মুন্নার থেকে যখন আমাদের গাড়ি রওনা দিল, চা-বাগানের শিশিরযাপন তখনও শেষ হয়ে যায়নি। শেষ শরতের নতুন রোদের সামনে হাত-পা ছড়িয়ে বসে তার নিঃশ্বাসে ভিজে গা সেঁকতে সেঁকতে টুকটাক গল্প চলছে। দক্ষিণে কেরলের এই গল্প অবশ্য সুদূর উত্তরপূর্বের দার্জিলিঙের থেকে আলাদা কিছু নয়। হবে না-ই বা কেন, উচ্চতার ঘাটতি তো মোটে হাজার দেড়েক ফিটের। অগত্যা পদে পদে মেঘেদের ব্যাঘাত, আড্ডার অকাল-ইতি। বাগান তখন আবারও কাকভেজা সবুজ সিল্কের শাড়ি। তার ছাইরঙা আঁচল মুন্নার-উদুমালপেট রোড। আঁচলপথে সংক্ষিপ্ত এই সফর মোটে আধটি ঘণ্টার, মাত্র ১৬ কিলোমিটার।

ভূগোলের পাতার সেই পশ্চিমঘাট পর্বতমালা। দক্ষিণের এই শেষ বিন্দুতে এসেও মাথা তুলে সফরসঙ্গী আরব সাগরকে একবার দেখার কী আকুতি! কিন্তু তারও বয়স হয়েছে, সংসার হয়েছে। নাম হয়েছে কানন দেবন পাহাড়। তার সেই উঁচু হয়ে থাকা শরীরের অংশগুলোয় কোলেপিঠে চেপে থাকা শিশুদের মতো ছড়িয়ে অরণ্যেরা। এরাভিকুলাম জাতীয় উদ্যান, কেরল রাজ্যের প্রথম জাতীয় উদ্যান— প্রকৃতিপ্রেমী, পরিবেশবিদ আর সংগ্রাহকদের স্বর্গরাজ্য।

Towards ENP
শিশির-কুয়াশায় ভেজা চা বাগান পেরিয়ে

আমাদের গাড়ি যেখানে আটক হল সেই জায়গাটার নাম পাঁচ মাইল। কোনও অপরাধে নয়। এটাই নিয়ম। এখানেই জরিমানা, থুড়ি এন্ট্রি ফি দিয়ে চড়ে বসলাম পার্কের নিজস্ব পরিবেশবন্ধু বাসে। চালকের আসনে স্থানীয়রা। ইকো টুরিজমের সফল প্রয়োগ। চা-বাগানের পথে ঢালে ঢালে বাস ক্রমশ উঠে চলল উঁচুতে। মেঘলা দিন। সকাল সাতটা থেকে বিকেল চারটে অবধি এই পথে গুটিকয়েক বাস। শুধুমাত্র পর্যটকদের আনা-নেওয়া ফেব্রুয়ারি ও মার্চে সেটুকুও নেই। তাই নিঝুম এক নির্জনতাই এই বাগানপথের অভ্যস্ত জীবন। পথের শেষ এক কিলোমিটার তো ওটুকু অসুবিধে নিতেও নারাজ। তাই বাস ছেড়ে হাঁটা শুরু। কিছুক্ষণ পরে পরেই বনবিভাগের বোর্ড সতর্ক করে দিচ্ছে তবু। বলছে, মুখে আঙুল দিয়ে চলুন, আপনি প্রায় এসে পড়েছেন অভীষ্ট লক্ষ্যে।

আরও পড়ুন: পায়ে পায়ে পঞ্চচুল্লির পায়ের কাছে

বর্গ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে এই অরণ্যানীর ছোট সংসার। গল্পটা যদিও শুরু ২২৭ বর্গ কিলোমিটার থেকে। ত্রিবাঙ্কুরের স্থানীয় রাজা পুঞ্জাতের থেকে সস্তায় জমি নিয়ে ইউরোপীয় পর্যটক কর্নেল ডগলাস হ্যামিল্টন ও জে ডি মুনরো ১৮৭৯ সালে এখানে স্থাপন করলেন নর্থ ট্রাভাঙ্কুর প্লান্টেশন অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল সোসাইটি। ১৮৯০ সাল নাগাদ এর উঁচু অংশে লাগানো হল চা গাছ। পাশাপাশি কফি, সিংকোনা ও ইউক্যালিপটাস— স্বাভাবিক উদ্ভিদকে কিছুটা ধ্বংস করেই। স্বাধীনতার বেশ অনেকগুলো বছর পরে কেরল সরকারের হাতে এই জমি ফিরে এলে ‘কানন দেবন হিলস আইন’, ১৯৭১-এর সাহায্যে স্থানীয়দের মধ্যে তা বন্টনের ব্যবস্থা হয়। যুক্ত হন পরিবেশবিদ ও বিজ্ঞানীরা। সেই পথেই আবার স্বাভাবিক উদ্ভিদ ও চাষবাসের চলন ফিরে আসে। অরণ্য অংশটি ১৯৭৫ সালে এরাভিকুলাম-রাজামালাই অভয়ারণ্য (Eravikulam National Park) নামে পরিচিত হয়। ১৯৭৮ সালে উন্নীত হয় জাতীয় উদ্যানে।

Park's own transport
গাড়ি রেখে পার্কের বাস ধরা

অনেকটা চড়াই ভেঙে উঠে এলাম বিশাল এক পাহাড়ের পায়ে একটা টেবিল-টপ মতো জায়গায়। হালকা শীত, হু হু বাতাস। দূর দূর অবধি সবুজের ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছে নীচের দিকে। জলের ধারায় ভিজেছে স্থানে স্থানে। মেঘলা আকাশের নীচে সমতলে হাঁটা যাবে ভেবে স্বস্তি পেতেই দেখি সামনের বোর্ড বলছে, ‘ব্যাস ব্যাস, আর নয়, আপনার অনুমতি এই পর্যন্তই’। জানলাম, যেখানে এসে দাঁড়িয়েছি তার নামই খসে গেছে জাতীয় উদ্যানের নামকরণের সময়। রাজামালাই— জাতীয় উদ্যানের মধ্যে পর্যটকদের জন্য খোলা রাখা অতি ক্ষুদ্র অংশ। হতোদ্যম হতে দেখে হাসলেন এক স্থানীয় যুবক। বললেন, ক্ষুদ্র তো কী, আপনি দাঁড়িয়ে আছেন অরণ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিন্দুতে। সামনে দেখুন, কতটা খোলা, কতদূর চোখ চলে যায় সবুজকে সবুজ পেরিয়ে। সেই সবুজ চিরে চিরে নানা দিক থেকে অকৃপণ জলের ধারা। তাই তো এরাভিকুলাম— দ্য স্ট্রিমস অ্যান্ড দ্য পুলস।

আমরা তাজ্জব। দাঁড়ান মশাই দাঁড়ান। পিছনে দেখুন। হাতির মাথার মতো দাঁড়িয়ে আছে ওই যে বিশাল পাহাড়টা। ওটাই দক্ষিণ ভারতের উচ্চতম শৃঙ্গ।

— “আনাইমুদি”! ঝুলে পড়া চোয়াল থেকে বেরিয়ে এল শব্দটা।

— “ধরেছেন ঠিক, তবে উচ্চারণ ভুল। আনাইমুড়ি। হাতির মাথা”, শুধরে দেন যুবকটি।

Anaimudi Peak from Rajamalai
রাজামালাই পয়েন্ট থেকে আনাইমুড়ি বা হাতির মাথা শৃঙ্গ

কিছু বলতে যাচ্ছিলাম। যুবক মুখে আঙুল দিলেন। তার পর নির্দেশ করলেন ডান দিকের ঢালে। চারপেয়ে প্রাণীটা উঠে আসছে। বিলুপ্তপ্রায় নীলগিরি থার। বড় ছাগলের মতো দেখতে, বাঁকানো শিং। এই জাতীয় উদ্যানের প্রধানতম আকর্ষণ। রাজামালাই অংশেই তাদের বাস সবচেয়ে বেশি।

সাধারণ লেন্সে আসবে, নাকি জুম লেন্স লাগাতে হবে— তর্কটা চলছিল ক্যামেরা বের করার সময় থেকেই। সুন্দরবনের বাঘ দেখতে পাওয়ার আনন্দে সবাই ছবি তুলতে ব্যস্ত। আর প্রাণীটি ব্যস্ত পেটপূর্তিতে। কচি সবুজ ঘাস। তারই টানে ঢাল বেয়ে বেয়ে দশ মিনিটের মধ্যে সে বেড়া পেরিয়ে সোজা পিচ রাস্তার ধারে, আমাদের হাতছোঁয়া দূরত্বে। ছাগলছানা ভেবে কোলে তুলে নেওয়াটুকু তখন আটকে শুধুই উদ্যানবিধির গেরোয়। জুম লেন্সে বিব্রত হওয়ার তোয়াক্কা নীলগিরি থার করে না, এটা জানা ছিল না।

Nilgiri tahr
খাবারের খোঁজে নীলগিরি থার

প্রত্যাশাকে ছাপিয়ে গেছে প্রাপ্তি। এর রেশ ধরে রেখেই নেমে যেতে চাই। ফিরতি পথ ধরলাম। স্থানীয় বাসে নেমে চলেছি গাড়ির পয়েন্টের দিকে। বাগানের পর বাগান পেরিয়ে আনাইমুড়িকে এখন অন্য দিক দিয়ে অন্যরকম দেখছি। জানালার কাচে পশলা বৃষ্টির ফোঁটা জমা হচ্ছে। আঁকড়ে ধরে আছে ছুটন্ত কাচটা। হয়তো বলছে, কী জীবনে কী বেড়ানোয়, যার প্রত্যাশার মাপেই ভুল তাকে প্রাপ্তির গরমিলের হিসেব নিয়েই যে ফিরতে হবে। প্রায় নিরক্ষীয় অঞ্চলে এমন উচ্চতা কতরকমভাবে ব্যতিক্রমী করে তুলেছে এরাভিকুলামকে, তার হিসেব কয়েক ঘণ্টায় কি পাওয়া যায়? প্রতি বারো বছরে নতুন করে সুনীল যৌবন ফিরে পায় এই অরণ্য। হাজারো ওষধি গাছের পাশে পাশে সেই বছর নীলাকুরুঞ্জি ফুলে ছেয়ে যায় তার বুক।

তার পর আবার এক যুগের অপেক্ষা।

Eravikulam National Park

লাখামের মতো বড় জলপ্রপাতের পাশে ছোট ছোট জলধারা পাম্বার নদী হয়ে পেরিয়ার ও কাবেরী নদীকে পুষ্ট করে। পশ্চিমঘাট পর্বতমালার মন্টেন-শোলা তৃণভূমির সবচেয়ে বড় একটানা অংশটি রয়েছে এই এরাভিকুলাম জাতীয় উদ্যানে। উচ্চতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে স্তরে স্তরে জল-জঙ্গল ঘিরে জলজ, স্থলজ উদ্ভিদ আর প্রাণী জড়ো হয়ে ক্ষুদ্র পরিসরে গড়ে তুলেছে এক বিরাট বাস্তুতন্ত্র। তাই দেখাতে গড়ে উঠেছে ছোট ছোট ট্রেক রুট— নীলাকুরুঞ্জি ট্রেল, কুটিককাড়ু লগ হাউজ। বাসের জানালা দিয়ে আবারও দেখলাম। আমাদের বিদায় জানিয়ে মেঘের ছায়ায় ঢেকে যাচ্ছে ঈশ্বরের আপন দেশে ঈশ্বরের এই আপন বাগান



ছবি সৌজন্য: লেখক

Shounak Gupta

পেশায় তিনি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আধিকারিক, কিন্তু নেশায় ভ্রামণিক। ট্রাভেল রাইটার্স ফোরাম-এর সদস্য। জড়িয়ে আছেন ফোরামের মুখপত্র 'ভ্রমি'-র সঙ্গেও। অবসরের শখ বই পড়া, লেখালেখি, ছবি তোলা।
লেখা প্রকাশিত হয়েছে দেশ, আনন্দবাজার পত্রিকা, চল যাই, ভ্রমণ আড্ডা, ভ্রমি, নীলকণ্ঠ, ভ্রমণ অনলাইন, যা ইচ্ছে তাই, কোলাজ (হায়দারাবাদ), আসমানিয়া সহ আরও অনেক পত্রপত্রিকার মুদ্রিত ও অনলাইন সংস্করণ।

2 Responses

  1. 1 comment
    Sort by
    Newest
    Add a comment…
    Post

    লেখার শেষভাগে ওই দার্শনিকতায় উত্তরণ – প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির সমীকরণ – অনেকটা দামী করে দিল লেখাকে। অনুভবের আর উপলব্ধির কাব্যিক প্রকাশে ছোট্ট ইতিহাস ভূগোল ছন্দে বাজলো। অদ্ভুত সুন্দর লেখা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *