বাদাবনে বাঘের দেখা
“বাদাবনে ঢুকে আমরা ভুলেও তেনাদের নাম করি না। বলি, দক্ষিণ রায়”… যতটা সম্ভব নিচু গলায় বনরক্ষী আমাকে বললেন। ঠিক ফিসফিস করে নয়, যেন চাপা রাগে হিসহিস করে। দোষ আমারই। সকালবেলায় যাত্রা শুরুর আগে সজনেখালি ফরেস্ট অফিসে বসে সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভ-এর রেঞ্জার সাহেব আমাদের ডিটেলসে ব্রিফ করে দিয়েছেন, কী কী করণীয়, কী কী একেবারেই করা চলবে না।
সবাই জানে, ‘বনে থাকে বাঘ, গাছে থাকে পাখি‘… পাখিটাখি নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু বাঘ যে মানুষের ঘাড় মটকে খায়! বিশেষ করে সুন্দরবনের রাজা বাঘ! রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার! গভীর জঙ্গলের মধ্যে তাদেরই রাজত্ব। তাই বনের মধ্যে বাঘের নাম নেওয়া বারণ, তাতে নাকি তেনাদের অসম্মান হয়। এটা সুন্দরবনের বাসিন্দাদের বিশ্বাস। বনকর্মীরাও তা মানেন। সে কথা রেঞ্জার সাহেব বলে দিয়েছেন পই পই করে। তারপরেও দুম করে আমি গভীর জঙ্গলের মধ্যে দাঁড়িয়ে বাঘের নাম নিয়ে ফেললাম! একেবারে অমার্জনীয় অপরাধ!
যতদূর মনে পড়ে সেটা ১৯৯৫ সালের নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি। সুন্দরবনে সে বছর বাঘসুমারি হবে। তার আগের বার বাঘ গণনা হয়েছিল ১৯৯২ সালে। গণনা হয়ে ফল বেরতে বেরতে ‘৯৩ হয়ে গেছিল। জানা গিয়েছিল, সুন্দরবনে ২৫১টি বাঘ আছে। তার মধ্যে নানা কারণে ছ‘টি মারা গেছে। সোজা হিসেব। তবে গণনার পদ্ধতি ঠিক বিজ্ঞানসম্মত নয় বলে অনেক কথা উঠেছিল। ধোঁয়াশা ছিল বেশকিছু, বন দফতর যার জবাব দিতে পারেনি। সেইজন্যই পরেরবার বনমন্ত্রী কীভাবে সুমারি হয় দেখার জন্য নানা কাগজের সাংবাদিকদের ডাকলেন। যতদিন বাঘ সুমারি চলবে, ট্যুরিস্টদের জন্য সুন্দরবন বন্ধ।

গোটা গণনা অফিশিয়ালি শুরু হওয়ার কথা ১৫ নভেম্বর। তবে আমরা ব্যাপার-স্যাপার খতিয়ে দেখে কিছু কার্টেন রেইজার পাঠানোর জন্য দিনকয়েক আগেই রওনা দিলাম। আমরা মানে আমি, আনন্দবাজারের রিপোর্টার, আর তারাপদ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিখ্যাত ফটোগ্রাফার। তারাদা সুন্দরবনে বেশ কয়েকবার ছবি তুলতে গিয়েছেন। অনেক আনাচ কানাচ জানা। আমি যদিও তার আগে বারকয়েক বেড়াতে গিয়েছি, অফিসের কাজে সেই প্রথম। তার ওপর টাইগার রিজার্ভ-এর একেবারে কোর এরিয়া, বাঘের ডেরায় যাওয়ার সুযোগ!
অফিসের গাড়ি আমাদের ক্যানিংয়ে ছেড়ে দিল। সেখানে নদীর ওপর রাশি রাশি নৌকো সুন্দরবনে যাওয়ার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। নৌকো মানে ভুটভুটি, বাতিল মোটরসাইকেলের মোটরে চলে। তার মধ্যে একটা তারাদা দেখেশুনে পছন্দ করে ভাড়া করে ফেললেন। আমাদের সঙ্গেই ক‘টা দিন থাকবে সেই ভুটভুটি। মাঝে একটা শক্তপোক্ত ছাউনি, গলুইয়ের একদিকে বাথরুমও আছে একটা। নৌকো ঠিক করে তারাদার আর দেখা নেই। একটু পরে বিজয় গর্বে দু‘দুটো টাটকা ভেটকি মাছ হাতে ঝুলিয়ে তিনি নৌকোয় উঠলেন। যেতে যেতে রান্নাবান্না খাওয়া-দাওয়া হবে। তারাদার সঙ্গে একজন তল্পিবাহক ছিল, অল্পবয়েসি একটি ছেলে, ফটোগ্রাফির ট্রেনিং নিচ্ছে। দামি ক্যামেরা তারাদার হাতে, আর ভারী ভারী বিশাল জুম লেন্সগুলো সেই ছেলেটির জিম্মায়।
ভুটভুটি ছাড়ল। নদীর জল কেটে ভুটভুট করতে করতে আমরা চললাম সজনেখালি। মাঝিরা দু‘জন রান্নাবান্না করে চমৎকার! হুসহাস করে ঝাল ঝাল মাছের ঝোল ভাত খেয়ে পৌঁছলাম সজনেখালি টুরিস্ট লজে। আর কোনও কাগজের কেউ তখনও যায়নি। শুধু আমরাই। শালগাছের খুঁটির ওপর বসানো কাঠের তৈরি দোতলা লজ। নীচে কর্মচারীদের কয়েকটা ঘর, আর ওপরে ট্যুরিস্টদের ঘর। ছোট, কিন্তু লাগোয়া বাথরুম আছে, পরিচ্ছন্ন বিছানায় মশারি টাঙানো। এল-শেপের লজের মাঝখানে বেশ বড় খাওয়ার ঘর। তার মুখোমুখি একটা ছোট সেতু দিয়ে একটেরে রান্নাঘর। আমরা ঘর নিয়ে দিব্যি গুছিয়ে বসেছি। তারাদা বললেন, লজে থাকবেন না, থাকবেন নৌকোয়। মাঝিরা তাতে খুব একটা উৎসাহ দেখাচ্ছিল না, কিন্তু তারাদা নাছোড়। অগত্যা!

সজনেখালি টুরিস্ট লজটা খুব সুন্দর দেখতে। তা ছাড়া ওরকম একটা জঙ্গলের ভেতরে ছমছমে পরিবেশে থাকাটা দারুণ অভিজ্ঞতা। তখন সজনেখালিতে ইলেকট্রিকের আলো ছিল না। কেন যেন মনে হয়, সেটা ওখানে মানাতও না। সন্ধেবেলা ঘরে একটা করে হ্যারিকেন ধরিয়ে দিয়ে যেত। আর অন্ধকার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গোটা জঙ্গলটা যেন ঝাঁপিয়ে পড়ত টুরিস্ট লজের উপর। হ্যারিকেনের টিমটিমে আলোয় লজের ঢালা বারান্দায় মোড়া নিয়ে বসে ‘সাউন্ড অফ সাইলেন্স‘ উপভোগ করা। নিস্তব্ধ গভীর অরণ্যে শব্দ বলতে কেবল নানা রকমের পোকার আওয়াজ। আশায় ছিলাম দূরে জঙ্গলের কোথাও যদি বাঘের গর্জন শোনা যায়! রাতে খেতে বসে লজের কর্মচারীদের কাছে এত ‘বাঘাড়ম্বর‘ শুনেছি, ঘুমের মধ্যেও স্বপ্নে দেখা দিয়েছেন দক্ষিণ রায়।
পরদিন সকালে রেঞ্জার-এর সঙ্গে কথা বলে আমরা সঙ্গ নিলাম ওঁর ঠিক করে দেওয়া বনরক্ষীদের। আমাদের ভুটভুটি করেই গভীর জঙ্গলে যাত্রা। তিনজন বনরক্ষী, তাঁদের মধ্যে দু‘জন বন্দুকধারী সামনে আর পেছনে, মাঝখানে আমরা তিনজন। বনকর্মীরা মাথায় উল্টো মুখোশ পরে চলেছেন। ওঁদের ধারণা, বাঘ ভাববে লোকটা বুঝি তার দিকেই তাকিয়ে আছে। তা হলে সরাসরি ঝাঁপিয়ে পড়বে না। এই ব্যাপারটা একসময় খুব চালু থাকলেও পরে দেখা গিয়েছে মনকে চোখ ঠারা ছাড়া তেমন একটা কাজ হয় না। ভুটভুটি থেকে পাড়ে নামতেই তলতলে কাদায় গোড়ালি পর্যন্ত পা ঢুকে গেল। এখন বাঘের দেখা পেলে ছুটে পালাতেও তো পারব না! গাধার পিঠে চড়ে গুপী গাইনের কাঁদো কাঁদো গলায় সেই গানটার কথা হঠাৎ মনে পড়ে গেল..
“সন্ধ্যা হইলে বনবাদাড়ে
বাঘে যদি ধরে,
গুপী যদি মরে...!”
বনবাদাড়ে এখানে বাদাবন, সন্ধ্যার জায়গায় দুপুর, আর গুপীর বদলে দীপু। তাই ভরসা নাই!

ম্যানগ্রোভের শ্বাসমূল খোঁচাখোঁচা বেরিয়ে রয়েছে। সেগুলো বিঁধে না–যায় দেখে পা টিপে টিপে গভীর বন থেকে আরও গভীরে চলেছি। তখনই হঠাৎ বলে ফেলেছিলাম, “এ তো পুরো বাঘের ডেরা!” তাতে যে বকুনি খেতে হয়েছিল প্রথমেই বলেছি। চারদিকে অসম্ভব ছমছমে একটা ভাব। বনকর্মীরা বেশিক্ষণ ওখানে থাকতে চাইছিলেন না। ফেরার জন্য ব্যস্ত। এরপর ভাটা এসে যাবে, জল থাকবে না, নৌকো চলবে না! বাঘেরা নাকি ওই সময়েই সবচেয়ে বিপজ্জনক হয়ে ওঠে, ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি আর তারাদা কাদামাটির ওপর ‘পাগমার্ক‘ বা বাঘের থাবার দাগ খুঁজছি। বনরক্ষীদের সতর্ক, ভয়ার্ত চোখ জঙ্গলের দিকে।
ছোটবেলায় পড়া ‘সুন্দরবনের আর্জান সর্দার‘ মনে পড়ে যাচ্ছিল। মনে পড়ছিল চাঁদ সদাগরের কাহিনি। সুন্দরবনেরই বাসিন্দা ছিলেন চাঁদ সদাগর। সেই বেহুলা-লখিন্দর, সেই নেতিধোপানি, পুজো না পেয়ে ক্রুদ্ধ মনসা শিবভক্ত চাঁদ সদাগরকে নাকানিচোবানি খাওয়ানোর কত চেষ্টাই করছেন, আর চাঁদবেনে হেঁতালের লাঠি উঁচিয়ে তাঁকে তাড়াচ্ছেন- সব মনে পড়ে যাচ্ছিল।
ফেরার মুখে দেখলাম বনবিবির মন্দির। ঘন জঙ্গলের মধ্যে চারিদিকে গাছপালায় ঘেরা ছমছমে পরিবেশ। তার মধ্যে ছোট্ট একটা চালাঘরে বনবিবির থান। এক সুফি ফকিরের মেয়ে বনবিবির একপাশে তাঁর বীরভাই শাহ্ জংলি, পক্ষপুটে তাঁর আশ্রিত ছোট্ট ছেলে দুখে, উল্টোদিকে ভয়ঙ্কর বাঘরূপী দক্ষিণ রায়। সুন্দরবনের মানুষের বিশ্বাস, বনবিবি তাদের রক্ষাকর্ত্রী। তাই হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে সকলের পুজো পান তিনি। দক্ষিণ রায় নাকি আসলে ছিলেন রক্তলোলুপ এক জমিদার। অন্ধকার হলেই বাঘের রূপ ধরে বেরিয়ে পড়তেন প্রজাদের ঘাড় মটকে খেতে। কে না জানে সুন্দরবনের বাঘ মানুষখেকো!

ওঁরা তার কারণও বলছিলেন, সুন্দরবনের জল নোনতা। বাঘেদের মূলত সেই জল খাওয়া অভ্যাস। মানুষ ছাড়া আর সব প্রাণীরই রক্ত মিষ্টি। তাই একবার মানুষের রক্তের স্বাদ পেলে সেই বাঘ মানুষখেকো হয়ে যায়। নোনতা স্বাদ নাকি তাদের খুব পছন্দ। সুন্দরবনের মৌলি, যাঁরা মধুর সন্ধানে বেরোন, যাঁরা কাঠ কুড়োতে জীবন হাতে করে জঙ্গলে যান, ভাটির কাদা ঘেঁটে কাঁকড়া তুলে আনেন, সবাই বাঘের হাত থেকে রক্ষা পেতে বনবিবির পুজো দিয়ে যাত্রা শুরু করেন। তবে সবসময় সুরক্ষা তারা পান না, প্রায়ই বাঘের পেটে যেতে হয় অভাবী মানুষগুলোকে। গোটা একটা গ্রামই আছে, বিধবাদের বাস।
গল্প শুনে মনটা ভারী হয়ে গেল। একটু ভয় ভয়ও করছিল। মাঝিরা বলল, বাঘের কাছে ছোট ছোট খাঁড়িতে লাভ দিয়ে নৌকায় উঠে কারও ঘাড় কামড়ে ধরে জঙ্গলে টেনে নিয়ে যাওয়া কোনও ব্যাপারই না। বহুবার এ রকম হয়েছে। বাঘ যেমন ওস্তাদ সাঁতারু, তেমনই যাকে টার্গেট করবে তাকে ধরবেই। তাই খুব সাবধান!
সুন্দরবন আমাকে বরাবরই ভীষণরকম টানে। এখনও! বাঘ, কুমির, কামট, মানুষজন, জল, দ্বীপ, ম্যানগ্রোভ জঙ্গল! সুন্দরী, গরান, হেঁতাল, বাইন গাছ। দোবাঁকি, নেতিধোপানি, সুধন্যখালি, সজনেখালি.. এক একটা বাঘের ডেরার কী সব নাম! শুনলেই বুকের ভেতর শিরশির করে ওঠে। মনে হয় এদিক ওদিকে গাছের আড়াল থেকে বাঘ বুঝি চুপচাপ আমাকে নজরে রাখছে।
এটা আমার একটা অদ্ভুত ব্যাপার। আমার কাছে সুন্দরবন মানেই বাঘ, শুধু বাঘ। প্রচণ্ড হিংস্র, ধূর্ত, অসম্ভব শক্তিশালী একটা প্রাণী। হয়তো আমার অজ্ঞতার জন্যই আগে বাঘকে ভয় করতাম না। বাঘ সম্পর্কে আমার জ্ঞানের বহরও বই-নির্ভর। জিম করবেট আর বুদ্ধদেব গুহর লেখা গোগ্রাসে গিলে নিজেকে বেশ ‘ব্যঘ্রজ্ঞানী‘ মনে করতাম। যদিও চিড়িয়াখানায় নিরাপদ দূরত্বে ছাড়া বাঘের মুখোমুখি হইনি কখনও। সেদিন কিন্তু সত্যি সত্যি বাঘের ভয় বুকে বাসা বাঁধল। কত পড়েছি, ‘বাঘের দেখা আর সাপের লেখা‘। সুন্দরবনের মানুষ মনে করে বাঘের দেখা পেলে রক্ষা নেই, আর সাপের লেখা মানে ললাট লিখন। সাপের কামড়ে মৃত্যু হবে বলে যদি কপালে লেখা থাকে, তা হলে হবেই হবে। কেউ আটকাতে পারবে না।

সজনেখালিতে ফিরে লজে ঢুকতেই দেখি প্রচণ্ড হইচই। ছ‘টি বিদেশি ছেলেমেয়ে সেখানে হাজির। কিন্তু ওই সময় তো ট্যুরিস্টদের যাওয়া বারণ! ওরা এসব কিছুই জানে না। রাইটার্স বিল্ডিং থেকে পারমিট নিয়ে এসেছে, সেখানেও যে ব্যাপারটা কারও জানা নেই, বোঝাই যাচ্ছে। অথচ এঁরা এখানে ওঁদের থাকতে দিতে চাইছে না। লজের ম্যানেজারকে বোঝালাম, ওঁরা সবাই বিদেশের নাগরিক। এখানে আসার জন্য সরকারি পারমিট আছে, আপনি না থাকতে দিলে বিপদে পড়বেন ওঁরা, আপনিও। শেষ পর্যন্ত ম্যানেজার রাজি হলেন। সব ছেলেমেয়ে ইউরোপের। পর্তুগাল, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানির। বিকেল হতে না হতে মাঝিদের তাড়ায় তারাদা অনিচ্ছা সত্ত্বেও নৌকোয় ফিরে গেলেন। মাঝিরা ভুটভুটি একেবারে মাঝনদীতে নিয়ে গিয়ে নোঙর ফেলল।
আমাদের লজে বসে চা আর চানাচুর খেতে খেতে বিদেশি ছেলেমেয়েগুলোর সঙ্গে গল্প শুরু হল। বললাম, এত চেঁচামেচি কোরও না, তা হলে কিন্তু বাঘ ধারে কাছেও আসবে না। বাঘেরা মানুষদের একদম পছন্দ করে না। তারপর থেকে ওরা ফিসফিস করে কথা শুরু করল।
সাময়িকভাবে সুন্দরবনে টুরিস্ট আসা বন্ধ, তাই লজে তেমন খাবারের আয়োজনও ছিল না। রাতে আমাদের সবার জন্য মুরগির মাংসের ঝোল আর ভাত হবে। অল্প বয়েসি ছেলেমেয়ে, কাজেই গোটা চারেক মুরগি জবাই হল। খাওয়াদাওয়া সেরে আমরা কেউ বারান্দায় দাঁড়িয়ে, কেউ মোড়ায় বসে গল্প করছি। তারাদার সঙ্গী ছেলেটির হাতে একটা পাঁচ সেলের টর্চ। হঠাৎ কী যেন একটা শব্দ শুনে সেদিকে টর্চ মারতেই দেখি ঘুটঘুটে অন্ধকারের ভেতর, রান্নাঘরের পাশে বেড়ার ধারে বিশাল কেঁদো একটা বাঘ ঘাপটি মেরে বসে আছে!!!
জোরালো টর্চের আলোয় তার চোখগুলো আগুনের গোলার মতো জ্বলজ্বল করে উঠল। আলো পিছলে যাচ্ছে বাঘের হলুদ গায়ের ওপর দিয়ে, কালো ডোরাগুলো চিকচিক করছে। খাদ্য ও খাদকের মাঝখানে মাত্র কুড়ি-পঁচিশ ফুটের দূরত্ব। হাঁড়ির মতো মুখ, খাড়া গোঁফ, ঘাড়ের রোঁয়া, সব দেখতে পাচ্ছি। আচ্ছা, ও-ও তো আমাদের দেখছে! ওর রাগ হচ্ছে, নাকি কৌতূহল? নাকি আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছে, কিছু দেখতে পাচ্ছে না! আমাদের ভরসা কেবল শক্ত লোহার তারের একটা বারো ফুটিয়া জাল। এত কাছাকাছি এত বড় বাঘ দেখব কল্পনাও করিনি। লজের কর্মীরা বললেন, বাঘটা বুড়ো। রান্নাঘরের জানালা দিয়ে মুরগির ছালচামড়া, নাড়িভুঁড়ি, হাড়গোড় জঙ্গলে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে, সেগুলো খেয়ে আরো খাওয়ার আশায় বসে আছে। আমি তারাদার ছেলেটিকে বললাম, শক্ত হাতে টর্চ ধরে থাক, বাঘের চোখ থেকে আলো সরিও না।

লজের কর্মীরা অভিজ্ঞ। এরমধ্যে দেখলাম সকলেই টুকটাক করে সরে পড়েছে, যে যার ঘরে গিয়ে দরজায় খিল দিয়েছে। আমরা তখনও মন্ত্রমুগ্ধের মতো দাঁড়িয়ে আছি বারান্দায়। বিদেশি ছেলেমেয়েদের কাছে যে ক্যামেরা ছিল, তাতে অন্ধকার চিরে বাঘের ছবি অত ভাল আসবে না। এই রকম ছবি তোলার মতো দামি ভাল ক্যামেরা রয়ে গেছে তারাপদদার কাছে। তখন হাত কামড়াতে ইচ্ছে করছে, কেন আমি আমার ক্যামেরা নিয়ে যাইনি। লজের কর্মীরা বলে গিয়েছিলেন, কোনওরকম আওয়াজ করবেন না। জোরালো আলো এদিক ওদিক ফেলবেন না। তাতে বাঘ বিরক্ত হযতে পারে।এমনিতে ভয় নেই, কারণ দোতলায় ওঠার কাঠের সিঁড়িতে ফাঁক আছে। সিঁড়ির ধাপে ওরকম ফাঁক দেখলে বাঘ নাকি ভয় পায়, সিঁড়ি বেয়ে ওঠে না। শুনে ওই সময়েও সৈয়দ মুজতবা আলীর একটা অসাধারণ মজার কথা মনে পড়ে গেল।
‘কুকুর ঘেউ ঘেউ করে ডাকছে, তাই শুনে একটা লোক ছুটে পালাচ্ছে। কে যেন বলল, আরে, খামোখা ছুটছ কেন? জানো না, যে কুকুর ডাকে সে কামড়ায় না? লোকটা ছুটতে ছুটতেই বলল, আমি জানি। কিন্তু কুকুরটা কি সে কথা জানে?’ এখানেও মনে হল, লজের লোকেরা জানে বাঘ ফাঁকওয়ালা সিঁড়ি দিয়ে উঠবে না। কিন্তু বাঘ কি সে কথা জানে?
এদিকে ভারী টর্চ ধরে রাখতে গিয়ে ছেলেটির হাত একটু সরে গিয়েছিল। আবার টর্চ মেরে দেখি, যেখানে বাঘ ছিল সেখানে নেই। ব্যস! সে তো আমাকেই টার্গেট করে রেখেছে! এবার এল বলে। আমার পুরো পা তখন যেন রবারের, থরথর করে কাঁপছে, কিন্তু ফেলতে পারছি না। সিঁড়ি দিয়ে উঠেই একটা ফঙ্গবেনে বেড়া টাইপের দরজা, হাঁ করে খোলা। ইংরেজ ছেলেটির কাছে গুলতির রবারের মতো একটা ফিতে ছিল। অসীম সাহসে বারান্দা দিয়ে এগিয়ে সে ওই কাঠের দরজাটা রবার দিয়ে বেঁধে দিল। যে বাঘের থাবায় একটা পূর্ণবয়স্ক মোষের মাথা চুরচুরে হয়ে যায়, তার কাছে ওই কাঠের পলকা বেড়ার মতো দরজা খোলা বা আটকানো থাকায় কী তফাৎ হবে জানি না! লজের লোকেরা বলেছিল, এখনই ঘরে চলে যান, দরজায় খিল এঁটে থাকবেন। বাঘ বারো ফুটি তারের জাল টপকে ভেতরে ঢুকতে পারবে না ঠিকই, তবে নদীতে নেমে সাঁতরে ঘাটে উঠে লজের সামনে চলে আসতে পারে।

সেই রাতটা যে কীভাবে কেটেছে, শুধু আমরাই জানি। যে যার ঘরে দরজা আটকে বসে রইলাম, ঘুম আর আসে না। তারপর কখন যে ভোর হয়েছে, ঘুমিয়ে পড়েছি, টের পাইনি। সকালে উঠে খবর পেলাম, কাছে আর একটা জঙ্গল থেকে বাঘ একজন বনকর্মীকে ধরে নিয়ে গেছিল, তিনি মারা গেছেন। তাই শুনে সুন্দরবনের বনকর্মীরা সব ভয়ে বাড়ি চলে গেছেন। সুমারি বন্ধ।
শুনেছিলাম, নেতিধোপানির কাছে একটি বাঘিনীকে দেখা গিয়েছে, সঙ্গে তিনটি ছানা। তাদের আর দেখা হল না, জঙ্গলের ভেতরেও আর যাওয়া হল না। তবে বাঘ তো দেখা হল! একেবারে সজনেখালি জঙ্গলের গা ঘেঁষে বাঘের দেখা পাওয়ার এই অভিজ্ঞতা কোনওদিন ভোলার নয়। আর ওই বিদেশি ছেলেমেয়েরাও ফেরার পথে সারাক্ষণ প্রচণ্ড উত্তেজিতভাবে সেই গল্পই করে গেল। ওদের সুন্দরবন আসা সার্থক। এর পরেও বহুবার সুন্দরবনে গিয়েছি, বাঘের টিকিটিও দেখিনি। ভারতের আরও বহু ব্যাঘ্র প্রকল্প ঘুরেছি, বাঘের দেখা পাইনি। শুধু সুন্দরবনে দক্ষিণ রায় কিছুক্ষণ দেখা দিয়ে ধন্য করলেন।
এই ঘটনার কথা অফিসে গিয়ে বলতেই সবাই হইহই করে উঠল। পরের দিন আনন্দবাজারের প্রথম পাতায় আমার অ্যাঙ্কর স্টোরি ছাপা হলো..
‘টর্চ ফেলতেই জ্বলে উঠল রয়্যাল বেঙ্গলের চোখ’…
*কাভার ছবি: Facebook
*বাকি ছবি: লেখকের সৌজন্য
দুই পুরুষের সাংবাদিক দীপংকর চক্রবর্তীর চার দশকের পেশাগত জীবনের শুরু ও শেষ আনন্দবাজার পত্রিকায়। মাঝে এক দশক বেতার সাংবাদিকতা জার্মানিতে ডয়চে ভেলে, আর ওয়াশিংটন ডিসিতে ভয়েস অফ আমেরিকায়। প্রিন্ট মিডিয়া থেকে অবসর নিলেও মাল্টিমিডিয়ায় এখনও পুরোপুরি সক্রিয়। করেছেন বই সম্পাদনার কাজও। দেশে বিদেশে তাঁর অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারও বিচিত্র ও চিত্তাকর্ষক।