বনবিবির বন। মানে সুন্দরবন। গরান, বাইন, শুলো, হেঁতাল আর সুন্দরী গাছের বাদা জঙ্গল বা ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। মাইল মাইল বিশাল এই দুর্গম অরণ্যের কিছুটা উত্তর ২৪ পরগনার ভাগে পড়লেও অধিকাংশটাই যেহেতু দক্ষিণ ২৪ পরগনার দখলে। সে কারণেই ‘দোখনো’ অর্থাৎ স্থানীয় মানুষের লবজে এর নাম সোঁদরবন। জগদ্বিখ্যাত রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের আবাসভূমি। লোককথার দুই দেবদেবী রাজা দক্ষিণ রায়ের বসত আর মা বনবিবির থান নামেও পরিচিত এ জঙ্গল। এর নামকরণ নিয়ে অসংখ্য প্রবাদ আর তথ্যের মধ্যে যেটা সবচেয়ে যুক্তিগ্রাহ্য, সেটা এই বিশাল বাদাবন জুড়ে বিপুলসংখ্যক সুন্দরী গাছের উপস্হিতি। ফলে সুন্দরী থেকেই সুন্দরবন, এই যুক্তিটাই মান্যতা পেয়েছে তথ্যনিষ্ঠ মহলের কাছে।
এ হেন সুন্দরবন বা সোঁদরবনের মাটিতে প্রথম পা রাখার অভিজ্ঞতা হয়েছিল আজ থেকে কম সে কম বছর বিশেক আগে। ৯০-এর শেষ অথবা ২০০০-এর প্রথমভাগে। তখন চাকরি করি। একটা নামী সামাজিক সমীক্ষা সংস্থায় ফিল্ড রিসার্চার হিসাবে। সে সময় একটা আন্তর্জাতিক অর্থদাতা সংস্থার তরফ থেকে বড়সড় একটা প্রজেক্টের বরাত পেল আমার অফিস। গর্ভবতী মহিলাদের স্বাস্থ্য এবং শারীরিক সমস্যা নিয়ে সুন্দরবন এলাকায় কাজ করে একটি এনজিও। ওই অঞ্চলের প্রত্যন্ত গ্রামগুলোয় আসন্নপ্রসবা মহিলাদের সু-প্রসবের ব্যবস্থা করা, প্রয়োজনে নিজেদের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে এসে কাজটা সুসম্পন্ন করা, এরকম আরও অনেক বিষয় তাদের কাজের আওতায় পড়ে। বেশ কিছু গ্রামে কয়েকটা উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রও রয়েছে তাদের। এছাড়াও প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মহিলাদের আনা-নেওয়ার জন্য দুটো মজবুত মোটর বোট আর বেশ কয়েকজন দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মী।

ওই আন্তর্জাতিক সংস্থাটির থেকে বেশ ভালোরকম অনুদান পায় ওই স্থানীয় এনজিও-টি। আমার কাজ আমাদের অফিসের তরফ থেকে কাজটার একটা ইয়ারলি ইভ্যালুয়েশন বা নিরীক্ষণ চালানো। আর সেই উদ্দেশ্যেই দুপুর দুপুর বোটে চড়ে রওয়ানা লাগিয়েছিলাম প্রত্যন্ত একটা গ্রামের উদ্দেশে। থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা রাতে ওখানকারই উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রে।
মিনিট পনেরোর মধ্যেই চওড়া হতে শুরু করল নোনা জলের নদী। দু’ধারে দলদলে কাদার পাড়ে উঁচিয়ে থাকা ট্যারাবাঁকা ছুরির মতো অসংখ্য শুলোগাছের শিকড়। যেখানে যাচ্ছি, অঞ্চলটার নাম কলস। কলস দ্বীপ নামেও ডাকে অনেকে। ক্রমশ চওড়া হচ্ছিল নদী। প্রতিমুহূর্তে দূরে, আরও দূরে সরে যাচ্ছিল কাদাজমির পাড়। পাড়ের শেষে ঘন ম্যানগ্রোভ জঙ্গল, দূর থেকে দেখতে লাগছিল সামান্য ঢেউ খেলানো দীর্ঘ সবুজ একটা রেখার মতো। বেশ কিছুক্ষণ বাদে মূল নদী থেকে বাঁক নিয়ে একটা শুঁড়ি খালে ঢুকে পড়ল বোটটা। ফের কাছে চলে এল শুলোকাদার পাড় জমি। পেছনে ঠাসবুনোট বাদা জঙ্গল তার দাপট জানান দিচ্ছিল চেহারায়। বোটের চালক মুক্তিপদ বারুই, বয়স বছর ৪০ (নামটা আজও মনে আছে), হাতে ধরা চার হাতলওয়ালা গোল স্টিয়ারিংটাকে ঘোরাতে ঘোরাতে মুচকি হাসলেন পাশে বসা আমার দিকে তাকিয়ে। “খোদ দক্ষিণ রায়ের রাজত্বে ঢুকে পড়লাম দাদা।”
মিনিট কুড়ি পরে দূরে চোখে পড়ল দু-তিন সারি কুঁড়েঘর। একটু অন্য ধরনের গাছপালা। সুপুরি, কলা, পাকুড়, আরও এটাসেটা। পাড়ের অনেকটা অংশই এখানে ইটে বাঁধানো। আর যেটা সবিশেষ লক্ষণীয়, পাড়ের ধার ঘেঁষে লম্বালম্বিভাবে টাঙানো নাইলনের জাল, চলে গেছে অনেকদূর অবধি। প্রশ্ন চোখে মুক্তিপদর দিকে তাকাতেই ফের মুচকি হাসলেন চালক।
– বাঘ আটকানোর জন্য।
– নাইলন কেন?
– যে জানোয়ারটা এক থাবায় গেরস্তর গোয়ালের মোষের ঘাড় ভেঙে, দাঁতে কামড়ে নিয়ে নদী পেরিয়ে যেতে পারে তার সামনে লোহার জাল নাও টিকতে পারে।
একটু গম্ভীর শোনাল চালকের গলা।
– যেটা লোহা ঠেকাতে পারবে না, নাইলন সেটা পারবে!
চরম বিস্ময় আমার গলায়। শোনামাত্র চিলতে পাতলা হাসিটা ফিরে এসছিল মুক্তিপদর ঠোঁটের কোনে।
– হ্যাঁ, ওই একটি কলেই বড় মিয়াঁ জব্দ। জইড়েমইড়ে ন্যাজেগোবরে হয়ে যায় এ্যাকেবারে।
– এত তো যাতায়াত করেন এসব লাইনে, আপনি কখনও দেখেছেন?
জবাবে শক্ত হয়ে উঠল মুক্তির চোখজোড়া।
– নাঃ! তবে জানেন তো আমাদের দোখনো দেশে একটা প্রবাদ আছে। কেউ বাঘ দেখলে তাকে আর দেখা যায় না। তাই দেখিনি বলে কোনও আফসোস নেই।

এসবের মধ্যেই একটা মৃদু গুঞ্জন ভেসে আসছিল গ্রামের মধ্যে থেকে। বোট যত এগোচ্ছিল, কোলাহলে পরিণত হচ্ছিল সেটা। আর ঘাটের কাছে পৌঁছতে পৌঁছতে সেই কোলাহল পাল্টে গেল বেজায় সোরগোলে। প্রচুর মানুষজন এদিক ওদিকে। জটলা ইতস্তত। বোট থেকে নেমে ঘাটে উঠতেই এগিয়ে এলেন গ্রামেরই দু’জন মহিলা স্বাস্থ্যকর্মী। জানা গেল ঘণ্টাখানেক আগেই নাকি পিছনদিকের খাল সাঁতরে তিনি ঢুকেছিলেন গ্রামে। ওদিকটায় এখনও জাল লাগানোর কাজ শুরু হয়নি। লোকজন বেজায় হল্লাহাটি শুরু করে দেওয়ায় খানিকটা বিরক্ত হয়েই বোধহয় স্থানীয় প্রাইমারি ইশকুলের মাঠে একটা চক্কর কেটে খাল সাঁতরে ফের ফিরে গেছেন জঙ্গলে। কথার মাঝখানেই আমাদের বোটের পিছনে ঘাটে এসে লাগল বন দফতরের বোট। আমাদেরটার চেয়ে আকারে একটু বড়। নেমেই ব্যস্ত পায়ে স্কুল মাঠের দিকে এগিয়ে গেলেন তাঁরা। পিছু পিছু আমরাও।
স্কুলের সামনে একফালি ছোট মাঠ। মাটিতে দু’দিন আগে হয়ে যাওয়া শীতকালে অসময়ের বৃষ্টির হালকা কাদায় গোবদা গোবদা পায়ের ছাপ। “পুরুষ বাঘ।” খুঁটিয়ে দেখে রায় দিলেন তরুণ বিট অফিসারটি। পটকা, আগুনের ব্যবস্থা, রাতে বাইরে না বেরনো, প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে ফিরে গেলেন তারা। আমরা এসে ঢুকলাম স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। ওখানকার ডাক্তারবাবু ভারী অমায়িক। সরকারি হাসপাতালের চাকরিতে কাটিয়েছেন গোটা চাকরি জীবন। অবসরের পর সময় আর কাটে না। তাই খানিকটা সেটা কাটাতেই এই এনজিও-র কাজ। জানালেন, গত কয়েকদিন ধরেই জঙ্গল থেকে তেনার হাঁক শোনা যাচ্ছে। আর আজ তো এই…।
আরও পড়ুন: দীপংকর চক্রবর্তীর কলমে: সুন্দরবনের বাঘের কথা
কাজকর্ম সেরে খেয়েদেয়ে শুতে শুতে রাত দশটা হল। হঠাৎই ঘুম ভেঙে গেল রাত দুটো নাগাদ। খালের ওপার থেকে ভেসে আসছে গর্জনটা। একটা বিশাল ফাঁকা জালার মধ্যে থেকে উঠে আসা গুমগুমে একটা আওয়াজের মতো। মিনিটখানেকের বিরতি দিয়ে দিয়ে একটানা মিনিট পনেরো চলল ব্যাপারটা। তারপর একসময় মিলিয়ে গেল ধীরে ধীরে। বনবিবির বাহনের সঙ্গে আমার মোলাকাত বলতে ওই গোবদা গোবদা পায়ের ছাপ আর সেই শীতরাতে শিরদাঁড়ায় কাঁপুনি ধরিয়ে দেয়া গর্জনের আওয়াজ।
কি, প্রিয় পাঠক? আমার সেদিনের সেই অভিজ্ঞতার সঙ্গে আজ কী যেন একটা মিলে যাচ্ছে না? মানে রোজ সক্কাল সক্কাল খবরের কাগজ খুললেই করোনাকে টপকে হেডলাইন। ‘গ্রামে ঢুকে পড়ল বাঘ।’ তারপর কয়েকদিন টানা খবর। ‘ত্রস্ত গ্রামবাসী’, ‘গোয়ালে বাঘ’, ‘অবশেষে বন দফতরের পাতা ফাঁদে দক্ষিণ রায়’, ‘প্রাথমিক চিকিৎসার পর ছেড়ে দেয়া হবে জঙ্গলে’…ইত্যাদি ইত্যাদি। অতঃপর প্রশ্ন, বাঘ কেন ঢোকে লোকালয়ে? বন্যপ্রাণ বিশেষজ্ঞ নই। তাই চূড়ান্ত মতামত দেয়ার জায়গায় নেই, তবে বিষয়টা নিয়ে আমার আগ্রহ চিরকেলে। ফলে সেই ছেলেবেলা থেকে এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের প্রচুর লেখালেখি পড়ে সামান্য যেটুকু জ্ঞান জন্মেছে, একে একে সেগুলোই বলার চেষ্টা করছি এখানে।
১) পর্যাপ্ত খাবার। জঙ্গলে সেটার অভাব বাঘের লোকালয়ে চলে আসার অন্যতম কারণ। আর সুন্দরবনের বাদা জঙ্গলে এই সমস্যাটা আরও প্রকট। বাঘের দুই প্রধান খাদ্য হরিণ বা বাঁদরের সংখ্যা মূলত পাহাড় আর বড় বড় গাছে ঘেরা সাধারণ সমতল বনভূমির তুলনায় এখানে অনেক কম। এছাড়াও নীলগাই, বুনো মোষ (ইন্ডিয়ান ওয়াটার বাফেলো), গওরের (কমন ইন্ডিয়ান বাইসন) মতো বড় শিকারের দেখাও মেলে না এখানে, যা বেশ কিছুদিন একটা বাঘের ক্ষুধা নিবৃত্ত করতে পারে।

এছাড়া মিষ্টি পানীয় জলেরও একান্ত অভাব এই জঙ্গলে। ফলে ক্ষিদে সামাল দিতে ভোঁদড়, কাঁকড়া এমনকি মাছও ধরে খেতে হয়। তৃষ্ণা মেটাতে পান করতে হয় কটু বিস্বাদ নোনা নদী আর খালের জল। ফলে সর্বদা পেটের মধ্যে দাউদাউ জ্বলতে থাকা ক্ষিদের আগুন বাদাবনের বাঘকে ঠেলে পাঠিয়ে দেয় লোকালয়ে, যেখানে গৃহস্থের গোয়ালে বাঁধা গরু-মোষ হয়ে পড়ে তার সহজ শিকার। অন্যদিকে প্রাণী বিজ্ঞানী বা বন্যপ্রাণ বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, চরম বিস্বাদ নোনা জল বাঘের মেজাজ করে তোলে রুক্ষ আর একইসঙ্গে শরীরে এর রাসায়নিক বিক্রিয়া তাকে করে তোলে মানুষখেকো। আর এ ক্ষেত্রে সেটি যদি বাঘিনী হয়, তার শাবকরাও শিকার করে আনা মানুষের মাংস খেয়ে হয়ে ওঠে বর্ন ম্যানইটার অর্থাৎ জন্মগত মানুষখেকো। যদিও এই শেষোক্ত মত এখনও সম্পূর্ণভাবে প্রমাণিত নয়, তবে এ নিয়ে গবেষণা চলছে নিরন্তর।

২) সহজে শিকার ধরার সুযোগ। শিকার বা খাদ্যের সহজলভ্যতার পাশাপাশি এটাও একটা বড় কারণ বাদাবনের বাঘকে লোকালয়ে টেনে আনার পক্ষে। রনথমভোর, কানহা, পেন্চ, পেরিয়ার, বান্ধবগড়ের মতো সমতল স্বাভাবিক অরণ্যে বাঘ অনেকদূর অবধি ধাওয়া করে গিয়ে তার শিকারকে ধরতে পারে। লক্ষ্য ফসকালে মাঝপথে গতিপথ বদলে অন্য শিকারকেও কবজা করে ফেলতে পারে কচিত কদাচিৎ। সুন্দরবনের মতো শুলো, কাদা আর হেঁতাল, গরান, বাইন, সুঁদরির জঙ্গলে বাঘকে তার শিকারকে ঘায়েল করতে হয় আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ে আঘাত হেনে। আর একবার সে সুযোগ ফসকালে কপালে সেদিনের মতো হরিমটর। প্রকৃতি এবং আকৃতিগতভাবে অনেক বেশি বেগবান এবং ক্ষুদ্রকায় হরিণ তীরগতিতে এঁকেবেঁকে গলে বেরিয়ে যাবে ঠাসবুনোট জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। সেখানে বড় চেহারা আর তুলনামূলকভাবে কম গতিশীল বাঘ হয়ে পড়বে রুদ্ধ।
সেদিক থেকে ধরতে গেলে গেরস্তের গোয়ালে বাঁধা গরু বা মাছ, কাঁকড়া ধরতে আসা মানুষ অনেক সহজ শিকার তার কাছে। শারীরিকভাবে দুর্বল এবং অনেক কম গতিসম্পন্ন শেষোক্ত এই প্রাণীটির অঢেল পরিমাণে দেখা মিলবে জঙ্গল লাগোয়া লোকালয় বা গ্রামগুলোতেও। ফলে ‘ডেস্টিনেশন ভিলেজ’ এখন সুন্দরবনের বাঘেদের কাছে এক সহজাত প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
৩) ‘জলে কুমির ডাঙায় বাঘ’– এই প্রবাদটা সর্বাংশে সত্যি সুন্দরবনের ক্ষেত্রে। সত্যি কথা বলতে কি, দেশের অন্যান্য সাধারণ সমতল জঙ্গলগুলোতে সেভাবে বাঘের কোনও শত্রু নেই। হাতি, বুনো মোষ, গওর বা শ্লথ ভল্লুকের মতো বড় প্রাণীরা সেখানে থাকলেও, নিজেরা বিপদে না পড়লে বাঘের সঙ্গে সংঘাতে যেতে চায় না। ফলে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বাঘকে আক্রমণ করার মতো প্রাণী সেখানে নেই বললেই চলে। কিন্তু সুন্দরবনে আছে। নোনাজলের কুমির। হিংস্রতায় তার দুই জ্ঞাতিভাই অস্ট্রেলিয়ার নোনাজলের কুমির আর নীল কুমির বা আফ্রিকান নাইল ক্রোকোডাইলের তুলনায় যারা কোনও অংশে কম নয়। আকারে মিঠে জলের কুমিরের তুলনায় অনেকটাই বড়। দৈর্ঘ্যে ১৮, ১৯ এমনকী ২০ ফুট পর্যন্ত পৌঁছতে পারে অনায়াসে। মাত্র দু-তিন ফুট গভীর জলের নীচেও ওই বিশাল দানবিক শরীর নিয়ে নিঃশব্দে সাঁতার কেটে এসে পৌঁছে যেতে পারে শিকারের একদম সামনে, তাকে কিছুমাত্র টের পেতে না দিয়ে।

অন্যদিকে সুন্দরবনের বাঘ জন্ম সাঁতারু। শিকারের সন্ধানে বা স্থান পরিবর্তনের প্রয়োজনে নোনা জলের নদী আর খালে মাইলের পর মাইল অনায়াসে সাঁতার কাটতে পারে এরা। সারা দুনিয়ায় অন্য কোনও অঞ্চলের বাঘের এই দক্ষতা বা ক্ষমতা নেই। আর এই সময় প্রায়শই কুমিরের হাতে আক্রান্ত হয় তারা। জলে যেহেতু স্বাভাবিকভাবেই কুমির অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ ফলে সেই লড়াইয়ে বাঘের আহত হওয়া, এমন কি প্রাণহানির সম্ভাবনাও থাকে। আর এক্ষেত্রেও জখম বাঘ তার স্বাভাবিক শিকার ধরার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে তার ‘ইজি টার্গেট’ হিসেবে বেছে নেয় গবাদি পশু অথবা মানুষকে, এবং বারবার চলে আসে লোকালয়ে।
এর পাশাপাশি আরও একটা কারণও রয়েছে। সেটা হল সজারু। নিশাচর এই প্রাণীটির সুস্বাদু মাংস বাঘের অত্যন্ত প্রিয়। একইসঙ্গে সজারু শিকার করতে গিয়ে তার কাঁটায় আহত হওয়াটাও আকছার ঘটে থাকে এ ক্ষেত্রে। কাঁটার ঘা বিষিয়ে আহত আর স্বাভাবিক শিকারক্ষমতা হারানো বাঘ মানুষখেকো হয়ে উঠেছে, এ উদহারণ ভূরি ভূরি। তবে এটা শুধু সুন্দরবনে নয়, বাঘের আবাস সব জঙ্গলেই দেখা যায়। জিম করবেটের একাধিক শিকারগাথার মূল চরিত্র এ ধরনের বাঘেরা।
শিকার বা খাদ্যের সহজলভ্যতার পাশাপাশি এটাও একটা বড় কারণ বাদাবনের বাঘকে লোকালয়ে টেনে আনার পক্ষে। রনথমভোর, কানহা, পেন্চ, পেরিয়ার, বান্ধবগড়ের মতো সমতল স্বাভাবিক অরণ্যে বাঘ অনেকদূর অবধি ধাওয়া করে গিয়ে তার শিকারকে ধরতে পারে। সুন্দরবনের মতো শুলো, কাদা আর হেঁতাল, গরান, বাইন, সুঁদরির জঙ্গলে বাঘকে তার শিকারকে ঘায়েল করতে হয় আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ে আঘাত হেনে। আর একবার সে সুযোগ ফসকালে কপালে সেদিনের মতো হরিমটর।
৪) পুরুষ বাঘের সংখ্যাধিক্য। এটা বাঘের লোকালয়ে চলে আসার ক্ষেত্রে অন্যতম এবং সবচেয়ে বিপদজনক কারণ। জঙ্গলে স্ত্রী বাঘের তুলনায় পুরুষ বাঘের সংখ্যা বেড়ে গেলে এটা ঘটে। সীমিত সংখ্যক বাঘিনীর দখল নিতে পুরুষ বাঘেদের মধ্যে বেধে যায় ধুন্ধুমার লড়াই, যে যুদ্ধের পরিণতি সবসময় মারাত্মক। দুই প্রতিদ্বন্ধীর মধ্যে অপেক্ষাকৃত দুর্বল এবং বয়স্ক বাঘটি হয় এ লড়াইয়ে হয় মারা পড়বে, নয়তো তাকে এলাকা ছেড়ে সরে পড়তে হবে। আর ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য বারবার হানা দিতে হবে লোকালয়ে। যেখানে তার সহজতম লক্ষ্যবস্তু মানুষ অথবা গবাদি পশু।
সাধারণ সমতল অরণ্যগুলিতে এ সমস্যার সমাধান করা হয় ওই একই ধরনের পরিবেশ যে সব জঙ্গলে রয়েছে সেখান থেকে স্ত্রী বাঘ এনে। কিন্তু এই কৌশল বা প্রক্রিয়া কার্যকর করাটা পুরোপুরি অসম্ভব সুন্দরবনের ক্ষেত্রে। সাধারণ সমতল জঙ্গলের বাঘ এই পরিবেশে কোনওমতেই টিকে থাকতে পারবে না। পৃথিবীর অন্যত্র, যথা শ্যাম, কম্বোজ, জাভা, সুমাত্রায় (ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া ইত্যাদি) এ ধরনের ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল থাকলেও নির্বিচার পরিবেশ ধ্বংস, অবাধ চোরাশিকারের কারণে সেখানকার ব্যাঘ্রকূল প্রায় বিলুপ্তির মুখে। এছাড়াও রয়েছে আন্তর্জাতিক আইনকানুন আর বিধিনিষেধের বেড়াজাল।
সে ক্ষেত্রে উপরোক্ত বাধা কাটিয়ে এ ধরনের প্রকল্প কার্যকর করা তো দূরের কথা, এ বিষয়ে ন্যূনতম ভাবনাচিন্তাটুকুও আপাততঃ বিশ বাঁও জলে। ফলে দক্ষিণ রায়ের লোকালয়ে আগমন ঘটতেই থাকবে আমাদের এই বাংলায়। আশু সমাধানের পথও অজানা এই মুহূর্তে।
*ছবি সৌজন্য়: Wikipedia, Sunderbannationalpark.in, bbc, viator
জন্ম ও বেড়ে ওঠা উত্তর কলকাতার পুরোনো পাড়ায়। বহু অকাজের কাজী কিন্তু কলম ধরতে পারেন এটা নিজেরই জানা ছিল না বহুদিন। ফলে লেখালেখি শুরু করার আগেই ছাপ্পান্নটি বসন্ত পেরিয়ে গেছে। ১৪২১ সালে জীবনে প্রথম লেখা উপন্যাস 'দ্রোহজ' প্রকাশিত হয় শারদীয় 'দেশ' পত্রিকায় এবং পাঠকমহলে বিপুল সাড়া ফেলে। পরবর্তীতে আরও দুটি উপন্যাস 'জলভৈরব' (১৪২২) এবং 'বৃশ্চিককাল' (১৪২৩) প্রকাশিত হয়েছে যথাক্রমে পুজোসংখ্যা আনন্দবাজার এবং পত্রিকায়। এছাড়া বেশ কিছু প্রবন্ধ এবং দু চারটি ছোটগল্প লিখেছেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকা আর লিটিল ম্যাগাজিনে। তার আংশিক একটি সংকলন বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে 'ব্যবসা যখন নারীপাচার' শিরোনামে। ২০১৭ সালে পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি পুরস্কার।
ভাল লাগল।
তথ্যসমৃদ্ধ । প’ড়ে ভাল লাগল ।
Very nice!