আশির দশকের শেষ দিক তখন। আমাদের বাড়িতে একদিন বেল বাজল। দরজা খুলে জানা গেল অনীশ দেব নামে এক তরুণ পদার্থবিদ আমাদের বাড়ির ঠিকানা খুঁজে ধাওয়া করে এসেছেন। রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের অ্যাপ্লায়েড ফিজ়িক্সের মেডেল পাওয়া ছাত্র তিনি। ১৯৬৮ সাল থেকে লেখালেখি করেন। গবেষণা করেন স্বতঃপ্রণোদিতভাবে, কল্পবিজ্ঞান নিয়ে। অনেক কষ্টে তিনি খুঁজে পেয়েছেন কল্পবিজ্ঞান লেখক দিলীপ রায়চৌধুরীর বাড়ির ঠিকানা।

আমার মায়ের সঙ্গে বিশাল আড্ডা দিলেন অনীশদা সেদিন। পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তথ্য দিয়ে তুলে ধরেছিলেন ষাট দশকের কল্পবিজ্ঞানের ইতিহাস, যা তাঁর কণ্ঠস্থ। প্রেমেন্দ্র মিত্র, সত্যজিত রায়, অদ্রীশ বর্ধনদের উৎসাহে তৈরি ‘আশ্চর্য!’ পত্রিকার কথা, যা অদ্রীশবাবুর অসামান্য উৎসাহে চলেছিল বেশ কিছু বছর এবং দাগ কেটেছিল জনমানসে। এইসব ইতিহাসের ভেতরে আমার বাবাও জড়িয়ে ছিলেন, কিন্তু তাঁর অকালমৃত্যুতে বন্ধ হয়ে যায় সেই কলম ১৯৬৬ সালেই।
‘আশ্চর্য!’ পত্রিকাতেই বেরুনো দিলীপ রায়চৌধুরীর বেশকিছু কল্পবিজ্ঞানের গল্প পড়েছিলেন অনীশদা, যখন তাঁর নিজের বয়স ১৫-১৬ মাত্র। সেগুলো তাঁর মানসে এতটাই দাগ কেটেছিল যে এই বিশাল গোয়েন্দাগিরিটি তিনি করে ফেলেন। অনীশদা মায়ের সঙ্গে কথা বলে এক কল্পগল্প সংকলনের জন্য অনুমতি নিয়েছিলেন বাবার একটি গল্প পুনর্মুদ্রণের। সেই সময়ে আমি সদ্য কলেজপড়ুয়া। সেই দিন থেকে সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত অনীশদার সঙ্গে আমার দীর্ঘকালীন অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। পরে সেই বইটি তিনি সযত্নে পাঠান আমাদের বাড়িতে।
২৮ এপ্রিল সকালে ঘুম ভাঙল একটা মারাত্মক দুঃসংবাদ নিয়ে। কোভিডের সঙ্গে লড়াইতে একেবারে অকালে চলে গেলেন এক কল্পবিজ্ঞান লেখক, কল্পবিজ্ঞানচর্চাকারী, পদার্থবিদ, বহুদিনের বন্ধু, দাদা, পথনির্দেশক। অনীশ দেব (২২ অক্টোবর ১৯৫১ – ২৮ এপ্রিল ২০২১)। তিনি তাঁর নিজের আশ্চর্য প্যাশন নিয়ে কল্পবিজ্ঞানের মশাল জ্বেলে রেখেছিলেন এই এতগুলো বছর। কী প্রবল প্রাণশক্তির মানুষ তিনি। সত্তর বছর বয়সে এই চলে যাওয়া মেনে নিতে পারিনি। আরও অন্তত কুড়ি বছর তাঁর হাত থেকে পাওয়া যেত কত না লেখা, কত কত রহস্য কাহিনি আর কল্পবিজ্ঞান কাহিনি।
১৯৬৮ সালে অনীশদার বয়স ১৭-১৮। তখন থেকেই নানা পত্রিকায় লেখা শুরু। ইতিমধ্যে ‘আশ্চর্য!’ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। পরে নিয়মিত আনন্দমেলা কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান, শুকতারা, কিশোর ভারতীতে কিশোরপাঠ্য লেখা শুরু। যে পত্রিকাই খুলি, দেখি অনীশ দেবের লেখা কল্পবিজ্ঞান গল্প। এর পর দেখি অজস্র রহস্য ও হরর জঁরের গল্প উপন্যাসও লেখেন তিনি, নবকল্লোল বা অন্য অনেক পত্রিকায়। আজ বইবাজারে তাঁর অজস্র বই, বেশ কিছু বই বেস্টসেলার তার মধ্যে। তেইশ ঘণ্টা ষাট মিনিট, ঘাসের শীষ নেই, সাপের চোখ, তীরবিদ্ধ, জীবন যখন ফুরিয়ে যায়… সামান্য কয়েকটা নামকরা বইয়ের নাম এখানে করলাম।
আরও পড়ুন: কৌশিক মজুমদারের কলমে: নারায়ণং নমষ্কৃত্যং নরঞ্চৈব নরোত্তমম্
তবে নানা ঘরানার লেখা লিখলেও কিন্তু আমার কাছে অনীশদার একমাত্র পরিচয় থেকে যাবে অসামান্য এক কল্পবিজ্ঞানপ্রেমী ও কল্পবিজ্ঞান লেখক হিসেবেই। অসংখ্য বইয়ের সম্পাদনা করেছেন অনীশ দেব। কেননা তাঁর পড়ার পরিধি ছিল বিশাল, ও ভাল গল্প মনে রাখার ক্ষমতাও প্রায় গল্প করে বলার মতো। এসবেই শেষ না। বাংলায় সহজ ভাষায় কল্পবিজ্ঞানের ইতিহাস রচনার প্রয়াস তিনি করেছিলেন, ইউএফও নামে একটা কলামে। প্রায় চেটেপুটে গিলে খেতাম সংবাদ প্রতিদিন ‘রোববার’ পত্রিকায় তাঁর সেই কলাম, ২০১৩-১৪ নাগাদ। সেখানে তিনি বাংলা কল্পবিজ্ঞানের ইতিহাস শুধু না, ইংরেজি কল্পবিজ্ঞানের গমনপথও ব্যাখ্যা করেছেন। নানা লেখকের, অজস্র অধুনা অমিল হয়ে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়া কল্পবিজ্ঞান গল্পের কথা সে লেখাগুলিতে থাকত, সংক্ষিপ্ত প্লট পয়েন্ট-সহ। অধিকাংশই আমার না-পড়া, যা থেকে বুঝতে পারতাম তাঁর স্মৃতি মেধা ও ভালবাসা কতখানি।

আর যা করেছেন অনীশদা, অজস্র মানুষকে কল্পবিজ্ঞান লেখার উৎসাহ দিয়েছেন তিনি। এই পৃথিবীতে খুব বিরল এই শেষ গুণটিই। লেখকদের অনেকেই অসামান্য লেখেন, এবং নিজের লেখার ভেতরে মশগুল থাকেন। খুব সামান্য কয়েকজনই হয়তো পারেন, চারিপাশের অন্যদের ফ্রেন্ড, ফিলজফার অ্যান্ড গাইড হয়ে উঠতে। সেটা অনীশদা পারতেন। বইমেলায় প্রতিবছর অনীশদার সঙ্গে দেখা হত। এক স্টল থেকে আর এক স্টলে ব্যস্তসমস্ত হয়ে হেঁটে যাচ্ছেন, সঙ্গে কোনও না কোনও তরুণ লেখক। এভাবেই আমাকে একবার আলাপ করিয়ে দিলেন ব্রিটেনের বাসিন্দা অভিজ্ঞান রায়চৌধুরীর সঙ্গে, যিনি নিজেই খুব নামজাদা কল্পবিজ্ঞান লেখক এখন। আমাদের বন্ধুবৃত্তে দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য, সন্তু বাগ, বিশ্বদীপ দে, দীপ ঘোষ, এদের সবার সঙ্গে অনীশদার এই সম্পর্কটা ছিল। এক অসম্ভব উদারচরিত দাদা, যাঁর সদা উৎসাহ নতুনদের লেখা পড়তে ও নতুন লেখার ব্যাপারে তাগাদা দিতে।
অনীশদার কর্মস্থল, শেষের বহু বছর ছিল রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে। ফলিত পদার্থবিদ্যার সেই ঘরটি সম্ভবত অবসরের পরেও তাঁর ছিল। সেখানেই বহুবার গিয়েছি আমি নানা কাজে। একবার আর একটা কল্পবিজ্ঞানের বই সম্পাদনা করতে আমাকে ডেকে বাবার একটি গল্প চাইলেন, আমার একটি গল্পও নিলেন। তারপর বহুবার ফোন, আমার গল্পের নানা জায়গায় ভাষা ও ভাবনার কোন অসুবিধা বা খটকা পেয়েছেন, তাই সে জায়গাটা আবার দেখার জন্য বললেন। সে বইও হয়ে গেল কত বছর। স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অনীশদা আমাকে কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়ার কোনও কোনও প্রকাশকের সঙ্গে ফোনে কথা বলিয়েছেন, আমার একটা বই যদি তারা প্রকাশ করে, তা নিয়ে উৎসাহ দেখিয়েছেন। এসব কে করে?

কল্পবিজ্ঞানের যে জোয়ার প্রথম ‘আশ্চর্য!’পত্রিকার সঙ্গে অদ্রীশ বর্ধনের ওয়ান ম্যান ইনস্টিটিউশনের সুবাদে এসেছিল, হুইলারে, ম্যাগাজিন স্ট্যান্ডে ‘আশ্চর্য!’-কে দেখার বিস্ময় ও আনন্দ, পাঠকমহলে রীতিমত সাড়া ফেলে, অসংখ্য নতুন লেখক উঠে আসা, অদ্রীশদার স্ত্রীর অকালমৃত্যুতে সেটা বন্ধ হয়ে যায়। পরে আবার আশির দশকে অদ্রীশ বর্ধন চালু করেন ‘ফ্যান্টাস্টিক’ বলে আর একটি পত্রিকা। অনীশদার ক্ষোভ ছিল, এরকম আরও পত্রিকা কেন বাংলায় এল না। পরে রণেন ঘোষ সম্পাদিত ‘বিস্ময়’ পত্রিকা এসেছিল । তবে সেভাবে বড় পত্রিকা আর ছিল না। ‘কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান’ ছিল কিছুদিন। পরে শুকতারা, আনন্দমেলা, কিশোর ভারতী মূলত এই পত্রিকাগুলিতেই কিশোরপাঠ্য কল্পবিজ্ঞান বেরুত।
অনীশদার লেখালেখি মূলত এইসব পত্রিকাকে কেন্দ্র করেই, কিন্তু তাঁর জনপ্রিয়তা বিপুল হয়ে উঠেছিল। বিজ্ঞান বিষয়ে বেশ কিছু বই তিনি লিখেছেন, বিজ্ঞানের দশদিগন্ত বা হাতেকলমে কম্পিউটার বইগুলি তারই স্বাক্ষর। তবে তাঁর মূল কাজ এর পর হয়ে যায় ফিকশন লেখা। এবং বেশ কটি রহস্য উপন্যাস জমিয়ে লিখেছেন তিনি। বড়দের বা অ্যাডাল্ট উপন্যাসই সেগুলি।
অনীশদা বলতেন, কল্পবিজ্ঞান লিখতে তিনটে জিনিস লাগবে। বিজ্ঞান জানতেই হবে। ব্যাড সায়েন্স দিয়ে কখনো গুড সায়েন্স ফিকশন হয় না। কিন্তু বিজ্ঞানের শুকনো কচকচি দিয়ে সাই ফাই হয় না। তাই দ্বিতীয় দাবি হল লেখকের কল্পনাশক্তি। এই বস্তুটিই আসল। তৃতীয় উপাদান ভাষাজ্ঞান, ভাষাবোধ, প্রচুর পড়ার অভ্যাস ও নিজের হাতে লিখতে লিখতে ভাষাকে আয়ত্ত করা। ভাষাকে তিনি সরস্বতী বলতেন। সুন্দর কাব্যিক ভাষাব্যবহার দেখলে ‘বাহ বাহ’ বলে উঠতেন, মনে আছে।

বড় লেখকের হাতে পড়ে বিজ্ঞানের সামান্য ভুল থাকলেও অসামান্য কল্পবিজ্ঞান গল্প রচিত হয়েছে, একথা বার বার উদাহরণ দিয়ে বলতেন অনীশদা। বলেছিলেন এইচ জি ওয়েলস-ও ভুল করেছেন, বা জেনেশুনে গল্পের খাতিরে ভুল লিখেছেন। কিন্তু সে তাকে মানিয়ে গিয়েছে। ‘দ্য ইনভিসিবিল ম্যান’ কাহিনির উদাহরণ দিয়ে বলতেন, যদি কেউ অদৃশ্য হয়ে যায় তবে তার রেটিনাও থাকবে না আর রেটিনাতে ছায়াও পড়বে না, সে হয়ে যাবে অন্ধ। এই ভুলটা চেপে দিয়ে এইচ জি ওয়েলস তাঁর গল্প লিখেছেন প্রসাদগুণে, কবজির জোরে। অনীশদাও বিজ্ঞানভিত্তিক কল্পবিজ্ঞান গল্প যেক’টি লিখেছেন তাতে এই জিনিস পাব। একটা ছোট বৈজ্ঞানিক প্রিন্সিপল বা নীতিকে ঘিরে বোনা ঠাশবুনোট গল্প। এক বৈজ্ঞানিক জীবনদর্শন আর সরস জীবন-আনন্দ (joie de vivre) সবগুলিতেই আমরা পাই। প্রতিটি কল্পবিজ্ঞান গল্পে কল্পনা তো থাকেই কিন্তু এক আধটা যুক্তিগ্রাহ্য বৈজ্ঞানিক প্রিন্সিপিল বা আদর্শ থাকেই ।
জমিয়ে গল্প বলতে হবে, এটাই এক গল্পকারের মূল গুণ, সে তিনি যে ঘরানার লেখক হোন না কেন। এই ছিল অনীশদার মূলমন্ত্র। আর সেকারণেই অতি উপভোগ্যভাবে নিজের লেখাকে পাঠকের কাছে পেশ করতেন। সেটাই পাঠকসমাদৃত হবার চাবিকাঠি ছিল তাঁর। ভূত, প্রেত, অশরীরীর গল্প বেশি লিখছিলেন অনীশদা। এ আমার ততটা পছন্দ না হলেও, জানি যে, আমাদের পাঠক-পত্রিকা-সম্পাদক মহলের চাহিদার সঙ্গে তাল রেখেই এক লেখককে লিখে যেতে হয়। পুরোদস্তুর, একশো ভাগ লেখক হিসেবে অনীশদা নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। সমাজ ও সময় যদি বিজ্ঞানমনস্কতা থেকে সরে যায়, লেখককে হরর বা ভূতের গল্প লিখতে উৎসাহ বেশি দেয়, সেখানে একা লড়তে পারেন না লেখক। অনীশদা সাম্প্রতিক এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ষাট বা আশির দশকের ‘আশ্চর্য!’, ‘ফ্যান্টাস্টিক’, এবং ‘বিস্ময়’ সায়েন্স ফিকশন-এর মতো কাগজের অভাব এখন।
আরও পড়ুন: সমর মিত্রের কলমে: শ্যামলচরিত মানস
বিজ্ঞানের সফল ছাত্র ও সুশিক্ষক, লেখালেখিতে নিবেদিত প্রাণ অনীশ দেবের লেখাগুলি থেকে গেল। ২০১৯ সালে তিনি বিদ্যাসাগর পুরস্কার পেয়েছিলেন, আরও অনেক পুরস্কার তাঁর প্রাপ্য ছিল। তাঁর জীবনের আরও অনেক পরিকল্পিত কাজই হয়তো অপূর্ণ রয়ে গেল। মারণ ভাইরাসের ঢেউ আর কতজন সরস্বতীর বরপুত্রদের কেড়ে নেবে কে জানে।
*দিলীপ রায়চৌধুরীর ছবি সৌজন্য: লেখক
*বাকি ছবি সৌজন্য: Facebook, Wikipedia, KhabarOnline, researchgate.net
কলকাতার বাসিন্দা | নব্বই দশকের কবি | কৃতি ছাত্রী | সরকারি আধিকারিক | একাধিক পুরস্কারপ্রাপ্ত | উল্লেখ্যোগ্য গ্রন্থের নাম পিশাচিনী কাব্য (১৯৯৮)‚ আবার প্রথম থেকে পড়ো (২০০১)‚ মেয়েদের প্রজাতন্ত্র (২০০৫) | কবিতাগদ্যে মননশীল্‚ গল্পেও স্বচ্ছন্দ |