কেউ তারে কন জলফ্রেজি। কেউ ঝালফ্রেজি বা জালফ্রেজি। তা বাপু নামে কী আসে যায়? আসে যায় বৈকি। যাহাই ঝাল তাহাই ফ্রেজি বা স্বাস্থ্যসম্মত। অথবা যদি বলি, ঝালফ্রেজি শব্দটি বাঙালি শব্দ ‘ঝাল’ ও ফার্সি শব্দ ‘ফ্রেজি’ মিলিয়ে একটি দ্বন্দ্ব সমাস? তাহলে বুঝতে সুবিধে হয়। ‘ফ্রেজি’ শব্দটির মানে স্বাস্থ্যকর। ডায়েটের উপযোগী। আর ঝাল মানে ঝাল অর্থাৎ ইংরেজীতে যাকে বলে হট। হ্যাঁ। আমরা পার্টিতে গিয়ে সুদৃশ্য ব্যুফে টেবিলে যখন ঝালফ্রেজির দিকে হাত বাড়াই তখন তাকে রীতিমতো “হট” বা “সেক্সি” লাগে বৈকি!
বাংলায় প্রথম রান্না এই ‘ঝালফ্রেজি’কে একটি অ্যাংলোইন্ডিয়ান রেসিপি বলেছেন শতরূপা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর “কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী” বইতে। শুধুই আমিষ নয়, নিরামিষও বানানো যায় এই ঝালফ্রেজি। এ রান্নার ঠিকুজি কুষ্ঠি ঘাঁটতে গিয়ে দেখলাম ব্রিটিশ আমলে বাংলায় এই রান্নার উদ্ভব। তাই যখন সত্য আর নামে বেশ নতুনত্ব, তাই সংকর জাতি বা ব্রিটিশ এবং ভারতীয় রক্তের সংমিশ্রণেই কি নতুনত্বের ছোঁয়া এই রান্নায়? আর সেই কারণেই বুঝি ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার যে কোনও ভালো কুকারি বুকে এর রেসিপি থাকে।
অ্যাদ্দিন নামীদামি রেস্তোরাঁয় সুদৃশ্য বাসনকোসনে পরিবেশিত হতে দেখে ভাবতাম অবাঙালিদের রান্না। ও বাবা! জেনে তো পুরো থ’ মেরেছি এক্কেবারে! এ যে আমাদেরই বাংলারই রান্না যার মধ্যমণি পাঁচমেশালি সবজি! সঙ্গে পনির অথবা মাছ কিম্বা মাংস থাকবেই। অথচ ঠিক যেমন গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না, কিম্বা বাড়ির গরু উঠোনের ঘাস মুখে তোলে না, তেমনই ভারতীয় উপমহাদেশ ও তার বাইরে তুমুল জনপ্রিয়তা থাকলেও আমাদের রোজকার হেঁশেলে কিন্তু এই পদটির তেমন একটা চল দেখি না। খুব মশলাদার রেসিপি অথচ তেল কম। তাই স্বাস্থ্যকর। উপকরণের মধ্যে অবশ্যই থাকবে ক্যাপসিকাম, পেঁয়াজ এবং টমেটো। আর বঙ্গীয় রান্নায় কাঁচালংকা, আদা রসুন তো থাকবেই।
সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং হল এই ঝালফ্রেজির মশলা, মানে যা আমাদের চিরাচরিত পাকশালের ধনে, জিরে, গোলমরিচ, শুকনো লংকা, মৌরি। এবার সব শুকনো খোলায় এদের নেড়ে নিয়ে আমরা যেমন মিক্সিতে গুঁড়ো করি একটু অমসৃণভাবে (coarse), ঠিক তেমনই হল ঝালফ্রেজির আসল মশলা। তেমনই জেনেছিলাম ক্যালকাটা ক্লাবের এক বাবুর্চির মুখে। এই ক্লাবের মেইন ডাইনিং হলের ফ্রাইডে লাঞ্চ ব্যুফের মেন্যুতে ঝালফ্রেজি থাকবেই। তবে শতরূপা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রেসিপিতে ভাজা মশলার উল্লেখ নেই।

ব্রিটিশ আমলে এই ঝালফ্রেজি বঙ্গে উদ্ভূত হয়েছিল। তাই বুঝি ব্রিটিশ ভারতের রান্নার বইগুলিতে এটির উপস্থিতি পাওয়া যায়। সাহেবসুবোর রান্না বেশি রিচ হবে না। আবার তেনারা তখন বাংলার মসলিন আর মশলাপাতির প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে ব্যবসা লুটছেন। তেল ঘি কম থাক, মশলাদার হলে ক্ষতি নেই। বঙ্গের বেয়ারা বাবুর্চিদের বুদ্ধিও তো কম নয়। আগের রাতের বেঁচে যাওয়া খাবারের সঙ্গে মানে যেমন ধরুন বেঁচে যাওয়া মুরগির রোস্ট বা স্ট্যু থেকে চিকেনগুলো ছাড়িয়ে নিয়ে, গুচ্ছের সবজি মানে গাজর, মটরশুঁটি, বিনস, ফুলকপি এসব হালকা সেদ্ধ করে খেল দেখাত তারা আর বাজিমাত হত ডাইনিং টেবিলে। সাহেবসুবো খেয়ে ধন্যি ধন্যি করত। তারা বুঝতেই পারত না যে বাসি মাংস আর সবজির মেলবন্ধনে প্রচুর গোলমরিচ, টমেটো এবং পেঁয়াজ দিয়ে স্টারফ্রাই করে একপ্রকার তরকারি হিসেবে তাদের মুখের সামনে হাজির করা হয়েছে এই ঝালফ্রেজি।
আসলে বিদেশিদের কাছে ‘প্যাকেজিং ইজ মোর ইম্পরট্যান্ট।’ ঠিক যেন “ওল্ড ওয়াইন ইন নিউ বটল”-এর কনসেপ্ট। নাড়িয়ে চাড়িয়ে ভাজা বা চিনা স্টার ফ্রাইয়ের আইডিয়া তখন আসেনি এদেশে। কিন্তু বাঙালির আদি অকৃত্রিম জল-ছাড়া বা জলের আছড়া দেওয়া ছেঁচকি তো দিব্য বেঁচেবর্তে ছিলই! তাই সেটাতেই সাহেবদের মন জয় করে ঝালফ্রেজির কাটতি হয়েছিল সে যুগে। বেয়ারা-বাবুর্চি অবিশ্যি আদর করে তাদের নিজস্ব অ্যাকসেন্টে ডাকত ‘ঝালফোরেজি’ নামে। কলকাতার কেতাদুরস্ত ক্লাবগুলিতে এখনও বাবুর্চিদের মুখে এই অ্যাকসেন্টেই শুনি ঝালফ্রেজির নাম।
এই রান্নায় মাছ, চিকেন কিম্বা পনিরের সঙ্গে কুচোনো নানাধরনের সবজি থাকবেই। গাজর, বিনস, ফুলকপি, মটরশুঁটি সবজিগুলোকে নুন দিয়ে সামান্য সেদ্ধ করে নিতে হয় তাদের রঙ ঠিক রেখে। রান্নায় ব্যবহৃত অর্ধেক পেঁয়াজ গ্রেট করে আর বাকিটা দো পিঁয়াজার মতো কেটে রাখতে হবে। অর্ধেক টোম্যাটো গ্রেট করে বাকিটা ডুমো করে আর ক্যাপসিকাম চৌকো কিম্বা লম্বা করে কুচিয়ে নিতে হবে। রসুনবাটা, আদাবাটা মাস্ট। সামান্য ধনেগুঁড়ো, জিরেগুঁড়ো, লংকাগুঁড়ো আর গোলমরিচ গুঁড়ো কষার সময় দিতে হবে। সেকালে বানানো হত সরষের তেলে। সাহেবসুবোদের পছন্দ ছিল সরষের তেলের ঝাঁঝ। এখন রিফাইন্ড তেলে সামান্য মাখন অথবা ঘি দিয়ে চিকেন, মাছ বা পনির নেড়ে নিয়ে বাটা মশলাগুলো দিয়ে বেশ করে কষে নিয়ে গুঁড়ো মশলা আর নুন, চিনি আর কসুরি মেথি দিতে হবে। এবার সবজি সেদ্ধ দিয়ে আরও কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া।

তারপর আলাদা করে ভেজে রাখা চৌকো করে কাঁটা পেঁয়াজ, টোম্যাটো আর ক্যাপসিকাম টুকরো দিয়ে আবারও নাড়তে হবে খানিক। সব শেষে সেই দেশীয় ইমিউনিটি ব্যুস্টার, শুকনো খোলায় ভেজে রাখা মশলা দিয়ে নেড়ে ধনেপাতা কুচোনো দিয়ে সার্ভ করতে হবে সামান্য ঘি বা মাখন ছড়িয়ে। এই ঝালফ্রেজিই গ্রেভির মতো বানাতে পোস্ত, কাজুবাটা, চারমগজ, কর্নফ্লাওয়ার, ক্রিম সব দেওয়া যায়। তখন অবিশ্যি এটি এত স্বাস্থ্যকর থাকবে না। সেটিতে আবার মোগলাই বা বাদশাহী টাচ হবে। সেটি ইন্ডিয়ান কারিতে পরিণত হবে।
সে সময় ব্রিটিশরা বাংলায় এসে বাংলার অনবদ্য মশলা আর মসলিনের প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে ব্যবসার খাতিরে জাঁকিয়ে বসেছিল। আর তাই মশলাদার ঝালফ্রেজি যে তাদের পছন্দের হয়ে উঠেছিল সে বিষয়ে কোনও সংশয় নেই। ভারতের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী “কারি”র পর্যায়ে ঝালফ্রেজির স্থান এক নম্বরে এবং তাকে ব্রিটিশ কারি নামে অভিহিত করা হয়। সেই শুনে দুয়ে দুয়ে চার করে বলি, বাংলার মশলা এবং কারির প্রেমে পড়ে ব্রিটিশরা যে এখনও এই রান্নার গুণমুগ্ধ, সেটা আমাদের পক্ষে অত্যন্ত সম্মানজনক।
*তথ্যসূত্র: “কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী” (আনন্দ) / শতরূপা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ইন্টারনেট
*ছবি সৌজন্য: theurbantandoor, spicediary
রসায়নের ছাত্রী ইন্দিরা আদ্যোপান্ত হোমমেকার। তবে গত এক দশকেরও বেশি সময় যাবৎ সাহিত্যচর্চা করছেন নিয়মিত। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায় এহং প্রথম উপন্যাস সানন্দায় প্রকাশিত হয়। বেশ কিছু বইও প্রকাশিত হয়েছে ইতিমধ্যেই। সব নামীদামি পত্রিকা এবং ই-ম্যাগাজিনের নিয়মিত লেখেন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, রম্যরচনা ও প্রবন্ধ।