একটা শহরের শরীরে অনেকগুলো টুকরো শহর লুকিয়ে থাকে। বাহ্যত চোখে পড়ে না তাদের। এমনকি মুখোমুখি দেখা হলেও ঠিক মতো ঠাহর হয় না যেন। কিন্তু তারা থাকে, থেকে যায়। উড়ালপুল, শপিং মল, কফি শপের তলায় যে অন্তঃসলিলা কলকাতা বয়ে যায়, সেখানে নামলে মাঝেমধ্যে দেখা হয়ে যায় ভিন শহরের বাসিন্দাদের সঙ্গে।

ধরা যাক মিস্টার গাঙ্গুলির কথা। যাদবপুর থানা থেকে বেঙ্গল ল্যাম্পের দিকে এগোতেই ডান দিকের ফুটপাথে তাঁর সংসার। সঙ্গী বলতে দুই পোষ্য। তাদের এক জনের নাম জ্যাকসন। আপনার সঙ্গে বন্ধুত্ব জমে উঠলে মিস্টার গাঙ্গুলি তাঁর ছোটবেলার গল্প বলবেন। বলবেন ফেলে আসা পূর্ব পাকিস্তান আর দক্ষিণ কলকাতার রিফিউজি কলোনির কথা। বলবেন কী ভাবে তিলতিল করে তাঁদের বড় করেছিলেন পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি থেকে তাড়া খেয়ে পালিয়ে আসা বাবা। তার পর নিজের চেষ্টায় অঙ্কে অনার্স নিয়ে পাশ করে স্কুলে পড়ানোর চাকরি জুটিয়েছিলেন। তখন থেকেই কুকুর পোষার শখ। সে নিয়ে বাড়িতে অশান্তি। সঙ্গে আরও নানা রকম সমস্যা। সম্পত্তি নিয়ে বিবাদ, মনান্তর। মানিয়ে নিতে পারেননি। ইতিমধ্যে চাকরিটাও চলে গিয়েছে। ফলে, খানিকটা বাধ্য হয়েই ফুটপাথে সংসার।
আপনি ওঁকে পাগল ভাবতে পারেন বা অনেকখানি এগিয়ে থাকা একটা মানুষ, ঘটনা হল, মিস্টার গাঙ্গুলি এখন খুব ব্যস্ত— জ্যাকসনের জীবনী লিখছেন।

ধরা যাক, যাদবপুরের সাড়ে তিন নামের কুকুরটির কথা। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মিলনদার ক্যান্টিন, ইউনিয়ন রুম চত্বর হোক বা এইটবি বাসস্ট্যান্ড— সাড়ে তিনকে দেখা যেত। একটা বুড়ো কুকুর যার তিনখানা পা আস্ত, আর বাকি এক খানার অর্ধেক নেই। খুঁড়িয়ে হাঁটত। এখন যারা স্নাতকস্তরে পড়ে, তাদের অনেকেই যেমন সাড়ে তিনকে দেখেছে, তেমনই দেখেছি আমরাও। দেখেছে আমাদের বেশ কয়েক বছর আগে ক্যাম্পাসের গন্ডি টপকে যাওয়া সিনিয়রেরাও। একটা বুড়ো কুকুর ঠিক কত দিন বাঁচে? আমি জানি না। যাদবপুর চত্ত্বরে মাঝেমধ্যেই যে সাড়ে তিনকে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়, সে কি একটিই কুকুর? যুক্তি বলে, তেমনটা হওয়া সম্ভব নয়। কোনও কুকুর এত দিন বাঁচে না। তা হলে কি বছরের দূরত্বে নতুন নতুন সাড়ে তিন পেয়ে কুকুর আসে যাদবপুরে? কিছু দিন আগে যে সাড়ে তিন মারা গিয়েছে, তাকে আদর করে ডাকা হত ডন। আবার কি কয়েক বছর পর একই রকম দেখতে কোনও সাড়ে তিন পেয়ে কুকুর হেঁটে বেড়াবে যাদবপুরে? জানার আগ্রহ নেই আমার। শুধু এটুকু জানি, কোনও ডগ শো বা সাজানো উন্নয়ন সাড়ে তিনদের ছুঁতে পারে না। যেমন পারে না লুব্ধকদের ছুঁতে।
সাড়ে তিনকে দেখলে আমার কল অফ দ্য ওয়াইল্ডের কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে জ্যাক লন্ডনের বাক-কে।

ধরা যাক, মীরাবাঈয়ের কথা। ধরা যাক, মীরার এক জন কৃষ্ণ আছেন এখনও, যাঁর কাছে তিনি মেলে ধরতে পারেন নিজেকে। অথবা, ধরা যাক, ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের কথাই। এইটবি’র মোড়ে লেনিনের একটি মূর্তি রয়েছে। অনেকেই সেটির কথা জানেন, কারণ কিছু দিন আগে রাতের অন্ধকারে একদল লোক মূর্তিটি ভেঙে দিয়েছিল। তখন ছিল আবক্ষ মূর্তি। পরে ঠিক ওই জায়গাতেই লেনিনের একটি পূর্ণাবয়ব মূর্তি নতুন করে তৈরি করা হয়। সকাল বেলার এইটবিতে যাঁরা চা খেতে যান, তাঁদের অনেকেই ওই মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে অনর্গল কথা বলে যাওয়া এক মহিলাকে দেখেছেন। অসম্ভব ভক্তিভরে ওই বৃদ্ধা রাশিয়ার তুষার প্রান্তরে ঝড় তুলে দেওয়া, দুনিয়ার চাকাটাকে উল্টোদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া লেনিনের সঙ্গে গল্প করেন, ঝগড়া করেন, হাসেন, কেঁদেও ফেলেন মাঝেমধ্যে। কখনও কখনও বাড়ির ঠাকুরকে দেওয়ার জন্য কেনা ফুল থেকে কয়েকটি লেনিনের পায়ের কাছে রেখে দেন। লেনিনকে তিনি বলেন পারিবারিক অশান্তির কথা, বাজারের দরদামের কথা, ভয়ঙ্কর গরম বা প্যাচপ্যাচে বৃষ্টির কথা। হ্যাঁ, লেনিনকে বলেন, এপ্রিল থিসিসের রচয়িতা, ঝড়ের পাখি লেনিনকে। অথবা বলেন তাঁর এক ব্যক্তিগত বন্ধুকে, যাঁর শরীরটাই কেবল লেনিনের।

আপনি পাগলামি দেখতে পারেন, অথবা ভালবাসা। আমি দেখতে পাই, নিকোনো উঠোন, কুয়োতলা, ছোট্ট মসজিদের আজান অথবা তুলসীমঞ্চ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *