শক্তির কবিতার সঙ্গে প্রথম দেখা হয়েছিল স্কুলজীবনের শেষদিকে, কবির মৃত্যুর প্রায় এক যুগ পরে। সমস্ত কবিতার অর্থ বুঝতে পারতাম না সেদিন, আজও যে সবটুকুই বুঝি এমন বলার দুঃসাহস করব না, তবু ছন্দের মাধুর্যেই তা মন টেনে রাখত কিয়দ্দূর।  সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রাথমিক আপাত-দুর্বোধ্যতার আড়াল সরিয়ে আমার কাছে ক্রমশ একটু একটু করে ফুটে উঠলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, আর হঠাৎ আসা বানের মত আকণ্ঠ মুগ্ধতায় ভাসিয়ে নিয়ে গেলেন। ষাটের দশকের প্রথমদিকে জীবনানন্দের তীরভূমি থেকে জেগে উঠছিলেন বাংলা ভাষার তিনজন প্রধান কবি– বিনয়, শক্তি, উৎপল: আজ থেকে প্রায় বছর পনেরো আগে, দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি লেখায় বলেছিলেন কবি জয় গোস্বামী। শক্তির প্রথমদিকের লেখায়, বিশেষত চতুর্দশপদী কবিতাগুলিতে, জীবনানন্দের চিহ্ন হয়তো ছিল কিছু। ক্রমশ সেই সূচনাবিন্দুকে অতিক্রম করে শক্তির কবিতা বয়ে গিয়েছে নিজস্ব বিচিত্র মায়াবী পথে। আমাদের বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে, বাংলা কবিতার এই দুই প্রবাদপ্রতিম কবি কোথাও স্পর্শ করে আছেন পরস্পরকে; যে হেমন্ত তার সর্বনাশা বিষণ্ণ সৌন্দর্য নিয়ে ফুটে উঠেছিল রূপসী বাংলার সনেটগুলোতে, সেই হেমন্তের অরণ্যেই শক্তি হলুদ ঝুলি কাঁধে চিঠি কুড়োতে দেখেছেন তাঁর পোস্টম্যানদের।

কবি শঙ্খ ঘোষের মতে, গ্রাম দিয়ে তাঁর কবিতা ভেঙে দিতে চেয়েছিল শহর। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতাযাপনের প্রবাদপ্রতিম দামালপনা চরিত্রে নাগরিক, শহর কলকাতার সঙ্গে ওতপ্রোত হলেও শক্তির কবিতার মধ্যে কোথাও যেন একটা রয়ে গিয়েছিল ফেলে আসা পাড়া-গাঁর জন্য পিছুটান, ফেরা হবে না জেনেও ফিরতে-চাওয়ার আকুল বিষণ্ণতা। ‘পাড়ের কাঁথা মাটির বাড়ি’তে শক্তি বলেছিলেন, “কখনো ফিরে পাবো না সেই সব দিন যা ঝড়-বৃষ্টি-রৌদ্র-হেমন্তে ভরা/সেইসব বাল্যকালের নগ্নতার কান্নার পয়সা-পাবার দিন/ফিরে পাবো না আর/ফিরে পাবো না আর কাগজের নৌকা ভাসাবার দিন উঠানের/ক্ষণিক সমুদ্রের কলরোলে…”[আমরা সকলেই]। পড়তে পড়তে মনে হয়, ভাল আরও ভাল থাকতে চেয়ে রোজকার এই ক্লান্তিকর ইঁদুরদৌড় আসলে অর্থহীন, মনে হয় কোলাহল আর উচ্চকিত উদযাপন থেকে দূরে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকা গেলে ভালো হতো, প্রিয় হাত হাতে ধরে রেখে। একুশ শতকের প্রথম দশকে আমরা যারা জেলার ছোট শহর-মফস্বল থেকে লেখাপড়ার সূত্রে এসে পড়েছিলাম কলকাতার মায়াবী গণ্ডির ভিতরে, ভীরু পায়ে হাঁটতে হাঁটতে চিনে নিতে চাইছিলাম মহানগরকে, আমাদের ছোটখাটো পিছুটানকে কোথাও একটা ছুঁয়ে যাচ্ছিল এই লেখাগুলো। হয়ত এটাই বড় স্রষ্টার চিহ্ন, তাঁর কবিতা, তাঁর লেখা সময়কে অতিক্রম করে জেগে থাকে লাইটহাউসের মতো, অনেকদিন পরে ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করে ক্লান্ত কোনও পথভোলা নাবিককে রাস্তা দেখাবে বলে।

বয়সের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে তো যাচ্ছিলই শক্তির লেখা, তার উপরে এসে পড়েছিল পায়রার ঘুলঘুলি ছুঁয়ে হেলে পড়া শেষবেলার রোদ্দুর। বেজে উঠছিল বার্ধক্যের, বিদায়ের সুর। শক্তি লিখবেন, “তরুণ কবি কখন তোমায় বলতো লোকে?/কোন বয়সে থমকে গেলে সুশ্রী দেখায়?’ লিখবেন, হয়তো কিছুটা পরিহাসের ঢঙেই, ‘বৃদ্ধ, মনঃ ছিল নাকি তোমারও শরীরে?’ আমরা লক্ষ্য করব, যেতে পারি কিন্তু কেন যাব-র সেই চিতাকাঠের অমোঘ আহ্বান কোত্থেকে যেন বারবারই ফিরে আসছে এই কবিতাগুলোর মধ্যে।

নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি চলে গেছেন শক্তি, সেই যখন মুক্ত অর্থনীতির সরণিতে সবে প্রথম পা ফেলেছিল আমাদের দেশ। অথচ আজ বিশ্বায়নের মহাসড়কের মাঝখানে যখন আমাদের প্রতিদিনের যাপনকে ঘিরে আছে অ্যাণ্ড্রয়েড-সোশ্যাল মিডিয়া-ই-কমার্স-বহুজাতিক ব্র্যাণ্ডগুলো, তখনও দেখি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্মদিন উদযাপনে ঠিকই ভরে যায় শহরের প্রেক্ষাগৃহ। বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়, কবির মৃত্যু নেই। শক্তি লিখেছিলেন: ‘আমি একধরনের ঈশ্বরে বিশ্বাস করি। ঈশ্বর মানে বড়, যে আমার কথা শোনে, আমাকে শোনায়। সেই ঈশ্বর– মধ্যরাতে যখন আমি অন্ধকার চৌরঙ্গি পার হই বা ট্রামলাইন ধরে দিই উন্মত্ত দৌড়– সঙ্গে থাকেন।’ শক্তির কবিতাও তো এমন করেই সঙ্গে থেকেছে, ছুঁয়ে থেকেছে আমাদের। বাংলা কবিতার নগণ্য, সামান্য পাঠক আমরা। আমাদের কাছে শক্তিই সেই ঈশ্বর। কোনো প্রাতিষ্ঠানিকতার নিগড়ে বাঁধা উপাস্য নন– একান্ত নিভৃত, ব্যক্তিগত ঈশ্বর।

তথ্যসূত্র:

১. কবিতাসমগ্র ১-৭, শক্তি চট্টোপাধ্যায়।

২. এই শহরের রাখাল, শঙ্খ ঘোষ।

৩. আকস্মিকের খেলা, জয় গোস্বামী।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি নিয়ে গবেষণা করছেন। অনর্থনীতির উপাসক। নিবাস কোন্নগর। হাজরাতে দোল খেলার সুযোগ ঘটেনি, তবে পাঁজরাতে চোরা মফস্বল পুষে রাখার বদভ্যাস আছে। কবিতা ও কুকুরের সঙ্গে কোন নগরে সময় কাটান তা কেউ জানে না। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ 'ভাঙা বিকেলের টুকরো'।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *