কালেচির পথে পথে: পর্ব ১

যে বাজার অঞ্চল গতকাল সন্ধেবেলা বাড়ি ফেরার ব্যস্ততায় চঞ্চল ছিল, তা আজ সকালেও এক্কেবারে জীবন্ত। পর্যটকদের টানতে হরেকরকম মেমেন্টো, পোস্টকার্ড, ম্যাগনেটের দোকান, বা রেস্তোরাঁর সারি যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে সারবাঁধা কার্পেটের দোকান। আসার আগে “আন্তালিয়ান রাগ” বা আন্তালিয়ার কার্পেটের ব্যাপারে খানিক পড়াশোনা করেছিলাম। তুরস্কের ইতিহাসে, কার্পেটের বুননের ঐতিহ্য বলা যায় এক্কেবারে প্রাগৈতিহাসিক। তবে আধুনিক “আন্তালিয়ান রাগ” বলতে ঐতিহাসিকরা সেলজুক যুগের বুননের সময় থেকেই ধরেন। এই এলাকার নানান দোকানের কারপেট দেখতে শুরু করলেই দিন কাবার হয়ে যেতে পারে। এক একটা কারপেটের কাজ এক একরকমভাবে চোখ ধাঁধানো। 

Antalian Carpet Weaving
আন্তালিয়ান কারপেট বুনন

একটু মন দিয়ে দেখলে আর তার সঙ্গে সামান্য পড়াশোনা জুড়ে দিলেই দিব্যি সেলজুক, অটোম্যান ও বাইজান্টিয়াম রাজা রাজড়াদের নানা কীর্তিকলাপ, লোককথা ইত্যাদির দেখা পাওয়া যায়। কিন্তু তার থেকেও আরও বেশি আকর্ষণীয় হল নিজের চোখে কারপেট বুনন পদ্ধতি চাক্ষুষ দেখার সুযোগ। প্রায় প্রত্যেকটি দোকনের সামনে বা পিছনের উঠনে নতুন নতুন কারুকাজের হাট বসেছে। শিল্পীদের ধৈর্য ও একাগ্রতা আমায় চিরকালই বিস্মিত করে, তবে এ যেন এক অন্য জগত। নানান রঙের নানান ধরনের সুতো এক পাকা কার্পেট শিল্পীর হাতে কেমন ম্যাজিক সৃষ্টি করে, মুগ্ধ হয়ে তা দেখতে দেখতে আমরা যে কখন পাড়ার মোড়েই প্রায় ঘণ্টাদেড়েক সময় কাটিয়ে ফেলেছি, খেয়ালই করিনি। আর বেশি দেরি হলে ফিরে সমস্তটা দেখা যাবে না, তাই বেরিয়ে পড়লাম।

মেয়দানির ট্রামস্টপে এসে দুটো টিকিট কেটে বসতেই এক মাঝবয়সী মহিলার সঙ্গে আড্ডা জমল। নিজেই অবাক হয়েছি যে, এই ক’বছরে নিজের অজান্তেই আমার ভাষাজ্ঞানটা নেহাত খারাপ দাঁড়ায়নি। মহিলা আঞ্চলিক, তাই তাঁর ডায়লেক্ট বা উচ্চারণ ইস্তানবুলের কসমো-উচ্চারণের থেকে বেশ খানিকটা আলাদা। প্রথম প্রথম বুঝতে সমস্যা হয়। প্রায় মিনিট কুড়ির আড্ডার মূল বিষয়বস্তু ভারতবর্ষ ও তুরষ্কের রান্নার একান্নবর্তী অস্তিত্ব। উনিই মূলত বললেন; আমি আমার ভাঙা তুর্কি ভাষায় যা বললাম, তা ওঁর কতটা বোধগম্য হল, উনিই জানেন। তবে ট্রাম এসে পড়ায় যা একগাল হাসি দিয়ে বিদায় নিলেন তাতে বুঝলাম বিশেষ অসন্তুষ্ট হননি।

Koniyalti Beach
নীলাভ স্বপ্নের নেশাতুর হাতছানি: কোনিয়ালতি সৈকত

অত্যাধুনিক ট্রামে চেপে কোনিয়ালতি সমুদ্রতট পৌঁছতে লাগল মিনিট পনেরো। আমরা যেই জায়গাটায় নেমেছি সেখান থেকে সমুদ্রতট অনেকটা নীচে। কাজেই দিব্যি প্যানোরামা পাওয়া যায়। আমি এমন শান্ত সমুদ্র ভারতবর্ষের কোথাও দেখিনি। ইস্তানবুলের মারমারা সাগর, বা গ্রিসের এজিয়ান সাগর, দুইয়ের কারোরই বুঝি এমন ব্যাপ্তি নেই। সাগরসৈকত যেখানে আকাশের সঙ্গে মিশেছে, ঠিক সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে বেশ কয়েকটা আকাশচুম্বি পাহারের চুড়ো, সব মিলিয়ে এক নীলাভ স্বপ্নের নেশাতুর হাতছানি।

মার্চমাস বলে বিশেষ জনসমাগম নেই। এমন সৈকতের নিজস্ব প্রশান্তিটাই আমায় টানে অনেক বেশি। মানুষ বড় বেয়াড়া, সমস্তকিছু নষ্ট করে ফেলে। ছোটো ছোটো গোল গোল পাথর ছড়ানো সৈকতে নেমে বোঝা গেল মার্চ মাসে কেন লোকে এখানে আসে না। হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় মিনিট দশের মধ্যে উঠে আসতে হল। তার মাঝেই চোখে পড়েছে এক ভদ্র্লোক সুইমিং কস্টিউম পরে সেই ভয়াবহ ঠান্ডা জলে সাঁতার কাটছেন। ও জলে আমি একবার হাত দিয়েছিলাম, মাগো! ভদ্রলোকের গন্ডারের চামড়া বললে কি অপমান করা হবে?

উপরে উঠে আসতে আসতে দেখি বেলা প্রায় দুটো। এইবার পেটে কিছু দেওয়া দরকার। বিচ থেকে উপরে উঠে রাস্তায় পড়তেই সাইকেল লেনের পাশে ইস্তানবুলের মতোই তরতাজা মাছ গ্রিল করার গন্ধ নাকে আসে। এ সুযোগ ছাড়ার প্রশ্নই ওঠে না। মধ্যযুগীয় আরাম, তুর্কি প্রাতরাশ, কোনিয়ালতির নীলাভতার পর গরম গরম সি-বাস (লেভ্রেক) ও স্যালাড না হলে এই বেড়াতে আসা পরিপূর্ণতা পায় না। তাতে পুরনো কালেচির দুটো জায়গায় সময় কম কাটালেও চলবে। খাওয়াদাওয়া সেরে আমরা যখন উঠলাম তখন বেলা প্রায় সাড়ে তিনটে। মার্চ মাসের এই সময়টায় এখানে সওয়া পাঁচটা-সাড়ে পাঁচটার মধ্যেই আলো পড়ে যায়। বেশ বোঝা যাচ্ছে কালেচির রাস্তার শেষে আন্তালিয়া বন্দর থেকে নৌকোভ্রমণ করতেই সন্ধ্যে নেমে যাবে। কাজেই ন্যাচেরাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম, হাদ্রিয়ান গেট কালকের প্ল্যানে তোলা থাক। 

Mediterranean Sea
বিভোর নিলাভ ভূমধ্য আন্তালিয়া

রাস্তার ওপারের ট্রামস্টপে বিশেষ অপেক্ষা করতে হল না। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ট্রাম আমাদের চটপট পুরনো মেয়দানির ঝকঝকে চত্বরে নামিয়ে দিয়ে আন্তালিয়ার শরতলিতে উধাও হয়ে গেল। আমরা আমাদের চেনা রাস্তা ধরে, হোটেল পেরিয়ে সোজা হাঁটতে শুরু করেছি। দু’ধারে আরো নানা কাফে, রেস্তোরাঁর সারি চোখে পড়ে। সবগুলোই সেই পুরনো মধ্যযুগীয় ছোট ছোটো বাড়ির একতলায় গজিয়ে উঠেছে। বেশ ঘরোয়া পরিবেশে পান-ভোজন করায় যাদের মন মজে তাদের জন্য এক্কাবারে আদর্শ জায়গা। এখন চারটে বাজতে চলল, তাই সাজো সাজো রব। আমরা পোর্টচত্বর দেখে ফিরতে ফিরতে জায়গাটা জমজমাট হয়ে উঠবে ভেবেই মনে মনে বেশ আনন্দ হচ্ছে।

তবে যতই কাফে রেস্তোরাঁর ভিড় থাক না কেন, পুরনো দিল্লির মতো পাড়াতুতো ভাবটায় ভাটা পড়েনি মোটেই। ছিমছাম বাড়িগুলোর প্রায় সবকটাতেই গুলঞ্চলতার ঝাড়। কোনওর পাশে ছোটো বাগান। যত এগোচ্ছি রাস্তা আস্তে আস্তে গলিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। একটা জায়গায় এসে খেয়াল হয়, সরু গলিটার ডানহাতে একটা খুব পুরনো মসজিদের দেওয়াল প্রায় ঘাড়ে উঠে এসেছে। বেশকিছু মানুষ মসজিদ চত্বরে রয়েছেন, কেউ কেউ বুঝি ভিতরে প্রার্থনারত। এই মসজিদ কত শতাব্দী ধরে আমাদের চণ্ডীমণ্ডপের মতো এই এক চিলতে পাড়ার সহস্র প্রার্থনার বোঝা সামলে এখনও দাঁড়িয়ে আছে, কেই বা বলতে পারে? আরও খানিকটা এগোতেই রাস্তা আবার চওড়া হয়ে আসে, লোকজন, দোকানপাটের ভিড় বেড়ে যায় হঠাৎ। বোঝা যায় বন্দরচত্বর নেহাতই কাছে, কারণ আবার মাছ গ্রিল আর নোনা পাথরের গন্ধ আসে। এই জায়গাটাই “আন্তালিয়া মারিনা”।

Antalia City
কালেচি বন্দর, পুরনো দূর্গের প্রাচীর ও বিস্তীর্ণ নতুন আন্তালিয়া শহর

আন্তালিয়া মারিনাই আসলে পুরনো কালেচির কার্যকরী বন্দর। এক ব্যস্ত সেলজুক এবং পরবর্তীকালে অটোম্যান বন্দরের চিহ্ন আজও তার আশপাশের মধ্যযুগীয় অফিস, দফতর, জংধরা নোঙরের সারিতে স্পষ্ট বোঝা যায়। আমরা যেই জায়গাটায় দাঁড়িয়ে আছি, সেখান থেকে একটা পায়ার (pier) জল পর্যন্ত নীচে নেমে গেছে। পায়ার ধরে নামতে নামতেই একাধিক টিকিট বিক্রেতার দেখা মেলে। তাদেরই একজনের সঙ্গে কথা বলে মারিনা থেকে জলবিহারে পুরনো কালেচির ঐতিহাসিক পাথুরে দেওয়ালের অংশগুলো দেখতে যাওয়ার ব্যবস্থা করা গেল। মিনিট ত্রিশের লঞ্চ যাত্রা। ব্যক্তিগত স্পিডবোট ভাড়া করারও ব্যবস্থা আছে, তবে তা ছাত্রাবস্থায় অসম্ভব। কাজেই একটা বড় নৌকোয় আগেভাগে উঠে রেলিঙের ধারে জায়গা নিয়েছি আমরা। তবে কাজটা বিশেষ ভালো হয়নি। খেয়াল করিনি সূর্য পড়ে এসেছে, ঠান্ডা আরো বেড়েছে আর হিমেল জোলো হাওয়া তীরের মতো গায়ে এসে বিঁধছে।

কাজেই কালেচি দূর্গের প্রাচীরের খানিকটা অংশ রেলিং-এর ধার থেকে দেখে, লঞ্চের ভিতরে এসে এক তলার কাফে থেকে দুকাপ গরম গরম চা আর কিছ বিস্কুট নিয়ে বসতেই শরীরে বেশ আরাম বোধ হল। দিন পড়ে আসছে, ভূমধ্যসাগরের উপকূলে কালেচির ঐতিহাসিক দুর্গের গায়ে রক্তিম তুলির টানে দিনশেষের প্রতিচ্ছবি এঁকে দেওয়ার অছিলায় সুয্যিমামা নিদ্রা যাচ্ছেন। আমরা ইতিহাস ও আধুনিকতার মাঝে চায়ের পেয়ালা হাতে মুগ্ধতার আবেশে বিভোর হয়ে আছি। এই তো বেশ, এই তো দিব্যি, আধুনিকতার নিশ্চিন্ত আশ্রয় থেকেই না হয় এবারের মতো ইতিহাসের শহরকে ক্ষণকালের বিদায় জানানো যাক!     (শেষ)

 

ছবি সৌজন্য: লেখক ও Theculturetrip

Rupak bardhan Roy

ড. রূপক বর্ধন রায় GE Healthcare-এ বিজ্ঞানী হিসেবে কর্মরত। ফ্রান্সের নিস শহরে থাকেন। তুরস্কের সাবাঞ্চি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করেছেন। বৈজ্ঞানিক হিসেবে কর্মসূত্রে যাতায়াত বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। লেখালিখির স্বভাব বহুদিনের। মূলত লেখেন বিজ্ঞান, ইতিহাস, ঘোরাঘুরি নিয়েই। এ ছাড়াও গানবাজনা, নোটাফিলি, নিউমিসম্যাটিক্সের মত একাধিক বিষয়ে আগ্রহ অসীম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *