বাগবাজারের ঘাটে নৌকো এসে ভিড়ল। রাত্রি প্রায় শেষ। কলুরা ঘানি জুড়ে দিয়েছে। ধোপার গাধা ধপাস্ ধপাস্ করে চলেছে। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা কোশা নিয়ে স্নানে যাচ্ছেন। সময়টা উনিশ শতকের মাঝামাঝি। বাগবাজার, মানে সুতানুটি অঞ্চল তথা সাবেক উত্তর কলকাতা। প্যারীচাঁদ মিত্র লিখছেন, 

‘মেয়েরা ঘাটে সারি২ হইয়া পরস্পরের মনের কথাবার্তা কহিতেছে। কেহ বলিতেছে পাপ ঠাকুরঝির জ্বালায় প্রাণটা গেল— কেহ বলে আমার শাশুড়ী মাগি বড় বৌকাঁটকি— কেহ বলে দিদি আমার আর বাঁচতে সাধ নাই— বৌছুঁড়ি আমাকে দু’পা দিয়া থেঁতলায়— বেটা কিছুই বলে না; ছোঁড়াকে গুণ করে ভেড়া বানিয়েছে— কেহ বলে এমন পোড়া জাও পেয়েছিলাম দিবারাত্রি আমার বুকে বসে ভাত রাঁধে, কেহ বলে আমার কোলের ছেলেটির বয়স দশ বৎসর হইল— কবে মরি কবে বাঁচি এইবেলা তার বিএটি দিয়ে নি।’

লেখাটি প্রকাশিত হয় মহিলাদের উপযোগী সাময়িকপত্রে। নাম ‘মাসিক পত্রিকা’। বন্ধু রাধানাথ সিকদারের সহযোগে পত্রিকাটি করেন প্যারীচাঁদ। প্রথম সংখ্যার প্রকাশকাল ১৬ আগস্ট ১৮৫৪। ধারাবাহিকভাবে ছাপা হয় ‘আলালের ঘরের দুলাল’। সাল ১৮৫৫। ঘাটে মহিলাকুলের মনের কথা বলার ছবিটি সেই আলাল-আখ্যানের অংশ। মনের কথা, দুঃখের কথা, সুখের কথা সবই ধরা হয়েছে মুখের কথায়। সংস্কৃতের পণ্ডিতি, গদাইলস্করি চাল, অস্বাভাবিকতা নেই। থাকলে এই ছবি এত প্রাণবন্ত হতে পারত না। ঘাটে জলের ছলচ্ছলের সমান্তরালে বয়ে যায় সেদিনের বাংলার অন্তঃপুরবাসিনীদের গার্হস্থ্য কলধ্বনি।

কথ্যভাষার কী অসম্ভব শক্তি! প্যারীচাঁদের লেখার আরেকটি অংশ:

‘এক পশলা বৃষ্টি হইয়া গিয়াছে— আকাশে স্থানে২ কাণা মেঘ আছে— রাস্তাঘাট সেঁত২ করিতেছে। বাবুরামবাবু এক ছিলিম তামাক খাইয়া একখানা ভাড়া গাড়ি অথবা পাল্কির চেষ্টা করিতে লাগিলেন কিন্তু ভাড়া বনিয়া উঠিল না— অনেক চড়া বোধ হইল। রাস্তায় অনেক ছোঁড়া একত্র জমিল। বাবুরাম বাবুর রকম সকম দেখিয়া কেহ২ বলিল, ওগো বাবু ঝাঁকা মুটের ওপর বসে যাবে? তাহা হইলে দু’পয়সায় হয়। তোর বাপের ভিটে নাশ করেছে— বলিয়া যেমন বাবুরাম দৌড়িয়া মারিতে যাবেন অমনি দড়াম করিয়া পড়িয়া গেলেন। ছোঁড়াগুলো হো২ করিয়া দূর থেকে হাততালি দিতে লাগিল।’

Alaler Ghorer Dulal
কথ্যভাষার জোর প্রথম বোঝা গেল প্যারীচাঁদ মিত্রের গদ্যে

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তখনও ‘দুর্গেশনন্দিনী’ লেখেননি। লিখবেন দশবছর পর। লিখবেন: 

‘৯৯৭ বঙ্গাব্দের নিদাঘশেষে একদিন একজন অশ্বারোহী পুরুষ বিষ্ণুপুর হইতে মান্দারণের পথে একাকী গমন করিতেছিলেন। দিনমণি অস্তাচলগমনোদ্যোগী দেখিয়া অশ্বারোহী দ্রুতবেগে অশ্ব সঞ্চালন করিতে লাগিলেন। কেন না, সম্মুখে প্রকাণ্ড প্রান্তর।… প্রান্তর পার হইতে না হইতেই সূর্যাস্ত হইল; ক্রমে নৈশ গগন নীলনীরদমালায় আবৃত হইতে লাগিল। নিশারম্ভেই এমন ঘোরতর অন্ধকার দিগন্তসংস্থিত হইল যে, অশ্বচালনা অতি কঠিন বোধ হইতে লাগিল। পান্থ কেবল বিদ্যুদ্দীপ্তিপ্রদর্শিত পথে চলিতে লাগিলেন।’

‘দুর্গেশনন্দিনী’ সম্পর্কে সেদিনের প্রতিক্রিয়া ছিল মিশ্র। ভাটপাড়ার পণ্ডিতরা অভিনন্দন জানালেন। পণ্ডিত দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ বঙ্কিমীভাষাকে বললেন, ‘শব পোড়া মরা দাহ।’ শিবনাথ শাস্ত্রী অবশ্য জানিয়েছেন, ‘দেখিয়া সকলে চমকিয়া উঠিল। কি বর্ণনার রীতি, কি ভাষার নবীনতা, সকল বিষয়ে বোধ হইল যেন বঙ্কিমবাবু দেশের লোকের রুচি ও প্রবৃত্তির স্রোত পরিবর্তিত করিবার জন্য প্রতিজ্ঞারূঢ় হইয়া লেখনী ধারণ করিয়াছেন।’

বাগবাজারের ভোরে সেদিন কথ্যভাষার স্পষ্ট আলো দেখেছিলেন প্যারীচাঁদ।

‘বাবুরাম বাবু অধোমুখে শীঘ্র একখানা লকাটে রকম কেরাঞ্চিতে ঠকচাচা প্রভৃতিকে লইয়া উঠিলেন এবং ঝনঝন২ শব্দে বাহির শিমলের বাঞ্ছারাম বাবুর বাটীতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন।’

সেইসময়ের কলকাতার পথঘাটের মানচিত্র অনুযায়ী শিমলে পেরিয়ে বাহির শিমলেয় যেতে হতো। শিমলেপাড়ার বিশ্বনাথ দত্ত পরিবারের নরেন্দ্রনাথ তথা বিবেকানন্দ তখনও ভবিষ্যতের গর্ভে। উনিশ শতকের প্রান্ত বছরে তিনি বলবেন,

“যখন মানুষ বেঁচে থাকে তখন জেন্ত-কথা কয়, মরে গেলে মরা-ভাষা কয়। যত মরণ নিকট হয়, নুতন চিন্তাশক্তির যত ক্ষয় হয়, ততই দু-একটা পচাভাব রাশীকৃত ফুলচন্দন দিয়ে ছাপাবার চেষ্টা হয়। বাপরে সে কি ধুম— দশপাতা লম্বা২ বিশেষণের পর দুম করে— ‘রাজা আসীৎ’!!! আহাহা! কি প্যাচওয়া বিশেষণ, কি বাহাদুর সমাস, কি শ্লেষ!! ও সব মড়ার লক্ষণ।”

বিবেকানন্দের আক্রমণের নিশানা সংস্কৃতানুসারী ভাষা। ঘোরতর দিগন্তসংস্থিত অন্ধকারে বিদ্যুদ্দীপ্তিপ্রদর্শিত পথে পান্থকে চালিত করলেও বঙ্কিমচন্দ্র ক্রমে বুঝেছিলেন সাহিত্যের পথ কথ্যভাষার নির্মাণে কতটা মজবুত হতে পারে, জ্যান্ত-কথার জোর কতদূর যায়। ছেলেবেলায় ভট্টাচার্য পণ্ডিতদের যে ভাষায় কথা বলতে তিনি শুনেছেন, তা শুধু সংস্কৃত ব্যবসায়ীদের বোধগম্য ছিল বলে অভিমত দিয়েছেন ১৮৯২ সালের একটি লেখায়। ‘দুর্গেশনন্দিনী’ প্রকাশের ২৭ বছর পর।

Swami Vivekananda Poetry
জ্যান্ত-ভাষা বা কথ্য ভাষার ক্ষমতার সমর্থনে স্বামী বিবেকানন্দ কথা বলেছেন

ভট্টাচার্য অধ্যাপকদের সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্র বলছেন, তাঁরা ‘খয়ের’ বলতেন না, বলতেন ‘খদির’। তাঁরা ‘চিনি’ ও ‘ঘি’ বলতেন না, বলতেন ‘শর্করা’ ও ‘আজ্য’। ‘চুল’ না বলে ‘কেশ’, ‘কলা’ না বলে ‘রম্ভা’, ‘দই’ না বলে ‘দধি’। ‘একদিন ‘শিশুমার’-এর ‘অর্থবোধ লইয়া অতিশয় গণ্ডগোল পড়িয়া গিয়াছিল’। এই ভাষায় লেখা বই অচিরেই বিলুপ্ত হত, কেন না কেউ তা পড়ত না। সংস্কৃত ভাষার সংকীর্ণ ও অস্বাভাবিক পরিস্থিতি থেকে বাংলা ভাষাকে মুক্তি দিলেন প্যারীচাঁদ মিত্র। বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন, আলালের ঘরের দুলাল প্রমাণ করল যে, 

‘যে বাঙ্গালা সর্বজনমধ্যে কথিত এবং প্রচলিত, তাহাতে গ্রন্থ রচনা করা যায়, সে রচনা সুন্দরও হয়, এবং যে সর্বজনহৃদয়গ্রহিতা সংস্কৃতানুগামিনী ভাষার পক্ষে দুর্লভ, এ ভাষার তাহা সহজ গুণ।’

ততদিনে বঙ্কিমচন্দ্রের সব উপন্যাস লেখা হয়ে গিয়েছে। জ্যান্ত-ভাষা বা কথ্য ভাষার ক্ষমতার সমর্থনে স্বামী বিবেকানন্দের অসাধারণ একটি মন্তব্য আছে। তিনি বলছেন,

‘স্বাভাবিক যে ভাষায় মনের ভাব আমরা প্রকাশ করি, যে ভাষায় ক্রোধ দুঃখ ভালবাসা ইত্যাদি জানাই, তার চেয়ে উপযুক্ত ভাষা হতে পারেই না; সেই ভাষা, সেই ভঙ্গি, সেই সমস্ত ব্যবহার করে যেতে হবে। ও ভাষার যেমন জোর, যেমন অল্পের মধ্যে অনেক, যেমন যে-দিকে ফেরাও সে-দিকে ফেরে, তেমন কোন তৈয়ারি ভাষা কোনও কালে হবে না।’

লেখাটি প্রকাশিত হয় মহিলাদের উপযোগী সাময়িকপত্রে। নাম ‘মাসিক পত্রিকা’। বন্ধু রাধানাথ সিকদারের সহযোগে পত্রিকাটি করেন প্যারীচাঁদ। প্রথম সংখ্যার প্রকাশকাল ১৬ আগস্ট ১৮৫৪। ধারাবাহিকভাবে ছাপা হয় ‘আলালের ঘরের দুলাল’। সাল ১৮৫৫। ঘাটে মহিলাকুলের মনের কথা বলার ছবিটি সেই আলাল-আখ্যানের অংশ। মনের কথা, দুঃখের কথা, সুখের কথা সবই ধরা হয়েছে মুখের কথায়। সংস্কৃতের পণ্ডিতি, গদাইলস্করি চাল, অস্বাভাবিকতা নেই। থাকলে এই ছবি এত প্রাণবন্ত হতে পারত না। ঘাটে জলের ছলচ্ছলের সমান্তরালে বয়ে যায় সেদিনের বাংলার অন্তঃপুরবাসিনীদের গার্হস্থ্য কলধ্বনি।

বিবেকানন্দ আরও এগিয়ে, কথ্যভাষার বিস্তীর্ণ পরিসরের মধ্যে নির্দিষ্টভাবে একটি ভাষাকে আগামীদিনের বাংলা সাহিত্যের বাহক হিসেবে, মাধ্যম হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘‘কলকাতার ভাষাই অল্পদিনে সমস্ত বাঙ্গালা দেশের ভাষা হয়ে যাবে। তখন যদি পুস্তকের ভাষা এবং ঘরে কথা-কওয়া ভাষা এক করতে হয়, তো বুদ্ধিমান অবশ্যই কলকেতার ভাষাকে ভিত্তিস্বরূপ গ্রহণ করবেন।” বিবেকানন্দের এই চিহ্নায়নের মূলে যে বিশ্লেষণ, তা হল: বাংলাদেশের এক এক জায়গায় এক এক রকম ভাষা। এক জেলা থেকে আর এক জেলায় ভাষা বদলে যায় শব্দে অর্থে উচ্চারণে। তাহলে একটি আদর্শ ভাষা গড়ে ওঠার সমাধান কোথায়? প্রাকৃতিক নিয়মে যেটি বলবান হচ্ছে এবং ছড়িয়ে পড়ছে, সেইটিই গ্রহণ করতে হবে। অর্থাৎ কলকাতার ভাষা। বিবেকানন্দ বলেন, ‘কলকেতার ভাষা।’

“পূর্ব পশ্চিম যে দিক থেকেই আসুক না কেন, একবার কলকেতার হাওয়া খেলেই দেখছি, সেই ভাষাই লোকে কয়। যত রেল এবং গতাগতির সুবিধা হবে, তত পূর্ব পশ্চিমী ভেদ উঠে যাবে এবং চট্টগ্রাম থেকে বৈদ্যনাথ পর্যন্ত ওই এক কলকেতার ভাষাই রাখবে।”

এই ভাষার লিখিত চর্চার আদিপুরুষ কালীপ্রসন্ন সিংহ। ‘আলালের ঘরের দুলাল’ প্রকাশের সাত বছর পর, ১৮৬২ সালে বের হয় তাঁর ‘হুতোম প্যাঁচার নক্শা’। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস-প্রণেতা ও ভাষাতাত্ত্বিক সুকুমার সেনের মতে, হুতোমের নকশা আলালের অনুকরণে রচিত। এই অভিমত নিয়ে বিতর্ক আছে। হুতোমের রুচি নিয়ে তাঁর মন্তব্যও প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়। তবে সুকুমার সেন স্বীকার করেছেন, হুতোম প্যাঁচার নকশা একেবারে কথ্যভাষার ছাঁদে লেখা। কলিকাতা অঞ্চলের উপভাষার ছাদ এই ভাষায় সুস্পষ্ট। সাধুভাষার অযথা মিশ্রণ নেই। সেই হিসাবে এর ভাষা আলালের ঘরের দুলালের ভাষা থেকে ব্যাকরণ হিসেবে বিশুদ্ধতর। তবে, সুকুমার সেনের মতে, উপভাষা-ঘেঁষা কথ্যভাষায় লেখা বলে রচনা নেহাৎ খেলো হয়ে গিয়েছে। আবার তিনিই বলছেন, হুতোমের ভাষার প্রধান গুণ হচ্ছে সরসতা। এই সরসতা সর্বত্র মার্জিত সূক্ষ্ম ও উঁচুদরের না হলেও খাঁটি।

কথাসাহিত্যিক ও সমালোচক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় কিন্তু হুতোমের রচনা সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত। তাঁর মতে, রামমোহন রায় ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সার্থক উত্তরসুরি কালীপ্রসন্ন সিংহের হুতোম প্যাঁচার নকশা একেবারে সর্বজনবোধ্য চলতি ভাষায় লেখা বই হিসেবে বাংলা গদ্যে প্রথমতম। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ভাষায়,

‘চলতি ভাষা— প্রাকৃতজনের মুখের কথাই যে আগামী দিনের সাহিত্যের বাহন, বীরবলের ‘সবুজ পত্র’-এর পাতায় এ বাণী ঘোষিত হওয়ার অনেক আগেই কালীপ্রসন্ন সিংহ তাঁর সূচনা করে দিয়েছিলেন। আধুনিক গদ্যরীতির তিনিই পথিকৃৎ। প্রথম প্রয়াসের সমস্ত অসম্পূর্ণতাকে অতিক্রম করে তাঁর সৎসাহস ও শক্তিমত্তা আপন গৌরবে দীপ্ত হয়ে উঠেছে। পরম পরিতাপের কথা, কালীপ্রসন্নের এই সংকেতকে বঙ্কিমচন্দ্র গ্রহণ করতে পারলেন না। যদি পারতেন, তাহলে অনেক আগেই তাঁর বলিষ্ঠ লেখনীর ছোঁয়ায় বাঙলা সাহিত্যিক গদ্যে নবযৌবনের জোয়ার আসত।’

vivekanda
‘Lecture ফেকচার তো কিছু লিখে দিই না, একটা লিখে দিয়েছিলুম’

হুতোম প্যাঁচার নকশা থেকে উদ্ধৃতি দেবার সমস্যা এই যে, বইয়ের সব ক’টি অনুচ্ছেদই, আমার ব্যক্তিগত বিচারে, উদ্ধৃতিযোগ্য। বাছাইয়ের উপায় নেই। তবু বেছে নিতে হল। 

‘কলকেতায় প্রথম বিধবা বিবাহের দিন বলী, উতোরপাড়া, অম্বিকে ও রাজপুর অঞ্চলের বিস্তর ভটচায্যিরা সভাস্থ হন—ফলার ও বিদেয় মারেন। তারপর ক্রমে গাঢাকা হতে আরম্ভ হন, অনেকে গোবর খান, অনেকে সভাস্থ হয়েও বলেন, আমি সে দিন শয্যাগত ছিলাম। যতদিন এই মহাপুরুষদের প্রাদুর্ভাব থাকবে, ততদিন বাঙালীর ভদ্রস্থতা নাই; গোঁসাইরা হাঁড়ী, মুচি ও মুদ্দফরাস নিয়ে বেঁচে আছেন, এই মহাপুরুষরা গোটা কত হতভাগা গোমূখ কায়স্থ ব্রাহ্মণ দলপতির জোরে আজও টিঁকে আছেন; এঁরা এক একজন হারামজাদকি ও বজ্জাতির প্রতিমূর্তি, এদিকে এমনি সাজসজ্জা করে বেড়ান যে হঠাৎ কার সাধ্য অন্তরে প্রবেশ করে— হঠাৎ দেখলে বোধহয় অতি নিরীহ ভদ্রলোক! বাস্তবিক, সে কেবল ভড়ং ও ভণ্ডামো।’

কথ্যভাষার কী জোর, কী জীবনশক্তি, কী প্রত্যক্ষ ও পরিমিতি। জ্যান্ত কথা। স্বামী বিবেকানন্দ স্বচ্ছন্দে এই কথ্য গদ্যের, কলকেতার ভাষা-নির্ভর গদ্যের, জ্যান্ত-কথার চর্চা করেছেন। লেখার সময় বিশেষ পাননি। রামকৃষ্ণানন্দকে লেখা চিঠিতে বলছেন,

“আমার বহুত চিঠি লেখার সময় বড় একটা হয় না। Lecture ফেকচার তো কিছু লিখে দিই না, একটা লিখে দিয়েছিলুম, যা ছাপিয়েছ। বাকি সব দাঁড়াঝাঁপ, যা মুখে আসে গুরুদেব জুটিয়ে দেন। কাগজপত্রের সঙ্গে সম্বন্ধই নাই। একবার ডেট্রয়েটে তিন ঘণ্টা ঝাড়া বুলি ঝেড়েছিলুম। আমি নিজে অবাক হয়ে যাই সময়ে সময়ে: ‘মধো, তোর পেটে এতও ছিল!’ এরা সব বলে পুঁথি লেখ; একটা এইবার লিখতে ফিকতে হবে দেখছি। ঐ তো মুশকিল, কাগজ কলম নিয়ে কে হাঙ্গামা করে বাবা!”

বিশ্বজুড়ে প্রব্রজ্যার তুমুল ব্যস্ততায় থাকতে না হলে, এত দ্রুত আয়ু না ফুরোলে হয়তো সেই চর্চার বহুতর নজির পাওয়া যেত। যেটুকু পাওয়া যায়, সেখানেই আছে সেই অসমাপ্ত সম্ভবের জীবিত সমর্থন। যেমন, বাস্তিল দুর্গের পতন সম্পর্কে তাঁর অনবদ্য ভাষ্য:

“দেশসুদ্ধ লোক এ সব অত্যাচারে ক্ষেপে উঠল, ‘ব্যক্তিগত স্বাধীনতা’, ‘সব সমান’, ‘ছোট বড় কিছুই নয়’— এ ধ্বনি উঠল, পারির লোক উন্মত্ত হয়ে রাজা-রানীকে আক্রমণ করলে, সে সময় প্রথমেই এ মানুষের অত্যাচারের ঘোর নিদর্শন বাস্তিল ভূমিসাৎ করলে, সে স্থানটায় এক রাত ধরে নাচগান আমোদ করলে। তারপর রাজা পালিয়ে যাচ্ছিলেন, তাঁকে ধরে ফেললে, রাজার শ্বশুর অস্ট্রিয়ার বাদশা জামাইয়ের সাহায্যে সৈন্য পাঠাচ্ছেন শুনে, প্রজারা ক্রোধে অন্ধ হয়ে রাজা-রানীকে মেরে ফেললে, দেশসুদ্ধ লোকে ‘স্বাধীনতা সাম্যে’র নামে মেতে উঠল, ফ্রাঁস প্রজাতন্ত্র [republic] হল; অভিজাত ব্যক্তির মধ্যে যাকে ধরতে পারলে তাকে মেরে ফেললে, কেউ কেউ উপাধি টুপাধি ছেড়ে প্রজার দলে মিশে গেল। শুধু তাই নয়, বললে ‘দুনিয়াসুদ্ধ লোক, তোমরা ওঠ, রাজা-ফাজা অত্যাচারী সব মেরে ফেল, সব প্রজা স্বাধীন হোক, সকলে সমান হোক’। তখন ইউরোপসুদ্ধ রাজারা ভয়ে অস্থির হয়ে উঠল—এ আগুন পাছে নিজেদের দেশে লাগে, পাছে নিজেদের সিংহাসন গড়িয়ে পড়ে যায় তাই তাকে নেবাবার জন্য বদ্ধপরিকর হয়ে চারদিক থেকে ফ্রাঁস আক্রমণ করলে।” 

ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাস এভাবে লেখা, ভাবা যায়! এই কথ্য ভাষায়, জ্যান্ত কথায়! আমাদের শিক্ষাবিদরা কত সিরিয়াসলি ব্যাপারটা গুরুগম্ভীর-কঠিন-দূরবর্তী করে তোলেন, রাজনীতিবিদরা নিজেদের তত্ত্ব জড়িয়ে কত রং চড়িয়ে বলেন। এই জ্যান্ত কথ্য বাংলা সাহিত্যের মূল ধারায় চর্চিত হল না। কেন হল না সে-প্রসঙ্গ ভিন্ন।

Foodie Swami Vivekananda
স্বামী বিবেকানন্দ স্বচ্ছন্দে এই কথ্য গদ্যের, কলকেতার ভাষা-নির্ভর গদ্যের চর্চা করেছেন

শুধু এটুকু এখানে মনে হয় বলা যেতে পারে, বাংলা সাহিত্যের ভাষা আজ রক্তাল্পতায় ভুগছে। যে অল্প কয়েকজন লেখক জ্যান্ত কথার পথে হেঁটেছেন, প্রান্তিক হয়ে পড়েছেন তাঁরা। মরা ভাষায় ধূপ-চন্দন-ফুলমালা চড়িয়ে চলেছে বাংলা সাহিত্য। এটা তো ঘটনা, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভাষা পালটায়। সময়ের সমস্ত অভিঘাত ভাষাকে পালটায়। কলকাতা বাংলার রাজধানী হলেও, ‘গঙ্গার উভয় তীরের ভাষা সুন্দর ও সুশ্রাব্য’ হলেও, বাঞ্ছিত ও অবাঞ্ছিত নানাবিধ পরিবর্তনের দাপট এড়িয়ে সে-ভাষা আদি ও অক্ষয় রূপে থাকতে পারে না। তার জন্য লেখকের পাঠকের রুচির পরিবর্তনও অপরিহার্য। প্রয়োজন সাহস ও নতুনকে গ্রহণের ক্ষমতা। পুরনো চাল থেকে বেরিয়ে আসতে পারা জীবিতের লক্ষণ। বিবেকানন্দের ভাষা-চিন্তা সেই নির্ভুল সংকেতই দেয়।

বিবেকানন্দের ‘বঙ্গোপসাগরে’ রচনায় গঙ্গামাহাত্ম্য ও পাঁঠাবলি নিয়ে সরস একটা বয়ান আছে। উদ্ধৃত করা যেতে পারে। হয়তো অনেকেরই পড়া, তবু। 

“তু-ভায়া বললেন, ‘মশায়! পাঁটা মানা উচিত মাকে’; আমিও বলি, “তথাস্তু, একদিন কেন ভায়া, প্রত্যহ।’ পরদিন তু-ভায়া আবার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মশায়, তার কী হল?’ সেদিন আর জবাব দিলাম না। তার পরদিন আবার জিজ্ঞাসা করতেই খাবার সময় তু-ভায়াকে দেখিয়ে দিলুম, পাঁটা মানার দৌড়টা কতদূর চলছে। ভায়া কিছু বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘ও তো আপনিও খাচ্চেন’। তখন অনেক যত্ন করে বোঝাতে হল যে— কোন গঙ্গাহীন দেশে নাকি কলকেতার এক ছেলে শ্বশুরবাড়ি যায়; সেখানে খাবার সময় চারিদিকে ঢাকঢোল হাজির; আর শাশুড়ীর বেজায় জেদ, ‘আগে একটু দুধ খাও।’ জামাই ঠাওরালে বুঝি দেশাচার, দুধের বাটিতে যেই চুমুকটি দেওয়া— অমনি চারিদিকে ঢাকঢোল বেজে ওঠা। তখন শাশুড়ী আনন্দাশ্রুপরিপ্লুতা হয়ে মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করে বললে, ‘বাবা! তুমি আজ পুত্রের কাজ করলে, এই তোমার পেটে গঙ্গাজল আছে, আর দুধের মধ্যে ছিল তোমার শ্বশুরের অস্থি গুঁড়া করা— শ্বশুর গঙ্গা পেলেন।’ অতএব হে ভাই! আমি কলকেতার মানুষ এবং জাহাজে পাঁটার ছড়াছড়ি, ক্রমাগত মা গঙ্গায় পাঁটা চড়ছে, তুমি কিছুমাত্র চিন্তিত হয়ো না। ভায়া যে গম্ভীরপ্রকৃতি, বক্তৃতাটা কোথায় দাঁড়াল— বোঝা গেল না।”

 

*এই প্রবন্ধটি ‘জাগ্রত বিবেক’ ২০১৭ জানুয়ারি সংখ্যায় প্রকাশিত। পরিমার্জিতভাবে এখানে প্রকাশিত হল। উদ্ধৃতির বানান অপরিবর্তিত। 
*ছবি সৌজন্য: Jagran.com, Wikipedia, Asianstudies.org

Madhumoy Paul

মধুময়ের জন্ম ১৯৫২ সালে পূর্ববঙ্গের ময়মনসিংহে, কিশোরগঞ্জে। লেখাপড়া কলকাতায়। শৈশব-যৌবন কেটেছে স্টেশনে, ক‍্যাম্পে, বস্তিতে। গল্প লিখে লেখালেখি শুরু। পরে উপন‍্যাস। বই আখ‍্যান পঞ্চাশ, আলিঙ্গন দাও রানি, রূপকাঠের নৌকা। অনুসন্ধানমূলক কাজে আগ্রহী। পঞ্চাশের মন্বন্তর, দাঙ্গা-দেশভাগ, নকশালবাড়ি আন্দোলন নিয়ে কাজ করেছেন। কেয়া চক্রবর্তী, গণেশ পাইন তাঁর প্রিয় সম্পাদনা। প্রতিমা বড়ুয়াকে নিয়ে গ্রন্থের কাজ করছেন চার বছর। মূলত পাঠক ও শ্রোতা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *