আগের পর্বের লিংক: [পর্ব ১] [পর্ব ২] [পর্ব ৩] [পর্ব ৪] [পর্ব ৫] [পর্ব ৬] [পর্ব ৭] [পর্ব ৮] [পর্ব ৯] [পর্ব ১০] [পর্ব ১১]

জুড়ানের ভয় নেই। সে বলল খারাপ ছবি দেবে না, কিন্তু নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ ছবি, নীলমাধব আর একটা লোকের ছবি। লোকটার নাম বসন্ত মল্লিক। সে হাবড়ার ওদিকে হোমিওপ্যাথ ডাক্তার ছিল হতে পারে, না হতেও পারে। কিন্তু ডাউটফুল, মানে ছদ্মবেশী মুজিব হত্যাকারী কিংবা রাজাকার, বাংলাদেশে ঢুকলেই বিচারে ফাঁসি।
তুমি সেই ছবি পেলে কোথায়?
– নিরীহ মানুষ জগদীশ হয়ে আছি কি এমনি? জুড়ান বলল।
– এসব পুলিশের ব্যাপার। ইন্টারনেটের সব তথ্য নাকি সরকার পেয়ে যায়। তুমি পাও, সরকার পাবে না?
আরে সরকার মানে গুণেন সরকার কিংবা অমুক সরকার নয়। সরকার হল গভমেন্ট। গভমেন্ট হলাম আমরা, মানে কর্মচারীরা। তাদের কী দায় পড়েছে কাজের বাইরে কাজ করার? কিন্তু আমি করি। আমি সবটা জানতে চাই, একটা বড় চক্রান্তের লিংক বের করে ইউটিউবে দিয়ে দেব। 
তুমি টারগেট হয়ে যাবে জুড়ান। না পেরে বললাম। হাহা করে হাসল জুড়ান। বলল:
– হব হব। পালোধীদের শেষ দেখতে চাই আমি।

জুড়ানচন্দ্র রায় আমাকে যেন ফাঁসিয়ে দেবে। কীসে ফাঁসাবে, না এইসব গোলমেলে ব্যাপারে। আমি ভাবছিলাম জুড়ানকে এড়িয়ে যাব। আর কোনও রোববারে যাব না জুড়ানের কাছে। কিন্তু লোকটার টান আছে। আমি যেন ক্ষুধিত পাষাণের সেই তুলোর কারবারির মতো ভগ্নস্তূপ হয়ে যাওয়া প্রাসাদের দিকে রোববারে এগিয়ে যাই। জুড়ান হল সেই প্রাসাদ। সেখানে কত নুপুরের কিঙ্কিনী, প্রাসাদের ধারের  স্রোতস্বিনীতে ইরানি মেয়েদের কলহাস্য রয়েছে। অন্ধকারে তা শোনা যায়।

জুড়ানও যা বলে তা কিছু কম নয়। তবু তাকে বললাম:
– এসব হল আন্তর্জাতিক ব্যাপার। অনন্ত বিশ্বাস রোডের ব্যাপার নয়। তুমি ফালতু ঝামেলায় কেন জড়াচ্ছ?
আমি তো বেআইনি কিছু করছি না। দেখ সেই ডাক্তার মরেনি। 
কোন ডাক্তার? আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম। 
মুজিব কিলার কিংবা রাজাকার, কিংবা বড় অপরাধী, অন্য কাউকে মার্ডার করে ভারতে এসে লুকিয়েছে।

গা ছমছম করে ওঠে। জুড়ান খুব বিপজ্জনক কথা বলছে। সেই কিলার শান্তিনিকেতনেও নাকি আশ্রয় নিয়েছিল পার্ক স্ট্রিটের মাস্টার ধরা পড়লে। আশ্রয় দিয়েছিল নীলমাধব। সে যে ছবি দেবে তা শান্তিনিকেতনের। নীলমাধব শিগগির ধরা পড়ে যাবে। জুড়ান রায় বলল:
– সব রোববারে কি শান্তিনিকেতন যায় নীলমাধব? হাবড়াও যেত।
– মানে সেই হোমিওপ্যাথ ডাক্তারের কাছে? 
– আমার সন্দেহ তাই, না গিয়ে উপায় নেই। তারা তো জানে পালোধীদের সব কিছু।
জুড়ান বিড়ি ধরায়। বলে:
– মোবাইলে যোগাযোগ করত। তুমি কি জানো মোবাইল সেট বারবার বদলায় কিনা নীলমাধব?
কী করে জানব? তবে নতুন মোবাইল তো কেনেই। ওর ক্ষমতা আছে বারবার বদলানোর।
– এর মানে আগের মোবাইলে থাকা সব তথ্য নষ্ট করে দেওয়া। আমার কথা ঠিক হল কিনা বল। 

 

আরও পড়ুন: অংশুমান ভৌমিকের কলমে: এটা কি স্বগতোক্তি না হলিউড স্টাইল?

 

ঠিক হল না বেঠিক হল, আমি বলব কী করে? জুড়ান বলছে, মাধবের সঙ্গে ঐ কিলারের নিশ্চয় যোগাযোগ ছিল। কিলার মাধবের বাড়িতেও এসেছে মনে হয়। পার্ক স্ট্রিটেও মাধব গেছে অনেকবার। সে বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ। সি সি টিভি থেকেই জানা যাবে। একদিন সব প্রকাশ হয়ে যাবে। এখন সব জানাজানি হয়ে গেছে। পাখি উড়ে গেছে। জুড়ানের গলায় হতাশা:
– কবে যে নীলাম্বর রাজাকার ধরা পড়বে।
তিনি তো মারা গেছেন। 
তা যান। লুটের মাল, কিলো কিলো সোনার গয়না, তার হদিশ তো দিতে হবে নীলমাধবকেই। ইনকাম ট্যাক্স, সিআইডি কি খোঁজ রাখে না? সময়ে চলে আসবে। আসবেই আসবে। জুড়ান নিজের বুকেই যেন  চাপড় মেরে বলল। তারপর একটু থেমে আবার বলল:
– ও বনগাঁয় যায়, তা জানো?
– বনগাঁয় তো আমিও যাই। আমার মাসির বাড়ি। কম বয়সে অনেক গেছি। এখন মাসি নেই, যাওয়া হয় না। বনগাঁর মিষ্টি খুব ভাল, কাঁচা গোল্লা। আমি হেসে বললাম।
– মাধবের মাসির বাড়ি, পিসির বাড়ি নেই। কিন্তু বর্ডার আছে। ওপারে বাংলাদেশ। ওদের যোগাযোগ আছে  এখনও। জুড়ান চাপা গলায় বলল:
– ও রিসিভ করে ওপারের কিলার কিংবা দাঙ্গাবাজ শয়তানকে। নটোরিয়াস লোককে। বুঝলে কিছু? পালোধীদের ভাল কানেকশন আছে ওপারের সঙ্গে।

চুপ করে থাকাই শ্রেয়। তবু না পেরে বললাম:
– ওপারে আমাদেরও কানেকশন ছিল। থাকলে কী হয়েছে? আমাদের এক পিসি ছিল ওদেশে। বাগেরহাটে বিয়ে হয়েছিল পিসির। এখন বেঁচে নেই। পিসির দুই ছেলের একজন কানাডায় থাকে। একজন দেশেই, সরকারি উপসচিব হয়ে রিটায়ার করেছে শুনেছি। আমি বললাম একটু গর্বিত স্বরেই। আমারও কিছু তথ্য আছে। জুড়ান এসব কথায় পাত্তাই দিল না। বলল, সে লিংক খুঁজে বের করবেই, নীলমাধব পালোধীদের ছাড়বে না। 

জুড়ানের কথা যেন বাতাসে ভেসে ভেসে বেড়ায়। সবটাই ওর কাল্পনিক মনে হয়। কিন্তু ও বলছে ইন্টারনেট ওকে সব তথ্য দিয়ে দেবে। ও কি এমনি ইন্টারনেট শিখেছে? এমনিই কি এত জানতে চাইছে মাধবদের কথা? একদিন ইন্টারনেট থেকেই বের করে আনবে সব পাপের খবর। আছে আছে, সব আছে বিশ্বের বিপুল তথ্যভাণ্ডারে। তার ভিতরে মাধব আছে, নীলাম্বর আছে, ওই আবাসনের সকলে আছে।  জুড়ান একদিন সফল হবেই। হাবড়া কিংবা বনগাঁ গেছে কিনা, যায় কিনা নীলমাধব, তা খুঁজে বের করবেই জুড়ান। আর নতুন কোনও তথ্য পেলাম না জুড়ানের কাছে। জুড়ান বলল:
– একদিন ফেঁসে যাবেই নীলমাধব। এমন ফাঁসা ফাঁসবে, যে বেরনোর পথ খুঁজে পাবে না। বলে দিও চঞ্চলচন্দ্র চন্দ্রের সঙ্গে যেন টক্কর দিতে না যায়। চঞ্চলচন্দ্র সাধারণ মানুষ নন।
– তাহলে তিনি কে? জিজ্ঞেস করলাম।
– ‘নিরীহ মানুষ জগদীশ’ জানে। জুড়ান রায় জানে না।
বলতে অসুবিধে আছে?
– ধীরে বন্ধু ধীরে। সব জানতে পারবে। 
আচ্ছা, তোমার কাছে যে ছবি আছে, পেলে কোথায়?
আগে জিজ্ঞেস করা একই কথা আবার জিজ্ঞেস করলাম আমি।
পেয়েছি। দেখলেই বুঝবে কিলার কিংবা ফ্রড, কিংবা রায়ট করা লোক। সরকার এদের খোঁজে সব সময়। 
দেখাও দেখি। আমি বললাম। 

গা ছমছম করে ওঠে। জুড়ান খুব বিপজ্জনক কথা বলছে। সেই কিলার শান্তিনিকেতনেও নাকি আশ্রয় নিয়েছিল পার্ক স্ট্রিটের মাস্টার ধরা পড়লে। আশ্রয় দিয়েছিল নীলমাধব। সে যে ছবি দেবে তা শান্তিনিকেতনের। নীলমাধব শিগগির ধরা পড়ে যাবে। 

জুড়ান রায় আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। তারপর বলল:
– তুমি বিশ্বাস করবে তো?
– কিসের বিশ্বাস? জিজ্ঞেস করলাম।
মানে সেই লোকটা কিলার, মুজিব হত্যাকারিদের একজন, বা পালিয়ে আসা অপরাধী, ফ্রড, খুনে,  বাংলাদেশের ব্যাঙ্ক লুটে একজন ইন্ডিয়ায় এসে আছে, তা তুমি বিশ্বাস করবে?
– থাকতেই পারে। অপরাধী তো এইভাবে লুকোয়। বর্ডার পেরিয়ে অন্য দেশে  চলে যায়। তবে সত্যি কথা বলতে আমি কিছুই জানি না এই বিষয়ে। আমি বাংলাদেশে কোনওদিন যাইইনি। পাসপোর্টই নেই আমার। 
– না গিয়েও সব জানা যায় এখন। ইন্টারনেটে সব আছে। আমি তোমাকে দেখাচ্ছি। আমি এটা নেটে পেয়েছি, ফেসবুক ফ্রেন্ড দিয়েছে। যে দিয়েছে তাকে তুমি চেন না। বাংলাদেশে তার বাড়ি। একেবারে ফরিদপুরে। কিন্তু এখন থাকে আমেরিকা। মাই ফ্রেন্ড, নাম জিজ্ঞেস কোরো না।

আমি অবাক। এমন হয়? এইভাবে যোগাযোগ হয় ফেসবুকে? জুড়ান বলছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মানুষ বন্ধু হয়ে যায়। আমেরিকার একটা শহর থেকে এই ছবি বারাসত ডি এম অফিসের প্রাক্তন কিন্তু এখনও বর্তমান ডি-গ্রুপ স্টাফ জুড়ানচন্দ্র রায়কে পাঠিয়েছে ফরিদপুরি প্রাক্তন? আমি শুধু অবাক হতেই জানি। আর  কিছুই জানি না। পৃথিবীতে কত কিছু ঘটে যাচ্ছে, তার ভিতরে আমি নেই। আমি যখন টিভির সামনে হাঁ করে বসে থাকি, ঝিমোই, কিংবা ব্যালকনিতে বসে অন্ধকারে তাকিয়ে থাকি, তখন হয়তো আমেরিকা কিংবা ইংল্যান্ডে বসবাসরত কোনও এক ব্যক্তির সঙ্গে জুড়ানচন্দ্র কথা বলে যাচ্ছে। সে ছবি পাঠাচ্ছে, জুড়ান খবর দিচ্ছে হাবড়া কিংবা এই অনন্ত বিশ্বাস রোডের।

একদিন সুমিতাভ মৈত্র বলেছিলেন:
– যখন আপনি ঘুমের ভিতর সুখের স্বপ্ন দেখছেন, তখন হয়ত ইরাকের হাসপাতালে বোমা পড়ছে। ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে গ্রিসে পৌঁছনর চেষ্টা করছে যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার উদ্বাস্তুরা। আপনি যখন ব্যালকনিতে বসে আকাশের তারা দেখছেন, তখন হয়তো যে তারাটির আলো এসে পড়ল লক্ষ আলোকবর্ষ দূর থেকে, সে হয়তো মৃত। শেষ আলোকবন্দুটি আপনি দেখতে পেলেন, কিন্তু আপনি তা জানলেন না। একটি মানুষ মারা যাচ্ছে, আর একটি মানুষ সেই মুহূর্তেই জন্মাচ্ছে। পৃথিবীতে ঘটনপুঞ্জের জন্ম হয় অবিরত। 

আমি এসবের বাইরে।

 

আরও পড়ুন: শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কলমে অগ্নি রায়ের কাব্যগ্রন্থের কথা

 

জুড়ানচন্দ্র রায় তার মোবাইল ফোনের ফোটো গ্যালারি থেকে একটি নিরীহ মুখ বের করে দেখাল। তার পাশে নীলমাধব। লোকটা রোগা, ঢ্যাঙা, চোখে চশমা, ধুতি পাঞ্জাবি পরা। তাকে দেখে একদমই সামরিক ব্যক্তি বলে মনে হয় না। নিরীহ মুখ। মুখটি আবছা চেনাও মনে হয়। কোথায় দেখেছি আমি, কোথায় দেখতে পারি, এ পাড়ায়? পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছবি তোলা। এ দিয়ে কী প্রমাণ করবে জুড়ান রায় বা নিরীহ মানুষ জগদীশ? জুড়ান জিজ্ঞেস করল:
– আমার কথা বিশ্বাস হল কিনা?
– চেনা মনে হয়। আমি অস্ফুট স্বরে বললাম।
– চেনা মানে? তুমি কি নীলমাধবের সঙ্গে হাবড়া গিয়েছিলে? জুড়ান অবাক হয়ে বলল:
– সাবধান! ও ধরা পড়লে তুমিও ফেঁসে যাবে অনুতোষ। 
না না না, কিন্তু কোথায় দেখেছি মনে হয়। আমি বললাম।
কোথায় আবার? তুমি তো পাড়া ছেড়ে বেরোও না বড় একটা। তাহলে পাড়ায় দেখেছ। বলল জুড়ানচন্দ্র। 
তা দেখতে পারি। অনুচ্চ কণ্ঠে বললাম।
তাহলে সে আসে এ পাড়ায়। তার মানে পালোধী বাড়ি। তার মানে আমার কথা ঠিক। জুড়ানের আত্মপ্রত্যয় বেড়ে গেল।  

আমি বুঝতে পারলাম না কী বলব। চুপ করে আছি। গা ছমছম করছে। জুড়ান বলল:
– আমি জানি তুমি বিশ্বাস করবে না অনুতোষ। নীলমাধবকে তুমি ভয় কর। কিন্তু একদিন যখন সব ফাঁস হয়ে যাবে, সেদিন কী করবে তুমি স্যার? ওরা যে রাজাকারের লিডার ছিল ছ’মাস, তা প্রকাশ হয়ে যাবেই।

Amar Mitra

অমর মিত্রের জন্ম ১৯৫১ সালে বসিরহাটে। তবে বহুদিনযাবৎ কলকাতাবাসী। ১৯৭৪ সালে 'মেলার দিকে ঘর' গল্প দিয়ে সাহিত্যিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ। প্রথম উপন্যাস 'নদীর মানুষ' ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত হয় অমৃত পত্রিকায়। প্রথম গল্পের বই 'মাঠ ভাঙে কালপুরুষ'-ও ১৯৭৮ সালেই। রাজ্য সরকারি চাকরি করেও আজীবন সাহিত্যসাধনায় ব্রতী। ২০০৬ সালে 'ধ্রুবপুত্র' উপন্যাসের জন্য পেয়েছেন সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার। ২০০১ সালে বঙ্কিম পুরস্কার পেয়েছেন 'অশ্বচরিত' উপন্যাসের জন্য। এছাড়াও ২০০৪ সালে শরৎ পুরস্কার ও ২০১০ সালে গজেন্দ্রকুমার মিত্র সম্মান পেয়েছেন তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *