প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন। 
দ্বিতীয় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন। 

বাবু কলকাতার শেষ উত্তরসূরি যাঁকে বলা হয়, সেই রসিক পণ্ডিত গবেষক চিন্তক এবং বুভুক্ষু পাঠক শ্রী রাধাপ্রসাদ গুপ্ত ওরফে আরপি ওরফে শাঁটুলবাবু পা দিলেন শতবর্ষে। ১৯২১ সালের ১৪ ডিসেম্বর তাঁর জন্ম। তাঁর লেখক পরিচয়টি মুখ্য নয়, কারণ বই লিখেছেন মাত্র তিনটে– কলকাতার ফিরিওয়ালার ডাক ও রাস্তার আওয়াজ, মাছ ও বাঙালি, স্থান-কাল-পাত্র। তাঁর কোন পরিচয়টি যে মুখ্য, তা নিয়ে আজও মাথা খুঁড়ে চলেছে বাঙালি। তিনি আড্ডাকে নিয়ে গিয়েছিলেন শিল্পের পর্যায়ে। তিনি ছিলেন বই ও শিল্পের সংগ্রাহক এবং কলকাতা শহরের ইতিহাস ঘেঁটে চলা একজন ‘ক্রনিকলার’। তাঁকে ঘনিষ্ঠভাবে দেখেছেন আর এক বিশিষ্ট বাঙালি সাংবাদিক-সাহিত্যিক শংকরলাল ভট্টাচার্য। তিনি লিখছেন তাঁর শাঁটুলদার কথা। আজ শেষ পর্ব। 

রাধাপ্রসাদ গুপ্ত, থুড়ি, শাঁটুলবাবুকে তো আমরা মনে করতামই চলন্ত বই, কিন্তু তাঁর কাছে চলমান বই ছিলেন কারা? প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় ডক্টর স্যামুয়েল জনসনের নাম, যাঁর সঙ্গে হরেক মিল শাঁটুলদার। প্রথমত ডক্টর জনসনের মতো আড্ডায় জমে অকাতরে জ্ঞান বিতরণের অভ্যেস ছিল শাঁটুলদারও। তবে তা পাণ্ডিত্য ফলাবার জন্য নয় একেবারেই, নানা জনের কৌতূহল মেটাতে, কথায় কথায়, প্রশ্নের উত্তরে-উত্তরে কত যে মূল্যবান তত্ত্ব ও তথ্য শুনিয়ে যেতেন। ওঁর বড় প্রিয় বইও ছিল বসওয়েলের ‘লাইফ অফ জনসন’, যার থেকে অপূর্ব সব উদ্ধৃতি শোনাতেন আমাদের। বলতেন,
লোকটার কপাল দ্যাখো। জন্মাল তো জন্মাল একেবারে বইয়ের দোকানের মালিকের ঘরে। তাই বড়ই হল বই পড়ে পড়ে, বই ঘেঁটে ঘেঁটে। নাহলে কোন্ বিষয়ে কী না পড়েছে লোকটা! আর একা হাতেই ইংরিজির প্রথম ডিকশনারি লিখে ফেললে! 
বলেই জনসনের ডিকশনারির (যাকে বাইবেলের মতো মান্য করতেন শাঁটুলদা) কয়েকটা দেদার মজার শব্দের মানে শুনিয়ে দিতেন। যেমন net বা জালের কী মানে দিয়েছেন সাহেব। net কী? না, ‘Anything reticulated or decussated at equal distances, with interstices between the intersections.’ 
– নাও বোঝো! এ বোঝা তো আইজ্যাক নিউটনের কম্মো!
শাঁটুলদার খুব পছন্দের ছিল আর একটা শব্দের বিবরণ। শব্দটা Patron, যার মানে করেছেন জনসন এরকম:
Commonly a wretch who supports with insolence and is paid with flattery.

শাঁটুলদার ডক্টর জনসন-প্রীতির আরও দুটো বড় কারণ ছিল লন্ডন আর চোখ। আমায় নিখুঁত বর্ণনা দিয়েছেন কীভাবে পায়ে হেঁটে হেঁটে জনসনের বাড়ি, ওঁর পাড়া, ওঁর প্রিয় পানশালা ও আড্ডা মহল ‘দ্য ইন’ দেখেছেন, জনসনের লন্ডনকে নিজের মতো আবিষ্কার করেছেন। শেষে যোগ করেছেন, “সাধে সাহেব বলতেন যে, যে-লোক হেঁটে বেড়ায়নি লন্ডন সে লন্ডন দেখেইনি।” জনসনকে ভালোবাসার তৃতীয় কারণটা চোখ। বই পড়ে পড়ে শব্দ ঘেঁটে ঘেঁটে প্রায় দৃষ্টি হারিয়ে বসেছিলেন পণ্ডিত। শাঁটুলদারও দৃষ্টি যখন ক্ষীণ হয়ে এসেছে উনি নিজেকে স্তোক দিতেন বিশ্বমান্য পণ্ডিতের চোখের কথা ভেবে। তারপরে যোগ করতেন: It is not too big a price for the great learning he had earned with those two eyes. আমার তখন না ভেবে উপায় থাকত না: শাঁটুলদা, এ তো আপনার সম্পর্কেও সমান খাটে। মুখে বলতাম না, কারণ তাতে পণ্ডিতমশাই পুরনো চালে জিভ কাটতেন অবশ্যই।

Photo by Sarah Fowles
সত্যজিৎ রায়ের বাড়িতে দুই বন্ধুর জমাটি আড্ডা। সারা ফাউলসের তোলা ছবি। সৌজন্য: উত্তরা ঘোষ ও গার্গী গুপ্ত

শাঁটুলদার আর এক প্রিয় পণ্ডিত কলকাতা এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম প্রেসিডেন্ট স্যর উইলিয়াম জোন্স। বলতেন,
ও সব কল্পনাতেও আনা যায় না, শঙ্কর। তিনের কোঠায় বয়স যখন, বিলেত থেকে কলকাতা আসছেন জজ হয়ে। তার মধ্যেই নাইডহুড পেয়েছেন। ফার্সি শিখে ‘আ গ্র্যামার অফ দ্য পার্শিয়ান ল্যাঙ্গোয়েজ’ লিখেছেন। এদেশে এসে পণ্ডিত রেখে সংস্কৃত শিখেছেন। আর শিখে কী করলেন? না, সংস্কৃত থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করলেন কালিদাসের ‘শকুন্তলা’। পত্তন করলেন কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটি। আর সোসাইটির গবেষণা পত্রিকা হিসেবে নিয়মিত সম্পাদনা করে প্রকাশ করে গেলেন এশিয়াটিক জার্নাল। সংগ্রহ করে বার করলেন হিন্দু অ্যান্ড মুসলমান ল’জ। ভাবা যায় একটা আটচল্লিশ বছরের জীবনে এত সব কাজ!

স্যর উইলিয়াম জোন্সকে নিয়ে আমার উপন্যাস ‘প্রথম পুরুষ’ লেখার সময় মাঝে মধ্যেই ওঁর পরামর্শ নিতাম। একটা পরামর্শের কথা না লিখলেই নয়। জিজ্ঞেস করেছিলাম, কীরকম বাংলা গদ্যে উপন্যাসটা লিখলে ব্যাপারটা সমীচীন হয়। ভদ্রলোক তৎক্ষণাৎ বলে দিলেন, “সাহেব সোসাইটি গড়ে সভাপতির যে-দুর্ধর্ষ বক্তৃতা করলেন সেটা অনুবাদ করলে যে-বাংলাটা পাবে সেরকম একটা বাংলায় লিখে ফ্যালো।” 

বলা বাহুল্য, ওঁর পরামর্শমতোই উপন্যাসের ভাষাটা গড়ে নিয়েছিলাম।

তবে শাঁটুলদার আরেকটা যে-পরামর্শ ছিল সেও বড় উপাদেয়। জিজ্ঞেস করেছিলেন, 
– সাউথ পার্ক স্ট্রিট সিমেটারিতে যাওয়া হয়? 
যেই বললাম, “কলেজকালে তো সপ্তাহে দু’দিন অন্তত গিয়ে বসা হত। নেশার মতো ছিল” অমনি পরামর্শদাতার আর এক প্রশ্ন, “বান্ধবী নিয়ে তো?” যখন দু’জনেই হাসছি শাঁটুলদা বললেন,
কবরখানার ঢোকার মুখে বাঁ হাতে সুন্দরী তরুণী রোজ এলমারের কবর। তাতে ওর প্রেমিক ইংরেজ কবি ও গদ্যকার ওয়াল্টার স্যাভেজ ল্যান্ডরের অপূর্ব এলিজিটা খোদাই করা। বড় সাহেব জোন্সের সমাধিতে বসে বেরোবার মুখে ওখানে একটু বসা দরকার। গার্লফ্রেন্ডকে ব্যাপারটা বোঝানোও চাই। শিক্ষিত বাঙালির এই তো রোম্যান্স।

RP Gupta at Kumartully
কুমোরটুলিতে শাঁটুলদা। ছবি সৌজন্য: উত্তরা ঘোষ ও গার্গী গুপ্ত

বলেই শাঁটুলদা আবৃত্তি শুরু করলেন ল্যান্ডরের ‘Rose Aylmer’ এলিজি কবিতাটার …

Ah, what avails the sceptred race!
Ah, what the form divine!
What every virtue, every grace!
Rose Aylmer, all were thine.

Rose Aylmer, whom these wakeful eyes
May weep, but never see,
A night of memories and of sighs
I consecrate to thee.

আধুনিক কালের পণ্ডিতদের মধ্যে শাঁটুলদার খুব পছন্দের ছিলেন মহান আর্জেন্টিনীয় লেখক হর্হে লুইস বর্হেস, যাঁর আদিগন্ত বিস্তৃত পড়াশুনোতে অবাক মানতেন। বলতেন,
লোকটা অর্ধেক জীবন দেখতেই পেলে না। কিন্তু পড়ে ফেললে চার-চারটে জীবনের পড়া। অনন্ত মহাবিশ্বকে বর্ণনা করলে এক অনন্ত মহাপাঠাগার হিসেবে। Universe is a grand library. একজন মহান, অন্ধ পাঠকের পক্ষেই এই বর্ণনা সম্ভব। যেমন অন্ধ হোমারের বর্ণনায় সমুদ্র। অন্ধ মিল্টনের বর্ণনায় রঙিন প্যারাডাইস।

শাঁটুলদার প্রিয় আরও দুই পণ্ডিত লেখক ফরাসি। আলব্যের কামু ও জ্যঁ পল সার্ত্র। এর মধ্যে সার্ত্রও শেষ বয়েসে দৃষ্টি হারিয়েছিলেন। তা খুব কথা হত ওঁর সঙ্গে। আর কামুর লেখালিখিতে অপার মুগ্ধ ছিলেন শাঁটুলদা। বলতেন, 
– ছোকরা বয়েসে চলে গেল লোকটা, আর তাতেই যা লিখলে জীবনটা ধন্য করে দিলে। তুমি প্যারিসে ওর প্রিয় কাফেগুলোতে গিয়ে বসতে জেনে বেশ হিংসেই হচ্ছে। 

শাঁটুলদাকে নিয়ে একটা ডকুমেন্টারি ফিল্ম তোলার উদ্যোগ নিয়েছিল ওঁর স্নেহধন্য ও আমার বন্ধু গৌতম ঘোষ। দু’তিন দিন লম্বা শুটিংও হয়েছিল পণ্ডিতের বাড়িতে। আমার ওপর ভার ছিল তাঁর সাক্ষাৎকার নেওয়ার। গৌতম একাধারে পরিচালক ও ক্যামেরা শিল্পী। ওহ্, কী সুন্দর যে কেটেছিল সময়গুলো! কপালদোষে ছবিটা শেষ হয়নি আর যেটুক-যা তোলা হয়েছিল তারও যে কী হল জানি না। থাকলে যে কী অমূল্য সম্পদ হত তা বাড়িয়ে বলার দরকার হয় না। 

At his drawing room - Sanjeet
নিজের বসার ঘরের প্রিয়তম কোণটিতে। ছবি সৌজন্য: সঞ্জিৎ চৌধুরী

সাক্ষাৎকারে আমার কাজ ছিল শাঁটুলদাকে ওঁর জীবন ও কলকাতা নিয়ে প্রশ্ন করা। পরে ওই সাক্ষাৎকারে ওঁর বলা কথা ধরে গৌতমের প্ল্যান ছিল কলকাতার সেই সব জায়গার শুটিং করা। কথা বলতে বলতে শাঁটুলদা দিব্যি বুঝিয়ে দিলেন যে উত্তর কলকাতা ও সাহেবি কলকাতার ওপর ওঁর সমান টান। খুব ইচ্ছে ছিল সাহেবপাড়া আর সাহেবদের গোরস্থান নিয়ে ওঁকে ডিটেলে বলতে বলব। তাহলে গৌতম স্যর উইলিয়াম জোন্স ও রোজ এলমারের সমাধির ছবি তুলে তথ্যচিত্রের রূপ, রস সুর গড়ে নেবে। কিন্তু হায়!…

শাঁটুলদার সে-সময় খুব মনে ধরেছিল সচিন তেণ্ডুলকরের ব্যাটিং। টিভিতে সচিনের ব্যাটিং দেখতে দেখতে আমায় ফোন দিতেন—
– টিভি খুলেছ? দ্যাখো, দ্যাখো কী খেলছে ছেলেটা? 
খুব বাসনা ছিল সৌরভেরও ওরকম একটা লম্বা ইনিংস দেখবেন আমার সঙ্গে ফোনাফুনি করে। শেষ অবধি সৌরভ যেদিন কেরলে (সম্ভবত) দেদার পিটিয়ে সেঞ্চুরি করছেন, রাধাপ্রসাদ গুপ্ত শেষ নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছেন। খবরটা আমাকে ফোনেই দিয়েছিলেন ওঁর দীর্ঘকালের বন্ধু কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। খেয়াল ও ক্রিকেটবিশারদ কুমারদার সেই বার্তাটা হুবহু মনে থেকে গেছে কারণ তা বলা হয়েছিল প্রায় ক্রিকেটীয় বাচনে। বলেছিলেন, 
– একটা খারাপ খবর, শঙ্কর। Your dear Shatulda has packed up.

আরপি কিছুটা লড়ছিলেন অসুখের সঙ্গে বলেই হয়তো কুমারদার ওই এক্সপ্রেশন। ‘সানন্দা’ পত্রিকায় শাঁটুলদার অবিচুয়ারিতে না লিখে পারিনি যে, খুব সম্ভবত এই ক্রিকেটপ্রিয় মানুষটি ওই ঘুমের মধ্যেই সৌরভের ব্যাটিং দেখছেন আনন্দের সঙ্গে স্বর্গযাত্রায়।    (সমাপ্ত)

Sankarlal Bhattacharya Author

শংকরলাল ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট, কলকাতায়। ইংরেজি সাহিত্যে স্বর্ণপদক পাওয়া ছাত্র শংকরলাল সাংবাদিকতার পাঠ নিতে যান প্যারিসে। তৎপরে কালি-কলমের জীবনে প্রবেশ। সাংবাদিকতা করেছেন আনন্দবাজার গোষ্ঠীতে। লিখেছেন একশো ত্রিশের ওপর বই। গল্প উপন্যাস ছাড়াও রবিশংকরের আত্মজীবনী 'রাগ অনুরাগ', বিলায়েৎ খানের স্মৃতিকথা 'কোমল গান্ধার', হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিমালা 'আমার গানের স্বরলিপি'-র সহলেখক। অনুবাদ করেছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা থেকে সত্যজিৎ রায়ের চিত্রনাট্য পর্যন্ত।

3 Responses

  1. আমরা কতটা অর্বাচীন মে এই সব লোক গুলো কে হয় ভুলে গেছি বা জানতে চেষ্টা করিনি। শ্রদ্ধেয় রাধা প্রসাদ গুপ্ত ( শাটুল দা) মনি কোঠায় থেকে গেলেন, চির কালের জন্য। এবার আরেক ব্যাকতি , শ্রদ্ধেয় শিবরাম চক্রবর্তী আর শ্রদ্ধেয় শরৎ পন্ডিত … এই দুই উজ্জ্বল বঙ্গ সন্তান সম্মন্ধে জানতে চাই। ধৃষ্টতা মার্জনীয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *