আগের পর্ব পড়তে: [] [] []

গরমের ছুটি এবার একটু আগেই পড়েছিল। প্রায় দু’সপ্তা আগে। সেই ছুটি শেষ হতে স্কুল খুলে গেল। তবু বর্ষা নামার নাম নেই। পারদ ৪০-এর নীচে নামছেই না। আবহাওয়ায় একটুও জলীয় বাষ্প নেই। বঙ্গোপসাগরে যদিও বা একটু জমবার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল…। টিচার্স রুমে যেন আলিপুর হাওয়া অফিসের একটা শাখা খোলা হয়েছে, এই ভঙ্গিতে আলোচনাটা হচ্ছিল। জ্ঞানবাবু সারাদিনে প্রচুর কলা খান। ওঁর নাকি পটাশিয়ামের ঘাটতি আছে। একটা কলার খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে উনি বললেন – আরও পনেরো দিন…
– পনেরো দিন, আরও! মরে যাব তো!
– আমার কাছে পাকা খবর আছে, পনেরো দিনের আগে গাঙ্গেয় পশ্চিম উপকূলে মৌসুমী বায়ু ঢুকছে না।
– ও দাদা, এ তো আপনি বর্ষার নিদেন দিচ্ছেন। আমরা একটু ঝড় টড় চাইছি, দু’এক পশলা বৃষ্টি হোক অন্তত।

জ্ঞানবাবু বিরক্ত হয়ে পরের কলাটায় মন দিলেন। রাজরূপ আর অশ্বিনীবাবু নিচুগলায় আলোচনা শুরু করলেন হাওয়া অফিসের অভাবনীয় উন্নতি বিষয়ে।
– সত্যি, আজকাল ওদের ফোরকাস্ট হুবহু মিলে যাচ্ছে। আর গোলদার যদি বলত আজ বৃষ্টি হবে, লোকে বাড়িতে ছাতা রেখে যেত।
– আরে ইনস্যাট ওয়ান, টু খবর পাঠাচ্ছে না? সেখানে গুলগল্প চালাবে কী করে?
মিথিলেশ কোণের চেয়ারে বসে জানলা দিয়ে চোখ বাড়াল। এখান থেকে নদীটা খানিকটা দেখা যায়। ভাল হত বাইরে চলে গেলে। কিন্তু বড্ড চড়া রোদ। এই রোদে নদীর ধারে গিয়ে দাঁড়ালে লোকে পাগল ভাববে। হঠাৎ ওর মোবাইল বাজল। নিউ কল। অচেনা একটা নম্বর। 

টিচার্স রুমে বসে ফোনে কথা বলতে কেমন অস্বস্তি হয় মিথিলেশের। শুধু টিচার্স রুম কেন, কোনও পাবলিক প্লেসেই ও ফোনে কথা বলতে পারে না। সেদিন বাড়ি ফেরার পথে বাসের মধ্যে ফোন এল। বউয়ের ফোন। বৌ বলল, মাসিরা এসেছে, বাসস্ট্যান্ডে প্রাণকেষ্টর দোকান থেকে গরম গরম সিঙ্গাড়া আর রসগোল্লা নিয়ে যেতে। বাসের মধ্যে বসে মিথিলেশ কিছুতেই জিজ্ঞেস করতে পারল না কটা সিঙ্গাড়া আর কটা রসগোল্লা নেবে। হুঁ হাঁ করে ছেড়ে দিল। স্ট্যান্ডে নেমে অর্জুন গাছের নিচে দাঁড়িয়ে সন্তর্পণে চারদিক দেখে নিয়ে সে ফিসফিস করে বউকে ফোন করে জিজ্ঞেস করল
– কজন এসেছে? কটা সিঙ্গাড়া নেব? রসগোল্লা কি বেশি করে নেব?
তখন তার ভাবভঙ্গি দেখলে মনে হতে পারত সে বিবাহ-বহির্ভূত কোনও বালিকা বন্ধুর সঙ্গে প্রেমালাপ করছে কিংবা সংসদ ভবন উড়িয়ে দেওয়ার ছক কষছে সহ-জঙ্গির সঙ্গে। স্কুলে তার বড় একটা ফোন আসে না। সে-ই মাঝে মাঝে ফোন করে ঝিল্লিকে। যখন নদীর ধারে গিয়ে দাঁড়াতে পারে, তখনই তার ঝিল্লির সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে হয়।

আজও সে ফোনটা নিয়ে টিচার্স রুমের বাইরে চলে গেল। ততক্ষণে বাজতে বাজতে থেমে গেল ফোন। অচেনা নাম্বারটা দেখতে দেখতে মিথিলেশ স্কুলবাড়ির বাইরে বেরিয়ে এল। ভ্যানে করে অনেক চেয়ার এসেছে বাইরেটায়। একটা খিটখিটে চেহারার লোক সেগুলো নামাবার তদারকিতে ব্যস্ত। ভোট এসে গেল। মিথিলেশ লোকটাকে পেরিয়ে যাবার সময় আবার ওর ফোন বাজল। যেন তার কাজে ব্যাঘাত ঘটছে, এরকম ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে মিথিলেশের দিকে তাকাল লোকটা। ফোন বাজার জন্য অপরাধবোধ পেড়ে ফেলল মিথিলেশকে, এবারও সে ফোনটা ধরতে পারল না। হাঁটতে হাঁটতে সে সত্যি নদীর কাছে চলে এসেছে। কাঠফাটা রোদ। তার সঙ্গে ছাতা নেই। রোদ, নদী, ঘাটে বাঁধা নিঃসঙ্গ নৌকো- এদের কাছে মিথিলেশের কোনও সংকোচ নেই। আগে অবশ্য সংকোচ হলেও মরিয়ার মতো ফোন ধরত সে। ফোনের পয়সা বাঁচাতে হত। এখন এইটুকু বিলাসিতা করতেই পারে। এখন ফোনটা বাজুক প্রার্থনা করছিল সে। সেটা বাজল। বাজতেই চট করে ধরল মিথিলেশ।

– কী ব্যাপার? ক্লাসে ছিলি নাকি? এতবার ফোন করছি…
ঝিল্লি। মিথিলেশ আশ্চর্য হয়ে বলল
– নতুন ফোন নিলি? আগেরটা?
– আছে। সবাইয়ের জন্যে। এই সিমটা শুধু তোর সঙ্গে কথা বলার জন্যে। সেভ করে নে।
মিথিলেশের মনে হল ও উড়ে চলে যাবে। শুধু তার জন্যে একটা সিম এই ত্রিভুবনে! এ বড় বিস্ময়ের কথা। এই সেদিন পর্যন্ত পৃথিবীতে যার জন্যে কোনও চাকরি ছিল না, যাকে কুড়ি বছর ধরে নানান উঞ্ছবৃত্তি করে পেটের ভাত জোগাড় করতে হয়েছে, তার জন্যে, শুধু তার জন্যে আস্ত একটা নাম্বার!
সে স্বপ্নচালিতের মতো বলে ওঠে:
– আমার জন্যে!
– উহ, হল কী তোর! শোন, আজ দিনটা খুব সুন্দর শুরু হয়েছিল বুঝলি। রোদ ওঠেনি। ঠান্ডা ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছিল কোথা থেকে কে জানে। আমি খুব সেজেছিলাম জানিস। এরকম একটা দিনে, তোর সঙ্গে অবন্তীনগরে যেতে পারতাম বল। কিন্তু দিনটা নষ্ট হয়ে গেল।
– নষ্ট হয়ে গেল!
প্রতিধবনির মতো ঝিল্লির কথাগুলোই আবৃত্তি করে মিথিলেশ।
– হ্যাঁ একদম নষ্ট হয়ে গেল। তুই ভাবতে পারিস এরকম একটা দিনে একটা ঝিংচ্যাক রেস্তোরাঁয় বসে আমাকে দেখতে হল দুজন লোক গবগব করে খাচ্ছে…’

man with phone
শুধু তার জন্য আস্ত একটা নাম্বার!

মিথিলেশ ভেবে পেল না এর মধ্যে নষ্ট হবার ব্যাপারটা কোথা থেকে আসছে। রেস্তোরাঁয় তো মানুষজন খেতেই যায় আর গবগব করেই খায় তারা। তার বৌ তো কতদিন ধরে বলছে তাদের নিয়ে কলকাতায় একদিন ভালো রেস্তোরাঁয় খাওয়াতে। এখন তো কত মল টলও হয়েছে, সেসব কিছুই দেখা হয়নি ওদের, চাকরিও হল একটা ধ্যাড়ধেড়ে গোবিন্দপুরে, সেখানে চা আর লেড়ো বিস্কুট পাওয়া গেলেই অনেক, তাই একদিন তাকে নিয়ে যেতেই হবে কলকাতায় বড় না হোক মাঝারি কোনও রেস্তোরাঁয়, আর তখন হয়তো তারাও গবগব করেই খাবে, রক্ত জল করা পয়সায় কেনা খাবার বলে কথা।

তারপরেই তার খেয়াল হল, ঝিল্লি সবার নয়, দুটো মানুষের খাবার কথা বলছে। তারা কারা? বিশেষ কেউ? তাদের সঙ্গেই ঝিল্লি রেস্তোরাঁয় গিয়েছিল? কেন? সে কিছু খায়নি? না খেলে কেন খায়নি? দু’জন মানুষ গবগব করে খাচ্ছে আর তৃতীয়জন না খেয়ে বসে আছে– দৃশ্যটা খুব অস্বাভাবিক লাগল ওর কাছে। মিথিলেশ রীতিমতো একটা রহস্যকাহিনির গন্ধ পেয়ে উত্তেজিত হয়ে উঠল। ওর মনে হল এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তরের সঙ্গে ওর জন্যে উৎসর্গীকৃত সিমের একটা নিগূঢ় সম্পর্ক আছে। সে উত্তেজিতভাবে জিজ্ঞেস করতে গেল কাদের সঙ্গে ঝিল্লি রেস্তোরাঁয় গিয়েছিল, কিন্তু তার আগেই ঝিল্লি তাকে প্রশ্ন করল,
– তোর টিফিন হয়ে গেছে?
– এই তো, তোর ফোন আসার একটু আগে।
– কী খেলি টিফিনে?
মিথিলেশ খুব চেষ্টা করে মনে করল
– রুটি, ভিন্ডিভাজা আর রসমুণ্ডি। ও হ্যাঁ, একটা আপেলও ছিল। 

সীমা, তার বৌ, আজকাল তার স্বাস্থ্যের খুব খেয়াল রাখছে। প্রায়ই টিফিনে আপেল দিয়ে দ্যায়। এদিকে টিফিনবক্স খুলে আপেল দেখলে কেমন যেন কুঁকড়ে যায় মিথিলেশ। ছেলের টিফিনে ভাগ বসাচ্ছে- এমনটাই মনে হয় তার। আপেল, কেক, পেস্ট্রি– আরও কত মহার্ঘ্য খাবারে যত্ন করে সীমা রোজ ছেলের টিফিনবাক্স সাজায়। মিথিলেশ বেরনোর একটু পরেই সে ছেলেকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। দু-দু’বার অটো বদলে কবি নজরুল মেট্রো স্টেশন। সেখান থেকে মেট্রোয় কালীঘাটে নেমে আবার অটো। প্রতিদিনের মা ছেলের এই যাত্রাপথটুকু নতুন নতুন আবিষ্কারে ভরা থাকে। সেদিন সীমা দেখেছে ইস্কুলের সামনে মোচা কেটে বিক্রি হচ্ছে। অতএব যে মোচা বারো থেকে পনেরো টাকায় মিথিলেশ কেনে, সেটা সে গর্বিত মুখে ৩৫ টাকায় কিনে নিয়ে এল। মিথিলেশ কিছু বলে না। 

মিথিলেশ যখন চাকরি পায়নি, টিউশনি আর নানান উঞ্ছবৃত্তি করে সংসার চালাত, তখন সীমা কীসের ভরসায় ছেলেকে কলকাতার নামী ইস্কুলে ভর্তি করাল, সেটাও সীমাকে জিজ্ঞেস করতে পারেনি মিথিলেশছেলেকে স্কুলে ঢুকিয়ে দিয়ে সীমার হাতে কয়েক ঘণ্টা সময় থাকে। সেই সময়টা কত কী করতে পারে সীমা। কত অর্থকরী বৃত্তি আছে দুনিয়ায়। মিথিলেশ কোনওদিন জানতে চায়নি। চল্লিশ পেরিয়ে যারা চাকরি পায়, তাদের এতকিছু জানার অধিকার থাকে না। ছেলের জ্ঞানের জগতও তার থেকে কত আলাদা হয়ে যাচ্ছে। দেখে তার বেদনা হয়, তাও সে চুপ করে থাকে। শুধু টিফিনে এই আপেলটা কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। সীমার লিপস্টিক মাখা ঠোটের মতো টুকটুকে লাল আপেল দেখলে তার কেমন বিবমিষা হয়।

টিচার্স রুমে বসে ফোনে কথা বলতে কেমন অস্বস্তি হয় মিথিলেশের। শুধু টিচার্স রুম কেন, কোনও পাবলিক প্লেসেই ও ফোনে কথা বলতে পারে না। সেদিন বাড়ি ফেরার পথে বাসের মধ্যে ফোন এল। বউয়ের ফোন। বৌ বলল, মাসিরা এসেছে, বাসস্ট্যান্ডে প্রাণকেষ্টর দোকান থেকে গরম গরম সিঙ্গাড়া আর রসগোল্লা নিয়ে যেতে। বাসের মধ্যে বসে মিথিলেশ কিছুতেই জিজ্ঞেস করতে পারল না কটা সিঙ্গাড়া আর কটা রসগোল্লা নেবে। হুঁ হাঁ করে ছেড়ে দিল।

– রসমুণ্ডি!
ঝিল্লি যেন লাফিয়ে ওঠে।
– খাওয়াবি একদিন? দাদু নিয়ে আসত। আমি বলতাম চিকচিকে মিষ্টি…
মিথিলেশ জানে সব মানুষের ছোটবেলার একটা নিজস্ব অভিধান থাকে, সেখানে সব প্রিয় জিনিসের একটা নিজস্ব নাম দ্যায় তারা। মিথিলেশেরও ছিল হয়তো। কিন্তু এই মুহূর্তে সেটা তাকে তেমন আকর্ষণ করে না। তার এই বড়বেলাটাই বা খারাপ কি? বরং অনেক ভালো, এখন সে নিজেকে খানিকটা বুঝতে পেরেছে, অনেকখানি নিজের মতো থাকতে পারছে, সে যতই অকিঞ্চিৎকর হোক না কেন। এখন তো তার আছে এক এবং একমাত্র অবন্তীনগর, যেখানে ঝিল্লি আসতে পারে যে কোনও দিন। সে গাঢ় স্বরে বলল,
– খাওয়াব। তুই যেমন আমার জন্যে একটা আলাদা সিম নিয়েছিস, আমি তোর জন্যে একটা নতুন রাস্তা খুঁজে বার করছি, একটা নতুন বাসরুট। তুই কবে আসবি ঝিল্লি?  (চলবে)

 

*পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ৮ অগস্ট ২০২২
*ছবি সৌজন্য: Dreamstime.com

যাদবপুর বিশববিদ্যালয় থেকে বি.ই‚ এম.টেক । সরকারি মুদ্রণসংস্থায় প্রশাসনিক পদ‚ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিদর্শী অধ্যাপনা তাঁর লেখনীকে বিশেষ স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে।গল্প‚ উপন্যাস, কবিতার পাশাপাশি ছোটদের জন্য কল্পবিজ্ঞান লিখে থাকেন নিয়মিত। প্রকাশিত হয়েছে বহু বই। নামজাদা পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন উত্তর-সম্পাদকীয়। সাম্প্রতিকতম কাব্যগ্রন্থ: 'লাইব্রেরি শার্ট খোলো'।

2 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *