারণ অরুণাভর ওদের বাড়িতে আসার পিছনে অন্য আরেকজনের ভূমিকা ছিল৷ বৃন্দা৷ বৃন্দার প্রতি সহজাত বিদ্বেষ ওকে সহজ হতে দিচ্ছিল না অরুণাভর সঙ্গে৷ বৃন্দা অরুণাভর হাতে অম্বিকার জন্য একটা বড় চিঠি পাঠিয়েছে৷ সে খবর অম্বিকাই বলেন মেয়েকে৷ 

‘হোয়াই ডিড ইউ এন্টারটেন দ্য পার্সন হু ইজ আ মেসেঞ্জার ফ্রম বৃন্দা?’ অরুণাভ প্রথম দিন চলে যাবার পর অম্বিকার কাছ থেকে জানতে চেয়েছিল ও৷

‘অকারণ বৃন্দার উপর রাগ কোরো না৷ বৃন্দা হ্যাজ নাথিং টু ডু উইথ ইওর মাদার’স লাইফ৷ সি জাস্ট হ্যাপেন্স টু বি হার সিস্টার৷ বৃন্দার সঙ্গে তার দিদির যদি সম্পর্ক থাকে, সেটা খুব স্বাভাবিক৷ বৃন্দা আমার রেফারেন্স অরুণাভকে দিয়েছে জাস্ট রেফারেন্স হিসেবেই৷ ছেলেটিরও যেহেতু কলকাতায় অন্য কোনও চেনাজানা নেই, তাই৷ আর শোনো, ডোন্ট গেট অবসেসড্‌ বাই ইওর টানেল ভিশন৷ বৃন্দা ওদের ফ্যামিলির অনেক দিনের চেনা৷ বৃন্দার কাছ থেকে চিঠি নিয়ে এসেছে বলেই যে ছেলেটি খারাপ, এরকম সিম্পলিস্টিকভাবে ভেবো না৷’

অম্বিকা কি অরুণাভর প্রতি একটু বেশি পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পড়েছিলেন? তাঁর কি মনে হয়েছিল এই পৃথিবীতে তাঁর সময় ফুরিয়ে আসছে? তার আগে আদরের মেয়ের ভার নেওয়ার জন্য এইরকম একটি ছেলেকেই দরকার? এগুলোর উত্তর জানে না সীমন্তিনী৷ শুধু ওর মনে আছে এক সকালে ওদের বাড়ির গাড়িতে অরুণাভ দমদমে ওর জন্মস্থান দেখতে যাবে ঠিক ছিল৷ সীমন্তিনীর জন্য নির্দিষ্ট কন্টেসাতেই যাবে অরুণাভ, সঙ্গে সীমন্তিনী যাবে পথপ্রদর্শক হিসেবে— তেমনই ঠিক৷ আগের রাতে সীমন্তিনীর ঘরে ঠক্‌ঠক্‌ করে একবার নক করেছিলেন অম্বিকা৷ সীমন্তিনী কী একটা বই পড়ছিল৷ হাতে বইটা রেখে বাবাকে দেখে খুব উদ্বেগের সঙ্গে বলেছিল, ‘কী হয়েছে বাবা? শরীর খারাপ লাগছে?’ সামান্য অপ্রস্তুত অম্বিকা ডাইনে বাঁয়ে ঘাড় নেড়েছিলেন৷ ‘ঘুম আসছিল না, তাই ভাবলাম একটু কথা বলি৷’

ভিতরে এসে বসে একটু কিন্তু কিন্তু ভাবে বলব কি বলব না ভঙ্গিতে বলেই ফেলেছিলেন অম্বিকা— ‘দ্যাখ মা গো! আমার তো বয়স কম হল না৷ অভিজ্ঞতাও আছে৷ তাই বলছিলাম… আমি কিন্তু মানুষ চিনতে ভুল করি না৷’ একটু চুপ করে পরের কথাগুলো গুছিয়ে নিচ্ছিলেন অম্বিকা৷ সীমন্তিনী বুঝতে পারছিল ঠিক কী বলতে এসেছেন বাবা৷

অম্বিকা ঠিক সেই কথাটাই বললেন, ‘আমি তো একজন হেরো মানুষ মা৷ এখন তো তোমার জানাই, জীবন আমার কাছ থেকে নিয়েছে অনেক বেশি৷ দিয়েছে কম৷ বিশ্বাস করে ঠকতে হয়েছে৷ তবু আত্মসম্মান বজায় রেখে বাঁচতে চেয়েছি সারাজীবন৷ তুমিও এইটুকু বয়সেই বিশ্বাসভঙ্গের যন্ত্রণা পেয়েছ৷ কিন্তু তোমার সামনে সারা জীবনটা পড়ে আছে৷ একটা কথা বলি৷ হি ইজ আ জ্যুয়েল অফ আ বয়৷ বড় খাঁটি মানুষ৷ আমি তোমাকে বলছি ওর কাছ থেকে তুমি ঠকবে না৷ টেক ইট ফ্রম মি, ওয়াইজ ওল্ডম্যান’স অ্যাডভাইজ বলতে পার৷’ এর চেয়ে স্পষ্ট করে আর কীই বা বলতে পারতেন অম্বিকা৷ সীমন্তিনীর উপর থেকে যেন একটা বড় ভার সরে গেছিল৷

*পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ৪ জানুয়ারি ২০২৩

ছবি সৌজন্য: Istock, Pexels, Needpix, Abode Stock, Can stock,

Aparajita Dasgupta

অপরাজিতা দাশগুপ্ত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদের মুখ্য নির্বাহী আধিকারিক। আগে ইতিহাসের অধ্যাপনা করতেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট মেরিজ কলেজে ইতিহাস ও মানবীচর্চা বিভাগের ফুলব্রাইট ভিজিটিং অধ্যাপকও ছিলেন। প্রেসিডেন্সির ছাত্রী অপরাজিতার গবেষণা ও লেখালিখির বিষয় উনিশ শতকের শেষে ও বিশ শতকের গোড়ায় বাঙালি হিন্দু ভদ্রলোকের চিন্তাচেতনায় এবং বাংলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নারী। অধ্যাপনা, গবেষণা, ও পেশা সামলে অপরাজিতা সোৎসাহে সাহিত্যচর্চাও করেন। তিনটি প্রকাশিত গ্রন্থ - সুরের স্মৃতি, স্মৃতির সুর, ইচ্ছের গাছ ও অন্যান্য, ছায়াপথ। নিয়মিত লেখালিখি করেন আনন্দবাজার-সহ নানা প্রথম সারির পত্রপত্রিকায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *