চা-বাগানের প্রত্যেক বাবুর বাড়িতে একজন করে কিশোর বয়সের ছেলে থাকত সংসারের কাজে সাহায্য করবার জন্য। শব্দটি এখন কানে খারাপ শোনায়, কিন্তু চাকর বলেই তাদের পরিচয় ছিল। মদেশীয়া শ্রমিকদের মধ্যে থেকেই সাহায্যকারী নেওয়া হত বেশি। নেপালি চাকর প্রায় দেখিনি বললেই চলে। এরা সকলে বাবুদের বাড়িতেই থাকত। কখনও কখনও নিশ্চয়ই নিজেদের কুলিলাইনের কোয়ার্টারে যেত, কিন্তু ফিরে আসত ফের দিনের দিনই। কাজেই তাদের দীর্ঘ অনুপস্থিতি খুব একটা মনে পড়ে না। আমাদের সঙ্গেই তারা দিব্যি হেসেখেলে দিন কাটাত। 

তাদের যে খুব কাজের চাপ ছিল, এমনটা কিন্তু নয়। আমাদের বাড়িতে বিশেষত, তাদের ফাঁকা সময় একটু বেশিই ছিল, কেননা আমাদের বাড়িতে অনেক আগে থেকেই একজন সারাদিনের লোক থাকত। তার নাম মোহিন্দর। আমাদের খুব ছোটবেলায় বিহারের মজঃফরপুর থেকে দুই ভাই হঠাৎ আমাদের বাগানে এসে হাজির হয়েছিল– মোহিন্দর আর  যোগিন্দর। কাজ খুঁজতেই যে তাদের ডুয়ার্সে আগমন, একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমাদের বাড়িতে এক ভাই কাজ পেল, অন্য ভাই আমাদেরই বাগানের টাইপবাবুর বাড়িতে।

আমাদের অজিত জ্যাঠামশাই অফিসে টাইপের কাজ করতেন বলে তাঁর এই নামকরণ। আমার বাবা যেমন স্টোরের দায়িত্বে ছিলেন বলে তাঁর উপাধি ছিল মালবাবু। তো এই মোহিন্দর আমাদের বড়োসড়ো রান্নাঘরের একদিকে চৌকি পেতে নিজের থাকার ব্যবস্থা করে নিয়েছিল। তার প্রধান কাজ ছিল আমাদের গরুগুলোর জন্যে চা-বাগান থেকে ঘাস কেটে আনা। এছাড়া দুপুরে সবাই যখন ঘুমোত, তখন যৌথ পরিবারের পাহাড়প্রমাণ থালাবাসন সংগীত সহযোগে মাজাও ছিল তার আর একটা কাজ। তখন বাড়িতে ব্যবহৃত হত কাঁসার বাসন। কলপাড়ে বসে সে গান গাইত আর বাসনগুলোকে কাঠের উনুনের ছাই দিয়ে ঝকঝকে করে তুলে রান্নাঘর সংলগ্ন একটা মাচায় রেখে দিত। সন্ধ্যার কাজ ছিল রুটি করা। সেও হত গলা সাধতে সাধতে। মোহিন্দর বেশি গাইত দেশোয়ালি গান আর মহম্মদ রফির গান। তার সবচেয়ে প্রিয় গান ছিল, ‘দূর গগনপে উড়তা বাদল আ আ আ, অভি দেখো কাচ্চা দানা পাক যায়ে তো খা’। এসব গান সম্ভবত আমাদের রেডিয়ো থেকে শিখত, কেননা মোহিন্দরকে আমরা কখনও সিনেমা হলের ধার দিয়েও যেতে দেখিনি।

এমনিতেও মোহিন্দরের জীবনযাত্রা ছিল অত্যন্ত সরল সাধাসিধে। আমাদের দেওয়া জামাকাপড়ের বাইরে অতিরিক্ত অন্য পোশাক নিজের জন্য কিনতে দেখিনি কখনও। যা সামান্য মাইনে পেত, দেশের বাড়িতে পাঠিয়ে দিত। দেশেও সে যেত দু’তিন বছর পরপর। একবার দেশ থেকে ফেরার সময় নিয়ে এল একটা সেকেন্ডহ্যান্ড গ্রামোফোন, হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে তাতে দম দিতে হয়। আর সঙ্গে আনল ভোজপুরি গানের কতকগুলো রেকর্ড। শুধু একটা ছিল শ্যামাসঙ্গীত। বলেছিল, বুড়া মাইজিকে লিয়ে, মানে আমার ঠাকুমার জন্য। মাঝে মাঝে ঘাস কাটতে গিয়ে মোহিন্দর আমার জন্য ধরে আনত বুনো খরগোস। ওদের খাঁচায় রেখে দিতাম। কিন্তু আমার প্রাণপণ যত্নেও ওরা বেশিদিন বাঁচত না। ওরা বনের জিনিস, খাঁচায় ওদের ভালো লাগত না।

Tea Garden
যোগিন্দর গরুদের ঘাস খাওয়াতে নিয়ে যেত চা-বাগানে।

মোহিন্দরের দাদা যোগিন্দর পরে চা-বাগানে চাকরি পায়। তার কাজ ছিল বাবুদের বাড়ির গরুর রক্ষণাবেক্ষণ করা। সে নিয়মিত গরুদের ঘাস খাওয়াতে নিয়ে যেত চা-বাগানে, আবার সন্ধ্যায় ফিরিয়ে আনত। সকালে দুধ দুইয়ে দিত রোজ। মোহিন্দর টাকা জমিয়ে একটা রিকশা কিনেছিল। প্রথমদিকে আমাদের বাড়িতে থেকেই রিকশা চালাত। কালচিনিতে স্ট্যান্ড। পরে দেশ থেকে বৌকে নিয়ে আসার পর, কালচিনি স্টেশনের পাশে জমি কিনে টিনের চাল দিয়ে কাঠের বাড়ি করেছিল।

বাড়িতে সবজি টবজি ফলাবার জন্য কোম্পানি থেকে সপ্তাহে দু’তিন দিন মালি পাঠানো হত। এরমধ্যে যমুনা মালি ও এতোয়া মালির কথা খুব মনে আছে। সে প্রায় চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগেকার কথা লিখছি। ওদের মতো মানুষ এখন আর মদেশীয়াদের মধ্যে বোধহয় দেখা যাবে না। এখন ওই অঞ্চলে পরিবহন ব্যবস্থা অনেক উন্নত হয়েছে। হাত বাড়ালেই নানা আধুনিক পণ্য। আদিবাসীদের অনেকেই লেখাপড়া শিখে বিভিন্ন সরকারি বিভাগে চাকরি করছে। চা-বাগানেও স্টাফ বা সাব-স্টাফের চাকরি করছে। জীবনযাত্রার মান তো অনেকটাই উন্নত হয়েছে নিশ্চয়ই। তবু আমার চোখে সেই আগেকার দিনের চেহারা আর পোশাকটাই রয়ে গেছে। এই মালি হিসেবে যারা আসতেন, তাঁরা সাধারণত চা-বাগানে কাজ করা শ্রমিকদের থেকে কিছুটা বয়স্ক হওয়াতেই বোধহয় এ কাজে বহাল হতেন। 

 

আরও পড়ুন: উৎপল চক্রবর্তীর কলমে: বনফুলের শিক্ষক বনবিহারি

 

যমুনা বা এতোয়া মালি কাজে আসতেন একটা লেঙট পরে। কোনওদিন এর বাইরে তাঁদের আর অন্য কোনও পোশাক পরতে দেখিনি। বাবা সকাল ন’টায় জলখাবার খেতে এসে ওঁদের সারা দিনের কাজ বুঝিয়ে দিতেন। নীরবে নির্দেশ শুনে যাওয়াই ছিল দস্তুর। কোনওদিন কাজ সম্পর্কে নিজস্ব মতামত দিতেন না ওঁরা। চুপচাপ শুনে নিয়ে কাজে লেগে যেতেন। ওঁদের মুখে আনন্দ আর হাসি ফুটে উঠতে দেখতাম, যখন মা নিজে বা আমাদের হাত দিয়ে ওদের জন্য গোটা ছ’সাত আটার রুটি, আখিগুড় আর বড় কাঁসার গেলাসে চা পাঠাত। বাগানে গোসাপ বা বড় সাপ পেলেও খুশি হতেন ওঁরা। মেরে নিয়ে যেতেন বাড়িতে। রান্না করে খাবেন বলে নিশ্চয়ই।  

যাঁদের কথা লিখব বলে শুরু করেছিলাম এই অধ্যায়, তার মধ্যে ঢুকে পড়লেন মোহিন্দর-যোগিন্দর আর যমুনা-এতোয়া মালিরা। এবার ওঁদের একটু সরিয়ে রেখে মদেশীয়া কিশোরদের কথায় আসি, যারা আমাদের বাড়িতে ‘কাজের ছেলে’ হিসেবে থাকত। আমার তিন চারজন ছেলের কথা বেশ মনে পড়ে। এই ছেলেদের সকলেরই একটা বিষয়ে খুব মিল ছিল। এরা প্রত্যেকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে থাকতে ভালোবাসত। খুব যত্ন করে স্নান করত, জামাকাপড়ও যত্ন নিয়ে কাচাকাচি করত। আর একটা বিষয়, এদের কখনও খুব রেগে যেতে দেখিনি। কাজের সূত্রে বকাঝকা খেলেও হাসিমুখটি মলিন হত না। কিন্তু ওদেরই বয়সী নেপালি ছেলেদের অনেক উদ্ধত হতে দেখেছি। একটা করে গুলতি সকলেরই ছিল নিত্যসঙ্গী আর প্রত্যেকেরই হাতে অব্যর্থ টিপ। ফলে পক্ষী প্রজাতি প্রায়শ ক্ষতিগ্রস্ত হত। শীতকালে আমাদের বাড়ির উঠোনে কাঠের আগুন জ্বালিয়ে তার চারদিকে গোল হয়ে বসত বাবুদের বাড়ির চাকরেরা। আগুনে ঝলসানো হত নানাধরনের পাখি। চড়ুই বোধহয় ওদের কাছে সবচেয়ে উপাদেয় ছিল।

Bird hunting
পাখি শিকার করত প্রায় সব আদিবাসী ছেলেরাই।

তখন মাসে একটা করে হিন্দি ছবি দেখানো হত কোম্পানি থেকে। শ্রমিকদের জন্যে হলেও তা দেখানো হত আমাদের বাবুবাসার মাঠে। সেদিন, সারাদিন ধরে ওদের উৎসাহের অন্ত থাকত না। সে উৎসাহে অবশ্য আমরাও সমানভাবে সামিল হতাম। তবে সকলের মধ্যে বিশেষভাবে লিখতেই হবে গন্ধুরের কথা। সে আমার জীবনের একটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ সময়ে আমার সঙ্গী হয়ে ছিল। তার সঙ্গে কাটানো সময়টা তাই মনের মণিকোঠায় সযত্নে তুলে রাখা আছে।

আমি যখন ক্লাস সিক্স-সেভেনে পড়ি, তখন আমার ছোটকাকা বর্ধমানের রায়নার শ্যামসুন্দর কলেজে পড়ানোর চাকরি পেলেন। সেই সূত্রে কলেজের একটা কোয়ার্টারও পেলেন। প্রস্তাব পাঠালেন, দাদাকে ওখানকার স্কুলে ভর্তি করার জন্যে পাঠিয়ে দিতে। দাদা তখন নাইন কি টেন। পরিবারের সবাই আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিল যে দাদার ওখানে যাওয়া দরকার। তবে সঙ্গে মা-ও যাবে। আর যাবে বোন। কারণ সে তো খুব ছোট, মাকে ছেড়ে থাকতে পারবে না। আর আমার সম্পর্কে ভাবা হল, যে ঠাকুমা ও দুই কাকিমার তত্ত্বাবধানে আমার মাকে ছাড়া খুব অসুবিধে হবে না। আমারও ব্যাপারটা শুনে কোনও অসুবিধার কথা মনে আসেনি।

 

আরও পড়ুন: দীপংকর চক্রবর্তীর কলমে: বাদাবনে বাঘের দেখা

 

তবে যাবার আগের কয়েকদিন মা অবশ্য আমাকে খুব বোঝালেন, দাদার কেন এখন পড়াশুনোর কারণে যাওয়া প্রয়োজন, মা না থাকলেও আমি যেন পড়াশুনোয় অমনোযোগী না হই ইত্যাদি। আমি নির্বিকার মুখে শুনলাম। আমার অসুবিধা যে কেন হবে, তা-ই আমি বুঝতে পারছিলাম না। দিব্যি দিন কাটাচ্ছিলাম। এমনি করে একদিন ওদের যাবার দিন এসে গেল। সবার সঙ্গে আমিও আলিপুরদুয়ার জংশনে গিয়ে কামরূপ এক্সপ্রেসে মা, বোন ও দাদাকে তুলে দিয়ে এলাম। মা খুব কাঁদলেন। আমি তখনও নির্বিকার। আমার আচরণে মনে হল সবাই বেশ অবাক।

বিকেলে ফিরে এলাম বাড়ি। এই পর্যন্ত মায়ের চলে যাবার জন্য বিশেষ কোনও অনুভূতি আমার হল না। কিন্তু সন্ধ্যাবেলায় মায়ের শূন্য ঘরে ঢুকে আমি বুঝলাম, কী হয়ে গেছে। মা তো ঘরে নেইই, দাদা আর বোনকেও নাগালের মধ্যে পাওয়া যাবে না। কতদিনের জন্য কে জানে?  কান্না আর মনখারাপ শুধু নয়, মা-বাবার প্রতি আমার বুকে খুব স্থায়ী এক অভিমান জমাট বেঁধে রইল।

এদিকে, মায়ের অনুপস্থিতিতে আমার ঠাকুমা এবং কাকিমারা আমাকে মাথায় তুলে ফেললেন। শুধু তাঁদের কাছে নয়, চা-বাগানের কাকিমা, জেঠিমা ও দিদিরাও আমাকে প্রশ্রয় দিতে শুরু করলেন।বাবা-কাকারা অফিস নিয়ে খুবই ব্যস্ত থাকতেন। আমার সারাদিনের রুটিন সম্পর্কে খোঁজখবর রাখতে পারতেন না। আমার পড়াশুনো নিয়ে বিশেষ কেউ মাথাই ঘামাত না। আমার যখন ঠিক এমন অবস্থা, তখন আমাদের বাড়িতে কাজ করতে এল গন্ধুর। সে আমার চেয়ে দু’তিন বছরের বড়ই হবে। গায়ের রং তো ওদের সকলেরই কালো, কিন্তু ওর চেহারাটি ছিল ঝকঝকে। চুলে তেল দিত নিয়মিত আর পরিপাটি করে আঁচড়ানো। হাসলে ওকে দেখাত বেশ। ওর সঙ্গে আমার ভারী ভাব হয়ে গেল। আমার সব মনখারাপ আর একাকীত্ব গন্ধুর একাই দূর করে দিল।

কিন্তু আমাদের বাড়ির কোনও জায়গাই থাকবার জন্য গন্ধুরের পছন্দ হল না। সে আমাদের রান্নাঘর ঘেঁষে, বাঁশ, কাঠ ও টিন দিয়ে একটা মনোরম আস্তানা বানিয়ে ফেলল নিজের জন্য। রান্নাঘরের ছায়ায়, কলাবনের পাশে কী সুন্দর সেই নির্মাণ। একটু উঁচুতে মাচার উপর ঘর, উঠবার জন্য মই আছে। সেই আস্তানার ভেতরে তার নিজস্ব জিনিসগুলো সে পরিপাটি করে গুছিয়ে রেখে দিল। বিছানা, গেঞ্জি আর হাফপ্যান্ট, সবুজ ফ্রেমে বাঁধানো আয়না ও লাল চিরুনিও গুছিয়ে রাখল। দরমার দেওয়ালে আশা পারেখের একটা ছবি সযত্নে টাঙাল। রাখল গুলতি, আরও কিছু টুকিটাকি জিনিস। আমাকে অবশ্য বিশেষ করে টানত এক কোণে রাখা অন্য একটা জিনিস– সেটা হল ওর তির-ধনুক। ও বলত চ্যেয়ারি। তিরগুলোর মাথায় লোহার ফলা বসানো, পেছনে পালক।

jaldapara_dooars
গন্ধুর ধরিয়ে দিল জঙ্গলে ঘুরে বেড়াবার নেশা

গন্ধুর আমাকে ধরিয়ে দিল জঙ্গলের নেশা। সে জীবনে স্কুলমুখো হয়নি। আমার স্কুলে যাওয়াও সে খুব জরুরি মনে করত না। আর আমারও তখন স্কুলের পড়ায় মন বসত না। সুতরাং ওর সঙ্গে শুরু হল জঙ্গলে আমার নানা অ্যাডভেঞ্চার। প্রায়শই স্কুলে যাবার নাম করে বেরিয়ে, বইয়ের ব্যাগ কোথাও লুকিয়ে রেখে আমরা দু’জনে জঙ্গলের পথ ধরতাম। এই সময়ে একবার গ্রীষ্মের ছুটিতে শংকরদা, আমার পিসতুতো দাদা, অনেকগুলো দিন আমাদের বাড়িতে এসে থেকেছিল। সে যোগ দেওয়াতে বিষয়টা আরও জমে গেল। 

একদিন সকাল সকাল আমরা তিনজনে বেরিয়ে পড়েছিলাম। আমরা দু’জন নিরস্ত্র, গন্ধুরের পিঠে তির-ধনুক, পকেটে নিত্যসঙ্গী গুলতি। ডালপালা কাটার মতো একটা কাটারিও নিয়েছিল। আমরা গারোপাড়ার দিক দিয়ে জঙ্গলে ঢুকে গেলাম। এখন ভাবতে অবাক লাগে, যে এ-সমস্ত ভ্রমণে বের হবার আগে কতকগুলো কথা আমাদের মাথাতেই আসত না। তেষ্টা পেলে জল কোথায় পাব, খিদে পেলেই বা কী করব, ফেরার পথ চিনতে না পারলেই বা কী হবে– এসব কিচ্ছু না ভেবে, গন্ধুর-ভরসা জেনে বেড়িয়ে পড়তাম। সে দিন জঙ্গল যতক্ষণ পাতলা ছিল, আমরা কথা বলতে বলতে চলছিলাম। গন্ধুর বাংলা ভালোই বুঝত। কিছুটা বলতেও পারত, তবে বেশিটাই বলত সাদরি ভাষা। ওর একটা মুশকিল ছিল, দশটা বাক্যের মধ্যে অন্তত চারবার সে অনিবার্যভাবে উচ্চারণ-অযোগ্য একটা বিশেষ ‘স্ল্যাং’ ব্যাবহার করত। উচ্চারণের সারল্যে তা খুব খারাপ শোনাত না বলে আমরা তাতে আপত্তিও করতাম না, বরং শোনবার জন্য খানিকটা উৎসাহই থাকত। গন্ধুরেরর গুলতি বা তির লক্ষ্যভেদে ব্যর্থ হলে সে শব্দটিকে বেশ খানিকক্ষণ ধরে টেনে উচ্চারণ করত।

সেদিন একটা বন-মুরগি আমাদের খুব ঘোল খাওয়াচ্ছিল। এ গাছ থেকে ও গাছে ক্রমাগত উড়ছিল। উড়ন্ত পাখিকে তিরে বিঁধে ফেলা সহজ নয়। কিন্তু গন্ধুর মরিয়া হয়ে ওর পিছু নিয়ে বেশ গভীর বনে ঢুকে পড়েছিল। এই নিবিড় বনে বনমুরগির দেখা আর মিলল না, বদলে এক অদ্ভুত দৃশ্যের সম্মুখীন হলাম। বনের মাঝে খানিকটা ফাঁকা জায়গায় গোটা আট/দশ বাঁশ-মাটি-ডালপালা দিয়ে তৈরি বাড়ি। বাড়ির সম্মুখে পরিষ্কার নিকনো উঠোন, মাটি দিয়ে লেপা কুয়ো। সেখানে দাঁড়িয়ে বসে নানা বয়সের স্ত্রী-পুরুষ, শিশু। তাদের স্বাস্থ্য চমৎকার। লজ্জা নিবারণের খুব একটা প্রচেষ্টা নেই। হাসিতে অনাবিল সারল্য। হাসিমুখেই আমাদের দিকে চেয়ে রইল। আমরা ভয় কাটিয়ে ওদের উঠোনে ঢুকে বাঁশের বেঞ্চে বসে জল খেলাম। ওরাই এনে দিল। এত ঘন জঙ্গলে ওরা থাকে? আমি আর শংকরদা অবাক হই। গন্ধুর বলে, এরা জংলি আদমি। অনেক পরে পড়েছিলাম, রাভা উপজাতিদের একটি গোষ্ঠী জঙ্গলে থেকে যাওয়াই স্থির করেছিল। এরা মনে হয় সেই রাভাদেরই বংশধর। জানি না উত্তরবঙ্গের জঙ্গলে এখনও এরা বাস করে কিনা! 

Rabha Tribe
রাভাদের একটি সম্প্রদায় গভীর অরণ্যচারী হয়েই থেকে গিয়েছিল

সেদিন আমার আরও একটি অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সে কথা বলে এবারের মতো জঙ্গুলে অ্যাডভেঞ্চারের কাহিনি শেষ করব। ঘুরতে ঘুরতে দুপুর নাগাদ হঠাৎ দেখি একটা বুনো শুয়োর বড় একটা গাছে দাঁতের ধার পরীক্ষা করছে। আমাদের দিকে তার নজর পড়েনি। কিন্তু গন্ধুরের সাবধানবাণী আর নির্দেশে আমরা শুয়োর দেখামাত্র উল্টোদিকে ছুট লাগালাম। বেশকিছুটা ছোটার পর আমার কানে এল সুরেলা কলকলধ্বনি। তারপর যতই ছুটি, আওয়াজ ততই জোরালো হয়ে ওঠে। ছুটতে ছুটতে একসময় জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসে বালিতে পা রাখলাম। আর চোখের সামনে খুলে গেল অবাক করা দৃশ্য। প্রমত্ত উল্লাসে সশব্দে মহাবেগে এক প্রশস্ত নদী আমাদের চোখের সামনে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে।

The river
সশব্দে মহাবেগে এক প্রশস্ত নদী আমাদের চোখের সামনে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে

পাথরে পাথরে আঁকাবাঁকা স্রোতের আঘাত যে শব্দ তুলেছে, তার তুলনা বুঝি হয় না। সে কি এক অতিকায় অজগরের নিশ্বাসের শব্দ? নাকি সজল মেঘে-মেঘে গরগর সংঘর্ষের আওয়াজ? এখানে এই প্রবল উপলমুখর জলরাশি, আদিম বনভূমি ছাড়া আর কেউ নেই। আমি আর শংকরদা অবাক হয়ে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। গন্ধুরের চোখেও বিস্ময়। তারপর তো জীবনভর কত নদী দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। কিন্তু সেদিনের অমন গা-ছমছমে অনুভূতি আর কখনও কোনও নদীর সামনে দাঁড়িয়ে হয়নি।

বর্ষাকালেই চা-বাগানে আসল ব্যস্ততা। চা-গাছের শক্ত ডালে নতুন পাতা বেরত। সবুজের বাড়-বাড়ন্ত এই ঋতুতে। উৎপাদনে ধুম লেগে যায় তাই। নথিবদ্ধ শ্রমিকদের দিয়ে আর কুলায় না। উৎপাদনের চাপ সামলাতে তখন অতিরিক্ত শ্রমিক অস্থায়ী চুক্তিতে নেওয়া হয়। আমাদের বাড়িতে বছর তিন-চারেক থাকার পর গন্ধুর এরকম ঠিকে কাজের সুযোগ পেয়ে যায়। এতে পরবর্তীকালে স্থায়ী চাকরির ক্ষীণ আশা থাকে, তাই সে চলে যায়। কিন্তু যাবার আগে আমাকে একদিন বড়ো করে দিয়ে যায়।

আসলে আমরা যে শুধু ফরেস্টেই বেড়াতে যেতাম তা তো নয়, প্রায়ই চা-বাগানের মধ্যে বেড়াতেও যেতাম। ও পাখি শিকার করত গুলতি দিয়ে। গন্ধুর মাঝে মাঝে ওর গুলতিটা আমার হাতে দিত। কিন্তু কী আশ্চর্য, সারা কৈশোরে আমি একবারও লক্ষ্যভেদ করতে পারিনি। লক্ষ্যভেদ ছিল আদিবাসীদের রক্তে। তো তেমনই একদিন আমরা দু’জনে বড়োসাহেবের কুঠির পেছন দিকে গিয়েছি। পাতা তোলার কাজ না চললে চা-বাগান এমনিতেই নির্জন। সাহেবকুঠির পেছন দিকটা ছিল একেবারেই জনহীন। গন্ধুরের সেদিন দেখি পাখির খোঁজে মন নেই। গাছের উপরের দিকে সে মোটে তাকাচ্ছে না। বরং খানিক পরে গাছের নীচে দাঁড়িয়ে থাকা একটি মেয়েকে দেখে হেসে এগিয়ে গিয়ে গল্প জুড়ে দিল। মেয়েটিও আদিবাসী। তারপর গন্ধুর আমার দিকে এসে গুলতিটা হাতে দিয়ে  বলল, ‘তুই একটু উইদিকটায় ঘুরে আয়, উইদিকে পাখি মিলবে।’ আমি বললাম, ‘তুই কোথায় যাবি?’ সে বলল, ‘এই মৈঁয়াটার সঙ্গে আমার একটা কাজ আছে। তুই ইদিকে একদম আসবি না। আমি কাজ শেষ হলে তোকে খুঁজে নেব।’

আমি অতশত না বুঝে গুলতি হাতে অন্যদিকে চলে গেলাম। বেশখানিক পর গন্ধুর এল। এবং হাসতে হাসতে তার ‘মৈঁয়ার সঙ্গে কাজ’-এর বর্ণনা দিল। শুনে তো আমি বিস্ময়ে হতবাক। শেষে মনে মনে ভাবলাম, যে কোনও কাজই কি তাহলে গন্ধুরের কাছে এত সহজ!

 

ছবি সৌজন্য: petmypet, indiatimes, wbtourism এবং লেখকের সংগ্রহ

অপূর্ব দাশগুপ্ত 'পুরোগামী' পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক। প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ভূমি ও ভূমি সংস্কার বিভাগের অবসরপাপ্ত বিশেষ রাজস্ব আধিকারিক।

One Response

  1. সত্যি অপূর্ব ( অপু) অপূর্ব অসাধারণ লেখা।আগেও বলেছি আবার বলছি তোর লেখা পড়তে পড়তে আমিও আমার ছেলেবেলায় ফিরে যাই, মনে হচ্ছে যেন দেখতে পাচ্ছি। তোর মতো না হলেও আমিও গরমের, পূজোর,আর ডিসেম্বরের ছুটিতে আমার দেশের বাড়ি আরামবাগ যেতাম দারকেশ্বর নদীর তীরে।তখনও অনেক বনজঙ্গল ছিল, এখন তার কোনো চিহ্ন নেই শুধু মানুষ আর বাড়ির জঙ্গল। যাইহোক চালিয়ে যা ভাই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *