সাল ১৯৮৪। আমি তখন ক্লাস টু, আমি তখন নিতান্তই হাফপ্যান্টুল। এপ্রিল মাসের এক বিকেলে বাবা বাড়ি ফিরল একটা রঙচঙে পত্রিকা হাতে নিয়ে, তাতে নকশাদার সাদা অক্ষরে লেখা, আনন্দমেলা। তার ভেতরে কত কী, রঙিন বিজ্ঞাপন, কী সুন্দর সব গল্প, বিমল দাসের আঁকা ছবি, কবিতা, শব্দজব্দ, ধাঁধা, রোভার্সের রয়, সদাশিব, গাবলু, সব পেরিয়ে চোখ আটকে গেল কুড়ি পাতা জোড়া একটা রঙীন কমিক স্ট্রিপে। ওপরে বড় বড় করে লেখা, লোহিত সাগরের হাঙর। 

টিনটিন, ক্যাপ্টেন হ্যাডক, এদের সঙ্গে সেই প্রথম পরিচয়। ক্রমে আনন্দমেলার পাতায় বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে আরও অজস্র বর্ণময় চরিত্রের সঙ্গে, প্রফেসর ক্যালকুলাস, নেস্টর, বিয়াঙ্কা কাস্তাফিওরে, গর্গনজোলা, জেনারেল আলকাজার ওরফে রামন জারাতে, চ্যাং, জলিয়ন ওয়াগ, সফোক্লিস সার্কোফেগাস – নাম নিয়ে শেষ করা যায় না। অন্যান্য কমিক স্ট্রিপের থেকে কীসে যেন আলাদা ছিল টিনটিনের দুটো পাতা। ক্রমশ এমন অভ্যেস হয়ে গেল, আনন্দমেলা হাতে পেয়ে সবার প্রথমে চলে যেতাম কুড়ির পাতায়, আগে টিনটিন, তারপরে অন্য কিছু। এবং শেষ করবার পর আবার পরের সংখ্যার জন্য হা-পিত্যেশ করে বসে থাকা। তখন টিনটিনের বই বাজারে কিনতেও পাওয়া যেত না। বাংলা অনুবাদগুলো যে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর করা, সে-ও জেনেছিলাম বড় হবার পরে। তখন নীরেনবাবুই ছিলেন আনন্দমেলার সম্পাদক।

tintin museum brussels
জনসন রনসনের টুপি। ছবি শমীক মপখোপাধ্য়ায়।

ছোটবেলার সেই হিরোর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ এসে গেল কদিন আগে। কাজের সূত্রে ইউরোপ এসেছি, উইকএন্ডে টুকটাক ঘুরে নেওয়া খুব বড় কিছু ব্যাপার নয়, তাই এক শনিবার বিকেলে বাস ধরে পৌঁছে গেলাম ব্রাসেলস। পরদিন যাবার কথা টিনটিনের বাড়ি। মার্লিনস্পাইক হলের ঠিকানা, 26, ল্যাব্রাডর রোড হলেও সে ঠিকানা বেলজিয়ামের কোন মুল্লুকে, কারুরই জানা নেই। কিন্তু টিনটিনের জন্যে আস্ত একটা মিউজিয়াম আছে, কারণ বেলজিয়ান কমিক ক্যারেকটার টিনটিন আম-বেলজিয়ামবাসীর চোখের মণি। 

মূলত দুটো মিউজিয়াম আছে। একটা ব্রাসেলস শহরেই তার নাম কমিকস আর্ট মিউজিয়াম, সেখানে টিনটিনের পাশাপাশি আরও অসংখ্য বেলজিয়ান কমিক স্ট্রিপের চরিত্রদের দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু শুধু টিনটিনের জন্য তৈরি মিউজিয়ামটির নাম, অ্যার্জে মিউজিয়াম। ব্রাসেলস শহর থেকে একটু দূরে, ট্রেনে করে যেতে হয়, ল্যুভেইঁ-লা-নিউভ নামে একটা নিরিবিলি স্টেশনের কাছেই।

tintin rocket brussels
টিনটিনের চাঁদে যাবার সেই বিখ্যাত রকেট। ছবি শমীক মুখোপাধ্য়ায়।

Georgés Remi, উচ্চারণ জর্জ রেমি, বেলজিয়ামে জন্মান ১৯০৭ সালে। ছোটবেলা থেকেই বইখাতার মার্জিনের আশেপাশে নানা রকমের কার্টুন স্ট্রিপ এঁকে তিনি সকলের নজরে পড়ে যান। প্রথম কমিক স্ট্রিপ তোতোর প্রকাশিত হয় বেলজিয়ান বয় স্কাউট পত্রিকার ম্যাগাজিনে, তখন রেমির বয়েস মাত্র উনিশ। টিনটিন চরিত্রটি প্রকাশ করেন বাইশ বছর বয়েসে, একটি দৈনিক পত্রিকার জন্য। তখনও পর্যন্ত এবং তার পরেও দীর্ঘদিন, রেমির খ্যাতি সীমাবদ্ধ ছিল কেবলমাত্র বেলজিয়ান পাঠকজগতের মধ্যেই। GR এই দুটো আদ্যক্ষর দিয়ে নাম লেখা এক সময়ে একঘেয়ে লাগলে, রেমি করলেন কি, অক্ষরদুটোকে আগে পরে করে নিলেন। GR হয়ে গেল RG। বেলজিয়ামের মুখ্য ভাষা ডাচ আর ফরাসী। রেমি ফরাসী মাধ্যমেই লেখাপড়া করেছিলেন, টিনটিনও শুরুর অনেক দিন পর্যন্ত ছিল ফরাসী ভাষার কমিক স্ট্রিপ, বাংলা উচ্চারণমতে তার নাম ছিল ত্যাঁত্যাঁ বা তেঁতেঁ। তো, ফরাসী উচ্চারণ কিনা ইংরেজির থেকে অনেকটাই আলাদা, আমরা যাকে আর-জি বলি ইংরিজি উচ্চারণে, ফরাসীতে সেটাই একটু ঠোঁট বেঁকিয়ে বলা হয় অ্যার-জে। ব্যস, সেইটাই হয়ে গেল রেমির নতুন ছদ্মনাম। অ্যার্জে, ফরাসী উচ্চারণপদ্ধতিতে Hergé। তাই কেউ কেউ হার্জ বা হার্জেও বলে থাকেন। 

টিনটিন প্রথম ১৯২৯ সালে প্রকাশিত হলেও, ১৯৫৮ সালে প্রকাশিত দ্য ব্ল্যাক আইল্যান্ড প্রথম ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়, এবং রাতারাতি হার্জে বিখ্যাত হয়ে যান। আর তাঁকে বিশেষ পেছন ফিরে তাকাতে হয় নি। পাঠকদের তুমুল চাহিদায় ততদিন পর্যন্ত প্রকাশিত টিনটিনের সমস্ত বই ইংরেজিতে অনূদিত হয়, এবং ক্রমশ বিশ্বের প্রায় চল্লিশটি ভাষায় অনুবাদ হতে থাকে হার্জের এই অমর সৃষ্টি। জানি না এই ভাষার লিস্টে বাংলা ভাষাও আছে কিনা, তবে বাইবেল, আর আনা ফ্র্যাঙ্কের ডায়েরির পরে টিনটিনের সিরিজ হল বিশ্বের সবথেকে বেশি ভাষায় অনূদিত হওয়া বই।

tintin storyboard Brussels
টিনটিন কমিকস-এর স্টোরিবোর্ড। ছবি শমীক মুখোপাধ্য়ায়।

টিনটিন ছাড়াও হার্জের আরও কিছু কমিক স্ট্রিপ আছে। সেগুলোও বিখ্যাত, তবে টিনটিনের মাপকাঠিতে তারা কাছাকাছিও আসে না। আনন্দমেলার পাঠকরা আরেকটা কমিক স্ট্রিপের কথা মনে করতে পারেন – জো জেট জোকো। কিন্তু টিনটিন নিজে একটা বিশ্বজোড়া ব্যবসার নাম। হার্জ মিউজিয়ামও শুধুমাত্র হার্জ আর টিনটিনকে নিয়েই তৈরি। টিনটিন এক ফেনোমেননের নাম। সেই ফেনোমেননের দেখা পেতে গেছিলাম একদিন। 

ব্রাসেলস থেকে চল্লিশ মিনিটের ট্রেন। ল্যুভেইঁ শহরের বিশ্ববিদ্যালয় ইওরোপের অন্যতম খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়, তার কাছাকাছিই ল্যুভেইঁ-লা-নিউভ আরেকটা ছোট স্টেশন। ব্রাসেলস সেন্ট্রাল থেকে যে ট্রেন ছাড়ে, সেই ট্রেন ধরে ওটিনি নামে একটা স্টেশনে নেমে ট্রেন বদলে একটা স্টপেজ পরেই ল্যুভেইঁ-লা-নিউভ স্টেশন। স্টেশন থেকে দু পা হাঁটলেই একটা অদ্ভুত মায়াবী সাঁকোর মত রাস্তা, আর সেই রাস্তার শেষে একটা ছোট্ট কাচের দরজা। 

তিনতলা এই মিউজিয়াম জুড়ে শুধু হার্জ, টিনটিন আর তার সঙ্গী সমস্ত চরিত্ররা। কীভাবে তারা এল, কীভাবে তৈরি হল, ডলফিনের মত দেখতে সেই সাবমেরিন, লাল সাদা ছক কাটা রকেট, রাজাইজা বিষের শিশি, জনসন-রনসনের সেই বিখ্যাত টুপি আর ছড়ি, কুট্টুসের স্বপ্নের হাড়, এমনকি নটরাজের সেই মূর্তি যার সামনে কুট্টুসকে প্রায় বলি দিয়েই ফেলছিল ভারতীয়রা, সব, সব হাজির মিউজিয়ামের আনাচে কানাচে। হার্জের ছোটবেলার আঁকার খাতা, টিনটিনের আসল রাফ স্কেচ, সব, সব দেখা যায় সেই স্বপ্নের মিউজিয়ামে। একটা ছোট স্যুভেনির শপও আছে, চাইলে কুশন কভার বা নোটবুক কিংবা টিনটিন চরিত্রদের মূর্তি – সবকিছুই পেয়ে যেতে পারেন এখানে। ইউরোপ, বিশেষত বেলজিয়াম বেড়াতে এলে এই মিউজিয়ামটা দেখতে ভুলবেন না।

বহুজাতিক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় কর্মরত, পেশায় ম্যানেজার হলেও ম্যানেজারিটা তেমন আসে না, পরিবারের থেকেও বেশি ভালোবাসে নিজের মোটরসাইকেলটিকে। সুযোগ পেলেই ঘুরে বেড়ানো, আর সেই বেড়ানোর গল্প সবাইকে পড়ানো বিশেষ হবি। এর পরেও সময় বেঁচে গেলে ইতিহাস পড়ে। মানুষের ইতিহাস, যুদ্ধের ইতিহাস, আর ইতিহাসের ইতিহাস।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *