মৃত্যুর ৩৪ বছর পরেও কণ্ঠে চিরবসন্ত নিয়ে আজও বাঙালিকে যিনি মুগ্ধ করে চলেছেন, তাঁর কথা বলতে বা ধুতি-শার্ট পরিহীত দীর্ঘদেহী মানুষটিকে স্মরণ করতে কি বিশেষ কোনও বছর, মাস বা দিনের প্রয়োজন হয়? পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলা আধুনিক গান, রবীন্দ্রসঙ্গীত, কাব্যগীতি, মুম্বইয়ের হিন্দি জনপ্রিয় সব ছবির মন মাতানো গান পরিবেশিত হয়ে এসেছে তাঁর কণ্ঠে। যখনই যেখানে যে গান তাঁর স্বর্ণকণ্ঠে শোনা গিয়েছে, তখনই মনে হয়েছে সেই বিশেষ গানটি গাওয়ার জন্যই যেন তাঁর জন্ম। যখন তিনি সুরকার হেমন্ত, তখনও তাঁর সৃষ্টি স্বতন্ত্র। সেই সুর বড় মিষ্টি আর সহজ। ‘নাগিন’-এর সুরকার যখন ‘শ্যামা’-র বজ্রসেনের গান করেন তখন সমস্ত শরীর যেন উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। কে বলবে একই মানুষ আর একই কণ্ঠ!

খ্যাতির উচ্চশিখরে পৌঁছে যাওয়া দীর্ঘদেহী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে আমি প্রথম দেখি উত্তর কলকাতার কেশবচন্দ্র সেন স্ট্রিটে আমার মামারবাড়ির সেকেলে উঠোনে। কেন এসেছিলেন? ঠিক কোন সালের কত তারিখ ছিল– আজ আর তা মনে নেই। বয়স কম থাকায় তাঁর ‘পাল্কির গান’ এই ছোট ছেলেটির মনে ধরেছিল। ভয়মিশ্রিত বিস্ময়ে তাঁকে দেখছিলাম। আরও পরে জানতে পারি মাতামহ কবি-গীতিকার অমিয় বাগচির বন্ধু হিসেবেই মামারবাড়িতে যাতায়াত ছিল তাঁর।

Hemanta Mukhopadhyay and Amiya Bagchi
দুই বন্ধু। অমিয় বাগচির (ডাইনে) সঙ্গে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়

শুনেছিলাম বৃষ্টিভেজা এক সন্ধ্যায় ওই বাড়িতে বসেই দাদুর লেখা ‘বাদল মেঘের ছায়ায়’ গানটিতে সুরারোপ করেছিলেন হেমন্তবাবু, বিকাশ রায়ের উপস্থিতিতে। দাদু অমিয় বাগচীর লেখা ‘কথা কোয়োনাকো শুধু শোনো’ গানটিই তাঁর জীবনের শুরুতে তাঁকে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছিল। এরপর তো দাদুর লেখা আরও কত গান গেয়েছেন এবং সেসব গানে সুরারোপ করেছেন।

গ্রামাফোন কোম্পানির ‘কলোম্বিয়া’-র লেবেলে ৭৮ আরপিএমের রেকর্ডের গানগুলি আজও শোনা যায়। পরবর্তীকালে তার মধ্যে থেকে নির্বাচিত কিছু গান রিমেকও করেন তিনি নিজেই। ব্যারিটোন ভয়েসের অধিকারী মানুষ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল ১৯৮৯ সালে তাঁর চলে যাওয়া পর্যন্ত। কখনও ফাংশনে, কখনও দক্ষিণ কলকাতার সার্দান অ্যাভেনিউ সংলগ্ন শরৎ চ্যাটার্জী রোডের বাড়িতে, আবার কখনও আমাদের বাড়ির বিভিন্ন উৎসবে। মাঝেমধ্যে ওঁর সঙ্গে কলকাতা দুরদর্শনের বিভিন্ন রেকর্ডিংয়েও গেছি, পাশে বসেছি। সেই সব সময়ে মনে হত ভারতবিখ্যাত সর্বজনশ্রদ্ধেয় গায়ক-সুরকার নন, পাশে বসে রয়েছেন ভবানীপুরের একজন মধ্যবিত্ত সাধারণ, নিরহঙ্কার, সৎ মানুষ, যাঁর মধ্যে মিথ্যে গ্ল্যামারের আবরণ বিন্দুমাত্র নেই।

Hemanta Mukhopadhyay with famous personalities
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে (ওপরে বাঁ দিকে) মুকেশ, (ডাইনে) তপন সিংহ, (নীচে বাঁ দিকে) গজ়লসম্রাট মেহেদি হাসান, (ডাইনে) প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরু

সম্ভবত ১৯৮৮ সাল, কলকাতা বিশ্যবিদ্যালয় তাঁকে সাম্মানিক ডিলিট উপাধি দেওয়ার কথা ঘোষণা করল। যদি খুব ভুল না করি, তাহলে কাঙ্খিত দিনটা ছিল ১ এপ্রিল। প্রবেশপত্রের চাহিদা তুঙ্গে। কিন্তু সাধারণের জন্য খুব সীমিত সংখ্যক টিকিটই দেওয়া হয়েছিল। এদিকে অগণিত হেমন্ত অনুরাগী এবং আপনজনেরা দেখতে চান, শুনতে চান সেই ঐতিহাসিক অনুষ্ঠান। শান্তিনিকেতন থেকে ফিরে বাড়ি এসে শুনলাম বাবা-মা যাচ্ছেন সেই অনুষ্ঠানে।

Hemanta Mukhopadhyay with Author
স্নেহের বুবানের (লেখক) সঙ্গে তার হেমন্তদাদু

প্রবেশপত্র সহজলভ্য নয়। তাই অগত্যা মন খারাপ করে বাড়িতেই রয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনও পথ খোলা নেই। ওঁরা চলে যাওয়ার প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে হঠাৎ দেখি বাবা হাঁপাতে হাঁপাতে ফিরে এসে আমাকে তাড়া লাগালেন, যত দ্রুত সম্ভব অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে নিতে। পরে মার কাছে শুনেছিলাম, ওঁরা হেমন্তদাদুর বাড়ি পৌঁছলে উনি আমার না যাওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করেন। যখন শোনেন কম কার্ড থাকার কারণে ওঁরা আমাকে নিয়ে যাননি, তখন বেশ বিরক্ত হয়ে মাকে বলেছিলেন, ‘তোদের এই ব্যাপারগুলো আমার বড় বিশ্রি লাগে।’ সঙ্গে সঙ্গে বাবাকে নির্দেশ দেন আমাকে অনুষ্ঠানে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবার্ষিকী ভবনের সেই অনুষ্ঠানে গেলাম, তাঁকে প্রাণভরে দেখলাম, শুনলাম আর মনে মনে গর্ববোধ করলাম।

Hemanta Mukhopadhyay felicitated by Calcutta University
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ডিলিট প্রদান অনুষ্ঠানে

পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন রাজ্যপাল অধ্যাপক ডাঃ. নুরুল হাসান তথা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য দু’জন ব্যক্তিত্ত্বকে সম্মানিত করলেন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ছাড়া অন্যজন ছিলেন একজন বিশিষ্ট রাশিয়ান বৈজ্ঞনিক, নামটা আজ আর মনে নেই। অনুষ্ঠান শেষে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে ছবি তোলার পরে আমার দিকে তাকিয়ে তাঁর সহাস্য মন্তব্য ছিল, ‘কীরে বুবান, (আমার ডাক নাম) তোকে তো ফেলেই আসছিল!’ সেই কথাটা আজও কানে বাজে।

কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে সাতের দশকে চিরাচরিত ঐতিহাসিক ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ শীর্ষক মহালয়ার প্রাক-প্রত্যুষে প্রচারিত আকাশবাণীর প্রভাতী অনুষ্ঠানের পরিবর্তে নতুন একটি অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সেই অনুষ্ঠানের সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন। সেই অনুষ্ঠান সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার নেই। যা হয়েছিল সেটা কিন্তু তদানীন্তন সরকারের নির্দেশেই আকাশবাণী কর্তৃপক্ষ করতে বাধ্য হন। অনেকে দেখি আজও অনেক কাল্পনিক কথা বলে থাকেন সেই অনুষ্ঠান সম্পর্কে।

Hemanta Mukhopadhyay
বাক্যালাপে মগ্ন

যদি কেউ সত্যিটা জানতে চান, তবে আজও আমাদের মধ্যে অনুষ্ঠানের নির্দেশক, বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী এবং চলচ্চিত্র প্রযোজক অসীমা ভট্টাচার্য জীবিত রয়েছেন, তাঁর কাছ থেকে অনায়াসে আসল তথ্যটি জেনে নিতে পারেন। যখন সেই বিশেষ অনুষ্ঠানটি পরিবেশিত হয়েছিল তখন কিন্তু রেডিও সেট সবার বাড়িতে ছিল না। আমি বায়না ধরলাম, হেমন্তদাদুর বাড়িতে থেকেই ওই অনুষ্ঠান শুনব। শেষ পর্যন্ত হলও তাই। তাঁরই পাশে শুয়ে ঘুমজড়ানো চোখে শুনেছিলাম ‘দেবীং দুর্গতিহারিণীম’ শিরোনামের অনুষ্ঠানটি। আজ তাঁর ১০১ তম জন্মদিন, অনেক স্মৃতিই ভিড় করে আসছে মনে, কিন্তু এর বেশি বললে আত্মপ্রচার হয়ে যাবে।

এবার তাঁর গাওয়া অল্পশ্রুত কয়েকটি গানের কথা আলোচনা করব। তপন সিংহ পরিচালত অত্যন্ত কম আলোচিত তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধায়ের লেখা ‘হাঁসুলীবাঁকের উপকথা’ এক অনবদ্য সৃষ্টি। আর সেই ছবির গানগুলিও বিশেষ প্রশংসার দাবি রাখে। ছবির সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। গানগুলির গীতিকার তারাশঙ্কর স্বয়ং। অদ্ভুত ব্যাপার হল, বীরভূমের পটভূমিতে লেখা উপন্যাস অবলম্বনে ছবিতে কিন্তু লালমাটির চিরাচরিত বাউলাঙ্গের সুর অনুপস্থিত। তার জায়গায় প্রতিটি গানে নদিয়ার কীর্তনাঙ্গের সুর, ছন্দ।  সে গান সবার মন ভরিয়ে দিয়েছিল। ‘গোপনে মনের কথা বলতে দে গো আঁধার গাছতলায়’, ‘হাঁসুলি বাঁকের কথা বলব কারে হায়, কোপাই নদীর জলে কথা ভেসে যায় রে’ বা ‘ভাই রে আলোর তরে ভাবনা’ ইত্যাদি গানগুলো শুনলে আজও চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।

অন্যদিকে সজনীকান্ত দাসের কাব্যগীতি ‘কে জাগে’-র সুর করেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এবং গানটি গেয়েওছিলেন নিজে। হিজ মাস্টার্স ভয়েস থেকে সেই গানের একটি এলপি রেকর্ডও বেরিয়েছিল। প্রথম থেকে মনোযোগ দিয়ে শুনলে চোখের সামনে ভেসে উঠবে রাতের কলকাতার একটি নির্মম ছবি। আবার তাঁরই কণ্ঠে গোয়ানিজ গান ‘জুলিয়ানা’ অদ্ভূত সুন্দর। পীষূষ বসু পরিচালিত ‘স্বর্ণশিখর প্রাঙ্গণে’ ছবির একটি গান প্রায় শোনাই যায় না। ‘নয় মনের থেকে ভুল বোঝারই কাঁটাগুলো সরিয়ে দিলে…’ অসাধারণ রোম্যান্টিক গান, তেমনই মিষ্টি সংবেদনশীল তার সুর। একমাত্র হেমন্তবাবুই পারতেন এ রূপ সৃষ্টি করতে।

গান আমি ভালবাসি, কিন্তু সঙ্গীতের বিশেষজ্ঞ নই|। তাই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গীত নিয়ে বিশদ আলোচনা আমার পক্ষে ধৃষ্টতামাত্র। পৃথিবীর অগণিত হেমন্ত-অনুরাগীদের মধ্যে আমিও একজন। পারিবারিক বৃত্তের বাইরে তাঁর গানের লক্ষ শ্রোতার মধ্যে আমিও রয়েছি। তাঁর শতবর্ষে অসংখ্য গুণীজনেদের হেমন্ত অনুরাগ আর স্মৃতিকে একত্রিত করে প্রকাশ করেছিলাম ‘কাছে রবে’ শীর্ষক গ্রন্থ| হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ১০১ তম জন্মদিনে তাঁকে প্রণাম জানাতে গিয়ে বাঙালির চিরকেলে অভ্যাসবশত আমিও তাই রবীন্দ্রনাথের গানের আশ্রয় নিয়ে বলি ‘তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম।’ তাঁর গানের স্বরলিপি আগামী দিনেও সঙ্গীতের অনুরাগীরা কান পেতে শুনবেন।  

 

*ছবি সৌজন্য: অঞ্জনকুমার মৈত্র, সুকুমার রায়, অমিত বন্দ্যোপাধ্যায়

অরিজিৎ মৈত্র পেশায় সাংবাদিক। দৈনিক যুগশঙ্খ পত্রিকায় সিনিয়র সাব-এডিটার পদে কর্মরত। তপন সিংহ ফাউন্ডেশনের সম্পাদক অরিজিৎ পুরনো কলকাতা নিয়ে চর্চা করতে ভালবাসেন। নিয়মিত লেখালিখি করেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। প্রকাশিত বই: অনুভবে তপন সিনহা, ছায়ালোকের নীরব পথিক বিমল রায়, চিরপথের সঙ্গী - সত্য সাঁই বাবা, বন্দনা, কাছে রবে ইত্যাদি।

3 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *