ভিয়েনা থেকে মোরাভিয়ার রাজধানী ব্রুনো হয়ে চেক রিপাবলিকের রাজধানী শহর প্রাগের পথে চলেছি আমরা। আমাদের বোহেমিয়ান ট্রিপ তখন প্রাগ দেখবার উত্তেজনায় জমে দই। এতদিন শুনে এসেছি প্রাগ বা প্রাহা হল এক মায়াময় স্বপ্নপুরী। সোহাগী প্রাগে পৌঁছনোর আগেই সেকথা অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেল লাঞ্চ স্টপ ব্রুনো শহরেই। না জানি প্রাগে পৌঁছে কী দেখব! যেমন অপূর্ব শহরঘেরা নিসর্গ, তেমনি হয়েছে সুন্দর শহরায়নের অগ্রগতি। এ যেন শহুরে তণ্বীকে বিউটিপার্লারে নিয়ে গিয়ে র‍্যাম্পে হাঁটার উপযুক্ত করে গ্রুম করা হয়েছে। তাই সে থৈথৈ রূপলাবণ্যে ভরপুর এবং ঝকঝকে নগরায়নের প্রতিমূর্তি হয়ে রয়েছে আজও।

হালকা ঠাণ্ডার রেশ বাতাসে। বাস থেকে নেমেই হাঁটা শুরু। প্রথমেই প্রাগ কাস্‌ল (চেক ভাষায় Pražský hrad)-এর দিকে পা বাড়াই। এই অভিনব প্রাগ কাস্‌লের মধ্যে পড়ে গথিক স্টাইলের সেন্ট ভিটাস ক্যাথিড্রাল, সেন্ট জর্জ চার্চ, বোহেমিয়ার প্রথম কনভেন্ট, অনেকগুলি বাগান ও প্রতিরক্ষা টাওয়ার, এবং একটি রোমানিস্ক রাজপ্রাসাদ। চেক রিপাবলিককেই মূলত বোহেমিয়া বলা হয়। আর এই দুর্গটি হল বিশ্বের বৃহত্তম এবং প্রাচীনতম দুর্গ, অন্ততঃ গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ড তাই বলে। পাথর বাঁধানো ফুটপাথে পুরনো শহরের বনেদিয়ানা প্রতি পলে অনুভূত হয়।

Prague Astronomical Clock

সেই জগদ্বিখ্যাত অ্যাস্ট্রো-ক্লক। ছবি লেখকের তোলা

হাঁটতে হাঁটতে আর গাইডের মুখে গল্প শুনতে শুনতে পৌঁছে যাই বিশাল টাউন স্কোয়ারে। বিখ্যাত অ্যাস্ট্রোনমিকাল ঘড়ি সম্বলিত ঐতিহাসিক টাওয়ারের সামনে ট্যুরিস্টদের ভিড় উপচে পড়ছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা পায়ের নিচে হোভারবোর্ড লাগিয়ে এমাথা থেকে ওমাথা চষে ফেলছে। এটি বিশ্বের তৃতীয় প্রাচীন অ্যাস্ট্রোনমিকাল ক্লক টাওয়ার। এর অভিনবত্ব হল সৌরমন্ডলের গ্রহবিন্যাস এবং সেইসঙ্গে জ্যোতিষশাস্ত্রে বর্ণিত দ্বাদশ রাশিচক্রের সহাবস্থান। ওল্ড টাউন স্কোয়ারটি হল খোদ ইহুদিদের পাড়া। সেখানে তাদের কবরখানা থেকে মিউজিয়াম, কফিশপ থেকে সুভেনির শপ, সব রয়েছে। দুপুর ঠিক বারোটায় সেই ঘড়ি স্তম্ভে ঘন্টাধ্বনি শোনার পর সংকীর্ণ এক রাস্তার মধ্যে ঢুকে পড়ি আমরা। দুপাশে ইহুদিদের বাড়িঘর। ঘোড়ার গাড়ি চলছে। রাস্তার ধারে কাঠকয়লার আঁচে শুয়োরের মাংস ঝলসানো হচ্ছে। পাশেই বেকারি। টাটকা গরম ব্রেড আভেনে বেক হয়ে বেরুনোর গন্ধে মাত সে পাড়া। সিঁড়ি দিয়ে নেমে আবার গিয়ে উঠি এক রাস্তায়। সেই মসৃণ পাথর বাঁধানো পথ। আশেপাশের সবকিছুই যেন ছবির মত সুন্দর। ছবি আঁকছে কেউ। কেউ নিজের ছবির পসরা সাজিয়ে বিক্রিও করছে। কোথাও এক গেটের মাথায় ছোট্ট এক ট্রামপেট বাজানো ছেলের মূর্তি, কোথাও সিঁড়ির ধারে গিটারবাদক মিহি সুর ছড়িয়ে চলেছে। পাশেই এক বেহালা বাদক করুণ সুরে বাজিয়ে চলেছে।

চোখে পড়ল প্রত্যেকটি ইহুদি বাড়ির দরজায় লাগানো আমাদের দরজার কড়া বা শিকলের অনুরূপ একটি ধাতব ফলক, যাতে হিব্রু অক্ষরে লেখা ইহুদিধর্মের কিছু অনুশাসন। যার অর্থ হল “on the doorstep of your house’ বা “আপনার বাড়ির দরজার চৌকাঠে।সে যুগে প্রত্যেক ইউরোপীয় ধনী পরিবারের একটি করে নিজস্ব চিহ্ন থাকত। তাদের পরিচিতির সেই সিলমোহরটিকে বলা হয় “কোর্ট অফ আর্মস”। তাদের টুপিতে, বাড়ির গায়ে, পোশাকে সেই চিহ্নটি থাকত। এটি ছিল প্রধানতঃ রাজবংশোদ্ভূত পরিবারের বৈশিষ্ট্য।

Kafka cafe

কাফকার বসতবাটি এখন বুটিক কফিশপ। ছবি- লেখক

এইবার প্রাগের সেই সোহাগী দুপুরে হাঁটতে হাঁটতে হাজির হলাম ফ্রান্জ কাফকা স্কোয়ারে। “ক্যাফে কাফকা” ফ্রাঞ্জ কাফকার বসতবাটি ছিল। এখন ব্যুটিক কফিশপ। লেখালেখি করি বলে আচ্ছন্ন হই কিছুক্ষণের জন্য। প্রাগের জার্মানভাষী এক মধ্যবিত্ত ব্যবসায়ী পরিবারে জন্ম হয়েছিল সাহিত্যিক ফ্রান্জ কাফকার। জাতে ইহুদি। কেমিষ্ট্রি পড়তে চেয়েও পরিবারের ইচ্ছেয় পড়তে হয়েছিল আইন। তারপর চাকরি হল এক বিমা সংস্থায়। লেখালিখি নেশা হলেও প্রায়শ‌ই বিরত থাকতে হত কাজের তাগিদে। জার্মান দার্শনিক, কবি গ্যেটে-অন্তপ্রাণ ছিলেন কাফকা। কিছু বোহেমিয়ান পত্রপত্রিকায় একে একে তাঁর লেখা ছোটগল্প প্রকাশিত হতে লাগল। সাহিত্যজীবন যখন মধ্যগগনে তখনই, মাত্র চল্লিশ বছর বয়সেই দুরারোগ্য ক্ষয় রোগে আক্রান্ত হয়ে চলে যেতে হল পৃথিবী থেকে। তখন এই রোগের ভাল ওষুধ ছিল না। তিনি ছিলেন পরিবারের জ্যেষ্ঠপুত্র। বাকি পাঁচ ভাইবোনের মৃত্যু হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাত্সীদের বীভৎস ইহুদি নিধন যজ্ঞ হলোকস্টে। মৃত্যুর আগে কাফকা নিজের প্রিয়তম বন্ধুকে লেখেন “ Dearest Max, my last request, Everything I leave behind me … in the way of diaries, manuscripts, letters (my own and others), sketches, and so on, is to be burned unread” … এমনটিই ছিল সাহিত্য অনুরাগী কাফকার একান্ত ইচ্ছে।

মৃত্যুর আগে নিজের সুহৃদ, সাহিত্যানুরাগী ম্যাক্স ব্রোডকে চিঠি লিখে বারণ করে গিয়েছিলেন অপ্রকাশিত লেখাগুলি ছাপতে। বরং অনুরোধ করেছিলেন লেখাগুলি নষ্ট করে দিতে। কিন্তু ব্রোডে সে কথা রাখতে পারেননি! ভাগ্যিস! একে একে তিনি প্রকাশ করেছিলেন কাফকার ছোটগল্প সংকলন এবং উপন্যাস। জীবিত অবস্থায় কাফকার প্রথম ১৮টি ছোটগল্পের সংকলন “Betrachtung’ বেশ সাড়া ফেলে দিয়েছিল, যার অর্থ হল Contemplation বা বাংলায় চিন্তন। লেখক জীবন বুঝি এমনি হয়। নিজের জীবদ্দশায় তাঁরা ব্রাত্য হয়েই থাকেন। আর মৃত্যুর পরে তাঁদের ভাগ্য খোলে। তাঁদের নিয়ে প্রকাশক, মিডিয়া ব্যবসা করে খায়। সেই কথায় বলে না, ‘জ্যান্তে দিল না দানাপানি, মরণের পরে তারে মানি!” কাফকার বেলাতেও ঠিক সেইটাই হয়েছিল।

তাঁর মৃত্যুর পরেই সাড়া পড়ে গেল প্রাগে। তাঁকে ও তাঁর রচনাবলীকে উত্সর্গ করে তৈরী হল ফ্রান্জ কাফকা মিউজিয়াম। তাঁর জন্মভিটেয় তাঁর স্মরণে তৈরী হল স্মৃতিফলক। প্রাগের টাউনস্কোয়ারে তৈরী হল ব্রোঞ্জ মূর্তি। ২০০১ সালে ফ্রানজ কাফকা সোসাইটি তাঁর নামে চালু করল বেস্ট লিটারারি এওয়ার্ড। এমন কি মার্কিন এক বিশ্ববিদ্যালয়ে কাফকা প্রজেক্ট নামে গবেষণাও হয় এখন। কিন্তু ফ্রান্জ কাফকা এসব কিছুই দেখে যেতে পারেননি। তাঁর বিখ্যাত নভেলা “মেটামরফোসিস’ এখন পশ্চিমী কলেজের পাঠ্যপুস্তক। ঘুরে ঘুরে এতসব জানতে গিয়ে কেমন যেন অতীতচারী হয়ে পড়লাম।

kafka home

কাফকার জন্মস্থান। তাঁর বাড়ি। ছবি- লেখক

প্রাগের কফিশপে তাঁর নাম। রেস্তোঁরার প্রবেশদ্বারে তাঁর ছবি। কেউ বলে এই বাড়িতে তিনি শুধুই গিটার বাজাতে আর কফি খেতে যেতেন। তবে যাহা রটে তাহা কিছু বটে। এই পাথর বাঁধানো ফুটপাথে কাফকা হেঁটেছিলেন কোনও একসময়ে সেটাই সেই মূহুর্তে চিরসত্য আমার কাছে। আমাদের শান্তিনিকেতন আর রবিঠাকুর, প্রাগের মানুষের ফ্রানজ কাফকা। সেই অঞ্চলে কী ফোটো তোলার হিড়িক! ডিজিটাল ক্লিকে আর সেলফি তোলার উন্মাদনায় মত্ত ভ্রমণপিপাসুরা। কফিশপের কফিও বেশ মহার্ঘ্য। তবুও সেই মুহূর্তে এক কাপ সাদামাটা ক্যাপুচিনোর আসল মূল্য আমার কাছে অনেক বেশি ঠেকল।

কাফকার বসতবাড়ি ফেলে রেখে ভ্লাতাভা নদীর ধার দিয়ে হেঁটে চলি। ফুরিয়ে আসে অলস সেই অপরাহ্নের মূহূর্তেরা। হঠাত মোলাকাত এক চেক আর্টিষ্টের সঙ্গে। সকালবেলায় দেখেছিলাম রাস্তার ধারে পসরা সাজিয়ে বসে নিজের হাতে আঁকা ছবি বিক্রি করছিলেন। ছবির বিষয় প্রাগ, ভ্লাতাভা নদী, প্রকৃতি, গির্জা, মধ্যযুগীয় প্রাসাদ আরও কতকিছু। দিনের শেষে ঘরে ফেরার সময় হাতে বেশ কিছু প্রাগ কারেন্সি পড়ে আছে দেখে কিনে ফেলি সেই বৃদ্ধ শিল্পীর কাছ থেকে একখানা ছোট্ট অরিজিনাল পেন্টিং। পাশে দাঁড়িয়ে ছবিও তুলেনি চট করে। এবার ছোট্ট দিবানিদ্রা। ছবির মধ্যে থেকে উঠে আসা কেউ তখন আমায় শোনায় মধ্যযুগীয় প্রাসাদের গল্প। তন্দ্রা আর নিদ্রার সন্ধিক্ষণে পৌঁছতেই দেখি হোটেল।সূর্যাস্তের ডুবজলে তখনো ভ্লাতাভা নদীর তীরে দাঁড়িয়ে ফ্রানজ কাফকা!

Indira Mukhopadhyay Author

রসায়নের ছাত্রী ইন্দিরা আদ্যোপান্ত হোমমেকার। তবে গত এক দশকেরও বেশি সময় যাবৎ সাহিত্যচর্চা করছেন নিয়মিত। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায় এহং প্রথম উপন্যাস সানন্দায় প্রকাশিত হয়। বেশ কিছু বইও প্রকাশিত হয়েছে ইতিমধ্যেই। সব নামীদামি পত্রিকা এবং ই-ম্যাগাজিনের নিয়মিত লেখেন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, রম্যরচনা ও প্রবন্ধ।

4 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *