আমেরিকায় বাংলা নাটক প্রযোজনা ও উপস্থাপনার ক্ষেত্রে যে নাট্যগোষ্ঠী গত তিন দশকে বহু নাটক সাফল্যের সঙ্গে মঞ্চস্থ করেছে, সেই ‘এপিক অ্যাকটর্স ওয়ার্কশপ’-এর উদ্যোগে সাউথ এশিয়ান থিয়েটার ফেস্টিভ্যালের পনেরো বছর পূর্ণ হল এ বছর, ২০২২ সালে। নিউজার্সির ‘নিউব্রানস উইক পারফর্মিং আর্ট সেন্টার’-এ গত ১১ ও ১২ ডিসেম্বরের নাট্য উৎসবে বাংলা, হিন্দি, দক্ষিণ ভারতীয় ও ইংরেজি ভাষায় পাঁচটি নাটক প্রযোজনা করেছে আমেরিকার কয়েকটি নাট্যগোষ্ঠী। 

পনেরো বছর আগে দক্ষিণ এশীয় নাট্যোৎসবের সূচনার ক্ষেত্রে ‘এপিকস’-এর স্থাপক সদস্য ডঃ দীপন রায়ের পরিকল্পনা ছিল— ভাষার গণ্ডি অতিক্রম করে ভারত ও উপমহাদেশের নাটক প্রযোজনাকে আমেরিকার বৃহত্তর দর্শকের কাছে উপস্থিত করা। সেই সময় থেকে ইংরেজি, হিন্দি, মারাঠী, গুজরাটি, কণ্ণড়, এমনকি সুদূর আফগানিস্থান থেকে নাট্যশিল্পীরা এসে ‘এপিক’-এর নাট্যসম্মেলনে অভিনয় করে গেছেন। বাংলা নাটকের পাশাপাশি এভাবেই আন্তর্জাতিক দর্শকের কাছে এই উৎসব আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। এবারের নাট্যোৎসবের উদ্বোধনপর্বে উপস্থিত ছিলেন নিউ ইয়র্কের ভারতীয় কনসাল জেনারেল রণধীর জয়সওয়াল, নিউ জার্সি স্টেটের সাংস্কৃতিক দপ্তরের প্রতিনিধি-সহ নাট্যদলের পৃষ্ঠপোষক ও কয়েকজন পরিচালক। তারপর নিউ জার্সির ‘মিডল সেকস কাউন্টি কালচারাল অ্যান্ড আর্টস ট্রাস্ট ফান্ড’ এবং কয়েকটি মার্কিন কর্পোরেট সংস্থা থেকে আর্থিক সহায়তা করার জন্য তাঁদের ধন্যবাদ জানানো হয়। 

১১ ডিসেম্বর প্রথম প্রযোজনা ‘দ্য নেকেড লাইন’ নৃত্যনাট্যের আঙ্গিকে মঞ্চস্থ করেছে ক্যালিফোর্নিয়ার ‘নবরস ডান্স থিয়েটার’। রচনা অপর্ণা সিন্ধুর ও এস এম রাজু। পরিচালনা ও নৃত্য পরিকল্পনা অপর্ণা সিন্ধুর ও অনিল নাট্যবেদী। সঙ্গীত জর্জ ব্রুকস। সঙ্গীত, দক্ষিণ ভারতীয় ধ্রুপদী নৃত্য, আধুনিক নৃত্যকলা ও অভিনয়ের মাধ্যমে মূলত ইংরিজি এবং মুহূর্ত বিশেষে কণ্ণড় ভাষায় ‘দ্য নেকেড লাইন’ নারীমনের চিরকালীন এক প্রশ্ন তুলে ধরেছে। আবহমানকাল ধরে যাবতীয় শিল্পকলা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে নারীর সীমাবদ্ধতা নিয়ে প্রতিবাদ, পুরুষ সমাজ আরোপিত নীতি, নিষেধের শৃঙ্খলে বাঁধা নারীশিল্পীর নৃত্য, গীত, অভিনয়, সাহিত্যচর্চা ইত্যাদি সাংস্কৃতিক যাত্রাপথের প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে এক প্রতীক চরিত্রের উত্তীর্ণ হওয়ার সংকল্প— এ নাটকের মূল বিষয়। মূল চরিত্রের একক অভিনয়ের মুহূর্তে সংলাপ কিছু দীর্ঘ ছিল। এ প্রযোজনায় অভিনবত্ব ছিল ভারতীয় ধ্রুপদী নৃত্য। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সঙ্গে পাশ্চাত্য আধুনিক নৃত্য ও মার্শাল আর্ট-এর সমন্বয়ে অসাধারণ সমবেত নৃত্য।

Dance Like a Man
নানা অনুভূতি, ঘাত-প্রতিঘাত নিয়ে কাহিনি শেষ হয়েছে পারস্পরিক বোঝাপড়ায়

এর পরের নাটক নিউ জার্সির ‘আই সি এস থিয়েটার’-এর ‘ডান্স লাইক আ ম্যান’। বিখ্যাত নাট্যকার মহেশ দাত্তানির এই মঞ্চসফল ইংরেজি নাটকটি পরিচালনা করতে তিনি নিজেও উপস্থিত ছিলেন। পেশায় ভরতনাট্যম শিল্পী এক প্রৌঢ় দম্পতির সম্পর্কের টানাপোড়েন, অতীতের এক পারিবারিক দুর্ঘটনা থেকে নিরন্তর অনুশোচনা, বর্তমান সময়ে তাঁদের একমাত্র সন্তানের নৃত্যশিল্পী হওয়ার উচ্চাশা ও তার জীবনসঙ্গী নির্বাচনের ক্ষেত্র তাঁদের আশঙ্কা, সংশয়— এমন নানা অনুভূতি, ঘাত-প্রতিঘাত নিয়ে কাহিনি শেষ হয়েছে পারস্পরিক বোঝাপড়ার মধ্যে দিয়ে। শিল্পীদের অভিনয়ের ক্ষেত্রে কন্যা ও তার প্রেমিকের ভূমিকায় দেবযানী বন্দ্যোপাধ্যায় ও অনিল জোসেফ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তবে মহেশ দাত্তানির সংলাপসমৃদ্ধ, আত্মবিশ্লেষণমূলক নাটকটি প্রৌঢ় দম্পতির অভিনয় দুর্বলতার কারণে, আদৌ পেশাদার পর্যায়ে পৌঁছয়নি। অতীত ও বর্তমানের ঘটনার প্রেক্ষাপট ফিরে ফিরে আসার মুহূর্তে কিছু দৃশ্য পুনরাবৃত্তির মতো মনে হয়েছে।

শনিবার তৃতীয় নাটক ‘অ্যাগনেস’ মঞ্চস্থ করেছে নিউ জার্সির ‘ইসিটিএ’ নাট্যগোষ্ঠী। আমেরিকার পটভূমিতে লেখা এ নাটকের নাট্যকার সুদীপ্ত ভৌমিক। ঐতিহাসিক তথ্য, রাজনৈতিক আদর্শ, জাতীয়তাবাদ ও এক আমেরিকান মহিলার জীবনী এবং আত্মজীবনীমূলক রচনার ভিত্তিতে নাট্যকার তাঁর স্বতন্ত্র চিন্তাধারা ও মানবিক চেতনাবোধ থেকে এ নাটকের কাহিনি নির্মাণ করেছেন। নাটকের ঘটনাক্রম বিংশ শতকের প্রথম দুই যুগ। পটভূমি আমেরিকার নিউ ইয়র্ক শহর। ব্রিটিশশাসিত ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে যে ভারতীয় বিপ্লবীরা আমেরিকা ও জার্মানী থেকে গোপনে যোগ দিয়েছিলেন, তাঁদেরই একাধিক সংগঠনের সদস্যরা এ নাটকের প্রধান কয়েকটি চরিত্র। লালা লাজপৎ রায়, মানবেন্দ্রনাথ রায়, শৈলেন্দ্রনাথ ঘোষ, বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ প্রবাসী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সঙ্গে আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন অ্যাগনেস স্মেডলি নামে নিউ ইয়র্কের এক বিদ্রোহী তরুণী। 

Agnes Poster
আমেরিকার পটভূমিতে লেখা এ নাটকের নাট্যকার সুদীপ্ত ভৌমিক

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতাবাদ, আমেরিকায় পুরুষতন্ত্রের আধিপত্য, সমাজের শ্রেণিবৈষম্য— এ সবের বিরুদ্ধেই তাঁর প্রতিবাদ। তবু, বিপ্লবী পুরুষদের সাহচর্যে তাঁর হৃদয় দুর্বল হয়। বিবাহিত মানবেন্দ্রনাথ রায়ের প্রতি অ্যাগনেসের আকর্ষণ, প্রত্যাখানের যন্ত্রণা, তাঁর গোপন রাজনৈতিক কার্যকলাপের অপরাধে মার্কিন পুলিশ প্রশাসনের পদক্ষেপ, ইত্যাদি নানাবিধ ঘটনায় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অ্যাগনেস আত্মহত্যার চেষ্টা করেন ও সুস্থ হওয়ার পরে নিউ ইয়র্ক ছেড়ে চলে যান। জার্মানীতে প্রবাসী বিপ্লবী বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হন। বীরেন্দ্র তাঁকে বিয়ে করেন। সন্দেহপ্রবণ স্বামীর সঙ্গে অশান্তির কারণে সে সম্পর্ক ভেঙে যায়। অ্যাগনেস জার্মানি ছেড়েও চলে যান। তাঁর শেষ জীবন কেটেছিল ডেনমার্কে। বিদেশ থেকেও পরবর্তী সময়ে ভারতবর্ষের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল।

এ নাটকের প্রধান চরিত্র অ্যাগনেস। তাঁকে ঘিরে অন্যান্য যে চরিত্রগুলি, সেই প্রবাসী বিপ্লবীদের স্বদেশপ্রেম, রাজনৈতিক মতাদর্শ তথা কমিউনিজমের প্রভাব, ক্ষমতালিপ্সা, পরস্পরকে সন্দেহ, ঈর্ষা, অ্যাগনেসের প্রতি বিশ্বাস, আকর্ষণ, বিকর্ষণ— নাট্যকার তথ্যবহির্ভূত কোনও ধারণা থেকে এমন চরিত্র সৃষ্টি করেছেন বলে আশা করা যায় না। সম্ভবত অ্যাগনেসই তাঁর তথ্য ও কল্পনানির্ভর চরিত্র, যাকে কেন্দ্র করে ইতিহাসের এক বিশেষ সময়ে পরাধীন ভারতবাসীর জন্য বিদেশী এক নারীর সহমর্মিতা এবং পরোক্ষভাবে বিপ্লবে সহযোগিতার কথা জানা যায়।

Agnes on stage
অ্যাগনেস নাটকে আবহসঙ্গীত, আলোকসম্পাত, ওই সময়ে বিদেশিদের পোশাক-পরিচ্ছদের পরিকল্পনা প্রশংসার্হ

নাট্য সম্মেলনে বিশেষভাবে মঞ্চসজ্জার সময় থাকে না। ফলে একই প্রেক্ষাপটে ‘অ্যাগনেস’-এর চরিত্রগুলি ভৌগোলিক সীমারেখা পার হয়ে আমেরিকা থেকে জার্মানি, রাশিয়া পৌঁছে যায়। আবহসঙ্গীত, আলোকসম্পাত, ওই সময়ে বিদেশিদের পোশাক-পরিচ্ছদের পরিকল্পনা, ব্যবহৃত জিনিসপত্র এবং চলমান ইংরিজি সুপার টাইটেল নাটকের পটপরিবর্তনের আভাস দেয়। নাটকের শেষ দৃশ্যে জার্মানির রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে নিঃসঙ্গ, ব্যথিত অ্যাগনেসের শেষ সংলাপ, ইঞ্জিনের তীব্র আলো আর হুইসল-এর শব্দ এক বিষণ্ণ পরিসমাপ্তি ঘোষণা করে। সুদীপ্ত ভৌমিকের নির্দেশনায় অ্যাগনেসের ভূমিকায় সুদীপ্তা মজুমদার পেশাদারী অভিনয় দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। বীরেন্দ্রর ভূমিকায় সুরথ সিনহার অভিনয় নাটকের শেষ পর্যায়ে অসাধারণ ক্লাইম্যাক্স মুহূর্ত সৃষ্টি করেছে। নাটকের দলগত অভিনয় যথাযথ। ‘ইসিটিএ’র নাট্য প্রযোজনা এবারেও নাট্য-উৎসবে দর্শকদের প্রশংসা পেয়েছে।

Radha Bina Ranade
মুম্বই শহরের এক মরাঠী উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারের দুই প্রজন্মের মূল্যবোধের সংঘাত এ নাটকের মূল উপজীব্য

উৎসবের দ্বিতীয় দিনের প্রথম নাটক ‘রাধা বিনা রানাডে’র (হিন্দি) লেখক চেতন দাতার ও পরিচালিকা ভিদুলা মাঙ্গেকর। প্রযোজনা নিউ জার্সির ‘থিয়েট্রিক্স’। মূল মরাঠী নাটকের এই হিন্দি নাট্যরূপে মুম্বই শহরের এক মরাঠী উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারের দুই প্রজন্মের মূল্যবোধের সংঘাত ও পরিণতির গল্প মঞ্চস্থ হয়েছে। সংসারের কর্ত্রী প্রধান মহিলা চরিত্র রাধার মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁরই দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে (অলক্ষ্যে উপস্থিত থেকে) পারিবারিক পরিস্থিতির পরিবর্তন ও মিলনাত্মক পরিণতির ঘটনা দেখানো হয়েছে। দীর্ঘ নাটকে রাধার ভূমিকায় পরিচালিকা ও অভিনেত্রী ভিদুলা মাঙ্গেকরের জীবিত ও মৃত অবস্থায় লাগাতার উপস্থিতি ও একমাত্রিক অভিনয় এ নাটকের সবচেয়ে বড় ত্রুটি। ‘এপিক’-এর নাট্যোৎসবে অন্যান্য বছরের মতো উন্নত মানের হিন্দি নাটক এবারে দেখার সুযোগ হল না।

রবিবার শেষ উপস্থাপনা ছিল উৎসবের উদ্যোক্তা ‘এপিক অ্যাকটর্স ওয়ার্কশপ’-এর বাংলা নাটক ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’। মূল বাংলা কাহিনির লেখক বাংলাদেশের সাহিত্যিক মোজাফফর হোসেন। নাট্যরূপ ও পরিচালনা গোলাম সারওয়ার হারুন ও গার্গী মুখোপাধ্যায়। গল্পের পটভূমি ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে নো ম্যানস ল্যান্ডের নিচু জমির দু’ধারে জলে ঘেরা একটা উঁচু ঢিবি। হঠাৎ সেখানে আশ্রয় নিয়েছে অসুস্থ, পঙ্গু, মানসিক ভারসাম্যহীন এক নারী। ভারত না বাংলাদেশ, কোথা থেকে সে পঙ্গু অবস্থায় জলাভূমি পার হয়ে ওই ঢিবির ওপর উঠে এসেছে, ভিখারির মতো পড়ে আছে— সীমান্তের দু’ধারের গ্রামের সন্দিগ্ধ লোকজনের কাছে, এ এক জটিল প্রশ্ন। বাংলাদেশের বর্ডার গার্ড আর ভারতীয় সীমান্তরক্ষীবাহিনীর খানা-তল্লাশির পর জানা যায়, অসহায়, অর্ধভুক্ত, ভিখিরির মতো পড়ে থাকা নারী সম্ভবত ভারতের গুপ্তচর নয়। বাংলাদেশের কোনও আত্মঘাতী ইসলামি জঙ্গিদলের ‘টোপ’ নয়। তবু উভয়পক্ষই নিরাপদ দূরত্ব থেকে তার দিকে বন্দুক উঁচিয়ে রাখে। 

No Man's Land
রূপকধর্মী এই বাস্তবকাহিনি উপস্থাপনার ক্ষেত্রে বিশেষ আঙ্গিক হিসাবে নাট্যকার কখনও লিরিক্যাল বিবরণ ও বিখ্যাত কবিতার অনুসঙ্গ যোগ করেছেন

শুরু হয় দুই রাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের বৈঠক। সিদ্ধান্ত নিয়ে মতান্তর। অবাঞ্ছিত, অনাহুত, ধর্মীয় পরিচয়হীন, নাগরিক মর্যাদাহীন, অর্ধভুক্ত মহিলার জন্যে গ্রামবাসীদের উৎকণ্ঠা থাকলেও সাহায্য করার দুঃসাহস নেই। এদিকে ঘটনার উত্তেজনায় দেশীয় মিডিয়া থেকে আন্তর্জাতিক মিডিয়া, নানা এনজিও, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দেশি, বিদেশি প্রতিনিধি, নারী সংগঠনের কর্মী, পঙ্গু ও বধির বিশেষজ্ঞ থেকে যাবতীয় মানবদরদী দল তাদের মতো পরিস্থিতি বিশ্লেষণে ব্যস্ত। অথচ মৃত্যুপথযাত্রী নারীর অবস্থানের পরিবর্তন ঘটছে না। তবে খাবার পৌঁছে দেওয়া হলে চিল, শকুনের সঙ্গেও সেও খাবার কাড়াকাড়ি করে খাচ্ছে— এ দৃশ্য দুই সীমান্তের দূরবিন দিয়ে দেখা গেছে। ক্রমশ বর্ষাকাল আসে। গ্রামের লোক ভাবে ঢিবির ওপর ওর জন্য একটা উঁচু মাচা তৈরি করা দরকার। সীমান্ত প্রহরীরা ভাবে ওকে অন্য কোথাও সরিয়ে নেওয়া দরকার। কিন্তু সেই জায়গা দিতে কোনও রাষ্ট্র রাজি নয়। ওর নাগরিকত্বের প্রমাণ কোথায়? কাহিনির শেষে ওর দায় নেয় নো ম্যানস ল্যান্ড-এর জলাভূমি। ঘোর বর্ষার প্লাবনে ঢিবিটি যখন নিচের জলভূমির গভীরে তলিয়ে যায়, তখনও ওর দুই হাতের পাতা ভেসে উঠছে।

পনেরো বছর আগে দক্ষিণ এশীয় নাট্যোৎসবের সূচনার ক্ষেত্রে ‘এপিকস’-এর স্থাপক সদস্য ডঃ দীপন রায়ের পরিকল্পনা ছিল— ভাষার গণ্ডি অতিক্রম করে ভারত ও উপমহাদেশের নাটক প্রযোজনাকে আমেরিকার বৃহত্তর দর্শকের কাছে উপস্থিত করা। সেই সময় থেকে ইংরেজি, হিন্দি, মারাঠী, গুজরাটি, কণ্ণড়, এমনকি সুদূর আফগানিস্থান থেকে নাট্যশিল্পীরা এসে ‘এপিক’-এর নাট্যসম্মেলনে অভিনয় করে গেছেন। বাংলা নাটকের পাশাপাশি এভাবেই আন্তর্জাতিক দর্শকের কাছে এই উৎসব আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। 

এ কাহিনির অসাধারণ নাট্যরূপে মানবজীবনের বিচিত্র ও অমানবিক আচরণ, আমলাতন্ত্রের হৃদয়হীনতা, রাষ্ট্রের নিষ্ক্রিয় ও দীর্ঘসূত্রী মনোভাব, আঞ্চলিক প্রধানদের ষড়যন্ত্র, তথাকথিত সমাজসেবী সংগঠনগুলির স্বার্থসিদ্ধি, মিডিয়ার অপপ্রচার, সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতা ও জাতপাতের বিভেদের গভীর সমস্যা বিভিন্ন চরিত্র সৃষ্ট ও ঘটনার মধ্যে দিয়ে উপস্থিত করা হয়েছে। রূপকধর্মী এই বাস্তবকাহিনি উপস্থাপনার ক্ষেত্রে বিশেষ আঙ্গিক হিসাবে নাট্যকার কখনও লিরিক্যাল বিবরণ ও বিখ্যাত কবিতার অনুসঙ্গ যোগ করেছেন। নাটকের মঞ্চসজ্জায় সীমান্তের কাঁটাতার, তার দুই প্রান্তের পরিবেশ আর জলাভূমির ওপর জেগে থাকা এক কালো মাটির ঢিবি, ঘটনার পটভূমি সৃষ্টির কাজে প্রতাপাদিত্য মল্লিক ও তাঁর সহযোগিরা দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। দুরন্ত বৃষ্টি ও বন্যার দৃশ্যে সুনন্দ মিত্রের আলোকসম্পাতের সঙ্গে বিরসা চট্টোপাধ্যায়ের আবহসঙ্গীত— নাটকের ট্র্যাজিক পরিণতির শেষ দৃশ্যের সার্থক মঞ্চায়ন।

নাটক পরিচালনা ও অভিনয়ের ক্ষেত্রে গার্গী মুখোপাধ্যায় এবং গোলাম সারোয়ার হারুণ নাট্যোৎসবে সেরা প্রযোজনাটি মঞ্চস্থ করেছেন। ‘এপিক অ্যাকটর্স ওয়ার্কশপ’-এর ইন্দ্রনীল মুখোপাধ্যায়, সজল মুখোপাধ্যায়ের অভিনয় এ নাটকে দর্শকদের বিশেষ প্রশংসা পেয়েছে। একই শিল্পীর বিভিন্ন ভূমিকায় আঞ্চলিক ও নাগরিক ভাষায় সাবলীল অভিনয় ও অভিব্যক্তির মধ্যে দিয়ে নাট্যগোষ্ঠীর শিল্পীরা দলগত নৈপুণ্যের পরিচয় দিয়েছেন। 

এই উৎসবে ‘অল্টারনেটিভ থিয়েটার প্ল্যাটফর্ম’ অর্থাৎ প্রথাগত মঞ্চের পরিবর্তে অন্য একটি পরিসরে ‘এপিকস’-এর সদস্য শুভাশিস দাস প্রতি বছরই নাটক ও অন্যান্য ধারার শিল্পকলার সমন্বয়ে বিশেষ অনুষ্ঠানের উদ্ভাবন ও পরিচালনা করেন। ভারতীয় ও আমেরিকান দুই প্রজন্মকে নিয়ে নাটকের ওয়ার্কশপ হয়। এ বছর বিশেষ বৈচিত্র্য ছিল ‘অ্যানানসিস স্টোরিস ফেস্টিভ্যাল’। কথাকাহিনির আঙ্গিকে কিছু ঐতিহাসিক চরিত্র, রূপকথা, প্রচলিত নাগরিক কাহিনি ও লোককথা অবলম্বনে নাটক। এপিক অ্যাকটর্স ওয়ার্কশপ ও নিউ জার্সির আমেরিকান নাট্যগোষ্ঠী ‘রিথিংক থিয়েট্রিক্যাল’-এর যৌথ প্রযোজনা। ‘এপিক অ্যাকটর্স ওয়ার্কশপ’ ও ডঃ দীপন রায়ের উদ্যোগে আয়োজিত সাউথ এশিয়ান থিয়েটার ফেস্টিভ্যালের পনেরো বছর পূর্ণ হওয়া উপলক্ষে নাট্যেৎসবে বহু দর্শক উপস্থিত ছিলেন। কোভিডের এই প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে ও সতর্কতার যাবতীয় নিয়মরক্ষা করে, মুখোশের আবরণে থেকেও সকলে দুটি সাংস্কৃতিক ‘উইকেন্ড’ উপভোগ করেছেন।  

 

*ছবি সৌজন্য: লেখক, South Asian Theatre Festival

দীর্ঘকাল আমেরিকা-প্রবাসী আলোলিকা মুখোপাধ্যায়ের লেখালিখির সূচনা কলকাতার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় প‍র্বে। আমেরিকার নিউ জার্সির প্রথম বাংলা পত্রিকা "কল্লোল" সম্পাদনা করেছেন দশ বছর। গত আঠাশ বছর (১৯৯১ - ২০১৮) ধরে সাপ্তাহিক বর্তমান-এ "প্রবাসের চিঠি" কলাম লিখেছেন। প্রকাশিত গল্পসংকলনগুলির নাম 'পরবাস' এই জীবনের সত্য' ও 'মেঘবালিকার জন্য'। অন্য়ান্য় প্রকাশিত বই 'আরোহন', 'পরবাস', 'দেশান্তরের স্বজন'। বাংলা সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারের জন্য নিউইয়র্কের বঙ্গ সংস্কৃতি সঙ্ঘ থেকে ডিস্টিংগুইশড‌ সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *