অটোরিক্সা থেকে নেমে পি.ডি. সামনের দিকে তাকিয়ে বলল “বাহ!, কেল্লাটা তো বেশ জম্পেশ দেখতে। আশা করি এখানে একটু জম্পেশ আমিষ খাবার দাবার পাওয়া যাবে। একটানা দুদিন ধরে নিরামিষ খাবার আর পোষাচ্ছে না।“ পি.ডি. র ভাল নাম পরমন্তপ দাশগুপ্ত। নামটা উচ্চারণ করতে অনেকেরই জিভে জড়তা এসে যায় বলে আমরা বন্ধু বান্ধবরা ওকে পি.ডি. সম্বোধন করে থাকি।
পি.ডি. আর তার বউ ডালিয়ার সঙ্গে বেশ কয়েক বছর আগে মহারাষ্ট্রের কোঙ্কন সমুদ্র উপকূলের কাছে একটা লম্বা সফরে গিয়েছিলাম। সে বার প্রচুর অখ্যাত কিন্তু অপরূপ সুন্দর কিছু সমুদ্র সৈকতে যাওয়া ছাড়া বেশ কিছু মারাঠিদের অধিকৃত কেল্লাতেও ঢুঁ মারা হয়েছিল। আমরা সে বার সিন্ধদুর্গ জেলার মধ্যেই ঘোরাফেরা করেছিলাম। ওই জেলার সব চাইতে বিখ্যাত কেল্লা সিন্ধদুর্গ হলেও, সব চাইতে পুরনো ও দুর্ভেদ্য কেল্লা হল বিজয়দুর্গ। মারাঠা বীর শিবাজী যে দুটি দুর্গে মারাঠা পতাকা নিজে হাতে উত্তোলন কর্রেছিলেন এটি তার মধ্যে একটি। অন্যটি হল তোর্না দুর্গ।
কোঙ্কন সমুদ্রতটের আশেপাশে খাওয়াদাওয়ার ব্যাবস্থা বেশ ভালই ছিল। আমরা মূলতঃ জেলেদের গ্রামে থাকতাম। অনেকের সামুদ্রিক মাছে আপত্তি থাকলেও , আমরা তিন জনে কোঙ্কনী স্টাইলে রান্না করা নানা রকম মাছ চেটেপুটে খেতাম।
সমস্যা হল আমাদের শেষ গন্তব্যস্থলে পৌঁছনোর পর। সে জায়গাটির নাম কুঙ্কেশ্বর। সিন্ধদুর্গ কেল্লা দেখে কুঙ্কেশ্বর পৌঁছে আবিষ্কার করলাম যে জায়গাটিতে সমুদ্রতটের পাশে যে হেতু একটি বিখ্যাত মন্দির রয়েছে , সেই জন্য আশেপাশে নিরামিষ খাবার ছাড়া কিছুই পাওয়া যায় না। কুঙ্কেশ্বর পৌঁছানোর পরের দিন আমরা মন্দির চত্বর ও তার পাশের সি-বিচ সকালের নরম আলোয় দেখে ব্রেকফাস্ট সেরে নিলাম। আবার সেই নিরামিষ ব্রেকফাস্ট। এর পর অসামান্য তারা মুম্বরি সমুদ্রসৈকত দেখে পৌঁছলাম দেবগড় কেল্লায়। এই কেল্লাটা দেখে একটু নিরাশ হয়েছিলাম কারণ কেল্লার ল্যাটেরাইট পাথরের প্রাচীর ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। একটা পুঁচকে কামান ছাড়া বিশেষ কিছু নেই। দেবগড় সমুদ্রতট অবশ্য আমাদের নিরাশ করেনি।
দেবগড় থেকে বিজয়দুর্গের দূরত্ব চব্বিশ কিলোমিটার। প্রথম দর্শনেই বিজয়দুর্গ বেশ চিত্তাকর্ষক লাগে। কেল্লাটি ৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ ভাঘোটান খাঁড়ির মোহনার কাছে একটা উঁচু টিলার উপর অবস্থিত। ল্যাটেরাইট পাথর দিয়ে নির্মিত দুর্গের দেয়াল কম বেশি অক্ষত। আমরা যখন গিয়েছিলাম মনে হয়েছিল কেল্লাটির মেরামতির প্রয়োজন আছে। বিজয়দুর্গ তিনদিকে জল দিয়ে ঘেরা বলেই এত দুর্ভেদ্য ছিল। এক দিকে আরব সাগর, অন্য দু’দিকে ভাঘোটান খাঁড়ির মোহনা।
বিজয়দুর্গ কেল্লাকে ‘ঘেরিয়া’ বলা হত। খুব সম্ভবতঃ গিরয়ে গ্রামের কাছে অবস্থিত বলেই এর পুরানো নাম ছিল ঘেরিয়া।”
কেল্লার মূল প্রবেশ দ্বার মনে হয় অনেক কাল আগেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ভিতরে ঢুকলেই চোখে পড়ে যে প্রাচীরের পাশ দিয়ে একটা রাস্তা চলে গেছে। এই রাস্তার বাঁ পাশেই ঠিক খাঁড়ির পাড় বরাবর একটা ছোট উচ্চতার দেওয়াল রয়েছে। রাস্তার ঢোকার মুখেই এই দেওয়ালের ফাঁক কয়েকটা ধাপ নেমে গেছে খাঁড়ির দিকে। এখানেই কয়েকটা ছোট মাছ ধরার নৌকো দাঁড়িয়ে থাকে। জেলেরা এইখান থেকেই মাছ ধরতে বেরিয়ে পড়ে। কেল্লার সুউচ্চ প্রাচীরের পাশ দিয়ে যেতে ডালিয়া বলল, “এই কেল্লা বানাতে মারাঠাদের অনেক সময় লেগেছিল নিশ্চই।”
“ উঁহু” মাথা নাড়ল পি.ডি। “এই কেল্লা মারাঠারা বানায়নি।”
“সে কী?” অবাক চোখে তাকিয়ে বলল ডালিয়া “তাহলে এটা তৈরি করেছিল কারা ?”
“এই কেল্লার মূল কাঠামো তৈরি হয়েছিল খুব সম্ভবত ১২০০ খ্রিস্টাব্দে।” বলল পি.ডি। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে শুধোল “গল্পটা বলবে নাকি? তুমি তো বেশ ভাল গল্প বলতে পার।”
“যথা আজ্ঞা। তবে আগে চলো কেল্লার মধ্যে ঢুকি।” এই বলে পা চালিয়ে প্রাচীরের গায়ের ছোট প্রবেশ দ্বার দিয়ে কেল্লার মূল প্রাঙ্গনের মধ্যে ঢুকে পড়লাম। পি.ডি ও ডালিয়াও পিছন পিছন ঢুকে পড়ল।
দুর্গের ভেতরে ঢুকেই প্রথম যে জিনিসটি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল তা হল মাটির উপর রাখা বেশ কয়েকটি লোহার বল। এগুলো আসলে কামানের গোলা। অদূরেই অযত্নে পড়ে আছে একটি কামান।
গেট থেকে বাঁ দিকে ঘুরলেই ছোট দরজা-সহ একটি পাথর নির্মিত ঘর চোখে পড়ে। ঘরটি খুব অন্ধকার, কোনও জানালা নেই। এককালে এটি কালবৎখানা বা গোপনীয় আলোচনার কক্ষ ছিল। কালবৎখানার পাশ দিয়ে কয়েকটা সিঁড়ির ধাপ উঠে গেছে। এটি আপনাকে কেল্লার প্রাচীরের উপরে নিয়ে যাবে। প্রাচীরটি বেশ চওড়া। একসময় এই প্রাচীর ধরে পুরো কেল্লাটা ঘুরে দেখা সম্ভব ছিল। দুর্ভাগ্যক্রমে বর্তমানে প্রাচীরের একটি অঞ্চল ভেঙে গেছে।
প্রাচীরের উপরে বিভিন্ন জায়গায় বুরুজ তৈরি করা হয়েছিল। সে রকম একটা বুরুজের উপর দাঁড়িয়ে পি.ডি. বলল, “এই সব জায়গা থেকেই শত্রুপক্ষের জাহাজের উপর কামান দাগা হত। আগেকার দিনে যেমন বিখ্যাত বীরের নামে কামানের নামকরণ করা হত, তেমনি এখানে বুরুজগুলো মারাঠি বীরদের নামে হতো। এদের মধ্যে একটা শিবাজী বুরুজ রয়েছে।”
বুরুজ থেকে নিচের রাস্তা, ভাঘোটান খাঁড়ি, এমনকি অনেক দূরে একটা ডক চোখে পড়ছিল। দেখলাম যন্ত্রচালিত চারটে মাছ ধরার নৌকো খাঁড়ি ধরে মোহানার দিকে এগিয়ে চলেছে। ওই দিকেই তাকিয়ে ছিলাম দেখে পি. ডি একটু হেসে বলল “কী, তোমার কি ওই মাছ ধরা নৌকো দেখে গালিভাটগুলোর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে ?”
আমিও একটু হেসে বললাম “তা তো যাচ্ছেই। তাছাড়া ওই দিগন্তে সমুদ্রের উপর অনেক পাল তোলা যুদ্ধ জাহাজ দেখতে পাচ্ছি যেন। এই সময়ে একটা টাইম মেশিন পেলে ভালো হত।”
“অসাধারণ।” মুচকি হেসে বলল পি. ডি । তারপর যোগ করল “এবার গল্পটা বল। ডালিয়া অধৈর্য হয়ে পড়ছে।”
ডালিয়া মুখ ব্যাজার করে বলল “হ্যাঁ, প্লিজ গল্পটা বল। তোমাদের এই ইশারায় কথাবার্তা শুনতে চাই না।”
আমি বলা শুরু করলাম।
“সেটা ছিল ১৬৫৩ সাল। শিবাজী মহারাজ বিজাপুরের আদিল শাহকে পরাজিত করে এই দুর্গটি দখল করেছিলেন। শিবাজী এর নামকরণ করেছিলেন “বিজয়দুর্গ“। দুর্গের আসল নাম ছিল “ঘেরিয়া” সে কথা আগেই বলা হয়েছে। আদতে এই দুর্গটি ১২০০ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় রাজা ভোজের শাসনকালে তৈরি হয়েছিল বলে মনে হয়। শিবাজি মারাঠা যুদ্ধজাহাজের গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি হিসাবে বিজয়দুর্গকে তৈরি করেছিলেন। উনি দুর্গটিকে ঢেলে সাজিয়ে আরও দুর্ভেদ্য করেছিলেন। কাছাকাছি যুদ্ধজাহাজের একটা বড় পোতাঙ্গন বা ডকইয়ার্ড তৈরি করা হয়েছিল।” এই পর্যন্ত বলা হতেই ডালিয়া একটু উত্তেজিত হয়ে বলল “তার মানে ওই দূরে খাঁড়ির পাড়ে যে ডক দেখা যাচ্ছে, ওটাই কি সেইটা ?”
পি.ডি. মুখের মধ্যে একটা বিরক্তির শব্দ করে বলল, “আরে না, ওটা নয়। ওটা বেশি দিনের নয়। সেই পোতাঙ্গনের ধ্বংসাশেষ এখান থেকে তিন কিলোমিটার দূরে রয়েছে।”
আমি আবার বলা শুরু করলাম। “এই দুর্গ শিবাজী জয় করলেও এর আসল নায়ক কিন্তু মারাঠা নৌবাহিনীর প্রধান কাহ্নজি আংগ্রে। যদিও তিনি মারাঠা রাজ্যের ছত্রপতি ছিলেন না, কিন্তু এই কোঙ্কন অঞ্চলে তাঁর একচেটিয়া দাপট ছিল। তিনি এই এলাকার অধিপতি হয়ে ওঠেন তারাবাঈয়ের রাজত্বকালে। তারবাঈয়ের গল্পটা নিশ্চই জানা আছে?”
“মোটামুটি। ১৬৮৯ সালে শিবাজীর প্রথম স্ত্রীর পুত্র শম্ভাজীকে আওরঙ্গজেবের আদেশে বন্দি করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। শিবাজির দ্বিতীয় স্ত্রী, পুত্র রাজারাম মারাঠা সাম্রাজ্যের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তিনিও বেশিদিন টিঁকলেন না । ১৭০০ সালে রাজারাম মারা যাওয়ার পর তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী তারাবাঈ নিজের শিশুপুত্রকে তৎক্ষণাৎ রাজারামের উত্তরসূরি হিসাবে সিংহাসনে বসিয়ে ১৭০১ থেকে ১৭০৭ পর্যন্ত বকলমে রাজ্যশাসন করেছিলেন।” বলল ডালিয়া
“ফুল মার্কস।” বলল পি.ডি.।
আমি বলে চললাম – “রাজারামের আমলেই কাহ্নোজি আংগ্রেকে সুরখেল (অ্য়াডমিরাল) পদ দেওয়া হয় এবং ১৬৯৮ খ্রিস্টাব্দে কাহ্নোজী বিজয়দুর্গকে কোঙ্কন এলাকার রাজধানী করে দেন। রাজারামের মৃত্যুর পর মারাঠা সাম্রাজ্যের যখন টালমাটাল অবস্থা তখন কাহ্নোজী এই এলাকার একছত্র অধিপতি হয়ে উঠেছিলেন। আরও অনেক কেল্লা তাঁর অধীনে থাকলেও বিজয়দুর্গ তাঁর প্রধান ঘাঁটি হয়ে ওঠে।”
“তুমি কি বলতে চাও যে মারাঠা সাম্রাজ্যের অবস্থার অবনতি হওয়ার সুযোগটা কাহ্নোজি নিজের একটা আলাদা রাজ্যপাট তৈরি করতে কাজে লাগিয়েছিলেন?” জানতে চাইল ডালিয়া।
“তা সে কতকটা তো বটেই। তবে কাহ্নোজির প্রধান লড়াইটা ছিল পর্তুগিজদের বিরুদ্ধে। পর্তুগিজরা মারাঠা সাম্রাজ্যের সার্বভৌমত্বের উপরে কর্তৃত্ব করার চেষ্টা করেছিল। আর সেটাই হল পর্তুগিজদের বিরুদ্ধে কাহ্নোজির লড়াইয়ের আসল কারণ। ওদিকে তারাবাঈ যখন মোগলদের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছেন, কাহ্নোজি কোঙ্কন উপকূলে পর্তুগিজদের বাড়বাড়ন্ত ঠেকাতে গেরিলা স্টাইলে আক্রমণ করছেন।” বললাম আমি।
“আর এইখানেই গালিভাটের গল্পটা আসছে।” পাশ থেকে বলে উঠলো পি.ডি। “তখন থেকে দুজনে মিলে এই একটা কথা বলে চলেছ। এই গালিভাট জিনিসটা কী? খায় না মাথায় দেয়?” একটু বিরক্ত হয়ে বলল ডালিয়া।
“গালিভাট হল এক ধরনের দাঁড় টানা নৌকা। একটা কী দুটো মাস্তুল থাকত। পালগুলো হত তেকোনা। মোটামুটি ২০ জন দাঁড় টানত। সাধারণতঃ ৭০ টনের বেশি হত না। কয়েকটা ছোট ছোট কামান নিয়ে গোলন্দাজরা তাক করে বসে থাকত। এর সঙ্গে থাকত এক ধরনের মাঝারি সাইজের যুদ্ধজাহাজ, যার নাম ছিল গ্র্যাব। এগুলোর ধারণ-ক্ষমতা ১৫০ থেকে ৫০০ টনের মধ্যে হত। এগুলো অগভীর জলেও খুব দ্রুতগতিতে যেতে পারত। কাহ্নোজির নৌবাহিনীর ঘাঁটি ছিল এই বিজয়দুর্গের কাছেই খাঁড়ির পাশে। এইখান থেকে যখন এক সঙ্গে অনেকগুলো গালিভাট আর গ্রাবের নৌবাহিনী এক সঙ্গে কোনও পর্তুগিজ জাহাজকে আক্রমণ করত, তাদের পালাবার পথ থাকত না। দরকার মতো এরা খাঁড়ির ভিতরে পালিয়ে আসতে পারত। অগভীর জলে বড় জাহাজ এদের ধাওয়া করতে পারত না। এছাড়া সাম্প্রতিক কালের অনুসন্ধানে দুর্গের পশ্চিম দিকে জলের তলায় পাথরের ব্লক দিয়ে নির্মিত বিশাল পাথরের কাঠামো আবিষ্কার করা হয়েছে। অনুমান করা হয় এটা মারাঠাদের তৈরি এবং কোনও জাহাজ যাতে দুর্গের খুব কাছাকাছি না আসতে পারে তার জন্য এটা তৈরি করা হয়েছিল।”
একটু থেমে বললাম “ আশা করি ব্যাপারটা বোঝাতে পেরেছি।”
“জলের মতো পরিষ্কার। স্থল পথে গেরিলা যুদ্ধ শুনেছি, কিন্তু জল পথে গেরিলা যুদ্ধ এই প্ৰথম শুনলাম।” জানাল ডালিয়া।
“ইতিহাস অনেক হল, চলো এ বার কেল্লার বাকিটা দেখা যাক।” বলে পি.ডি সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল ।
সিঁড়ি দিয়ে নেমে কিছুটা যাওয়ার পর আর একটা ঘর চোখে পড়ল। এটা বারুদঘর ছিল। এর পাশ দিয়ে আবার একটা সিঁড়ি প্রাচীরের দিকে উঠে গেছে। এই দিকের বুরুজটা অনেকটাই অক্ষত। কামান রাখার জায়গাগুলো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। সিঁড়ির উল্টোদিকেই ছাতবিহীন একটা বিশাল বড় ঘর। এইটাই ছিল কাহ্নোজির দরবার ঘর যেখানে গুরুত্বপূর্ণ সব আলোচনা হত । এইখান থেকে কয়েক পা এগোলেই একটা সুড়ঙ্গপথ, যেটা দিয়ে কেল্লার অন্য একটা অংশে পৌঁছে যাওয়া যায়। সেখানে একটা দোতলা বড় বাড়ি রয়েছে যেটা কিনা একসময় গুদাম ছিল। এছাড়া জলের ট্যাংক, রানির মহল, ইত্যাদি আরও অনেক ছোটখাটো স্থাপত্য রয়েছে। রানির মহলের কয়েকটি দেওয়াল ছাড়া কিছু নেই । তবে এই প্রথম একটা বাড়ি বা ঘর চোখে পড়ল যেটায় অনেকগুলো জানালা রয়েছে।

রাজস্থানের কেল্লার সঙ্গে এখানকার অধিকাংশ কেল্লাগুলোর তফাৎ হলো এগুলো একটু কাঠখোট্টা ধরনের। ঘরগুলো বেশ প্রিমিটিভ, বিশেষ যত্ন নিয়ে বানানো নয়। যেন শুধু দুর্গটাকে দুর্ভেদ্য করাই প্রধান কাজ ছিল। দেখে মনে হয় মূলতঃ শত্রু আক্রমণ প্রতিহত করার জন্যই এগুলো বানানো হয়েছিল।
আমরা দুর্গের উত্তর দিকে চলে এসেছিলাম। এদিকের বুরুজ থেকে খাঁড়ির মোহানাটা পরিষ্কার দেখা যায়। এখানে এসে দেওয়ালে হেলান দিয়ে ডালিয়া প্রশ্ন করল “এই এলাকায় কাহ্নোজির দাপট কত বছর ধরে ছিল?”
“কাহ্নোজির দাপট? সে তো তাঁর শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত ছিল। এটা মাথায় রাখতে হবে যে পর্তুগিজরা ভারতবর্ষে ১৪৯৮ সালে এদেশে এসেছিল। মানে কাহ্নোজি যখন মাঠে নেমেছিলেন তখন পর্তুগিজরা ২০০ বছরের বেশি এদেশে রয়েছে। ইংরেজরা তখন সবে এদেশে হামা দিতে শিখেছে | পর্তুগিজদের সঙ্গে ফ্যামিলি রিলেশন তৈরি করছে। মানে এলাকার দাদা আর কি। সেই সময় যত বাণিজ্যিক জাহাজ এ চত্বর দিয়ে যেত, সবার কাছ থেকেই পর্তুগিজরা একটা টাকা চেয়ে বসেছিল। তার বদলে পর্তুগিজরা এই জাহাজগুলোকে জলদস্যুদের হাত থেকে রক্ষা করবে। এইখানেই কাহ্নোজি বাধা দিয়েছিলেন। বলেছিলেন এই এলাকা তাঁদের। এইখান দিয়ে যে যে জাহাজ যাবে তাদের মারাঠাদের নিজস্ব ট্যাক্স ‘দস্তক’ দিতে হবে।” একটানা বলে থামলাম আমি
“সোজা কথায় হপ্তা তোলা নিয়ে মারপিট। একটু বড় লেভেলে।” ফোড়ন কাটল পি.ডি.।
আমি বলে চললাম – “বিজয়দুর্গের পজিশনটা বেশ যুৎসই ছিল। যে যে জাহাজ গোয়া বা কালিকট হয়ে মুম্বই যাবে তাদের এখান দিয়ে যেতেই হবে। সুতরাং “দস্তক” না দিলে মস্তক যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা। কাহ্নোজি জানতেন তাঁর প্রচুর বড় নৌবহর নেই। তাই গেরিলা কায়দায় যুদ্ধ ছাড়া গতি নেই। এই বিজয়দুর্গের কাছেই গালিভাট আর গ্র্যাবগুলো পজিশন নিয়ে তৈরি থাকত। কেউ ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেই আক্রমণ। এই যে বুরুজটার উপর দাঁড়িয়ে আছি, এইখান থেকেই মনে হয় ব্যাপারটা সবচাইতে ভাল পর্যবেক্ষণ করা যেত । ১৭০০ থেকে ১৭১৩ পর্যন্ত বিজয়দুর্গকে প্রধান ঘাঁটি বানিয়ে কাহ্নোজি প্রচুর জাহাজ আটক করেছিলেন। ১৭১৩ থেকে ১৭১৫ ব্রিটিশদের সঙ্গে একটা সন্ধি হয়েছিল বটে কিন্তু সেটা বেশিদিন টেঁকেনি।”
“বিজয়দুর্গের উপর সোজাসুজি আক্রমণ হয়েছিল?” জানতে চাইল ডালিয়া।
“কাহ্নোজি জীবিত থাকাকালীন দুবার বড় আক্রমণ হয়েছিল। ১৭২০ সালে ব্রিটিশরা পূর্ণ শক্তি দিয়ে বিজয়দুর্গের উপর আক্রমণ করেছিল। লাভের লাভ কিছুই হয়নি। বিজয়দুর্গের দেওয়ালে ওরা একটা আঁচড়ও কাটতে পারেনি, ভিতরে ঢোকা তো দূর অস্ত।১৭২৪ সালে ডাচ সৈন্যদল একটা চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তারাও ঢুকতে পারেনি। আসলে ততদিনে কাহ্নজি নিজেই একটা বড় শক্তি হয়ে গিয়েছিলেন।”
“সেটা বোধহয় তারাবাঈয়ের পরের জমানায়?” জানতে চাইল ডালিয়া।
“একদম ঠিক। শম্ভাজির সঙ্গে তাঁর শিশুপুত্র সাহুকেও মোগলরা বন্দি করেছিল। ১৭০৭ সালে আওরঙ্গজেব মারা যাওয়ার পর মোগলরা শম্ভাজির ছেলে সাহুকে কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে দেয়। তাঁর বয়স তখন পঁচিশ। মুক্তি পেয়েই সাহু মারাঠা সাম্রাজ্যের আসল উত্তরাধিকারী হিসেবে সিংহাসন দাবি করে বসেন এবং মসনদ আদায় করে ছাড়েন। সেই বছরেই ছত্রপতি সাহু তার প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে কাহ্নোজির সঙ্গে একটা সমঝোতায় আসেন। কাহ্নোজিকে তারাবাঈয়ের প্রতি তার আনুগত্য ছাড়তে বলা হয়। তার বদলে সাহু কাহ্নোজিকে ২৬টি দুর্গের অধিপতি করে সাহুর মারাঠা নৌবাহিনীর প্রধান নিযুক্ত করেন। কাহ্নোজি এতে রাজি হয়ে যান। তারপর থেকেই কাহ্নোজির বাড়বাড়ন্ত। ওঁর বাহিনীতে শুধু মারাঠারা ছিল না, প্রচুর ইউরোপিয়ানও ছিল।”
বেলা পড়ে আসছিল। আমাদের কোঙ্কন অভিযানে আমরা দারুন সব সূর্যাস্ত দেখেছি। আকাশের অবস্থা দেখে মনে হল আজও তার ব্যতিক্রম হবে না। বিজয়দুর্গের অন্যপাশেই সেখানকার সমুদ্র সৈকত। বিজয়দুর্গ থেকে বেরিয়ে সমুদ্র সৈকতের দিকে পা বাড়ালাম। ততক্ষণে সন্ধের আকাশ রঙের খেলা দেখাতে আরম্ভ করেছে। সমুদ্র সৈকতে কিছু ছেলেপুলে ক্রিকেট খেলছিল । আমরা ওখানে বসে সূর্যাস্তের কিছু ছবি তুলে যাবার জন্য পা বাড়ালাম।
বিজয়দুর্গের পাশেই একটা ছোট রেস্তোঁরা ছিল। সেখানকার এক ওয়েটার দেখলাম বাঙালি। সে আমাদের সঙ্গে গল্প জুড়ে দিল । ভাগ্য ভাল ওই দোকানে চিকেন ড্রামস্টিক পাওয়া যাচ্ছিল। চিকেনের ঠ্যাং চিবোতে চিবোতে পি.ডি. বলল “আহ, এতক্ষণে একটু ধড়ে প্রাণ এল।
“শেষমেশ তো ইংরেজরা বিজয়দুর্গের দখল নিতে পেরেছিল। তাই না? সেটা কী ভাবে সম্ভব হল ?” জানতে চাইল ডালিয়া।
“ভারতবর্ষের অধিকাংশ দুর্গ যেভাবে দখল হয়েছিল ঠিক সেই ভাবে। ঘর শত্রু বিভীষণদের দ্বারা। ১৭২৯ সালে কাহ্নোজির মৃত্যুর পর শেষের দিকে তাঁর এক ছেলে তুলাজি কিছুটা বাবার মত দাপুটে স্বভাব দেখাতে পেরেছিলেন। তিনিও ইংরেজদের অনেক জাহাজ দখল করেছিলেন। ছত্রপতি সাহু তুলাজিকে তাঁর বাবার পদটি দিয়েছিলেন, মানে সেই নৌবাহিনীর প্রধানের পদ। বালাজি বাজী রাও ছিলেন ছত্রপতি সাহুর পেশওয়া, মানে প্রধানমন্ত্রী। তাঁকে তুলাজি পাত্তা দিতেন না। ছত্রপতি সাহু যতদিন বেঁচে ছিলেন বালাজি বাজী রাও চুপচাপ ছিলেন। যেই ছত্রপতি সাহু মারা গেলেন আর বালাজি বাজী রাওয়ের হাতে ক্ষমতা চলে এল, অমনি তাঁর ঈর্ষা আর লোভ মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। ইংরেজদের সঙ্গে চুক্তি করে তিনি তাঁদের সাহায্যে আংগ্রে পরিবারের সমস্ত দুর্গ হাতানোর চক্রান্ত করলেন। চুক্তির একটা শর্ত ছিল যে বিজয়দুর্গের মালিকানা তাঁকে দিতে হবে। ইংরেজরা তো এটাই চাইছিল। যে দুর্গের জন্য ৫০ বছর ধরে তাদের আংগ্রে পরিবারের হাতে ক্রমাগত হেনস্থা হতে হয়েছে, তার প্রতিশোধ নেওয়ার এর থেকে ভালো উপায় কী আছে। এদের যৌথ আক্রমণে শেষ পর্যন্ত তুলাজি আংগ্রে হার মানলেন আর বিজয়দুর্গের পতন হল। ১৭৫৬ সালের ১১ মার্চ রবার্ট ক্লাইভ তাঁর নৌসেনাবাহিনী নিয়ে বিজয়দুর্গ দখল করলেন। পলাশীর যুদ্ধের প্রায় এক বছর আগে।”
আমরা খাওয়াদাওয়া সেরে রাস্তায় নেমে এলাম। সন্ধের আকাশের নিচে বিজয়দুর্গের বিশাল অবয়ব নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, কত শত যুদ্ধের সাক্ষী হয়ে। “যাই বল, তুলাজি লোকটার কিন্তু কপাল খারাপ ছিল। হয়তো শেষমেশ হেরে যেত, কিন্তু যে ভাবে হারল সেটা কপাল খারাপ ছাড়া কিছু নয়।” মৌরি চিবুতে চিবুতে বলল পি.ডি। আমি জবাব দিলাম না। ডালিয়া একটু অবাক চোখে তাকিয়ে বলল “কপাল খারাপ মানে? ছত্রপতি সাহু তো একদিন না একদিন মারা যেতেন। তখন তো এটা হতই।”
পি.ডি মাথা নেড়ে বলল, “সে জন্য কপাল খারাপ বলিনি। যুদ্ধের আগে মারাঠাদের যাবতীয় জাহাজ, গ্র্যাব ও গালিভাট সারিবদ্ধ হয়ে খাঁড়ির মুখে আক্রমণ করার জন্য তৈরি হয়ে ছিল। এই নৌবাহিনীর আক্রমণ সামলে তবেই ইংরেজরা বিজয়দুর্গ পর্যন্ত পৌঁছতে পারত। অমিতাভদা একটু আগে বলল যে তুলাজি ইংরেজদের অনেক জাহাজ দখল করে নিজের নৌবহরে যুক্ত করেছিলেন। তার মধ্যে একটি জাহাজ ছিল রেস্টোরেশন। সমস্যা হলো যে এই রেস্টোরেশন জাহাজটিতে আগুন ধরে গিয়েছিল।সেখান থেকে বাকি জাহাজগুলোতে দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ল। দেখতে দেখতে কাহ্নোজি আংগ্রের তিল তিল করে গড়ে তোলা দোর্দন্ডপ্রতাপ মারাঠা নৌবহর নিমেষের মধ্যে পুড়ে ছাই হয়ে গেল। তুলাজি শেষ মুহূর্তে পেশওয়ার সঙ্গে একটা সন্ধি করার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তাতে লাভ হয়নি।”
আমরা কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। বিজয়দুর্গের সামনের আকাশে তখন সূর্যাস্তের আলোর অপূর্ব খেলা চলছে। সেই দিকে তাকিয়ে মনে হলে এটা যেন সূর্যাস্তের আলো নয়। এটা মারাঠা নৌবহরের চিতার আগুনের আলো। আমি যেন টাইম মেশিনে করে ১৭৫৬ সালে চলে গেছি। আমার সামনে বিজয়দুর্গের সামনের খাঁড়িতে মারাঠা নৌবহর দাউ দাউ করে জ্বলে শেষ হয়ে যাচ্ছে আর তুলাজি অসহায়ের মতো নিয়তির কাছে পরাজয় স্বীকার করছেন।
.
ছিলেন নামী কোম্পানির দামী ব্র্যান্ড ম্যানেজার | নিশ্চিত চাকরির নিরাপত্তা ছেড়ে পথের টানেই একদিন বেরিয়ে পড়া | এখন ফুলটাইম ট্র্যাভেল ফোটোগ্রাফার ও ট্র্যাভেল রাইটার আর পার্টটাইম ব্র্য্যান্ড কনসাল্টেন্ট | পেশার সঙ্গে মিশিয়ে নিয়েছেন নেশাকেও | নিয়মিত বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ হয় বেড়ানোর ছবি এবং রাইট আপ |
asadharon… barnonar gune jeno chokher samne dekhte pachhilam sei din taake…. sabbas.. aaro aaro chai