প্রথমে ছড়াটির নাম রেখেছিলেন ‘জিজ্ঞাসু’, সন্দেশ পত্রিকায় তা ছাপাও হল। পরে যখন বই আকারে বের হবে তখন বিস্তর কাটাকাটি শুরু করলেন ডামি কপিতে। বহু ছড়ার নাম দিলেন বদল করে। ‘জিজ্ঞাসু’ ছড়াটিরও নাম তখন বদলে রাখলেন ‘নোটবই’। এই ছড়ায় এবং ছবিতে নাকি তাঁরই এক অন্তরঙ্গ বন্ধুর নানাবিধ জিজ্ঞাসু মনের কথা নিয়েই সুকুমার রায় সেদিন ছড়া বেঁধেছিলেন। ছড়ার সঙ্গে ছবিটিও এঁকেছিলেন বন্ধুবরকে মনে করে। লম্বা ছিপছিপে সেই বন্ধুর নাকটিও ছড়ার ছবিটির মতো টিকোলোই ছিল।
এ দাবি বন্ধুবরের একসময়ের সহকর্মী বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ পরিসংখ্যানবিদ প্রয়াত দেবকুমার বসুর! এ দাবি সত্যিই চমকপ্রদ! এহেন সেই বন্ধুর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নানা বিষয়ে জানার কৌতুহলের যেন কোনও শেষ ছিল না!! জানার সঙ্গে সঙ্গেই বন্ধুটি তা নোটবইয়ে লিখে রাখতেন। তাঁর দীর্ঘ কর্মমুখর জীবনের অজস্র বিষয় চর্চার ইতিবৃত্ত নানা নোটবইয়ের পাতায় ছড়িয়ে আছে। ফলে তাঁর এই বিবিধচর্চার জন্য তাঁকে শুধুই পদার্থবিদ বা অর্থনীতিবিদ কিংবা পরিসংখ্যানবিদ অথবা সাহিত্য-সংস্কৃতির তন্নিষ্ঠ পাঠক কোনও একটি বিশেষ নামে পরিচিতি দেওয়া সম্ভব নয়।
সুকুমার রায়ের এই ‘জিজ্ঞাসু’ বন্ধুটি হলেন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ।
আজ ‘কবি-সমীপে’র নিবন্ধে রবীন্দ্র-অনুষঙ্গে প্রশান্তচন্দ্রের ভূমিকার কথা জানা যাক। শোনা যায়, প্রশান্তবাবুর এই নোটবইয়ের জন্যই নাকি রবীন্দ্রনাথের কাছে তাঁর গদ্য পদ্য গল্প নাটক প্রবন্ধ ইত্যাদির ব্যাপারে কেউ কিছু জানতে চাইলে তিনি অনায়াসে তাঁদের বলতেন ‘প্রশান্ত জানে।’ এর মূলে রয়েছে প্রশান্তচন্দ্রের নিরন্তর রবীন্দ্রচর্চা। তিনি রবীন্দ্রনাথের গ্রন্থপঞ্জি তৈরি করেছিলেন। এর পাশাপাশি কবির বর্ষপঞ্জি তৈরি করাও ছিল তাঁর আরেকটি আরাধ্য কাজ। দৈনন্দিন কাজের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করার পর তাঁকে রবীন্দ্রনাথে মন দিতে হয়েছিল যা ছিল তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত ইচ্ছে।
ব্রাহ্মসমাজের সচেষ্ট ও একনিষ্ঠ কর্মী থেকে রবীন্দ্রনাথের নিবিড় সান্নিধ্যে এসেছিলেন প্রশান্তচন্দ্র। আর একবার যিনি এই মনীষার সান্নিধ্যলাভ করেছেন, তৎক্ষণাৎ মন্ত্রমুগ্ধও হয়েছেন। প্রশান্তচন্দ্রের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। নিজে বৈজ্ঞানিক হয়েও তাঁর সাহিত্যপ্রীতি কবিকে আকৃষ্ট করেছিল।
আসলে প্রশান্তচন্দ্র রবীন্দ্রনাথের সমগ্র সৃষ্টির জগৎ নিয়ে ভাবতেন, বলতেন, এমনকী লিখতেনও। যদিও তাঁর এই রবীন্দ্রচর্চার কথা আড়ালেই থেকে গেছে। বরং তাঁকে দেখা যায় কবির সহচর হিসেবে। প্রশান্তচন্দ্র লিখছেন এক জায়গায়:
‘১৯১১ সালের গ্রীষ্মের ছুটির আগের দু’মাস শান্তিনিকেতনে কাটিয়েছিলুম– তখন কলেজে পড়ি, সতেরো আঠারো বছর বয়স। তখন সারাদিন প্রায় ওঁর কাছে কাছেই থাকতুম। শান্তিনিকেতন পুরানো Guest House-এর দোতলায় পূর্বদিকের সেই ছোট ঘর-খানায় উনি থাকেন। এই ঘরে বসেই গীতাঞ্জলি, রাজা, ডাকঘর লিখেছেন। মাঝে একটা বসবার ঘর। আমি থাকি পশ্চিমের ঘরে। গ্রীষ্মকাল– আমি একটা মাদুর নিয়ে উপরের বড়ো ছাদে শুতাম।… রাত্রে খানিকক্ষণ কথাবার্তা বলতে বলতে দেখতুম উনি চুপ করে আসছেন। আমি ছাদে চলে যেতুম। কোনো কোনো দিন আমিও অনেকবার ছাদে বেড়াতে বেড়াতে দেখতুম কবি তখনও স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন। তারপরে গভীর রাতে কখন শুতে যেতাম। সূর্য্য ওঠবার আগে নীচে এসে দেখতুম কবি তার অনেক আগে উঠেছেন। কোনোদিন বারান্দায় বসে আছেন। কোনোদিন বা মন্দিরের সামনে পুবদিকের চত্বরে গিয়ে বসেছেন। সকালবেলা চায়ের টেবিলে নানা রকম আলোচনা। কখনো কখনো বিদ্যালয় থেকে কেউ আসতেন কাজকর্ম্মের কথা নিয়ে।… সকালে অনেকক্ষণ কবি নিজের লেখাও লিখতেন, চিঠির জবাব দিতেন। বেশ একটু বেলায় যেতেন স্নানের ঘরে। এই ছিল ওঁর অবসর। কখনো একঘন্টা কখনো দেড়ঘণ্টা স্নানের ঘরে থেকেছেন। কখনো শুনেছি গান করছেন।’

রবীন্দ্রনাথের দৈনন্দিন জীবনের কথা এমন সহজ করে আরও বলেছেন,
‘দুপুরে খাওয়ার পরে আবার কাজ। বিদ্যালয়ের ব্যবস্থা। লেখা। অধ্যাপকদের সঙ্গে আলোচনা। এছাড়া মাঝে মাঝে সকালে বা দুপুরে ক্লাশ পড়াতেন। কোনো নতুন গান লেখা হলে অজিত বা দিনুবাবুকে ডেকে পাঠাতেন। বিকেলে এক একদিন গান শেখানোর পালা। সন্ধ্যেবেলা আবার দুচার জনের সঙ্গে কথাবার্ত্তা। মাঝে খানিকটা বেরিয়ে আসতেন।…’
এরকম করেই দিনের পর দিন রবীন্দ্রনাথকে কাছ থেকে দেখেছেন। স্বীকার করেছেন, ‘ওঁর সঙ্গে সত্যিকারের পরিচয় এই রকম করে ঘটেছে।’
আসলে কবি তাঁকে পছন্দ করেছেন বলেই কিন্তু প্রশান্তচন্দ্রের পক্ষে এভাবে চেনা-পরিচয়টা সহজ হয়েছিল, এটা মাথায় রাখা দরকার। রবীন্দ্রনাথ এতটাই ভালবাসতেন তাঁর এই সুহৃদকে, একদিনের একটি ঘটনায় তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কী ঘটেছিল সেদিন?
প্রশান্তচন্দ্রের মতে, বাঙালির একটা স্বভাবের মধ্যে পড়ে বড্ড বেশি গলাগলি মাখামাখি করা। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের এমন স্বভাব ছিল না। তিনি চিরকাল একটু দূরত্ব বজায় রেখেই মিশতেন। একবার কবির এমন স্বভাবের ব্যতিক্রম ঘটায় প্রশান্তচন্দ্র খুব অবাক হয়েছিলেন। সেবার গ্রীষ্মকালে দুপুরের গাড়িতে বেলা বারোটা নাগাদ প্রশান্তচন্দ্র শান্তিনিকেতনে পৌঁছেছেন। রবীন্দ্রনাথকে তিনি জানিয়েওছিলেন সে কথা। এদিকে রবীন্দ্রনাথ না খেয়ে দেয়ে প্রশান্তচন্দ্রের জন্য অপেক্ষা করছিলেন ঠায়। প্রশান্তচন্দ্র শান্তিনিকেতনে পৌঁছনোর পর রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘যাও তোমার জন্য জল রেখে দিয়েছি। স্নান করে এসো।’

তখন রবীন্দ্রনাথ ‘দেহলি’ বাড়ির দোতলায় থাকতেন। সেখানে একটাই ঘর ছিল। প্রশান্তচন্দ্রের জন্য গেস্ট হাউসে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু এই গরমে খানিকটা হেঁটে গেস্ট হাউসে যেতে হবে বলে রবীন্দ্রনাথ তাড়াতাড়ি নিজের স্নানের ঘরের দিকে তাকিয়ে তাঁকে আদেশ করলেন। অনন্যোপায় হয়ে প্রশান্তচন্দ্র তাড়াতাড়ি স্নানঘরে গিয়ে দেখেন একটা পরিষ্কার তোয়ালে এবং জল তুলে রাখা হয়েছে তাঁর স্নানের জন্য। এমন ব্যতিক্রমী ঘটনায় প্রশান্তচন্দ্র রবীন্দ্রনাথের ভালবাসার এক নতুন দিকের সন্ধান পেয়েছিলেন। এমন ঘটনা অবশ্য আরও একাধিকবার হয়েছে।
সে-ও এক তপ্ত গ্রীষ্মের কথা। সেদিন প্রচণ্ড গুমোট গরম ছিল। সন্ধ্যায় কালবৈশাখী ঝড়ের সঙ্গে শিলাবৃষ্টি হল। অল্পবয়সী প্রশান্তচন্দ্র শান্তিনিকেতনের সমবয়সীদের সঙ্গে দৌড়াদৌড়ি করে বৃষ্টিতে খুব ভিজে গেলেন। ভেজা জামাকাপড় ছেড়ে শুকনো কাপড় পরে কবির কাছে গেলেন। এদিকে সেদিন খুব ঠান্ডা পড়েছে বৃষ্টির জন্য। হঠাৎ রবীন্দ্রনাথ উঠে পাশের ঘরে চলে গেলেন, ফিরে এলেন একটা গরম কাপড় নিয়ে। প্রশান্তচন্দ্রের গায়ে গরম কাপড় জড়িয়ে বললেন ‘বেশ ঠান্ডা আছে আর বাহাদুরি করতে হবে না!’ এমন ছোট ছোট অনেক ঘটনার মধ্য দিয়ে এই দুই অসমবয়সীর অন্তরের টানের কথা জানা যায়।

প্রশান্তচন্দ্রের কাছ থেকেই জানা যায়, প্রথম দিকে তিনি যখন পরিসংখ্যান বা রাশিবিজ্ঞান নিয়ে কাজকর্ম শুরু করছেন, তখন রবীন্দ্রনাথ যথেষ্ট আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। প্রেসিডেন্সি কলেজের স্ট্যাটিসটিক্যাল ল্যাবরেটরি পরিদর্শনে তাঁর কাছে একাধিকবার এসেছিলেন কবি। প্রশান্তচন্দ্র এবং নির্মলকুমারী মহালানবিশের বিয়ের সময় স্বয়ং কবি আশীর্বাণী লিখে দিয়েছিলেন,
‘প্রশান্ত, রাণী
তোমাদের এই মিলন-বসন্তে
দিলেন কবি বসন্ত-গান আনি।
সুন্দর প্রেম সাজুক আনন্দে
পরুক গলায় সুরের মালাখানি।
– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
১৫ ফাল্গুন ১৩২৯।’
নির্মলকুমারী মহলানবিশ কবির সঙ্গে প্রশান্তচন্দ্রের সম্পর্কের ব্যাপারে বলতে গিয়ে লিখেছিলেন,
‘কবির সঙ্গে প্রশান্তচন্দ্রের জীবনের গ্রন্থিবন্ধন দিনে দিনে তিলে তিলে কেমন করে গড়ে উঠেছিল তার ইতিহাসটা ফেলে দেওয়ার মত জিনিষ না বলেই আমার বিশ্বাস।’
*চিত্রঋণ: লেখক
*তথ্যঋণ:
১) রবীন্দ্রনাথ – প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ
২) রবিজীবনী ৫ম-৯ম খণ্ড – প্রশান্তকুমার পাল
৩) শারদীয় দেশ ১৯৭৫; চিঠি
৪) দেশ সাহিত্য সংখ্যা ১৩৮৬, চিঠি
প্রাক্তন সাংবাদিক। পড়াশোনা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ষোলো বছর বয়স থেকে কলকাতার নামী পত্রপত্রিকায় লেখালেখির হাতেখড়ি। ছোটোদের জন্য রচিত বেশ কিছু বই আছে। যেমন 'বিশ্বপরিচয় এশিয়া', 'ইয়োরোপ', 'আফ্রিকা' সিরিজ ছাড়া 'দেশবিদেশের পতাকা', 'কলকাতায় মনীষীদের বাড়ি', 'ঐতিহাসিক অভিযান', 'শুভ উৎসব' ইত্যাদি। এছাড়া বর্তমানে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নানা গবেষণার কাজে নিবেদিত। ইতিমধ্যেই এই বিষয়ে দুটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। 'রবীন্দ্র-জীবনে শিক্ষাগুরু' এবং 'রবীন্দ্র-গানের স্বরলিপিকার'। বর্তমানে একটি বাংলা প্রকাশনা সংস্থায় সম্পাদক।
খুবই মনোগ্রাহী লেখা। এই কলমে লেখকের প্রতিটি লেখা পড়েই মুগ্ধ হই বারংবার। আগামীর অপেক্ষায় রইলাম আবারও।