বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য কে?

না। একবারে নাম বলামাত্র চিনে ফেলা সম্ভব নয়। অন্তত আমার মতো আম-বাঙালির পক্ষে তো নয়ই। কারণ আমরা সকলেই তাঁকে চিনি ছদ্মনামে। বলা যায়, তাঁর ছদ্মনামটাই আসল নাম বা পরিচয় হয়ে উঠেছিল ক্রমে ক্রমে। বাণীকুমার। ঠিকই ধরেছেন। বাণীকুমার বললেই বাঙালির মনে অবধারিতভাবে একটি শব্দ ভেসে ওঠে– মহালয়া। হ্যাঁ, মহালয়ার ভোরে বাঙালির ঘরে ঘরে রেডিওর অদৃশ্য তরঙ্গ বেয়ে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের অমোঘ উচ্চারণে যে সংস্কৃত শ্লোকের অনুপ্রবেশ ঘটে, তার রচনা ও সংকলন বাণীকুমার ওরফে বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্যের। কিন্তু এর বাইরেও তো এক আস্ত বাণীকুমার রয়েছেন! তাঁকে আলাদা করে শিল্পী হিসেবে দেখার চেষ্টা করেছে কি বাঙালি? তবে এ কথাও ঠিক, যে পঙ্কজকুমার মল্লিক, বাণীকুমার এবং বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র– এই ত্র্যহস্পর্শে সৃজিত ‘মহিষাসুরমর্দিনী’কে বাদ দিয়ে বাণীকুমারকে সম্পূর্ণ করে দেখা কঠিন। কাজেই সে কথা আসবে এ লেখার স্বাভাবিক পরিণতি হিসেবেই, তার বেশি নয়।

বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্যের জন্ম তাঁর মামাবাড়িতে, হাওড়ার কানপুর গ্রামে। পৈতৃক বাড়ি ছিল হাওড়ারই আঁটপুর গ্রামে। বাবা ছিলেন ইতিহাসবেত্তা, পণ্ডিত বিধুভূষণ ভট্টাচার্য ও মা অপর্ণাদেবী। বিধুভূষণবাবুও সাহিত্যচর্চা করতেন। একাধিক বই লিখেছিলেন, যার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিল ‘রায়বাঘিনী ও ভূরিশ্রেষ্ঠরাজকাহিনী।’ আজ থেকে প্রায় সাড়ে চারশো বছর আগে আফগান আক্রমণ প্রতিহত করেছিলেন এক বাঙালিনী। তিনি ভূরিশ্রেষ্ঠ রাজ্যের রাজা রুদ্রনারায়ণ রায়ের স্ত্রী। উড়িষ্যার সুলতান ওসমান খান ১২০০০ আফগান সৈন্য নিয়ে ভূরিশ্রেষ্ঠ আক্রমণ করলে বাশুড়ির যুদ্ধে রানি আফগানদের শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন। এ কারণেই তাঁকে রায়বাঘিনী নাম দেওয়া হয়। এই ঘটনা অবলম্বনে বই লিখেছিলেন বিধুভূষণ। এছাড়াও ‘বঙ্গবীর রণজিৎ রায়’, ‘পতিপ্রাণা’ নামে একাধিক বইয়ের প্রণেতা তিনি। ফলে ছেলে বৈদ্যনাথের যে সাহিত্যে আগ্রহ থাকবে, তাতে অবাক হবার খুব বেশি অবকাশ নেই।

বৈদ্যনাথের লেখালিখির শুরু ছাত্রাবস্থাতেই। পড়তেন হাওড়া জিলা স্কুলে। সেখানে তখন শিক্ষকতা করতেন কবি করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়। ততদিনে করুণাবাবুর অন্তত গোটা চারেক কাব্যগ্রন্থ পাঠকমহলে সুপরিচিত। রংমহল, প্রসাদী, ঝরাফুল, শান্তিজল– বইগুলি বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। এহেন কবিকে মাস্টারমশাই হিসেবে পেয়ে বৈদ্যনাথের কাব্যপ্রীতি তরতর করে এগিয়ে চলল। বাংলার পাশাপাশি চলল সংস্কৃতচর্চাও, কারণ বাপ-ঠাকুরদা সে ভাষায় সুপণ্ডিত। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, প্রেসিডেন্সি কলেজে বাংলা নয়, সংস্কৃত নয়, ইংরিজি সাহিত্য পড়তে ভর্তি হলেন বৈদ্যনাথ। ততদিনে ‘কবি’ পরিচয় তাঁর সঙ্গী হয়ে গিয়েছে। সংস্কৃতে কাব্যরচনা করে ‘কাব্যসরস্বতী’ উপাধিও জুটেছে।

 

আরও পড়ুন: ভবেশ দাশের কলমে: দীপনারায়ণ মিঠোলিয়া: বেতারের এক অবিস্মরণীয় বিস্মরণ

 

ত্রিশের দশকে প্রেসিডেন্সি কলেজে বাণীকুমারের পরিচয় হল অশোকনাথ শাস্ত্রীর সঙ্গে। কলেজ ম্যাগাজ়িনে মহাকবি ভাস রচিত ‘শোণিত পারনা’ নাটকের বাংলা অনুবাদ ছাপা হল। অনুবাদক অশোকনাথ শাস্ত্রী। নাট্যরূপ বাণীকুমার। সাধারণের বোধগম্য করার জন্য সংস্কৃত নাট্যকাব্যকে একাধিক দৃশ্যে ভাগ করে দিয়েছিলেন তিনি। এদিকে ছেলের মন পদ্য আর সাহিত্যের দিকে ক্রমেই ধাবিত হচ্ছে, এ কথা ভালো চোখে দেখলেন না অভিভাবকেরা। বৈদ্যনাথ স্নাতক হতে না হতে তাঁর বিয়ের ব্যবস্থা করলেন বাবা বিধুভূষণ। পাত্রীর নাম গৌরী। কাব্যের নিভৃতিতে নিমগ্ন হয়ে থাকার দিন শেষ হয়ে এল। বাণীকুমারকে একরকম বাধ্য হয়েই যোগ দিতে হল টাঁকশালে কেরানির চাকরিতে। কিন্তু রসকসহীন সেই হিসেবের চাকরিতে কবির মন উতলা হয়ে উঠত। খুঁজতে থাকত মুক্তির পথ।

সে পথ মিলে গেল ১৯২৭ সালে কলকাতায় ‘ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানি’ তাদের আপিস খোলার পর। ১ নং গার্সটিন প্লেসের একটা ভাড়াবাড়ি থেকে চালু হল রেডিও সম্প্রচার। খুব বড়লোকেদের বাড়ি ছাড়া তখন রেডিও থাকত না। থাকলেও সে রেডিও একবারে একজনই শুনতে পেত, কারণ কানে হেডফোন লাগাতে হত। তখন ব্রডকাস্টিং কোম্পানির অধিকর্তা ছিলেন স্টেপলটন সাহেব। কলকাতা কেন্দ্রের স্টেশন ডিরেক্টর হলেন সি সি ওয়ালিক এবং ভারতীয় অনুষ্ঠানের পরিচালক নিযুক্ত হলেন বিশিষ্ট ক্ল্যারিওনেট-শিল্পী নৃপেন্দ্রনাথ মজুমদার। এই রেডিও সম্প্রচার সংস্থাতেই ‘রাইটার স্টাফ আর্টিস্ট’ পদে যোগ দিয়েছিলেন একুশ বছরের বাণীকুমার।  

টাঁকশালে চাকরি করার সময়েও নাট্যচর্চায় ছেদ পড়েনি বাণীকুমারের। ‘চিত্রা সংসদ’ নামে এক নাটকের দলের সদস্য ছিলেন। সেখানেই আলাপ পঙ্কজকুমার মল্লিক, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, বিজন বসু, রাজেন্দ্রনাথ সেন প্রমুখের সঙ্গে। নৃপেন্দ্রনাথ মাঝেমাঝেই আসতেন চিত্রা সংসদের অনুষ্ঠান দেখতে, নতুন প্রতিভার সন্ধানে। সেখানেই উপরোক্ত একঝাঁক গুণী তরুণের সমাহার তাঁকে মুগ্ধ করে। এবং ক্রমে সকলকেই তিনি রেডিওতে নিয়ে আসেন। বাণীকুমারের বড়ছেলে নৃসিংহকুমার ভট্টাচার্যের লেখা থেকে জানা যায়, বাণীকুমার পরশুরামের ‘চিকিৎসা সঙ্কট’ গল্পের নাট্যরূপ দিয়েছিলেন এবং তা বেতারে সম্প্রচারিতও হয়েছিল। সেই নাটক শুনেই নৃপেন্দ্রনাথ বাণীকুমারকে রেডিওতে পাকা চাকরির প্রস্তাব দেন। ১৯২৭-‘২৮-এর মধ্যে বাণীকুমার ছাড়াও কলকাতা বেতারে একে একে যোগ দেন রাইচাঁদ বড়াল, হীরেন বসু, নলিনীকান্ত সরকার, বেহালার জমিদার-তনয় বীরেন রায়, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, বিজন বসু প্রমুখেরা। পঙ্কজকুমার মল্লিক অবশ্য কর্মী হিসেবে নয়, যোগ দিয়েছিলেন সংগীতশিল্পী হিসেবে।  

Biren Bhadra Banikumar and Pankaj Mullick
কলকাতা বেতারের তিন স্তম্ভ– বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, বাণীকুমার এবং পঙ্কজকুমার মল্লিক (বাঁ দিক থেকে)

এরপর বাণীকুমারের জীবনে শুরু দীর্ঘ এক কর্মময় যাত্রার, যা ছুঁয়ে গিয়েছিল অজস্র, অসংখ্য শ্রোতার মন। বেতারে যোগ দেবার অব্যবহিত পরেই রামনারায়ণ তর্করত্ন বিরচিত ‘কুলীন-কুল-সর্বস্ব’ নাটকটির বেতার নাট্যরূপ দেন বাণীকুমার। সম্ভবত বেতারে এটাই তাঁর প্রথম কাজ। অভিনয় করেছিলেন পঙ্কজকুমার মল্লিক, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ও নটীর ভূমিকায় উমাবতী। এরপরে চলল একের পর এক বেতার নাটক আর গান রচনা। বঙ্কিম থেকে রবি ঠাকুর, সকলের লেখার নাট্যরূপ দিয়েছিলেন বাণীকুমার। ১৯৩১ সালে ‘বেতার বিচিত্রা’ অনুষ্ঠানের সূচনা হয় তাঁরই হাত ধরে। তারপর টানা একুশ বছর অনুষ্ঠানে ছেদ পড়তে দেননি তিনি।

১৯৩২ সাল। বাণীকুমার নিজেও জানতেন না এ বছরেই জীবন্ত কিংবদন্তীতে পর্যবসিত হবার সূচনা ঘটবে তাঁর জীবনে। সে বছর চৈত্র মাসে অন্নপূর্ণা পুজো আর বাসন্তী পুজো পড়েছিল কাছাকাছি। সেই উপলক্ষে দুই পুজোর মাঝামাঝি সময়ে একটা অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করলেন বাণীকুমার। নাম দেওয়া হল ‘বসন্তেশ্বরী’। গানের দিকে পঙ্কজ মল্লিক, রাইচাঁদ বড়াল তো ছিলেনই, সঙ্গে ছিলেন হরিশ্চন্দ্র বালি। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র নাট্যকথাসূত্র এবং কাব্য পাঠ করেন। শ্লোকপাঠে ছিলেন স্বয়ং রচয়িতা বাণীকুমার। তার কিছুদিনের মধ্যেই দুর্গাষষ্ঠীর ভোরে সম্প্রচারিত হয় সেই বিখ্যাত আলেখ্য, যার নাম তখন ছিল ‘মহিষাসুর বধ’। পরে ১৯৩৭-এ নাম দেওয়া হয় ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। এই একটি আলেখ্যের পথ ধরে বাণীকুমার চিরকালের মতো বদলে দিলেন বাঙালির পিতৃতর্পণের ভোর, দেবী দুর্গার আগমনী।

তবে আগেই বলেছি, ‘মহিষাসুরমর্দিনী’-র বাণীকুমারকে নিয়ে বেশি কথা এখানে বলব না। এই অনুষ্ঠান ছাড়াও তাঁর কর্মক্ষেত্র ছিল বিস্তীর্ণ। নাটক, গান লেখা, কবিতা লেখা, পত্রপত্রিকায় লেখা, সবই চলেছে একই সঙ্গে। ১৯৩৫ সালে নীতিন বসুর পরিচালনায় ‘ভাগ্যচক্র’ ছবির কাজ শুরু হল। এ ছবিতে অন্যতম গীতিকার ছিলেন বাণীকুমার। আর এই ছবি দিয়েই শুরু হয় বাংলা প্লেব্যাকের জয়যাত্রা। সখিদের গান ‘মোরা পুলক যাচি তবু সুখ না মানি, ব্যথায় দোলে তব হৃদয়খানি’, কৃষ্ণচন্দ্র দে-র কণ্ঠে ‘ওরে পথিক তাকা পিছনপানে’, পাহাড়ি সান্যালের গলায় ‘কেন পরাণ হল বাঁধনহারা’ সব গানেরই রচয়িতা বাণীকুমার। ১৯৩৬-এ প্রমথেশ বড়ুয়ার দেবদাসেও সায়গল সাহেবের গলার দুটি সুপারহিট গান ‘কাহারে জড়াতে চাহে ও দুটি বাহুলতা’ ও ‘গোলাপ হয়ে উঠুক ফুটে তোমার রাঙা চরণখানি’ লেখেন তিনিই।

পাশাপাশি রেডিওতে চলছিল নাটকের কাজ। তবে নাটকপাগল বাণীকুমার কিন্তু পেশাদারি মঞ্চ থেকে দূরেই থেকেছেন। একবারই রংমহলে ‘সন্তান’ নামে আনন্দমঠ উপন্যাসের বাণীকুমারকৃত নাট্যরূপ মঞ্চস্থ হয়। কিন্তু সে অভিজ্ঞতা সুখের হয়নি। বিতর্ক শুরু হয়, এ নাটকে নাকি সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ তৈরি হবে। পরে অবশ্য সেসব গোলমাল মিটে গিয়ে নাটক তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। কিন্তু বাণীকুমার আর মঞ্চে ফেরত আসেননি সেভাবে।

ত্রিশের দশকে প্রেসিডেন্সি কলেজে বাণীকুমারের পরিচয় হল অশোকনাথ শাস্ত্রীর সঙ্গে। কলেজ ম্যাগাজ়িনে মহাকবি ভাস রচিত ‘শোণিত পারনা’ নাটকের বাংলা অনুবাদ ছাপা হল। অনুবাদক অশোকনাথ শাস্ত্রী। নাট্যরূপ বাণীকুমার। সাধারণের বোধগম্য করার জন্য সংস্কৃত নাট্যকাব্যকে একাধিক দৃশ্যে ভাগ করে দিয়েছিলেন তিনি। এদিকে ছেলের মন পদ্য আর সাহিত্যের দিকে ক্রমেই ধাবিত হচ্ছে, এ কথা ভালো চোখে দেখলেন না অভিভাবকেরা।

চল্লিশ-পঞ্চাশের দশক জুড়ে বাণীকুমারের মনপ্রাণ অধিকার করে ছিল বেতারের জগৎ। ১৯৪৭ সালে রবীন্দ্রনাথের ‘বাঁশরী’-র নাট্যরূপ দেন তিনি। ১৯৪৯-এ ‘ঘরে বাইরে’ ও ‘দুই বোন’। ১৯৫০-এ ‘যোগাযোগ’। এছাড়াও রবীন্দ্রনাথের বহু ছোটগল্প (‘মালঞ্চ’, ‘গুপ্তধন’, ‘মাস্টারমশাই’, ‘পরিত্রাণ’, ‘কঙ্কাল’, ‘সুয়োরাণীর সাধ’, ‘মহামায়া’, ‘কালের যাত্রা’, ‘রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা’) থেকে বেতার নাটক করেছেন বাণীকুমার। বঙ্কিমের ‘দুর্গেশনন্দিনী’, ‘সীতারাম’, ‘আনন্দমঠ’, ‘ যুগলাঙ্গুরীয়়’; শরৎচন্দ্রের ‘অরক্ষণীয়া’, ‘মেজদিদি’ ইত্যাদি রচনাও বাণীকুমার নাট্যরূপ দিয়েছেন। রবি ঠাকুরের কবিতার নাট্যরূপকেও শ্রোতাদের মধ্যে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন তিনি। দেবতার গ্রাস, হোরিখেলা, ফাঁকি, পুরস্কার এমন একাধিক কবিতার সার্থক নাট্যরূপ দেন।  

১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে ছ’টি রবীন্দ্রসঙ্গীত সংস্কৃতে অনুবাদ করেন বাণীকুমার। তবে শুধু কথার অনুবাদ নয়, ছন্দ প্রায় অক্ষুণ্ণ রেখে অনুবাদ করেছিলেন। লেখার পর সঙ্গীত পরিচালক বিমলভূষণের সঙ্গে বসে সেগুলি পরিমার্জিত করে গাইবার উপযোগী করেন। বছর দুয়েক বাদে তার মধ্যে পাঁচটিই আকাশবাণীর হয়ে রেকর্ড করেন পঙ্কজ মল্লিক ও বিমলভূষণ। ১৯৬১-তেই রবীন্দ্রশতবর্ষের অনুষ্ঠান উপলক্ষে ‘কবিপ্রণাম’ নামে বন্দনাগীত লেখেন বাণীকুমার, যার সুর দেন পঙ্কজ মল্লিক। গানটি ছিল–

পূরব গগন জাগ্রত করি নব উদয়ন সঙ্গীতে
দিলে এনে তুমি প্রাণ রসধারা বিশ্বে ললিত ভঙ্গিতে

কাজি নজরুলকে নিয়েও কবিতা লিখেছিলেন বাণীকুমার। চল্লিশের দশকে নজরুলের ‘রুবায়ৎ-ই ওমর খৈয়াম’-এর নাট্যরূপ দেবার সময় কবির সঙ্গে গভীর হৃদ্যতা গড়ে ওঠে তাঁর। সেই নাটকে সঙ্গীত পরিচালনা করেন খোদ নজরুল। কিন্তু এর বছরখানেকের মধ্যেই কবি অসুস্থ হয়ে পড়েন। বাকশক্তি, স্মৃতিশক্তি চলে যেতে থাকে। যন্ত্রণায় বাণীকুমারের কলম দিয়ে বেরয় প্রিয় কবির জন্য সুস্থতার আর্তি…

আজিকে সহসা কেন নিয়তির নিষ্ঠুর শাসন
বাধা দেয় প্রকাশ-আগ্রহ তব, দৃপ্ত সম্ভাষণ। …
সাধনার মহাক্ষণ ধূলিতে কি হইবে বিলীন,
পরম চৈতন্য-বরে জাগিবে না তব জন্মদিন?

ছোটগল্প-প্রবন্ধও লিখেছেন বাণীকুমার। প্রবাসী, ভারতবর্ষ, ভারতী, মাসিক বসুমতী, সাহানা প্রভৃতি সাময়িক পত্রিকা ছাড়াও  শিশুসাথী, শুকতারা ও মৌচাকে ও নিয়মিত লিখেছেন তিনি। এখানে তাঁর ছদ্মনাম বাণীকুমার নয়। কখনও বৈ.না.ভ, কখনও আনন্দবর্ধন, আবার কখনও বা বিষ্ণুগুপ্ত। বই লিখেছেন বেশকিছু। তাঁর বাবার লেখা বই পরিমার্জন পরিবর্ধন করে পুনঃপ্রকাশে উদ্যোগী হয়েছেন। এমনকী অবসর নেবার পরেও ঘনিষ্ঠ বন্ধু চারুচন্দ্র চক্রবর্তীর (জরাসন্ধ) বই ‘লৌহকপাট’ থেকে কিছু ঘটনার নাট্যরূপ দিয়েছেন। 

আমৃত্যু বাংলা ভাষা-সংস্কৃতির সাধনায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন মানুষটি। কবিতা, নাটক, গান, সাহিত্যে ডুবিয়ে রেখেছিলেন নিজেকে। তথাপি ‘বাণীকুমার’ নাম বললে আজ ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ ত্রয়ীর একজন বলে অতিকষ্টে মনে করতে হয় তাঁকে। তাঁর ভাষা, তাঁর বাণী, তাঁর ছন্দ, তাঁর শিল্প, এসব কিছুকে মহালয়ার ভোরে গঙ্গাজলে ডুবিয়ে দিয়ে আমরা বাঙালিরা মহানন্দে বাঙালিয়ার ধ্বজা তুলে ঘুরে বেড়াই। আজ, বাণীকুমারের ১১৪তম জন্মদিবসে তাঁকে আরও একটু কাছ থেকে চেনার, জানার প্রয়াস করুক বাঙালি, এই ইচ্ছেটুকু প্রণতি হিসেবে থাক।    

*তথ্যসূত্র: শতবর্ষে বাণীকুমার: স্মরণে ও বরণে
আকাশবাণীর বাণীকুমার: দীপক সেনগুপ্ত (অবসর)
মহিষাসুরমর্দিনী গীতি-আলেখ্য ও বাণীকুমার: গৌতম বসুমল্লিক (আনন্দবাজার পত্রিকা)
ধরার আঙিনা হতে ঐ শোনো উঠিল আকাশবাণী! – মিহিরকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় (বাংলালাইভ)

*ছবিসূত্র: Facebook ও Banglalive

লিখতে শিখেই লুক থ্রু! লিখতে লিখতেই বড় হওয়া। লিখতে লিখতেই বুড়ো। গান ভালবেসে গান আর ত্বকের যত্ন মোটে নিতে পারেন না। আলুভাতে আর ডেভিলড ক্র্যাব বাঁচার রসদ। বাংলা বই, বাংলা গান আর মিঠাপাত্তি পান ছাড়া জীবন আলুনিসম বোধ হয়। ঝর্ণাকলম, ফ্রিজ ম্যাগনেট আর বেডস্যুইচ – এ তিনের লোভ ভয়ঙ্কর!!

One Response

  1. এভাবেই আমরা স্রস্টা কে ভুলে যাই, সৃষ্টি কে নিয়ে আনন্দ করি। ভুলে যাওয়া আমাদের ধর্ম হয়তো।তবু বানী কুমার বেঁচে আছেন, থাকবেন, যতদিন মহালয়া শুনবো আমরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *