আগের পর্বের লিংক: [] [ ২] [] [] [] [] [] [] [ ৯] [১০] [১১] [১২] [১৩][১৪][১৫] [১৬] [১৭]

নীলমাধব যে এইসব করে বেড়াচ্ছে, সে খবর জুড়ানচন্দ্র রায়ের কাছে চলে গেছে। গেছে গুণেন মারফত। নীলমাধব নিজেই তো বলেছে, যে কেউ জানতে পারে, তার কিছু যায় আসে না। জুড়ান আমার বাড়ি এল এক সন্ধ্যায়। এবার সঙ্গে গুণেন সরকার। গুণেনের সঙ্গে তার দেখা পথে। বলল,
– চল গুণেন,  ঘুরে আসি অনুতোষের ওখান থেকে।
গুণেন  বলল, হ্যাঁ, তাই। সে ফিরছিল বড় মেয়ের বাড়ি থেকে। কিন্তু আমার মনে হল তা নয়। জুড়ান এবং গুণেন সাঁট করেই এসেছে। তারা নীলমাধবকে নিয়েই কিছু বলবে। নীলমাধব কিংবা বশির মল্লিক। কিংবা বশির মল্লিকের মেয়ে। দু’জন একসঙ্গে আসায় আমার মনে হল তারা খুব শীঘ্রই নীলমাধবের ব্যাপারে হেস্তনেস্ত কিছু করে ফেলবে। জুড়ান সেই আগের মতো। হেসে বলল,
– কী অনুতোষ, ফ্ল্যাটে  ঢুকতে দেবে তো? নাকি মাধব পালোধীর ভয়ে…
– আরে গুণেনবাবু যে, আসুন আসুন। গুণেনকে আমি ডাকলাম। জুড়ানকে বললাম,
– খুব ভাল করেছ গুণেনবাবুকে নিয়ে এসে। 
জুড়ান বসতে বসতে বলল,
– অনুতোষ, তুমি খুব ভাল আছ। ইন্টারনেট ব্যবহার করলে অনেককিছু জানতে পারতে, আবার না ব্যবহার করলে না জেনেও দিন চলে যায়। বেশি জানলে বেশি সমস্যা। 
– এত মানুষ ব্যবহার করছে, সমস্যা হচ্ছে কি সকলের? আমি জিজ্ঞেস করলাম।
– এড়িয়ে  থাকতে পারলে কিছুই হবে না। কোনও কিছুই না ছুঁয়ে, দেখেও না দেখে থাকতে পারলে সমস্যা হবে না। কিন্তু  তা কি পারা যায়? জুড়ান আয়েশ করে বসে বলল। 
– যে কাজ সরকারের, কে পলাতক আসামী, কে লুটের সোনাদানা নিয়ে পরিচয় লুকিয়ে সমাজের মাতব্বর হয়ে উঠেছে, তা খুঁজে বের করবে সরকার। আমরা কেন মাথা ঘামাব?
– এসবই হল সব কিছু  থেকে দূরে থাকার প্রবণতা। তুমি ঝামেলা এড়িয়ে থাকতে চাও। আমি চাই না। ঝামেলা হয় হোক, অপরাধীকে আমি ক্ষমা করতে পারি না। জুড়ান  বলল।  

কথা হতে লাগল। জুড়ানের সন্দেহ বশির আলির মেয়েকে নিয়েই নীলমাধব হিমাচল প্রদেশে গিয়েছিল। অথবা উত্তরাখণ্ডে। অন্য জায়গাতেও যেতে পারে। যেমন নেতারহাট, রাঁচি। গিয়েছিল কোথায় তা কিন্তু নীলমাধব ঠিক বলবে না, যাতে তদন্ত করতে অসুবিধে হয়। কিন্তু সে অনলাইনে যোগাযোগ করে নেবে। জেনে নেবে কে গিয়েছিল সঙ্গে। কী করে তা হবে, আমার বোধগম্য হয় না। কিন্তু জুড়ান বলছে আর গুণেন সায় দিচ্ছে ঘাড় নেড়ে। আমি ভাবলাম বলি, কী হবে এসব করে? অহেতুক সময় নষ্ট? মুখে  কিছু বললাম না। জুড়ান একটু থেমে আবার বলল,
– বের করে নিতে হবে ও কোথায় গিয়েছিল, সঙ্গে কে গিয়েছিল। অনুতোষ তুমি আমাদের সঙ্গে থাক। নীলমাধব জানে না তোমার সঙ্গে আমার এই রকম যোগাযোগ আছে। তুমি ওর বাড়ি যাও, মেয়েটার ছবি দেখে বল সে কে?

আমি ওর বাড়ি যাব ছবি দেখতে, এই খবর জুড়ান পেল কী করে?  গুণেন সরকার। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না, মেয়েটার ছবি দেখব, দেখে কী করে বলব সে কে? জুড়ান কথিত বশির মল্লিকের ছবি দেখেছি আমি। তার মেয়ের ছবি কি দেখেছি? বা তার মেয়েকে? বশিরকে চিনে তার মেয়েকে চিনতে পারব আমি? এসব আজগুবি কথা নিয়ে জুড়ান না হয় আসতে পারে, পঞ্চাশ বছর ধরে একই কথা বলে যাচ্ছে। কিন্তু কিছু করতে পারছে না। কিন্তু গুণেনও এতে বিশ্বাস করে ফেলেছে!  

জুড়ান এবং গুণেন সাট করেই এসেছে। তারা নীলমাধবকে নিয়েই কিছু বলবে। নীলমাধব কিংবা বসির মল্লিক। কিংবা বসির মল্লিকের মেয়ে। দুজন এক সঙ্গে আসায় আমার মনে হল তারা খুব শীঘ্রই নীলমাধবের ব্যাপারে হেস্তনেস্ত কিছু করে ফেলবে।

গুণেন বলল,
– আমাদের কাছে কয়েকটা ছবি আছে, আপনার  হোয়াটসঅ্যাপে দিয়ে দিই। আপনি মিলিয়ে নেবেন মনে মনে।
বশির মল্লিক যাকে বলছ জুড়ান, তার মেয়ের ছবি আছে?
– হয়তো আছে, হয়তো নেই। ডেফিনিট করে কিছু বলা যাচ্ছে না কে বশির মল্লিকের মেয়ে। বলল জুড়ান।
– তুমি যৌবনের বশির মল্লিক আর এখনকার বসন্ত মল্লিককে  যেভাবে মিলিয়েছ, তা ঠিক নয় জুড়ান। আমি বললাম।
– তুমি জান না, বশির মল্লিকের নামে ইন্টারপোলে অভিযোগ করেছে বাংলাদেশ। এখন শুধু  সময়ের অপেক্ষা। জুড়ান বলল।

যাই হোক, এইসব কথা বলে তারা এক সময়ে গেল। আমার মনে হতে লাগল, গুণেন সরকার জুড়ান রায়ের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছে। কিন্তু আমিও যাব নীলমাধবের ফ্ল্যাটে তার যুবতী প্রেমিকার ছবি দেখতে। নীলমাধব ডেকেছে। আমার মনে হচ্ছিল, মেয়েটি যদি প্রবীণ নীলমাধবের প্রেমে পড়ে থাকে, বা তাকে বিশ্বাস করে তার সঙ্গে হিমাচল যেতে পারে, নীলমাধবের উচিত গোপনীয়তা রক্ষা করা। আর অস্বস্তি লাগছিল। আমি জড়াতে চাইছিলাম না। ছবি দেখা মানে সাক্ষী হয়ে যাওয়া। নিষিদ্ধ কোনও কিছুর সাক্ষী হতে চাই না। নীলমাধব এক পারভার্ট। কেন যাব আমি?

কিন্তু মানুষের ভিতরে পাপ বলি, পুণ্য বলি, কামনা বাসনা তো  নিঃশেষ হয় না। জ্ঞানবৃক্ষের ফল আমরা ভক্ষণই করে যাচ্ছি অবিরত। নিষিদ্ধর প্রতি আকর্ষণ থেকে আমি গেলাম এক সন্ধ্যায়। নীলমাধব উপরে বসে দূরবীনে আমাকে দেখে ফোন  করল,
– নাইন্থ ফ্লোরে আসুন।
আমি ভূমিতল থেকে লিফটে উঠব, তো চঞ্চলচন্দ্র লিফটের  ভিতর থেকে বেরিয়ে এলেন। দরজা খোলা রেখে হাসলাম,
– ভাল আছেন?

– আপনি? চঞ্চলচন্দ্র ভ্রূ কঁচকে আমাকে চিনে নিতে চাইছিলেন।
– আ
মি অনুতোষ মজুমদার। আপনাকে চিনি। আপনি কি জেরুজালেম গেছেন? হিব্রু জানেন?
– একটু জানি। গিয়েছিলাম। যিশুর সমাধিতে জ্বলা অনির্বাণ  দীপের আলোর তাপ নিয়ে এসেছি। আমি তো এখন বেরচ্ছি, না হলে আপনার সঙ্গে গল্প করতাম। চঞ্চলচন্দ্র বললেন।
– আমি জেরুজালেমের কথা শুনতাম।
বলেও ভাবলাম উনি বেরচ্ছেন, আমি বেঁচে গেলাম। না হলে হয়তো ওঁর সঙ্গে ওঁর ফ্ল্যাটেই চলে যেতাম। কেউ আমেরিকা যায়, ইংল্যান্ড যায়, ইতালি যায়, জেরুজালেম ঘুরে আসা কোনও মানুষ আমি দেখিনি। জুড়ান ইন্টারনেট থেকে কতকিছু জানে, আমি চঞ্চলচন্দ্রর কাছে জানতাম না হয় কয়েকটি কথা। চ
ঞ্চলচন্দ্র বললেন,
– একদিন আসবেন, কথা হবে।

উপরে উঠতে মিনিট  সাত-আট দেরি হল। ডোর বেল বাজাতেই দরজা খুলেছে নীলমাধব। সন্দেহভরা চোখে জিজ্ঞেস করল,
– দেরি হল যে? ঐ লোকটার সঙ্গে কথা বলছিলেন মনে হয়।
আমি অস্বীকার করতে পারলাম না। জানি তো নীলমাধবের দূরবীন দেখেছে কখন আমি ভিতরে ঢুকেছি। দেখেছে চঞ্চলচন্দ্রর নিষ্ক্রমণ। দুইয়ে দুইয়ে চার। সুতরাং সুর কেটে গেল।

নীলমাধব একটি ছবি দেখাল তার ল্যাপটপে। এক যুবতীর কাঁধে হাত রেখে সে দাঁড়িয়ে। যুবতীর পরনে জিনস, জ্যাকেট, মাথায় টুপি। চোখে সানগ্লাস। ভাল করে চেনা গেল না। নীলমাধব বলল,
– আরও ছবি আছে, পরে দেখাব, ভেরি মাচ পারসোনাল। 
– মেয়েটি কি শ্যামবর্ণা? বোঝা যাচ্ছে না। আমি জিজ্ঞেস করলাম। 
– না দুধে আলতায়। গায়ের রং যেন ফেটে পড়ছে। কেন?
আবার সন্দেহ ভরা দৃষ্টি।
আমি বললাম,
– এমনিই জিজ্ঞেস করলাম। নন্দিনী মালিয়ার কথা মনে আছে? ছুটি সিনেমা?
– না মনে নেই। প্যানপ্যানানি সিনেমা, রুগ্ন। আর এ হল ভলাপচ্যুয়াস। এই মেয়েটার শরীরে দিনেমারদের মানে হল্যান্ডের রক্ত আছে, নীল চোখ। একসময় হুগলি জেলায় ডাচ, দিনেমার, ফ্রেঞ্চদের আধিপত্য ছিল তো, ওদের পূর্বপুরুষ ছিল দিনেমার। নীলমাধব বলল।
– আ
পনাকে এসব বলেছে?
– না বললেও কি বোঝা যায় না? পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি লম্বা। আমার হাইট পাঁচ ফুট ছয়, ভাবুন দেখি।
– হ্যাঁ, বেশ লম্বা।  
– জিম করে। শিগগির নায়িকা হবে একটা ফিল্মে। আমার যোগাযোগ, আমি কয়েক সেকেন্ড আপনাকে দেখাতে পারি দিনেমার রক্তের মেয়ের যৌবন আর রূপে কতটা আগুন।  

আমি চুপ করে আছি। নীলমাধব তার মোবাইল থেকে এক  নগ্নিকার ছবি বের করেছে। মুখখানি ঘুরিয়ে রেখেছে মেয়ে। সেই মেয়ে আর ওই মেয়ে এক কিনা, বুঝতে না বুঝতে নীলমাধব ছবি বন্ধ করে দিয়ে বলল,
– শি ইজ কলাবতী।
– কলাবতী নাম?
– হুঁ, কলাবতী, আসল নাম অন্য।  
– আসল নাম জানেন না?
– জানি, কিন্তু বলব না। সব জানাব কেন? সে বিশ্বাস করে আমাকে। নীলমাধব বলল।

– হ্যাঁ, তাইই তো উচিত।
আপনাকে জানালাম। কিন্তু আর কেউ জানবে না সে কে।
এইসব বলতে বলতে  নীলমাধব বলল, একদিন সেই আবদাল্লাকে খুব ধমকেছে। বলেছে, ফের মণিমালিকা আবাসনে ঢুকলে ধরে  পুলিশে দেবে। পুলিশ তাকে হাজতে নিয়ে  পেটাই করবে। “হাড়গোড় ভেঙে ফুটপাথে পড়ে থাকবি শুয়োরের বাচ্চা।” বাড়ি তো তাঁরই, প্রমোটিংয়ে গেলেও তাঁর।  

চা খেয়ে আমি নিশ্চিন্ত হয়েই যেন নেমে আসি কাকলি গানের বাড়ি থেকে। শ্যামাশ্রীর গানের বাড়ি থেকে। শ্যামবর্ণের কন্যা  নয়, আর কিছুও মেলেনি। কী আশ্চর্য! আমি কি ভেবেছিলাম শ্যামাশ্রীর ছবি দেখব? শ্যামাশ্রী গেছে নীলমাধবের সঙ্গে? পঞ্চাশ বছরেরও আগের শ্যামাশ্রী? তখন সে পঞ্চদশী। এখন সে মধ্য ষাট। সেই শ্যামাশ্রী এখনও তেমনই আছে? অদ্ভুত! কী মেলাতে এলাম আর কী মিলিয়ে এলাম।

কত বছর চলে গেছে নিঃশব্দে। কোনওকিছুই কি আর আগের মতো আছে? কিন্তু শ্যামাশ্রীরা হুগলি জেলার মানুষ ছিল না মনে হয়। এও আমার অনুমান। সে বীরভূমের হতে পারে, বোলপুর, লাভপুর, অজয় নদের ধারে হতে পারে। বাড়ি আমার ভাঙন ধরা অজয় নদের বাঁকে, জল যেখানে সোহাগ করে স্থলকে ধরে রাখে। অজয় নদের বাঁকে সেই মেয়েটার গ্রাম। আমার শ্যামাশ্রীকে নিয়ে বহুদিন বাদে কিছু লিখতে ইচ্ছে হল। এখন কি হয়? এই বয়সে গোপনে। গল্প লিখব না স্মৃতিকথা লিখব। যা হয়েছিল তাই। একটা কিছু লিখতে হবেই। লিখে নিয়ে সুমিতাভর কাছে যাব। 

হোয়াটস্য়াপে ছবি দিয়েছিল জুড়ান। সেগুলো খুলে দেখে নিই কতটা মিল। পাঁচ ফুট চার কিংবা পাঁচ ইঞ্চি  উচ্চতা, দুধে  আলতায় রঙ। আমি মেলাইনি। হোয়াটস্যাপের ছবি মুছেই দিলাম। গুণেনকে বললাম,
– মেলেনি। একদম মেলেনি। আন্দাজ করে কারও সম্পর্কে কিছু  বলা ঠিক না।
– মিলবে না, মিলছে না করতে করতেই একদিন মিলে যাবেই। মাথা নেড়ে গুণেন বলল। 

Amar Mitra

অমর মিত্রের জন্ম ১৯৫১ সালে বসিরহাটে। তবে বহুদিনযাবৎ কলকাতাবাসী। ১৯৭৪ সালে 'মেলার দিকে ঘর' গল্প দিয়ে সাহিত্যিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ। প্রথম উপন্যাস 'নদীর মানুষ' ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত হয় অমৃত পত্রিকায়। প্রথম গল্পের বই 'মাঠ ভাঙে কালপুরুষ'-ও ১৯৭৮ সালেই। রাজ্য সরকারি চাকরি করেও আজীবন সাহিত্যসাধনায় ব্রতী। ২০০৬ সালে 'ধ্রুবপুত্র' উপন্যাসের জন্য পেয়েছেন সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার। ২০০১ সালে বঙ্কিম পুরস্কার পেয়েছেন 'অশ্বচরিত' উপন্যাসের জন্য। এছাড়াও ২০০৪ সালে শরৎ পুরস্কার ও ২০১০ সালে গজেন্দ্রকুমার মিত্র সম্মান পেয়েছেন তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *