জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন, “সকলেই কবি নয়/কেউ কেউ কবি।” আজ তিনি বেঁচে থাকলে কী বলতেন ভাবতে ইচ্ছে হয়। ফেসবুকে কবিতার বিস্ফোরণ কিংবা কবি-সম্মেলনে উপচে পড়া ভিড় কি তাঁকে খুশি করত? তিনি কি উৎসাহিত হতেন? নাকি ভিন্ন কোনও ভাবনার কথা বলতেন? কিছুদিন আগেই যেমন এক কবি লিখেছিলেন — ‘এখানে কাকের চেয়ে কবির সংখ্যা বেশি।’ তাই নিয়ে বিতর্ক কম হয়নি। তবে পক্ষে বিপক্ষে দু’তরফেই ছড়িয়েছিল যুক্তিজাল। সেই বিতর্কের ঝাঁঝালো উত্তাপে আঙুল না-পুড়িয়েও কবি ও কবিতার সঙ্গে যুক্ত প্রায় ছ’শো শিল্পীকে একত্র করে রাজ্য সরকারের অনুপ্রেরণায় অনুষ্ঠিত হল কবিতা উৎসব ২০২০ (৫-৮ মার্চ)। রবীন্দ্রসদন, শিশির মঞ্চ, বাংলা আকাদেমি, অবনীন্দ্র সভাগৃহ, চারুকলা পর্ষদ প্রাঙ্গণ, একতারা মুক্তমঞ্চ এবং গগনেন্দ্র শিল্প প্রদর্শনশালায় একযোগে চলল অনুষ্ঠান।
এ প্রসঙ্গে অভিনেতা কবি চিরঞ্জিত চক্রবর্তীর মতে, “কবিতা হল প্রাচীনতম শিল্প।” কিন্তু আমরা তো সবাই জানি, প্রাচীনতম শিল্প হল চিত্রকলা।তাহলে কেন এমন বললেন চিরঞ্জিত? তাঁর উত্তর, “আলতামিরার গুহার গায়ে যে বাইসন আঁকা, তার পায়ের সংখ্যা চারের অধিক। কী করে সম্ভব? প্রকৃতপক্ষে প্রাগৈতিহাসিক মানুষের দেখা বাইসন ছিল ছুটন্ত বা গতিমান। যে ভাবে আমরা মাথার ওপর ঘুরন্ত ফ্যান দেখি। ফ্যানের ব্লেডের সংখ্যা তিন হলেও গতিমান অবস্থায় তা তিনের বেশি মনে হয়। এই বাইসনও সেই রকম। বাস্তব ছবি নয়। বাস্তবভিত্তিক ইলিউশন। বা হতে পারে কাল্পনিক অভিব্যক্তি। হাইপোথেটিক্যালি বলা যায় কবিতার জন্মবীজ এখানেই। আর কে না জানেন চর্যাপদ বাংলা কাব্যসাহিত্যের প্রাচীনতম পদ সংকলন। সে সময় থেকে আজও কবিতা সমবেগে ধাবিত। সংখ্যাটা  ছশো হোক বা ছয়। তাতে কী? কবিতা কবিতা হয়ে উঠছে কিনা সেটাই আসল। গত ৭ মার্চ রবীন্দ্রসদন এবং শিশির মঞ্চে যে কবিতার বর্ষণ শুনলাম, তাতে মনে হল কবিতা স্বতঃস্ফূর্ত আবেগের অভিব্যক্তি।”
রবীন্দ্রসদনে অনুষ্ঠানের সূচনায় সুতপা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচালনায় পরিবেশিত হল আবৃত্তির কোলাজ। তাতে ছিল নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘দেশ দেখাচ্ছ অন্ধকার’,অমিতাভ দাশগুপ্তর ‘আমার নাম ভারতবর্ষ’, শমীন্দ্র ভৌমিকের ‘ভারতবর্ষ।’ কোলাজের বিষয়বস্তুতে যেমন ঠাঁই পেয়েছিল দাঙ্গা, ধর্ষিতা আদিবাসীর দাউ দাউ চোখ, ঘাতকের স্টেনগান, ফোঁটা ফোঁটা রক্ত… তেমনই সমাপ্তি এসেছে সম্প্রীতির সুরে। কবিতার আবহে ছিল আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্য সুন্দর, বন্দেমাতরম, আমার সোনার বাংলা-র সুরে যন্ত্রানুষঙ্গের ব্যবহার। ধর্ম নয়, মনুষ্যত্বই মুখ্য। কবিতার এহেন সারমর্ম সময়ের মুখপাত্র। চতুর্দিকে রক্তপাত, হানাহানিতে উত্তপ্ত রাজধানী থেকে সারা দেশ। তখন কবিতার মাধ্যমে আশ্রয়ের আশ্বাস এনে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। যেন রাজনৈতিক হিংস্রতার মধ্যেও শৈল্পিক মলমে মানসিক উপশম।
অনুরাধা মহাপাত্রের ‘নিধিরামের নিবেদন’ কবিতাটিও আজকের আলোয় আলোকিত। কবি-বুদ্ধিজীবীদের সাইবার ট্রোলিং,পুঁজিবাদের আক্রমণ, নতুন যুগের অভয়বাণী উঠে এসেছে কবিতায়। অনুরাধার একটি পংক্তি বড়ই আন্তরিক–
“স্পর্শ করো কথা দাও…
আমার বিদ্যুত পোড়াবে তোমাকে।”
এই স্পর্শ কতটা বৌদ্ধিক আর কতটা শারীরিক সেটা অবশ্য কিঞ্চিত রহস্যাবৃত। আলো আঁধারির রহস্যময়তা কবিতার অতি আবশ্যিক আভাস। জীবনানন্দ যেমন বলেছিলেন–
“এইখানে সরোজিনী শুয়ে আছে,
জানি না সে এইখানে শুয়ে আছে কিনা।
অনেক হয়েছে শোয়া;
তারপর একদিন চলে গে’ছে কোন দূর মেঘে।”
এখানে টুবি অর নট টুবি-র দ্বন্দ্ব সদা জাগ্রত। কবিতা উৎসবেও তাই আলোচিত হল শিল্পের অতিপ্রয়োজনীয় বিষয় দ্বন্দ্ব নিয়ে। এই দ্বন্দ্বকে আমরা তিন ভাবে ভাবতে পারি। অন্তর্দ্বন্দ্ব, বহির্দ্বন্দ্ব এবং আকস্মিক দ্বন্দ্ব। গল্প বা গদ্যের ক্ষেত্রে একটি সূত্র উল্লেখযোগ্য — মুখ্য শক্তি (মেইন) + বিরোধী শক্তি (অপোজিশন) = দ্বন্দ্ব। গদ্য সাহিত্যের অধিকাংশ এই সূত্রের অনুসারী। কিন্তু কবিতা? সেখানে কি দ্বন্দ্বের চেয়ে ছন্দ বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়?
কবি চৈতালী চট্টোপাধ্যায় পরিবেশন করলেন তিনটি কবিতা। তার মধ্যে ‘প্রস্তাব’ কবিতাটি নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রমী।
“ঢেউ জ্বলে আর নিভে যায়…
আমি রাত্রিকে বলি ফিরিয়ে দেবে না…
নিজে আগুন গিলব
সঙ্গে নেব না।”
sujoyprasad in kabita utsav 2020
কবিতা পাঠ করছেন সুজয়প্রসাদ। ছবি – তন্ময় দত্তগুপ্ত
বাচিক শিল্পী কাজল শূ্রের পরিবেশনায় ছিল শামসুর রাহমানের ‘প্রেমের পদাবলি’, শঙ্খ ঘোষের ‘দেশকে ছুঁয়েছি পাথরে’, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘অদ্ভুত সময়।’ শিল্পীর উচ্চারণ, অভিব্যক্তি, স্বরক্ষেপণে শামসুর রাহমানের প্রেমের পদাবলির কিছু লাইন স্মৃতির আলো জ্বালিয়ে দিল,
“এখন ঘুমিয়ে আছো তুমি বৈবাহিক বিছানায়,
মৈথুনের ক্লান্তি কুয়াশার মতো লেগে আছে
সারা শরীরে তোমার সপ্তর্ষিমণ্ডলে আর
আমি দূরে বাংলা কবিতার মোড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি।”
সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের ঝুলিতে ছিল সুবোধ সরকারের ‘চুমু’,অপূর্ব দত্তের ‘ক্রিকেট সংক্রান্ত ছড়া’, এবং পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গানের কাব্যিক রূপ। সুবোধ সরকারের ‘চুমু’ কবিতাটি বেশ চমকপ্রদ–
“বেডরুমে বুদ্ধমূর্তি, লেনিন ও মার্ক্স-মেরে জান
চুমু খেতে পারছি না
একটাকে অন্তত সরান।”
সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠস্বরের গাম্ভীর্য কবিতাকে স্বতন্ত্র করে তোলে। ছন্দা রায়ের স্বরচিত ‘ফাগুনিয়া বন্ধু’ কবিতায় বাহা পরবের বিষয় সম্পৃ্ক্ত। শিল্পীর পরিবেশনা অভিনব, যেখানে অভিব্যক্তির মধ্যে ছন্দের তাল ও লয় সুস্পষ্ট। অন্যান্য কবিদের মধ্যে
বিশ্বদেব ঘোষ ও মৃদুল দাশগুপ্তের কথা বিশেষ ভাবে বলতে হয়। এছাড়া আবৃত্তিকার নুপুর বসুর কণ্ঠে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘যেতে যেতে’-র পরিবেশনা তারিফযোগ্য। আর বলব সম্মেলক আবৃত্তির কথা। পরিচালনায়  অরুণাভ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁরা আবৃত্তি করেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, জয়দেব বসু এবং মল্লিকা সেনগুপ্তর কবিতা। সামগ্রিক অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন সন্দীপ ঘোষ এবং মৌ ভট্টাচার্য।
এদিন শিশির মঞ্চেও ছিল নজর কাড়া কবি-আবৃত্তিকারের উপস্থিতি। শ্বেতা চক্রবর্তী, সৌরভ চন্দ, জয়ন্ত জয় চট্টোপাধ্যায়, প্রসূন ভৌমিক, সুজয়প্রসাদ প্রত্যেকেই ছিলেন স্বমহিমায়। প্রসূন ভৌমিকের একটি পংক্তি মনে রাখার মতো–
“আজও ফাঁসির কাঠে ঝুলছে ক্ষুদিরামের লাশ…
গুলি খাওয়া মাতঙ্গিনী উঠে দাঁড়াচ্ছে আবার।
আবৃত্তিতে ছিলেন ঊর্মি মুখোপাধ্যায়, শুভব্রত রায়চৌধুরী, অসীমা বন্দ্যোপাধ্যায়, পিনাকী দাস, প্রিয়দর্শিনী মৈত্র, অঞ্জল চট্টোপাধ্যায়, শ্রীমন্তী দাশগুপ্তর মতো বিশিষ্ট শিল্পীরা। অনুষ্ঠানের বিশেষ সঞ্চালিকা ছিলেন মধুমিতা বসু।
শেষ কথা হিসেবে শুধু এটুকুই বলার যে, রবীন্দ্রসদন ও শিশির মঞ্চে দর্শক সংখ্যা আশানুরূপ ছিল না। এ ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গ কবিতা আকাদেমির সভাপতি সুবোধ সরকারকে প্রশ্ন করায় তিনি অবশ্য বলেন, “আমাদের অংশগ্রহনকারীদের মধ্যে কবি তো আছেনই। আছেন বাচিক শিল্পী। আছেন সঞ্চালনার সঙ্গে যুক্ত পঞ্চাশ জন। আছেন আলোচক রূপে বিভিন্ন প্রাবন্ধিক ও অধ্যাপকেরা। এই সব নিয়ে সংখ্যাটা প্রায় ছশো। একতারা মঞ্চে লোকে বসার জায়গা পায়নি। লোকে দাঁড়িয়ে অনুষ্ঠান দেখেছে।হয়ত কোনও একটি বিশেষ দিনে হল ভরেনি। কিন্তু সেটা কিছু করার নেই। ছ’টা হলে একসঙ্গে অনুষ্ঠান হচ্ছে তো। তাই লোক কোথাও কোথাও শিফ্ট করে যায়। শেষ ছবিটা দেখলে বুঝতে পারতেন, একতারা মঞ্চে খোলা আকাশের নিচে কবিতার জন্য এত জনসমাগম আর কখনও হয়নি।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *