*আগের পর্বের লিংক: [পর্ব ১], [পর্ব ২], [পর্ব ৩] [পর্ব ৪], [পর্ব ৫], [পর্ব ৬]

বস্টন কলেজের ইতিহাস বিভাগের সেমিনার হল সেদিন জমজমাট। কলেজের দুই ইতিহাস-শিক্ষক এমন এক কাণ্ড করেছেন যা এর আগে কেউ ভাবতেও পারেনি। প্রায় অসম্ভব এক যাত্রায় রোমানিয়ার উদ্দেশে রওনা হয়েছিলেন তাঁরা। কাউন্ট ড্রাকুলা নাকি সত্যিই ছিলেন, আর সেই দুর্গ খুঁজে বার করতে চলেছেন এই দু’জন। দু’জনের মধ্যে রাদু ফ্লোরেস্কু বয়েসে বড়। দারুণ কথা বলতে পারেন। তুলনায় বয়সে ছোট রেমন্ড ম্যাকনেলি একটু চুপচাপ, গম্ভীর। ১৯৭০ সালের এক বসন্ত বিকেলে তাঁদের ঘিরে ধরা ছাত্রছাত্রীদের ধেয়ে আসা জিজ্ঞাসার খিদে মেটাচ্ছিলেন রাদুই। মাঝে মধ্যে কথার সূত্র ধরিয়ে দিচ্ছিলেন রেমন্ড। কে বলবে ড্রাকুলা অভিযানের আসল কাণ্ডারী তিনিই!

ছাত্ররা জিজ্ঞেস করছিল:
– স্যার কী পেলেন এই অভিযান থেকে?
– এক কথায় বলব? হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস। যে ড্রাকুলার নামটুকু শুনে ব্রাম স্টোকার এত বড় একটা কাল্পনিক উপন্যাস লিখে ফেললেন, সেই আসল মানুষটাকে জানার ইচ্ছে ছিল অনেকদিন ধরেই। ধর সেই জন্যেই যাত্রা করা।
– শুধু নামটুকু জেনে? প্রশ্ন করল সোনালি চুল আর উজ্জ্বল মুখের এক মেয়ে।

Bram_Stoker_1906
‘ড্রাকুলা’-খ্যাত নাট্যকার ব্রাম স্টোকার

– ঠিক তাই। এক সন্ধ্যাবেলা রেস্তরাঁয় বসে বন্ধুর মুখে গল্প শুনে এই মানুষটাকেই বেছে নিলেন নাট্যকার বাম স্টোকার। কিন্তু খুব বেশি কিছু জানতেন না ড্রাকুলাকে নিয়ে। কী আর করা! ট্রানসিলভানিয়ার লোককথা, মৃতদের রাজত্ব, প্রেম, যৌনতা, ইতিহাস, রক্তচোষা ভ্যাম্পায়ার, নেকড়ে, বিশালাকার বাদুড়, আচমকা প্লট টুইস্ট সব মিলিয়ে মিশিয়ে তৈরি করলেন এক চরম ভিক্টোরিয়ান পট বয়লার। ১৮৯৭ সাল থেকে আজ পর্যন্ত একবারও আউট অফ প্রিন্ট হয়নি ব্রাম স্টোকারের ‘ড্রাকুলা’ বইটি। প্রকাশের দিন থেকেই পাঠককে ক্রমাগত সে এক অজানা জগতের হাতছানি দিয়ে যাচ্ছে। যে জগতের কিছুটা জানা, অনেকটাই অজানা। যাঁরা একে ভাল উপন্যাস বলতে দ্বিধা করেন, তাঁরাও স্বীকার করতে বাধ্য হন যে এত ভাল গল্প খুব কমই বলা হয়েছে।

ড্রাকুলার যে দুঃস্বপ্ন বইয়ের পাতায় এঁকে গেছিলেন স্টোকার, তা থেকে আজও আমাদের মুক্তি নেই। এখনও ভয় বলতে বারবার চলে আসে এই বইয়ের কথা। একদম শুরুতেই। ড্রাকুলা শুধু এক উপন্যাসের চরিত্র না। সত্যি-মিথ্যে কাল্ট মেশানো এক অনবদ্য প্রতিনায়ক। আর এই ফিকশনাল ড্রাকুলার ফাঁদে পড়ে হারিয়ে গেছিলেন আসল মানুষটা। আমাদের এই সন্ধান সেই হারিয়ে যাওয়া আসল ড্রাকুলাকে খুঁজে পাওয়ার সন্ধান।   

রাদু হাসিমুখে বলে চলছেন…
– বুঝলে হে, যারা কোনওদিন মূল ড্রাকুলা উপন্যাসটা পড়েনি, ইদানীং সেই সংখ্যাটাই বেশি, বা এই নিয়ে সিনেমাও দেখেনি, তারাও মোটামুটি জানে ব্রাম স্টোকারের এই গথিক উপন্যাসের মূল কাহিনি কী। তাই তো?
– হ্যাঁ স্যার। ওই তো… নেকড়ের দল আছে, বাদুড়ের গল্প আছে, রক্তচোষা ভ্যাম্পায়ার আছে, কাঠের গজাল সোজা বুকে গুঁজে দেবার ঘটনা আছে… এই হল মোটের উপর কাহিনি।

Raymond and Radu
বাঁদিকে রাদু ফ্লোরেস্কু ও ডাইনে রেমন্ড ম্যাকনেলি

এবার হেসে ফেললেন রাদু।
– সবাই তাই ভাবে, জানো। কিন্তু শুনলে অবাক হবে, স্টোকারের উপন্যাসে এর একটাও কেন্দ্রীয় ভূমিকায় নেই। গোটা বইতে যা আছে, তা হল চমকের পর চমক। আজকের দিনে অধিকাংশ গবেষক এই উপন্যাসকে খুব একটা দর দিতে রাজি নন। বিশ্বের সেরা উপন্যাসগুলোর ধারেকাছে আসবে না এটা। গোটা আখ্যানে প্রচুর তথ্যের অসঙ্গতি, অসম্ভব সব তত্ত্বের অবতারণা, অতিনাটকীয় চরিত্রের ঘনঘটাসত্যি বলতে কী, ট্রানসিলভানিয়ায় জোনাথন হার্কারের সেই রুদ্ধশ্বাস অভিযান আর তার বেশ কিছুদিন বাদে লন্ডনে ড্রাকুলার শিষ্যের আবির্ভাবের পরে গোটা গল্প আচমকা ঝিমিয়ে পড়ে। মিনা আর জোনাথনের লম্বা লম্বা কথোপকথন কাহিনির গতিকে একেবারে ঢিলে করে দেয়। ডাচ প্রফেসর ভ্যান হেলসিং তো এসেই পাতার পর পাতা লেকচার দিয়ে ভরে দেন। রিয়েল এস্টেটের বিক্রির কাগজ, টাইপ করা কপি, ভ্যাম্পায়ারের ইতিহাসের মাঝে একটা বড় জায়গা জুড়ে কোথাও ড্রাকুলার নামগন্ধ নেই।

– বলেন কী? সমবেতভাবে দু-তিনজন ছাত্রছাত্রী বলে উঠল।
– বইয়ের যখন আর সিকিভাগ বাকি, রাদু বলে চলেন, তখন পাগলাগারদের এক কুখ্যাত পাগল রেনফিল্ডকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। তাঁর মাথা চুর্ণবিচূর্ণ। মারা যাবার আগে তিনি শুধু এটাই বলে যান যে ড্রাকুলা নাকি রোজ রাতে লুকিয়ে মিনার সঙ্গে দেখা করে। পাঠকদের কাছে এ খবর নতুন কিছু না। এতক্ষণ তাঁরা এই সন্দেহই করছিলেন। 

এবার একটু গলা খাঁকড়ালেন পাশে বসা রেমন্ড।
– বলছিলাম কী, যারা এখনও উপন্যাসটা পড়ে উঠতে পারেননি, তাঁদের কাছে কিন্তু এই আলোচনা একটু খাপছাড়া লাগবে। তাই শুরু থেকে শুরু করা যাক বরং। অল্প কথায় তোমাদের বলি মূল ড্রাকুলা-য় ঠিক কী আছে। এই বলে ব্যাটন নিজের হাতে তুলে নিলেন রেমন্ড টি ম্যাকনেলি। বস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূত আর ভয়ের বিশেষজ্ঞ। শরদিন্দু থাকলে বরদাচরণকে ছেড়ে এঁকে নিয়েই লিখতেন তাঁর অলৌকিক গল্পগুলো। আবার একবার গলা ঝেড়ে শুরু করলেন ম্যাকনেলি। 

FLORESCU
ভ্লাড দ্য ড্রাকুলার ছবির সামনে রাদু ফ্লোরেস্কু

– একটা ব্যাপার গোড়াতেই বলে রাখা ভাল। গোটা উপন্যাসে লেখক ব্রাম স্টোকার একবারের জন্যও উঁকি দেননি। একটি শব্দও তাঁর নিজের নয়। গোটা উপন্যাস গড়ে উঠেছে একের পর এক চিঠি, জার্নাল, ডায়রির পাতা, পুরনো দলিল অথবা স্বীকারোক্তি দিয়ে। আর সে জন্যেই একদল ড্রাকুলা-গবেষক বিশ্বাস করেন, স্টোকার সত্যিই একটা শব্দও লেখেননি। এই উপন্যাসের প্রতিটি ঘটনা সত্য, আর স্টোকার শুধু সেই সব দলিল খুঁজে পেতে এক করেছেন। শুরুতে একেবারে আবেগহীন ভাবে লেখক শুধু লিখেছেন “How these papers have been placed in sequence will be made manifest in the reading of them.” কাহিনি শুরুর আগে স্টোকার ওই একবারই একটু টুকি দিয়ে গেলেন।  

কাহিনির প্রথম চার অধ্যায়ের পটভূমি সুদূর ট্রানসিলভানিয়া। লন্ডনের এক সলিসিটর ফার্মের কেরানি জোনাথন হার্কারকে পূর্ব ইউরোপে কাউন্ট ড্রাকুলার দূর্গে যেতে হয়। কাউন্ট লন্ডনে কিছু জমি জায়গা কিনতে চান। বুডাপেস্ট থেকে রওনা হয়ে হার্কার বিস্ট্রিৎস পৌঁছালেন। এই গোটা পথ, মানুষজন, রাস্তাঘাট এমনকী খাবার দাবারেরও নিখুঁত বিবরণ দিয়েছেন স্টোকার। মনে রেখ, উনি কিন্তু জীবনেও এর আগে ওই অঞ্চলে পা দেননি। যখন হার্কার বোরগো পাস পেরিয়ে ড্রাকুলার দুর্গের দিকে যাবেন, তখনই প্রথম সরাইখানার এক বৃদ্ধা মালকিন তাঁকে বাধা দিলেন। শুধু তাই নয় নাছোড় হার্কারের গলায় একটা ক্রুশও ঝুলিয়ে দিলেন তিনি “তোমার মায়ের দিব্যি” দিয়ে। সেই প্রথম পাঠক একটা চাপা টেনশন অনুভব করে। টেনশন বাড়তে থাকে।

কার্পেথিয়ান পর্বতমালা ধরে ঘোড়ার গাড়ি চেপে যাবার সময় সঙ্গীরাও নানা ভয় দেখায়। বলে আজ সেন্ট জর্জের দিন। আজ রাত বারোটা পেরলে বনে সব অশরীরী আত্মারা জেগে ওঠে। বোরগো পাসেই এক রহস্যময় ঘোড়ার গাড়ি আর চালক আসে হার্কারকে নিয়ে যেতে। পথে মধ্যরাত হয়ে যায়। গাড়ি ঘিরে ধরে নেকড়ের পাল। দূরে দেখা যায় নীলচে এক অপার্থিব আলো। গাড়ি খাড়া পাকদণ্ডী বেয়ে দুর্গের সামনে থামে। এক অতি বৃদ্ধ, লম্বা ফ্যাকাশে সাদা গোঁফ কাউন্ট দরজায় এসে হার্কারকে অভিনন্দন জানান। নিজের পরিচয় দেন ”I am Dracula” বলে…

 

আরও পড়ুন: প্রসেনজিৎ দাশগুপ্তের কলমে: শ্যামা মায়ের পাগল ছেলে

 

– সে কী? শুরুতেই সাসপেন্স শেষ? ড্রাকুলা বলেই দিল সে রক্তচোষা ড্রাকুলা? বিস্ফারিত চোখে প্রশ্ন করে এক ছাত্রী।
– ভুল করছ। রক্তচোষা বলা হল কোথায়? ভ্যাম্পায়ার আর ড্রাকুলা এক নয়। বহু বছর ধরে এই উপন্যাসের জনপ্রিয়তা আমাদের মনে ড্রাকুলা আর ভ্যাম্পায়ারকে এক করে দিয়েছে। এই উপন্যাস যখন প্রথম প্রকাশ পায়, তখন ড্রাকুলা নামটা আর দশটা নামের মতোই একটা নাম ছিল। পাশ থেকে ধরিয়ে দিলেন রাদু। ম্যাকনেলি ফের খেই ধরলেন:

– যা বলছিলাম, কিছুদিন বাদেই হার্কার বুঝতে পারেন এই দুর্গে একটিও জীবিত মানুষ বাস করে না। কাউন্ট নিজে দেখা করতে আসেন রাতে। তাঁর ছায়া আয়নায় পড়ে না, তাঁর হাত মরা মানুষের মতো ঠান্ডা, তাঁর দুর্গ ধুলোয় ঢাকা এক পরিত্যক্ত ধ্বংসাবশেষ। এক সন্ধ্যায় হার্কার দেখলেন দুর্গের খাড়া দেওয়াল বেয়ে টিকটিকির মতো নেমে যাচ্ছেন কাউন্ট। তাঁর আলখাল্লা পতপত করে উড়ছে বাদুড়ের ডানার মতো। ভয়ে হার্কার আর কাউন্টের কথা মানলেন না। উঁকি দিলেন সেই সব ঘরে, যেখানে ঢুকতে কাউন্ট তাঁকে মানা করেছিলেন। সেখানেই তিন সুন্দরী মহিলা তাঁর রক্তপানের চেষ্টা করে। মোক্ষম সময়ে কাউন্ট এসে হার্কারকে রক্ষা করেন।  বদলে তাঁদের ছুড়ে দেন কাপড়ে মোড়া এক থলি, তা থেকে ভেসে আসে এক শিশুর কান্না।

হার্কার বুঝতে পারেন, তাঁর আর বাড়ি ফেরা হল না। তিনি ড্রাকুলার দুর্গে বন্দি। কাজ হয়ে গেলে তাঁকেও মেরে ফেলবেন কাউন্ট। হার্কার পাগলপারা হয়ে যান। চিঠি লিখে সব ঘটনা জানাতে চান লন্ডনে, প্রেমিকা মিনাকে। কিন্তু চিঠি পাঠাবেন কী করে? এদিকে কাউন্টের নির্দেশে একদল জিপসি এসে অদ্ভুত কিছু কাঠের বাক্স ঘোড়ার গাড়িতে চাপাতে থাকে। জোনাথন তাঁদের মাধ্যমে চিঠি পাঠানোর চেষ্টা করেন। সে চিঠি কাউন্টের হাতে পড়লে তিনি রেগে চিঠি পুড়িয়ে ফেলেন। মরিয়া হার্কার একদিন এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে আচমকা আবিষ্কার করে ফেললেন ড্রাকুলার কফিন, ‘মুখ টকটকে লাল, চোখ খোলা, ঠোঁটের কষ বেয়ে রক্তের একটা ক্ষীণধারা চিবুক আর গলা ভিজিয়ে দিয়েছে। গোটা শরীরে জীবনের কোনও লক্ষণ নেই।’ হার্কার এতক্ষণে বুঝতে পারে, সে এক ভয়াল ভ্যাম্পায়ারের পাল্লায় পড়েছে। পালাতে না পারলে তার মুক্তি নেই। আর এখানেই হার্কারের জার্নাল শেষ।”

Book by Stoker on Dracula
ব্রাম স্টোকারের লেখা ‘ড্রাকুলা’

এতক্ষণ টানা কথা বলে একটু দম নিলেন রেমন্ড। সব ছাত্রছাত্রীরা প্রায় আর্তনাদ করে উঠল। এমন টানটান উত্তেজক জায়গায় শেষ! এটা ঠিক না।
– কী আর করা যাবে? পাঠককে খাদের ধারে দাঁড় করিয়ে রাখার বিদ্যেটা ভালই রপ্ত করেছিলেন স্টোকার। অবশ্য বছর চারেক পরে তাঁর বন্ধুসম ডাক্তার আর্থার কোনান ডয়েল ঠিক একই কায়দা প্রয়োগ করেছিলেন বিখ্যাত সেই শিকারী কুকুরের কাহিনির প্রতি অধ্যায়ের শেষে। পাঠক যাতে বাধ্য হয় পরের অধ্যায় পড়তে…” আবার ফুট কাটলেন রাদু। 

এক ঢোঁক জল খেয়ে আবার শুরু করলেন রেমন্ড।
– পঞ্চম অধ্যায়ে হঠাৎ কাহিনিতে নতুন মোচড়। আখ্যান শুরু হল হার্কারের প্রেমিকা মিনা মুরের জার্নাল দিয়ে। তিনি স্কুল শিক্ষিকা, এসবের কিছুই জানেন না, শুধু অপেক্ষায় আছেন, কবে জোনাথন এলে তাঁদের বিয়েটা হবে। তাঁর প্রাণের বন্ধু লুসি ওয়েস্টেনরা এক চিঠিতে তাঁকে জানায় একদিনে সে তিনটে বিয়ের প্রস্তাব পেয়েছে। একজন লন্ডনের পাগলাগারদের ডাক্তার জন সিউয়ার্ড, অন্যজন আমেরিকার কাউবয় কুইন্সি মরিস। তবে দু’জনকেই না করে সে তৃতীয়জন, মানে তার সত্যিকারের ভালবাসা আর্থার হোমউডের প্রস্তাবে সাড়া দিয়েছে। 

এর পরের অধ্যায় আদতে মোমের সিলিন্ডারের ফোনোগ্রাফে নেওয়া ডাঃ সিউয়ার্ডের কথার অনুলিখন। এখানেই প্রথমবার তাঁর পাগলাগারদের সবচেয়ে অদ্ভুত রোগী আর এম রেনফিল্ডের নাম শুনি। এরপরে ছোট ছোট একাধিক চিঠি। জানা যায় একদিকে লুসি আর তাঁর মা, আর একদিকে মিনা মুরে এসেছেন হোয়াইটবিতে বেড়াতে। তবে এই অবকাশ সুখের হল না। জোনাথনের চিঠি আসা আচমকা বন্ধ হওয়াতে মিনার মন কু-গাইছিল। আর এখানে এসেই প্রথম জানা গেল, লুসির নাকি রাতে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হাঁটার অভ্যাস আছে। 

Dracula books by Radu and McNelly
ফ্লোরেস্কু ও ম্যাকনেলির লেখা ড্রাকুলা সম্পর্কিত তিনটি জগদ্বিখ্যাত বই

এদিকে প্রায় একশো বছরের বৃদ্ধ এক নাবিক, মিস্টার সোয়েলস মিনাকে জানায় “লক্ষণ ভাল না। হোয়াইটবির কবরগুলো কথা বলতে শুরু করেছে। খুব শিগগির মৃতেরা পাতাল থেকে জেগে উঠবে।” মিনা না বুঝলেও পাঠক বোঝে ড্রাকুলার লন্ডনে আসার সময় হয়েছে। হোয়াইটবি বড় সাধারণ জায়গা না। এর পরেই দ্য ডেলিগ্রাফ পত্রিকার একটা খবর উদ্ধৃত করা হয়েছে। তাতে লেখা: হোয়াইটবির বন্দরে ডিমেটার নামে এক জাহাজ আছড়ে পড়েছে। কিন্তু এ কেমন জাহাজ! ক্যাপ্টেনের দলা পাকানো দেহ আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা জাহাজের চাকার সঙ্গে, তাঁর হাতে ঝুলে আছে একটা ক্রুশ। গোটা জাহাজ খালি। শুধু একগাদা মাটিভরা কাঠের খালি কফিন। খবরে প্রকাশ, জাহাজ বন্দরে আসামাত্র এক দানবীয় কুকুর কিংবা নেকড়ে জাহাজ থেকে লাফিয়ে নেমে পালিয়ে যায়…

শ্বাস টানার একটা চাপা শব্দ ঘরে বয়ে গেল। ফিসফিসে গলায় এক ছাত্রী বলে উঠল:
– ড্রাকুলা তবে সদলবলে লন্ডনে চলে এল?
– হ্যাঁ, কিন্তু আদর্শ থ্রিলারের মতো এখানেও সেটা একমাত্র পাঠক বুঝতে পারছে। আর কেউ না।
– সে তো বটেই। পাশ থেকে বলল সোনালি চুলের এক তরুণ ছাত্র। বাকিরা তো হার্কারের জার্নাল পড়েনি। – একদম ঠিক। বলে আবার বলতে লাগলেন রেমন্ড ম্যাকনেলি।
– ক্যাপ্টেনের লগ বুক পড়ে সবার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। যাত্রার শুরু থেকেই যেন অশুভ আত্মারা ভর করেছিল এই জাহাজে। একের পর এক নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছিলেন খালাসিরা। গোটা পথে জাহাজের সঙ্গী ছিল বিষণ্ণ কুয়াশা। লগ বুকে ক্যাপ্টেনের শেষ যে কথা পাওয়া গেল, তাতে স্পষ্ট যে কোনও এক অজানা ভয়াল দানব গ্রাস করেছিল গোটা জাহাজকে। সেই রাতেই লুসি আবার ঘুমের মধ্যে হাঁটতে শুরু করে। মিনা তাঁর পিছনে ধাওয়া করেন। দেখেন, এক অন্ধকার পরিত্যক্ত গির্জার পাশে লুসি বসে আছেন। তাঁর গলার কাছে ঝুঁকে আছে লম্বা ফ্যাকাশে এক পুরুষ। মিনা তাঁর বন্ধুর নাম ধরে ডাকতেই সেই লোকটি যেন মিলিয়ে গেল পাতলা কুয়াশায়। মিনা দেখলেন লুসির গলায় দুটো স্পষ্ট ফুটো। তাজা। রক্তাক্ত। এর মধ্যেই মিনার কাছে বুদাপেস্ট হাসপাতাল থেকে খবর আসে, জোনাথন সেখানে ভর্তি। অসুস্থ, ভুল বকছেন। মিনা বুদাপেস্ট যান। হার্কার একটু সুস্থ তখন। মিনা হার্কারের ডায়রি আর জার্নাল পড়েন। সেই হাসপাতালের বেডেই তাঁদের বিয়ে হয়। কিন্তু সুখে শান্তিতে বসবাস তাঁদের কপালে সইল না। 

*ছবি সৌজন্য: Wikipedia, Pinterest, Goodreads, Vamped.org 
*তথ্যঋণ:

১। ফ্লোরেস্কু, রাদু অ্যান্ড ম্যাকনালি, রেমন্ড টি, ইন সার্চ অফ ড্রাকুলা: দ্য হিস্ট্রি অফ ড্রাকুলা অ্যান্ড ভ্যামপায়ারস (১৯৯৪), হটন মিলিফিন কোং
২। ফ্লোরেস্কু, রাদু অ্যান্ড ম্যাকনালি, রেমন্ড টি, ড্রাকুলা: আ বায়োগ্রাফি অফ ভ্লাড দ্য ইমপেলর (১৯৭৩), হথর্ন
৩। লেদারডেল, ক্লাইভ, ড্রাকুলা, দ্য নভেল অ্যান্ড দ্য লেজেন্ড: আ স্টাডি অফ ব্র্যাম স্টোকার্স গথিক মাস্টারপিস (১৯৮৫), উইলিংবরো নর্থহ্যামপ্টনশায়ার, ইউকে
৪। রিকার্ডো, মার্টিন, ভ্যাম্পায়ার্স আনআর্থড (১৯৮৩), গারল্যান্ড, নিউ ইয়র্ক
৫। ট্রেপ্টো, কার্ট এডিটেড ড্রাকুলা এসেজ অন দ্য লাইফ অ্যান্ড টাইমস অফ ভ্লাড টেপেস (১৯৯১), কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি প্রেস

জন্ম ১৯৮১-তে কলকাতায়। স্নাতক, স্নাতকোত্তর এবং পিএইচডি-তে স্বর্ণপদক। নতুন প্রজাতির ব্যাকটেরিয়ার আবিষ্কারক। ধান্য গবেষণা কেন্দ্র, চুঁচুড়ায় বৈজ্ঞানিক পদে কর্মরত। জার্মানি থেকে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর লেখা গবেষণাগ্রন্থ Discovering Friendly Bacteria: A Quest (২০১২)। তাঁর লেখা ‘কমিকস ইতিবৃত্ত’ (২০১৫), 'হোমসনামা' (২০১৮),'মগজাস্ত্র' (২০১৮), ' জেমস বন্ড জমজমাট'(২০১৯), ' তোপসের নোটবুক' (২০১৯), 'কুড়িয়ে বাড়িয়ে' (২০১৯) 'নোলা' (২০২০) এবং সূর্যতামসী (২০২০) সুধীজনের প্রশংসাধন্য। সম্পাদনা করেছেন ‘সিদ্ধার্থ ঘোষ প্রবন্ধ সংগ্রহ’ (২০১৭, ২০১৮)'ফুড কাহিনি '(২০১৯) ও 'কলকাতার রাত্রি রহস্য' (২০২০)।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *