প্রেসিডেন্সি কলেজের তিনবছরের জীবন আমাকে কী দিয়েছিল, তা তখন ভালো করে বুঝিনি। পারিবারিক সমস্যা সকল এক ময়াল সাপের মতো জড়িয়ে থাকত গলায়, আমার মনে জমে থাকত বিষাদের মেঘ। পরে বুঝেছি, বিশেষ করে কর্মজীবনে। আনাড়ি হাতে তৈরি বেতের চেয়ারে বসার ঘর সাজাতে লজ্জা পাইনি কিংবা ঘরের সতরঞ্চি পাতা মেঝেতে গ্রাম থেকে আসা স্বেচ্ছাসেবী অতিথিরা এসে শুয়ে থাকলেও। অরণ্যের দুর্মূল্য সেগুন কাঠে খাট-পালঙ্ক-সোফা তৈরি করিয়ে নেওয়ায় আমাদের দু’জনেরই আপত্তি ছিল। বিত্ত নয়, জীবনে আকাঙ্খা, মানুষের সংস্পর্শ আর অন্তর্দৃষ্টির। এ শিক্ষা প্রেসিডেন্সি কলেজেই পাওয়া।
আমাদের অধ্যাপকেরা ছিলেন অন্য জগতের মানুষ। বাস্তব বিরহিত বলব না, কিন্তু মেঘের উপর লেগে থাকা সন্ধ্যার আলোর মতো, তাঁদের মনে লেগে থাকত মননের মায়া। শিক্ষাজগতের কুটিল রাজনীতি কি ছোট এই বিভাগটিকে স্পর্শ করেনি? সে সব তখন জানতাম না। বড় গ্যালারির পাশে ছোট ছোট সাধাসিদে কিউবিকলে অধ্যাপকেরা বসতেন। ক্লাসের পর পর্দা তুলে যে কোনও সময় তাঁদের কাছে যাওয়া যেত, অ্যাপয়েন্টমেন্টের বালাই ছিল না। কখনও দেখিনি তাঁদের কেউ বিরক্ত হয়েছেন। সাজপোশাকে কোনও বাহুল্য ছিল না। প্রহ্লাদ জানাকে বোধহয় চুল আঁচড়াতে হত না। ছোট বুরুশকুচি চুল। নবেন্দু সেনের মনে হয় চিরুনিই ছিল না। দীপক বন্দ্যোপাধ্যায়কে সাধারণ স্ট্রাইপ হাফ শার্টেই মনে হত স্ম্যাশিং। অমিতা দত্ত শতবর্ষ পূর্ণ করলেন এ বছর। তিনি এখনও যেমন, তখনও। ব্যক্তিত্বময়ী বিদুষী, আমাদের বুদ্ধিহীনতায় তাঁর মুখে ঝলসে উঠত শ্লেষের হাসি। একইভাবে অধ্যাপক মিহির রক্ষিতকে যেমন মান্যি করতাম, তাঁর হাসিকেও ততটাই ভয় পেতাম। প্রশংসা, সমালোচনা যে হাসিতে একইভাবে ব্যক্ত হয়, তাকে সমীহ করতে হবে বৈকি। এক ক্লাস টেস্টের পর মিহিরবাবু আমাকে বাক্য গঠনের আদর্শ নিয়ম শিখিয়েছিলেন, পেনসিল দিয়ে খাতা দাগিয়ে। যেভাবে ইংরাজি বাক্য সাহিত্যরচনায় ব্যবহার করি, সেটা অর্থনীতির জন্য উপযুক্ত নয়, ঠোকর খেয়ে বুঝলাম।
অধ্যাপকেরা সকলেই চিন্তার স্বাতন্ত্রকে মূল্য দিতেন, এটা তখনই বুঝতাম। অর্থনীতির পাঠে সফল না হলেও আমার এবং অন্যদের মনেও জ্বেলে দিয়েছিলেন জানার জন্য আকুলতা। সিলেবাস কী, কতখানি, তা নিয়ে কেউ খুব ভাবত বলে মনে হয় না। বরং রেফারেন্স তালিকা থেকে যা পড়তাম, তার অনেকটাই বুঝতাম না। কিন্তু নিরক্ষর কৃষ্ণভক্তের গীতার শ্লোক দেখে অশ্রুবিসর্জনের মতো, আমিও এক নিরাকার জ্ঞানের জন্য আকিঞ্চন বোধ করতাম।
সেই আকুলতা অবশ্য আমার ব্যস্ত জীবনে পূর্ণতা পায়নি। কাজের ঝড় জাগা করিডর ধরে ছুটতে ছুটতে তুলে নিতাম এক আধখানি বই, তাদের সান্নিধ্যে থাকতাম। পাখি যেমন বাসা বাঁধার জন্য ঘাস কাঠকুটো ঠোঁটে নিয়ে চলে, কিন্তু তার সব কটি নীড় গড়ায় লাগে না। কিন্তু প্রেসিডেন্সিতে এসে সতেরো বছরের আমি বুঝেছিলাম, যে জ্ঞানী, দার্শনিক এবং ইতিহাস-সচেতন, তার ক্ষমতাই প্রকৃত ক্ষমতা। ‘ধন জন’ বলে অর্জিত ক্ষমতার রাজনীতির স্বরূপ চিনে গিয়েছিলাম প্রশাসনে পা রেখেই। আমাকে তা কোনওদিন মুগ্ধ বা বিচলিত করেনি, যার ফলে ক্ষমতার কাছে মাথা নত না করে কাজ করতে পেরেছি। সাহিত্যজগতের নিকৃষ্ট রাজনীতির পাকে যে কোনওদিন পড়তে হয়নি, তার পিছনেও প্রেসিডেন্সি কলেজের দিনগুলির পরোক্ষ ভূমিকা আছে। একটা আপাত তুচ্ছ ঘটনার উল্লেখ করি। পার্ট ওয়ানে আমাদের হোম সেন্টার পড়েছিল সম্ভবত নকশাল আন্দোলনঘটিত কোনও আশঙ্কার ফলে। প্রেসিডেন্সির অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষকরা বললেন, কী, তোমাদের উপর নজরদারি করতে হবে নাকি? নিজেদের উপর বিশ্বাস নেই? সত্যিই সে পরীক্ষায় ইনভিজিলেশন হয়নি। টোকার মতো অমর্যাদাকর কাজের প্রশ্নই নেই, কেউ ফিসফিসও করেনি, বাথরুমে যাওয়ার ফাঁকেও কথা নয়। এই ছোট ঘটনাটা আমার মনে আছে। বিশ্বাস অর্জন করতে গেলে যে যোগ্যতা লাগে, তার পরীক্ষায় পাস হয়েছিলাম পুরো ব্যাচ।
জ্ঞানের জগত যতই পরাবাস্তবতুল্য মায়ালোক নির্মাণ করুক, বাস্তব ছাড়ে না। বিয়ে নামক এক অনিশ্চিত উৎপাত লেগেই আছে। শিক্ষাজগতের এক নামজাদা ব্যক্তিত্বের পরিবার থেকে সম্বন্ধ এল। কন্যা মেধাবী, কবিতা লেখে। কিন্তু ধনে মানে আমরা কুলীন নই। আমাদের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের আপত্তির প্রশ্নই থাকবে না ধরে নিয়ে তাঁরা স্নেহভরে তারিখও ঠিক করে ফেললেন। এবার শিয়রে সত্যিই শমন। চোখের সামনেই ব্লাইন্ড লেন। কান্নাকাটি না করে শান্তভাবে আমি মা-বাবাকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম, এই অকাল বিবাহ আমার কেরিয়ারের পক্ষে যথেষ্ট ক্ষতিকর হতে পারে। কিছুটা কাজ হল। আমার নির্বিবাদী ছোড়দা, যে পারিবারিক শাসনতন্ত্রে কোনও সক্রিয় অংশ নেয় না, এসে ভয় দেখাতে লাগল– দক্ষিণ কলকাতার এক ধনী পরিবারের গৃহবধূর হত্যার ঘটনায় শহর তখন উতরোল, এরকম পরিণতি আমারও হতে পারে ইত্যাদি। এইসব চেষ্টার ফলে প্রস্তাব থেকে বেরিয়ে আসা হল, কিন্তু বাবা-মায়ের মনে জেগে রইল আশঙ্কা। প্রতিশোধের তীর কোন দিক থেকে আসে!
অধ্যাপকেরা সকলেই চিন্তার স্বাতন্ত্রকে মূল্য দিতেন, এটা তখনই বুঝতাম। অর্থনীতির পাঠে সফল না হলেও আমার এবং অন্যদের মনেও জ্বেলে দিয়েছিলেন জানার জন্য আকুলতা। সিলেবাস কী, কতখানি, তা নিয়ে কেউ খুব ভাবত বলে মনে হয় না। বরং রেফারেন্স তালিকা থেকে যা পড়তাম, তার অনেকটাই বুঝতাম না। কিন্তু নিরক্ষর কৃষ্ণভক্তের গীতার শ্লোক দেখে অশ্রুবিসর্জনের মতো, আমিও এক নিরাকার জ্ঞানের জন্য আকিঞ্চন বোধ করতাম।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তখন নানাবিধ অনিয়মের বাসা। তার পিছনে দুর্নীতিও সম্ভাব্য কারণ। রেজাল্ট সময়ে বেরনো থেকে পরীক্ষার পরিণাম, সবই অনিশ্চিত। মার্চের মাঝামাঝি পার্ট ওয়ানের ফল বেরল। কিন্তু আমাদের কয়েকজনের রেজাল্ট উইথহেলড। দিন পনেরো উদ্বেগ ও আশঙ্কার পর রেজাল্ট বেরোলে দেখলাম প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়েছি বটে, তবে গুলি বেরিয়ে গেছে কান ঘেঁষে। এত কম নম্বর পাব ভাবিনি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষকবর্গ নম্বর কম দিয়ে নিজেদের আধ্যাত্মিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে চাইতেন হয়তো, কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের জীবন বিপন্ন হত। যাইহোক, ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট মানে তো বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্স্ট, তাই গণদাবিতে হইহই করে সবাই ছুটলাম কফি হাউস। মনে পড়ে বিল হয়েছিল পঁচিশ টাকা বারো আনা। আমার কাছে মোটে পনেরো টাকা ছিল। সব খুচরো জড়ো করেও পুরোটা হল না। তখন উদারহৃদয় বন্ধুরা পকেট থেকে টাকাপয়সা বার করে বিল মেটাল।
ইকনমিক্স মাস্টার্সে ততদিনে সেমেস্টার সিস্টেম চালু হয়ে গেছে। ফলে, এমএ-র পরীক্ষা সময়মতো হয়, রেজাল্ট সময়মতো বেরয়। অন্য সব বিষয়ের ক্লাস কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় মেইন ক্যাম্পাসে হয়। সেখানে প্যাসেঞ্জার ট্রেনের মতো ঢিলেঢালা ব্যাপার। অর্থনীতির ক্লাস হয় বরানগরের কাঁটাকলে। বিএ পার্ট টু পরীক্ষার রেজাল্ট বেরনোর জন্য অপেক্ষা করতে হল না। তার আগেই আলাদা এন্ট্রান্স দিয়ে, এবং তাতেও প্রথম স্থান পেয়ে এমএ-তে ভর্তি হয়ে গেলাম।
ক্লাস আরম্ভ হল। দু’বছরে মোট ষোলোটি পেপার, আলাদা বিষয়। পরীক্ষার নম্বর পছন্দ না হলে রি-এক্সামের ব্যবস্থা আছে। সূক্ষ্মতর জ্ঞানচর্চার সুযোগ, উজ্জ্বল শিক্ষকমণ্ডলী। অন্য কলেজ থেকে আসা বন্ধুরা। এখানে ক্যান্টিনে বসায় নিষেধাজ্ঞা নেই। তবু ক্যাম্পাস হিসেবে বরানগর আমার কোনওদিনই ভালো লাগেনি। বাড়িটি কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগ হওয়ার উপযুক্তই নয়। সবুজ নেই, পিচ রাস্তার ধার ঘেঁষা এক চিলতে লন, ছোট্ট একটু বাগান। লাইব্রেরিতে বসে পড়ার মতো পরিবেশ নেই। আর হায়, এখানে কোথায় আমাদের বিমানদার স্নেহ?
বিএ পার্ট টু-র রেজাল্ট বেরল এমএ প্রথম সেমেস্টার চলাকালীন। কাকতালীয় ঘটনাপরম্পরার অনুমান আমাকে সেদিন পুলকিত করেনি, আজ এতদিন পর তো নয়ই। বিএ পার্ট টু-তে আমি নম্বরে নিজের ব্যাচের একেবারে নীচে, ভালোরকম দ্বিতীয় শ্রেণী, যাতে দুই পার্টের নম্বর জুড়লেও বিএ অনার্সের চূড়ান্ত ফল সেকেন্ড ক্লাসই হয়। এটার পিছনে কারও অনুমোদন বা অনুশাসন ছিল? সেই সময় মনে হয়েছিল, একটা দরজা বন্ধ হয়ে গেল চিরতরে। আটত্রিশ কিলো ওজন, মাঝেমাঝেই নানা অসুখে ভুগি। মনের জোরটুকু আর বিপুল জেদ ছাড়া কোনও অবলম্বন ছিল না, বাড়ির ভিতরে, বাইরেও।
তিনটে পেপারের নম্বর রিভিউ করার দরখাস্ত দিলাম। ততদিনে সেই নামজাদা শিক্ষাবিদ বিভাগীয় হেড হয়ে এসেছেন। আমার ডাক পড়ল। তিনি বসে, সামনে দাঁড়িয়ে আমি। আর কেউ নেই। আমাকে বসতে বলা হয়নি। ইনি তো দীপক বন্দ্যোপাধ্যায় নন। কন্ঠস্বরে স্নেহের লেশমাত্র নেই। জানতে চাওয়া হল রিভিউয়ের দরখাস্ত কেন করেছি। শুনলাম, কোনও লাভ হবে না। যেন আবেদন তুলে নিই। আমিও জেদ ধরে বললাম, তুলব না। নম্বর না বাড়ে তো না বাড়ুক। বুঝেছিলাম, আবেদনে ফল হবে না। হয়ওনি। তবে কলকাতার শিক্ষাজগতের ক্ষুদ্রতা নিয়ে মনে যতটুকু অস্পষ্টতা ছিল, দূর হল। আহত বাঘের মতো নিজের ক্ষতস্থান লেহন না করে, কলকাতা কীভাবে ছাড়ব, সে দিনের পর তাই হয়ে দাঁড়াল অন্যতম চেষ্টা।
কলকাতায় জন্ম, বড় হওয়া। অর্থনীতির পাঠ প্রেসিডেন্সী কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কবিতা দিয়ে লেখক জীবন আরম্ভ। সূচনা শৈশবেই। কবিতার পাশাপাশি গল্প, উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী, প্রবন্ধ, ছোটদের জন্য লেখায় অনায়াস সঞ্চরণ। ভারতীয় প্রশাসনিক সেবার সদস্য ছিলেন সাড়ে তিন দশকেরও বেশি সময়। মহুলডিহার দিন, মহানদী, কলকাতার প্রতিমা শিল্পীরা, ব্রেল, কবিতা সমগ্র , দেশের ভিতর দেশ ইত্যাদি চল্লিশটি বই। ইংরাজি সহ নানা ভারতীয় ভাষায়, জার্মান ও সুইডিশে অনূদিত হয়েছে অনিতা অগ্নিহোত্রীর লেখা। শরৎ পুরস্কার, সাহিত্য পরিষৎ সম্মান, প্রতিভা বসু স্মৃতি পুরস্কার, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুবন মোহিনী দাসী স্বর্ণপদকে সম্মানিত। পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমীর সোমেন চন্দ পুরস্কার ফিরিয়েছেন নন্দীগ্রামে নিরস্ত্র মানুষের হত্যার প্রতিবাদে। ভারতের নানা প্রান্তের প্রান্তিক মানুষের কন্ঠস্বর উন্মোচিত তাঁর লেখায়। ভালোবাসেন গান শুনতে, গ্রামে গঞ্জে ঘুরতে, প্রকৃতির নানা রূপ একমনে দেখতে।
খুব ভালো লাগছে।
Amar oikantik kamona “likhte-likhte athoi dur” jano sesh na hoy;jeeboner onek kothai to hoyni ekhono bola..
aapni bolben aar amra guno-mugdher dol shune jabo..
nomoskar O dhonyobad.
Amar oikantik kamona “likhte-likhte athoi dur” jano sesh na hoy;jeeboner onek kothai to hoyni ekhono bola..
aapni bolben aar amra guno-mugdher dol shune jabo..aageo lokhechi ,barbar likkhte icche kore.
nomoskar O dhonyobad.