অপর্ণা সেন একবার একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ছোটবেলায় তাঁর খুব ইচ্ছে করত ট্রাপিজের খেলা দেখাতে। কিন্তু সে ইচ্ছে আর পূরণ হল কই! শুনে প্রশ্নকর্তা, প্রতিষ্ঠিত পুরুষ সাংবাদিক, বলেছিলেন, “সে জন্যে নিজের জীবনটা নিয়েই ট্রাপিজ খেললেন!” উত্তরে অপর্ণা সেন তাঁর স্বভাবসিদ্ধ অভিমানী গলায় জোর দিয়ে বলেছিলেন, “মোটেই না। মোটেই আমি আমার জীবনটা নিয়ে ট্রাপিজ খেলিনি!” ব্যতিক্রমী, সমাজকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজের শর্তে, নিজের ইচ্ছায় বাঁচা আত্মবিশ্বাসী মেয়েদের জীবনকে সমাজ মাঝে মাঝেই এ ভাবে ট্রাপিজের খেলা বলে দেগে দিতে চায় বটে। 

“সার্কাস”- এই শব্দের মধ্যে যেমন হাসি-আনন্দ-হুল্লোড়-খেলা-মজা রয়েছে, তেমনই রয়েছে খোঁচা, তিরস্কার, উপহাস, হেয় করার, তাচ্ছিল্য করার, লঘু ও আমুদে বলে চিহ্নিত করার, ছোট করার, নিন্দা করার সামাজিক প্রবণতা। অথচ সার্কাস একটা মূলস্রোতের পারফরমিং আর্টস এবং দীর্ঘদিন পর্যন্ত, বিশেষত সিনেমা শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত যথেষ্ট সফল একটি বিনোদন ব্যবসা। তবু সার্কাসে কাজ করা সমাজে তেমন সম্মানের সঙ্গে আদৃত হয়নি কোনওদিনই। বরং বরাবর নানারকম বিতর্ক, গল্পগুজব আর অনিশ্চয়তা ঘিরে থেকেছে তাকে। পেশায় টিঁকে থাকা, শরীরকে সুস্থ ও খেলা দেখানোর উপযুক্ত করে ধরে রাখা, হিংস্র জন্তুদের পোষ মানানো, তাদের রক্ষণাবেক্ষণ, নানা রকম খেলাকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের বিপদ, ম্যানেজার ও স্পনসরদের নেকনজরে থাকার প্রতিযোগিতা, পারফরমারদের নিজস্ব রেষারেষি, আর্থিক সংকট, কম পারিশ্রমিক, অবসরভাতা না পাওয়া এমন অজস্র অসুবিধে যে পেশায়, সেখানে মেয়েদের অবস্থান ঠিক কী রকম? বিশেষত এমন একটা পুরুষপ্রধান মাধ্যমে? 

গোড়াতেই বলা যায়, সার্কাসের জীবন সম্মানের নয়। এখানে যে মেয়েরা খেলা দেখায়, তারা নানাস্তরে বহু হাত ঘুরে, বহু অপমান ও লাঞ্ছনার পথ বেয়ে কিছু উপার্জনের রাস্তা পায়। এমনই ছিল রীতি। বহুদিন পর্যন্ত। হয়তো আজও। হয়তো কেন, হাজারো আইনি সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি আছে এমন সম্মানজনক পেশায়ও তো মেয়েদের এই অসম্মানের কাঁটা ডিঙিয়ে, বাঁচিয়ে চলতে হয় সারাক্ষণ। সে মেয়ে ডাক্তার, আইনজীবী, অধ্যাপিকা, ছাত্রী, গবেষক, বিজ্ঞানী, অভিনেত্রী, পুলিশ যাই হোক না কেন। তাহলে সার্কাসের মেয়েদের জীবন আলাদা হবে কী ভাবে? 

কিন্তু হয়েছিল। সার্কাস মেয়েদের একটা আলাদা জায়গা কিন্তু দিয়েছিল। 

উজ্জ্বল আলোর নীচে ঝলমলে পোশাক পরা কিশোরী, তরুণী মেয়েদের ছিপছিপে বেতসলতা-শরীরের আঁকেবাঁকে গুঁজে দিয়েছিল গ্ল্যামার, যৌনতা আর বিস্ময়ের হাতছানি। স্বল্পবাস মেয়েগুলো চোখের পলক ফেলতে না ফেলতে নানারকম কসরত করে, ডিগবাজি খেয়ে, লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে, দৌড়ে, ঝুলে, নেচে, গেয়ে, হেসে কেমন ঘোর লাগিয়ে দিত লোকের মনে। শরীর আছে। কিন্তু সেই চিরকেলে আলতুসি লবঙ্গলতার মতো লজ্জাবনতা নয়। সে শরীরের উন্মোচনে উদ্দামতা আছে, উল্লাস আছে, ঝুঁকি আছে, খেলা আছে। সে মনোরঞ্জন শুধু যেন দর্শকের নয়। শরীরের মালকিনেরও। তাই প্রত্যেক খেলার শেষে অক্ষত, অপরাজিত মেয়েগুলো ঠিক শুধুই সেক্স সিম্বল নয়। তারা খেলোয়াড়, তারা পারফরমার। পুরুষের সঙ্গে, হিংস্র জন্তুদের সঙ্গে দাঁতে নখে লড়ে, জমি কেড়ে নেওয়া মানুষী। তাদের মোমশরীরের পিঠ থেকে ডানা বেরোলে, পা ছুঁয়ে থাকে মাটি। তারাই সার্কাসের মেয়ে। 

আড়াইশো বছর আগে যখন প্রথম আধুনিক সার্কাস শুরু হয়েছিল বলে মনে করা হয়, তখন সাধারণ মেয়েদের রক্ষণশীল ভিক্টোরিয়ান সাজসজ্জার বিপরীতে সার্কাসের মেয়েদের আঁটোসাঁটো পোশাক ছিল অনেকটাই এমপাওয়ারমেন্ট-এর, ক্ষমতায়নের প্রতীক। শরীরকে কিছুটা মুক্ত করতে পারার, অবাধ গতি আর স্বাচ্ছন্দ্য পাওয়ার স্বাধীনতা। তখন খেলার উপযুক্ত পোশাক পরতে পারাটাই ছিল মূল দাবি। যৌনতার প্রসঙ্গ বরং এলো বেশ খানিক পরে। যে সময় থেকে মেয়েদের ক্ষমতায়নের ছবিটা পালটে গেল। হাতে চাবুকই থাক, আর পায়ে হান্টার জুতোই থাক, চকচকে চামড়ার ক্ষুদ্রবাস পরা ঘোড়সওয়ার মেয়েটির কসরত ছাপিয়ে যেতে থাকল তার শরীরী আবেদন। মেয়েদের ব্যবহার করতে শুরু করা হল এমন এমন খেলায় যেখানে মেয়েটির ভূমিকা বদলে যেতে থাকল। কাঠের পাটাতনে হেলান দিয়ে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির শরীরের চারপাশে গেঁথে যেতে থাকল ছুটে আসা ধারালো ছোরা। ভয় আর শক্তির আস্ফালন দেখিয়ে ঠিক যে ভাবে সমাজ চায় দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাক মেয়েদের। আগুনের রিং লাফিয়ে পেরিয়ে যেতে লাগল উন্মুক্ত উরু, কাঁধ, বুক। লকলকে আগুনের জিভ ঠিক যেন মেয়েটিকে ঘিরে থাকা পৃথিবী। বার বার পুড়ে না গিয়ে, ঝলসে না গিয়ে গলে যেতে হবে তাকে। তবেই হাততালি ছুটবে গ্যালারি থেকে। 

ট্রাপিজের খেলায় নারী-পুরুষের যুগলবন্দী যে নান্দনিকতা, যে সাম্য, যে শিল্পের জন্ম দেয়… এই খেলাগুলো ঠিক তার বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে, যেখানে নারীকে ঘিরে ছত্রে ছত্রে ফুটে ওঠে সমাজের ধর্ষকাম। ড্যামজেল ইন ডিসট্রেস। হিরো-র, নায়ক-এর উত্থান। এই কারণে সার্কাসে মেয়েদের হাড়-মাংস-পেশি-কংকাল কাঠামোর মানুষী উপস্থিতিকে ক্রমশ ঢেকে দিতে থাকে তার মেদ অথবা মেদহীনতা। পেশির জায়গা নিতে থাকে ত্বক। উন্মুক্ত ত্বক। তবুও এইসব রাজনীতি পেরিয়ে পৃথিবীর ইতিহাসে কিছু মেয়ে নিজেদের দোর্দণ্ডপ্রতাপ উপস্থিতি নিয়ে উজ্জ্বল থেকে গেছে। 

যেমন মারিয়া স্পেলতেরিনি। ১৮৭৬ সালের ৮ জুলাই ,আড়াই ইঞ্চি ব্যাসের একটা দড়ির ওপর দিয়ে হেঁটে নায়াগ্রা প্রপাত পেরিয়েছিলেন যখন, মারিয়ার বয়স তখন মাত্র তেইশ। মারিয়া, টাইটরোপ ওয়াকার। এই অবিশ্বাস্য স্টান্ট-এ স্তম্ভিত আমেরিকাকে এরপর বার বার বাকরুদ্ধ করে গেছেন তিনি। এই ঘটনার ঠিক চারদিন পর পায়ে পিচফল ভরতি ঝুড়ি নিয়ে পেরিয়ে গেলেন নায়াগ্রা, আবার। তারপর এক সপ্তাহ বাদে কাগজের ঠোঙা দিয়ে চোখ আর মাথা ঢেকে আবার। তারপর কখনও পেছনে হেঁটে,কখনও নাচ করতে করতে, কখনও স্কিপিং দড়ি নিয়ে লাফাতে লাফাতে আবার, আবার, আবার। যেমন ‘ইস্পাতমানবী’ নামে পরিচিত কেটি স্যান্ডউইনা। ছ’ফুট লম্বা ১৮৭ পাউন্ড ওজনের এই কিশোরী কুস্তির রিং-এ অবলীলায় হারিয়ে দিতেন পুরুষদের। যেমন ছিপছিপে সুন্দরী রোজা জ্যাজেল, মাত্র ষোল বছর বয়সে যিনি ইতিহাসে নাম তুলে নেন, যেদিন রয়্যাল অ্যাকোয়ারিয়ামের একটি শো’য়ে প্রথমবার কোনও মানুষকে একটা কামানের মুখ থেকে গোলার মতো শূন্যে সত্তর ফুট উঁচুতে অক্ষত শরীরে উড়ে যেতে দেখেছিল দর্শক। উনিশ শতকে গোটা ইউরোপ জুড়ে শোরগোল ফেলে দিয়েছিলেন লিওনা ডেয়ার। ১৮৮৮ সালে লন্ডনের ক্রিস্টাল প্যালেস থেকে তাঁর বিখ্যাত শো “আয়রন জ” (লোহার চোয়াল) প্রদর্শন করেন তিনি। নীচে কোনও জাল নেই। গরম গ্যাসবেলুনের দড়িটা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে স্রেফ ঝুলে ছিলেন শূন্যে। ঝুলতে ঝুলতে এভাবে উড়ে যান ৫০০০ ফুট উচ্চতায়! আন্তোনিয়েত্তে কোনচেল্লো, যিনি তাঁর ট্রাপিজের সঙ্গীকে বিয়ে করেন এবং একত্রে এই জুটি পরিচিত হন ‘দ্য ফ্লাইং কোনচেল্লো’ নামে। দ্যমিল- এর বিখ্যাত সার্কাসকেন্দ্রিক সিনেমা ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’-এ এঁরাই ছিলেন ট্রেনার।  

শুধু শারীরিক কসরত নয়, হিংস্র বন্য জন্তুর সঙ্গে নানারকম খেলা দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন অনেকে। নার্সিং এর পেশা ছেড়ে সার্কাসে এসেছিলেন মেবেল স্টার্ক। বাঘেদের ট্রেনিং দিতেন তিনি। একসঙ্গে ১৮টা বাঘকে নিয়ে খেলা দেখানোর রেকর্ড গড়েছিলেন। ‘রাজা’ নামে একটি বাঘকে নিয়ে তাঁর একটি খেলা ছিল বিখ্যাত। প্রতি শো’য়ে রুদ্ধশ্বাসে বসে দর্শক দেখত মেবেলকে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে রাজা। সার্কাসের ইতিহাস বলছে, এই খেলা ছিল ভয়ের চেয়েও বেশি যৌনতার! তবে বিপদ ছিল। মেবেল নিজেও বলতেন, বাঘ কিন্তু কখনও সে ভাবে পোষ মানে না। মাত্র পাঁচ ফুট এক ইঞ্চি উচ্চতার জার্মান মেয়ে উরসুলা ব্লুচেন দৈত্যাকৃতি পোলার বেয়ার বা মেরুভালুকদের ট্রেনিং দিয়ে প্রচুর খ্যাতি কুড়িয়েছিলেন। ১৯৫২ সালে সাফাইকর্মী হিসেবে পূর্ব জার্মানির বুশ সার্কাসে কাজে ঢুকেছিলেন উরসুলা। সেখানেই ভালুকদের ট্রেনিং দেওয়া শেখেন। পশুগুলোকে নিজের সন্তানের মতোই ভালবাসতেন। ১৯৯৮ সালে যখন অবসর নেন, তাঁর সব ভালুকদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন জার্মানির চিড়িয়াখানায়। ১৯৩০ সালে যখন সার্কাস শুরু করেন, বারবারা তখন ছোট্ট মেয়ে। চিতাবাঘদের পোষ মানাতেন তিনি। পরে উইলিয়াম ‘বাকলস’ উডককের সঙ্গে বিয়ে হয়, যাঁর পারিবারিক পেশা ছিল হাতিদের তালিম দেওয়ার। স্বামী স্ত্রী দু’জনে হাতির খেলা দেখাতেন। তাঁদের সন্তানেরাও সেইসব খেলায় যোগ দিত। খুব ভাল কস্টিউম ডিজাইন করতেন বারবারা, নিজের শো’য়ের জন্য। শোম্যানশিপের কারণে প্রচুর খ্যাতি আর উপার্জন ছিল তাঁর। 

বিদেশ থেকে এবার একটু ভারতের দিকে চোখ ফেরানো যাক। ফিলিপ অ্যাসলে-কে যেমন আধুনিক সার্কাসের জনক হিসেবে মানা হয়, তেমনই ভারতীয় সার্কাসের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মানা হয় যাঁকে, তাঁর নাম বিষ্ণুপন্থ ছত্রে। ইনি প্রথম বম্বে প্রেসিডেন্সিতে সার্কাস কোম্পানি খোলেন। পরে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি এবং ত্রিবাংকুরেও সার্কাস শুরু হয়। ‘মালাবার সার্কাস কোম্পানি’ নামে কেরালায় একটি সার্কাস ট্রেনিং স্কুলও চালু হয়। সারা দেশ ঘুরে ঘুরে ভারতের এই সার্কাসগুলো জাগলিং, ট্রাপিজের খেলা, জাদু, সাইক্লিং নানারকমের সার্কাস দেখাত। তবে এইসব সার্কাসের মূল আকর্ষণ ছিল মেয়েরা। ১৯০১ সালের ২১শে নভেম্বর ‘ইংলিশম্যান’ কাগজে ছবিসমেত ফলাও করে ছাপা হয়েছিল একটি রিপোর্ট। সুশীলাসুন্দরী, সেই সময়ের ডাকসাইটে মহিলা রিং-মাস্টারকে নিয়ে। একসঙ্গে দুটো রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার আর একটা সিংহকে নিয়ে খেলা দেখাতেন যিনি। শাড়ি আর টিপ পরা শান্ত হিন্দু নারীর প্রচলিত ভাবমূর্তিকে ভেঙেচুরে দিয়েছিলেন সুশীলা। জন্মেছিলেন কলকাতার নিষিদ্ধপল্লী রামবাগানে। প্রিয়নাথ বোস, কলকাতার প্রথম রিং মাস্টারের নিজের হাতে তৈরি সুশীলাকে নিয়ে সেসময় কানাঘুষো গড়িয়েছিল আরব সাগর পেরিয়ে খাস ইংল্যান্ডের দরবার পর্যন্ত। জাদুকর গণপতি-র সঙ্গে তাঁর নাম জড়ায়। এই গণপতি খ্যাত ছিলেন ‘প্রাচ্যের হুডিনি’ নামে। সুশীলা আর তাঁর সঙ্গে পারফর্ম করতে রাজি না হওয়ায় গণপতির পসার আর জনপ্রিয়তা অচিরেই কমে যায়। 

সুশীলার সহকর্মিনী, প্রিয়নাথ বোসের আর এক শিষ্যা মৃন্ময়ীর জীবন যদিও ছিল ট্র্যাজিক। পোস্টারে-প্রচারে তাঁর ইমেজ ছিল শক্তিশালী এক মাতৃমূর্তির। যদিও বাস্তব জীবন ছিল ঠিক উলটো। অশক্ত, অসহায় বিধবার জীবন। স্বামীর মৃত্যুর পর মৃন্ময়ীকে কঠোর বৈধব্যের আচার পালন করতে বাধ্য করা হয়। ভারতে সার্কাসের ইতিহাসে মেয়েদের মধ্যে রুকমাবাঈ এক আশ্চর্য নাম। তাঁর নিজের নামে গ্র্যান্ড সার্কাস ছিল। তিনি নিজে ছিলেন সেই সার্কাসের ম্যানেজার। ‘প্রফেসর’ খেতাব জুটেছিল রুকমার, যা এতদিন একচেটিয়া ছিল পুরুষের। স্বাভাবিক ভাবেই সেই তিরিশ দশকের পরাধীন, ঔপনিবেশিক, পুরুষশাসিত ভারতীয় সমাজ মেনে নিতে পারেনি রুকমার স্বাধীনতা, সাফল্য এবং ক্ষমতার দাপট। তাকে নিয়ে বিস্তর নিন্দা, সমালোচনা এবং মানহানিকর সংবাদ আর লেখালেখির ঝড় ওঠে দেশের কাগজগুলোয়। একমাত্র বাংলা ভাষার কিছু দৈনিকে রুকমার কাজের সুখ্যাতি হয়। “ঝাঁসির রানি” নামে প্রশংসাও মেলে। নিজে প্রচণ্ড শারীরিক বলশালিনী ছিলেন। দর্শককে হতবুদ্ধি করে রাখতে পারতেন। কিন্তু ক্রমে তাঁর মূলধন কমতে থাকে এবং মহিলা বলে কেউ টাকাপয়সা ধার দিতে রাজি হন না। রুকমার পসার কমে ক্রমশ। 

সময় বদলেছে। এখন সারা পৃথিবী জুড়ে সার্কাসের ৬০% কর্মীই মেয়ে। অনেক শহরে আধুনিক সার্কাস দল গড়ছেন মেয়েরা। নারীবাদী দর্শন মাথায় রেখে এসব দলে জেন্ডার সেনসিটিভিটি নিয়ে কাজ হচ্ছে। হচ্ছে নারী পুরুষের ভূমিকার অদল বদল। মেয়েদের পারিশ্রমিক, পুনর্বাসন নিয়ে কাজ চলছে। ‘মেটা সার্কাস’, ‘দি এক্সপ্লোডেড সার্কাস’ এমন কয়েকটি দল অপেরা আর সার্কাসকে মিলিয়ে মিশিয়ে নানারকম নাচ গান, অ্যাক্রোব্যাটিক্স, হুলাহুপ, ট্রাপিজ ইত্যাদির সংমিশ্রণে নতুন নতুন শো করছে যেখানে পুরনো টেক্সটগুলোকে নতুন চোখ দিয়ে নতুন করে পাঠ করার সুযোগ মিলবে দর্শকের। যেমন ‘লিটল মারমেড’-এর মতো অতি পরিচিত একটা গল্পের নারীচরিত্রগুলোর চিত্রায়নের চিরাচরিত বাঁধা গত বদলে নতুন ছাঁচে পরিবেশন করছে মেটা সার্কাস। এখানে মারমেড এক শক্তিশালী মেয়ের গল্প। এই গল্পের হাত ধরে সিস্টারহুড-এর কথা বলছেন তাঁরা। এই দলের সব কর্মীই মেয়ে। 

সার্কাসের মেয়েদের নিয়ে গবেষণাও চলছে। তাঁদের কাজ, ছবি, পোস্টার, কস্টিউম, প্রপ, জীবনী নথিবদ্ধ করে রাখা হচ্ছে বিশ্বের অনেক সংগ্রহশালায়। নানা রকম প্রদর্শনীও হচ্ছে। এই কিছুদিন আগেই ইংল্যান্ডের শেফিল্ড শহরে সার্কাসের আড়াইশো বছর পূর্তি উপলক্ষে এক বর্ণাঢ্য প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল শেফিল্ড মিউজিয়ম-এর ‘সার্কাস আর্কাইভ’। সেখানে এই প্রদর্শনীর মূল আকর্ষণ হিসেবে ‘দ্য ন্যাশনাল গ্যালারি’ থেকে ধার করে আনা হয়েছিল দেগা-র বিখ্যাত ছবি “মিস লা লা অ্যাট সির্ক ফেরনান্দো”। ছবিটি দেগা এঁকেছিলেন পারি শহরে। এরই পাশাপাশি ১৯৯০ সালে ব্যবহৃত বেকি ট্রুম্যান এর ডিজাইন করা ট্রাপিজ ও পোশাকেরও প্রদর্শনী হয়। ব্র্যাডফোর্ড শহরে মাত্র একুশ বছর বয়সে বেকি যে সার্কাস কোম্পানি খোলেন, সেখানে সমস্ত কর্মীই নারী। হালফিলে ঠিক এরকমই আরেকটি সার্কাস কোম্পানি ‘আলুলা’-র ‘হায়েনা’ নামে একটি শো আদ্যন্ত মেয়েদের দ্বারা নির্মিত ও পরিচালিত। 

সার্কাসের ক্লাউন মানেই সাদা চামড়ার একজন পুরুষ, এই ধারণাকেও বদলে দিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের লুলু অ্যাডামস। কিংবা ফ্রান্সের রেনে বার্নার্ড, যিনি কোরিঙ্গা নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। তাঁর বিশেষ খেলা ছিল, মঞ্চে কুমীরদের ঘুম পাড়ানো। তবে তারও অনেক আগে ১৯১২ সালে মেয়েদের নিয়ে তৈরি হয়েছিল ‘বার্নাম অ্যানড বেইলি’, যেখানে মেয়েরা ক্লাউন হিসেবে শো করতেন। সারা পৃথিবী জুড়ে মেয়েদের সার্কাস কোম্পানি যেমন চালু হচ্ছে তেমনই মেয়েদের সার্কাস প্রশিক্ষণ, উৎসব, কর্মশালা, প্রোডাকশন চলছে। বিশেষ করে কিশোরীদের জন্য, বয়স্কাদের জন্য, ক্যান্সারজয়ী মেয়েদের জন্য। ফিনল্যান্ড এবং সুইডেনে “রেড পার্ল উইমেন ক্লাউন’স ফেস্টিভাল” শুধু মহিলা ক্লাউনদের নিয়ে উৎসব। অনেক রকমের স্কলারশিপ ও গ্রান্ট চালু হয়েছে। তৈরি হচ্ছে শুধু মেয়েদের জন্য নেটওয়ার্ক ও ডেটাবেস। সার্কাস নিয়ে আনুষ্ঠানিক পড়াশোনা ও গবেষণা চলছে। 

ক্রমশ পুরুষতান্ত্রিকতার চেনা ছক ভেঙ্গে বেরিয়ে আসছে সার্কাসের নারী। মেবেল স্টার্ক-এর কথা মনে পড়ে। তিনবার সাঙ্ঘাতিকভাবে আক্রান্ত হয়েছিলেন পোষ মানানো বাঘেদের হাতে আর অনেকবার ছোটখাটো দুর্ঘটনা সামলেছেন। কিন্তু কখনও পশুগুলোর ওপর রাগ করেননি। বলেছিলেন, বাঘের হাতে মরাই তাঁর কাছে কাম্য। মানুষের সমাজের প্রতি, মানুষের প্রতি দুর্মর অভিমান ছিল বলেই কি? 

 

দোয়েলপাখি দাশগুপ্ত বিজ্ঞান, অ্যানিমেশন, থিয়েটার, ছোট পত্রিকা, টেলিভিশন, সিনেমা, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত এইসব করে এখন ফরাসি চর্চায় নিমগ্ন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ঠেঙান ফরাসিতে। একদা রসাতল নামে একটি রম্যরচনার পত্রিকা চালাতেন, যার সমাধি ঘটেছে। বই পড়তে, এদিক সেদিক বেড়াতে, গান শুনতে, শোনাতে এবং ব্যাডমিন্টন খেলতে ভালবাসেন। তিনি একটি একবছুরে বেড়ালের মা। ভাল কফি খাওয়ালে প্রচুর ভালবাসা বিলিয়ে থাকেন।

7 Responses

  1. দারুণ লেখা।
    শীতের ছুটি মানেই সার্কাস। কমলালেবু। মহাজাতিসদনে ম্যাজিক শো।
    বাংলাদেশে একটা ফিল্ম হয়েছে সার্কাস নিয়ে। খুব ভালো লাগলো লেখাটা।
    লেখককে ধন্যবাদ ?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *