আগের পর্ব পড়তে: [১]
আমেরিকায় বঙ্গ সম্মেলনে সেই আশির দশক থেকে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনাসভা বা সেমিনার বেশ গুরুত্ব পেয়ে এসেছে। মার্কিন প্রবাসী ভারতীয় সমাজের পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক জীবনকে কেন্দ্র করে নানা বিষয়ের ওপর যেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়, সেরকমই প্রাধান্য পেয়ে এসেছে পশ্চিমবাংলা আর বাংলাদেশের সাহিত্য, সংস্কৃতিবিষয়ক আলোচনার আসর। এখানকার অভিবাসী সাহিত্যেরও চর্চা হয়। তবে আকর্ষণের মূল কেন্দ্রে থাকেন আমন্ত্রিত প্রখ্যাত কয়েকজন কবি-সাহিত্যিক। দীর্ঘদিন সেইসব সাহিত্যসভায় সঞ্চালনার দায়িত্ব পালন করেছি আমি। আজ আমার সেই সংক্রান্ত কিছু অভিজ্ঞতার কথা লিখব।
রবীন্দ্রনাথের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে নিউ ইয়র্কে দু’দিন ধরে উৎসব হয়েছিল। ডক্টর ভবতোষ দত্ত এসেছিলেন। চমৎকার বক্তৃতা দিয়েছিলেন। আর দ্বিতীয় দিনে সাতসকালে ছিল আমাদের দু’চারজনের নোটখাতা উগরে দেওয়া ‘বাণী’র ব্যবস্থা। অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাপক ডঃ খন্দকার আলমগীর প্রত্যেককে সময় দিয়েছিলেন কুড়ি মিনিট। সে তো মেলা সময়। এখন আর আমরা অত সময় দিই না। দশ মিনিট হয়ে গেলেই স্টেজে গিয়ে চিরকুট ধরাই। আসলে বক্তার সংখ্যা অসম্ভব বেড়ে যাচ্ছে তো! আগে আগে ‘বাণীকুমার’দের একটু আকাল ছিল বলে অনায়াসে কুড়ি-পঁচিশ মিনিট ধরে বকবক করা যেত। তা যা বলছিলাম। ডঃ আলমগীরকে ‘জো হুকুম’ বলে বেশ দিস্তেখানেক কাগজ নিয়ে লিখতে বসে গেলাম। বিষয়— রবীন্দ্র সাহিত্যে অস্পৃশ্যতার প্রতিবাদ ও মানবতাবাদ। কোটেশনে কোটেশনে ছয়লাপ। তারপর সেমিনারের দিন পাতা উল্টে উল্টে পড়ে গেলাম। গোরা, চণ্ডালিকা, অচলায়তন আর প্রবন্ধ থেকে কোটেশন-টোটেশন দেওয়ার সময় শ্রোতাদের দিকে তাকানোর চেষ্টা করছিলাম। যেন ওসব আমার কণ্ঠস্থ! সময়ের মধ্যেই শেষ করেছিলাম। বাংলা জানা আধডজন সাহেব, মেমসাহেব নিয়ে সর্বসাকুল্যে জনা পঞ্চাশেক শ্রোতা পেয়েছিলাম। তাঁরা যেমন বলেন, সেরকমই বলেছিলেন— আহা! বেশ, বেশ, বেশ। কিন্তু গানে ভুবন ভরিয়ে দিইনি বলে স্বভাবকবি ও বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক ডক্টর যদুগোপাল একটু সমালোচনা করেছিলেন। গান নাকি শুকনো বিষয়ে প্রাণসঞ্চার করে। ধাবমান জনতাকে চেয়ারে এনে বসায়। বাণী নিবেদন শেষে যখন ক্যাফেটেরিয়াতে চা খেতে গেছি, যদুগোপালের সঙ্গে দেখা। বললেন— সব কিসুরে ইন্টারেস্টিং করা যায়। আপনের উসিত সিলো ‘গোরা’র প্যাসাল বাদ দিয়া দুইখান করুণ গান গাওয়া। ওই সুঁয়ো না সুঁয়ো না সিঃ। নয়তো ঘৃণা করিয়াসো তুমি মানসের প্রাণের ঠাকুরে… যদি গাইয়া দিতেন, দ্যাখতেন ইমপ্যাক্ট কারে কয়।
ডঃ যদুগোপালের পরামর্শ আমি না শুনলেও একেবারে উড়িয়ে দিতে পারিনি। ডেমনস্ট্রেশন সহযোগে সেমিনার ক্যানাডার বঙ্গ সম্মেলনে গিয়ে শুনেছিলাম। শুকনো বিষয়কে হারমোনিয়ামের সাহায্যে ঝংকৃত করে চিত্তাকর্ষক করতে চাওয়া হয়েছিল। তবে হ্যাঁ, সেমিনারে বক্তৃতা শেষ করার পরে জনতার দাবিতে বস্টনের বঙ্গসম্মেলনে বুদ্ধদেব গুহ টপ্পা শুনিয়েছিলেন। খুব ভিড় হয়েছিল। গান যা গেয়েছিলেন, মোটেই চানঘরে গানের মতো নয়। রীতিমতো হলঘরে গাওয়ার মতো বিশুদ্ধ টপ্পা। শিকাগো বঙ্গ সম্মেলনে সাহিত্য সেমিনার শুরুই হয়েছিল রবীন্দ্রসঙ্গীত দিয়ে। আলোচনার বিষয় ছিল পশ্চিমবঙ্গের সেই সময়ের শিক্ষাব্যবস্থা। সেখান থেকেই বুদ্ধিজীবীরা প্যানেলিস্ট হিসেবে এসেছিলেন। বিষয়টা যে উচ্ছ্বসিত হওয়ার মতো নয়, সে-কথা সম্মক অনুধাবন করেই বোধহয় স্থানীয় শিল্পী গান ধরলেন— “আর রেখো না আঁধারে আমায় দেখতে দাও”। দ্বিতীয় গান— “দুঃখের তিমিরে যদি জ্বলে মঙ্গল আলোক”। আমার ধারণা প্রথম গানটা দেশের লোডশেডিংয়ের সময় ছাত্রছাত্রীদের অবস্থার কথা ভেবেই বোধহয় গেয়েছিলেন। এমন প্রাণ-ঢেলে গাইলেন যে প্যানেলিস্ট, মডারেটর সবাই অভিভূত। এই যে একটা বিমর্ষভাব ছড়িয়ে গেল, পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাব্যবস্থার আবহসঙ্গী হিসেবে, তা অনেকক্ষণ চালু থাকল। নবনীতা দেবসেন ভারাক্রান্ত হয়ে বলেছিলেন— “আমাদের ছেলেমেয়েরা, শিক্ষাব্যবস্থা সবই যেন সিসিফাসের মতো পাথর বহন করে চলেছে।” আজ নবনীতাদি বেঁচে থাকলে কি বলতেন?
সেমিনারে নাচ দেখেছেন? আমি দেখেছি। এক বঙ্গ সম্মেলনে ‘অভিবাসী বাঙ্গালী ছেলেমেয়েদের বিবাহ’ ছিল আলোচনার বিষয়। সময়মতো পৌঁছে দেখি সেমিনারের হলে টেবিল, চেয়ারের কোনও ব্যবস্থাই নেই। চারজন বসব বলে শুনেছি। বাকি তিনজন এসে গেছেন। কিন্তু স্টেজে কোনও গীতি আলেখ্য-টালেখ্য হবে বলে মনে হচ্ছে। সেমিনারের আয়োজক বললেন— এই টপিকটা ভীষণ সেনসেশন ক্রিয়েট করেছে। টিনএজাররা, পেরেন্টস, ডেটিং কাপল— সবাই জয়েন করতে চাইছে। তাই ভাবলাম বিয়েই যখন টপিক, তখন আরম্ভটা একটু ইন্টারেস্টিং করা যাক। দু’তিনটে নাচ থাকছে প্রথমে। বাঙালি বিয়ের কনসেপ্ট দিতে চাইছি, বুঝলেন? সে আর বুঝিনি? একদল মেয়ে হাত-পা ঘুরিয়ে, কোমর দুলিয়ে ‘সোহাগ চাঁদবদনী’ নাচতে লাগল। সেকেন্ড জেনারেশনকে বিয়ের কনসেপ্ট দেওয়া হল। বালারা সব ‘হেলিয়া দুলিয়া পড়ে নাগকেশরের ফুল’ বলে মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে নাচ শেষ করার পরে উইংসের পাশে আরও একটা ছোট্ট বউ মুখ বাড়াচ্ছিল। তখনই জানি আরও বউনাচ বাকি আছে। কিন্তু আচমকা ক্যাসেটের বিশ্বাসঘাতকতায় ‘কোনও এক গাঁয়ের বঁধূ’ ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত আমাদের আলোচনাচক্রে বসিয়ে দিয়ে কনভেনর টোপর, মুকুট মাথায় দেওয়া ছেলেমেয়েগুলোকে মেইন অডিটোরিয়ামে পাঠিয়ে দিলেন।
আগে আগে ‘বাণীকুমার’দের একটু আকাল ছিল বলে অনায়াসে কুড়ি-পঁচিশ মিনিট ধরে বকবক করা যেত। তা যা বলছিলাম। ডঃ আলমগীরকে ‘জো হুকুম’ বলে বেশ দিস্তেখানেক কাগজ নিয়ে লিখতে বসে গেলাম। বিষয়— রবীন্দ্র সাহিত্যে অস্পৃশ্যতার প্রতিবাদ ও মানবতাবাদ। কোটেশনে কোটেশনে ছয়লাপ। তারপর সেমিনারের দিন পাতা উল্টে উল্টে পড়ে গেলাম। গোরা, চণ্ডালিকা, অচলায়তন আর প্রবন্ধ থেকে কোটেশন-টোটেশন দেওয়ার সময় শ্রোতাদের দিকে তাকানোর চেষ্টা করছিলাম। যেন ওসব আমার কণ্ঠস্থ! সময়ের মধ্যেই শেষ করেছিলাম। বাংলা জানা আধডজন সাহেব, মেমসাহেব নিয়ে সর্বসাকুল্যে জনা পঞ্চাশেক শ্রোতা পেয়েছিলাম। তাঁরা যেমন বলেন, সেরকমই বলেছিলেন— আহা! বেশ, বেশ, বেশ।
এমন বহু বিষয়ে বিচিত্র অভিজ্ঞতা আছে। ক্রমশ পরবর্তী লেখায় লিখব। এবার আমন্ত্রিত সাহিত্যিকদের কথায় আসি। হ্যাঁ, সেমিনারে বিতর্কের ঝড় উঠেছিল বটে সাহিত্যিক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের সময়। ১৯৮৯ সালে নিউইয়র্কের লং আয়ল্যান্ডে মিলনী ক্লাবের উদ্যোগে বঙ্গ সম্মেলন হয়েছিল। সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় আর ডঃ শঙ্করীপ্রসাদ বসুকে আমন্ত্রণ করে আনা হয়েছিল। সেমিনারে ‘দুই বাংলার উপন্যাসের ধারা’ বলে একটি বিষয় নির্বাচন করেছিলাম। পশ্চিমবাংলার উপন্যাস প্রসঙ্গে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় বলবেন। ওদিকে বাংলাদেশের উপন্যাস আলোচনার জন্যে নিউজার্সির কবি ওমর শামস, নিউ ইয়র্কের সাংবাদিক কৌশিক আহমেদ ছিলেন। শঙ্করীপ্রসাদ বসু মডারেটর। উনি আমাদের অধ্যাপক ছিলেন। মনে হয়েছিল শক্ত হাতেই হাল ধরবেন। দর্শকরা খুব আগ্রহ নিয়ে এসেছেন। নভেলিস্ট সঞ্জীববাবুকে আমরা প্যানেলিস্ট করেছি। সে আলোচনা তো আকর্ষণীয় হবেই। তো, প্রথম দিকে সঞ্জীববাবু বাংলা উপন্যাসের জন্ম, ইতিহাস, ধারাবাহিক বৈশিষ্ট্য, যুগধর্মের প্রভাব, বিদেশি সাহিত্যের প্রভাব, পৌরাণিক রচনার প্রভাব, উপন্যাসে সমসাময়িক সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রভাব, আঞ্চলিকতা, প্রেক্ষাপট ইত্যাদি নানা বিষয়ে আলোকপাত করতে করতে চলেছিলেন। একেবারে শেষ পর্বে এসে মুক্তকণ্ঠে ঘোষণা করলেন— শ্রীম রচিত ‘কথামৃত’ হল পশ্চিমবঙ্গের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। ব্যস! আগুনে ঘি পড়ার অবস্থা। এক তো আমেরিকার বঙ্গসম্মেলনে ধর্ম বা রাজনীতির আলোচনা নাস্তি। তার ওপর সেদিন হলভর্তি দুই বাংলার শ্রোতা। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান বাদ দিলেও বাঙালি নিরীশ্বরবাদীর দল গিজগিজ করছেন। ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালিরা সঞ্জীবকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করছেন। সাহিত্যিকের সমর্থকরা চিৎকার করে বলছেন— ধর্মই যদি বাধা হয়, তবে রামায়ণকে ‘এপিক্’ বলে আপনারা অ্যাকসেপ্ট করেছেন কেন?

তখনকার মতো কোলাহল থামিয়ে দিয়ে বাংলাদেশের উপন্যাসের আলোচনা শুরু করা হল। সে পর্ব চুকলে প্রশ্নবাণের আসর। বাঙালি সমঃস্বরে চ্যালেঞ্জ দিল— ‘কথামৃত’ উপন্যাস হল কবে থেকে? উপন্যাসের আলোচনায় ধর্মেই বইয়ের কথা আনছেন কেন? সঞ্জীববাবু বিনীতভাবে বললেন— “আমার যা বিশ্বাস কিংবা বিচারবুদ্ধি, সেই অনুযায়ী বলেছি। আপনারা না মানতেই পারেন।” হলের মধ্যে গুঞ্জন বেড়েই যাচ্ছিল। আবার হট্টগোল শুরু হতে শঙ্করীপ্রসাদ বসু বললেন— “ওভাবে বললে তো হবে না সঞ্জীব। তোমাকে যুক্তি, ব্যাখ্যা আর উদাহরণ দিয়ে বোঝাতে হবে।” তারপর দর্শকদের উৎসাহ দিলেন— “আপনারা করছেন কি? এত সহজে মেনে নিলেন? সঞ্জীবকে ভাল করে চেপে ধরুন।” আবার হৈ হৈ শুরু হল। ব্যাখ্যা চাই, প্রমাণ চাই, উদাহরণ চাই। সঞ্জীববাবুকে খোলসা করে বলতে হবে কথামৃতর মধ্যে উপন্যাসের কোন্ ডেফিনিশন খুঁজে পেয়েছেন। ক্রমশ সেমিনার হলে দলে দলে লোক ঢুকে পড়ছে। সঞ্জীববাবু নড়েচড়ে বসলেন। ওমর শামস্ আর কৌশিক আহমেদ বললেন, “আমাদেরও কিন্তু সময় দিতে হবে।” আমি ঘড়ি দেখে প্রমাদ গুনছি। সঞ্জীববাবু শঙ্করীপ্রসাদ বসুর দিকে শীতল চাউনি দিয়ে বললেন— “আমি আপনার কি করেছি শঙ্করীদা? যেখানে যাচ্ছেন, পেছন পেছন যাচ্ছি। আর এখন সবাইকে বলছেন সঞ্জীবকে আক্রমণ করুন! আক্রমণ করুন! কেন? আমি কি বেড়াল না কুকুর? নাকি এঁরাই তাই?” শঙ্করীপ্রসাদ হাসলেন— “আহা, রেগে যেও না। এত বড় একটা স্টেটমেন্ট দিলে। নিশ্চয়ই তার পেছনে যুক্তি আছে। সে কথা খুলে বলতে হবে তো?”
তখনই বুঝেছি শঙ্করীবাবু কি চাইছেন। তিনি বিলক্ষণ জানতেন সঞ্জীববাবুকে একবার মুখ খোলাতে পারলে কী ঘটবে। তথ্য, তত্ত্ব, বিশ্বাস, উপলব্ধি আর দৃষ্টিভঙ্গি যদি ‘বিষয়’ হয়, যদি দর্শকের মুখোমুখি বসে বহু প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার দায়বদ্ধতা থাকে, তবে একজন কথাশিল্পী কী করেন? মসীর বদলে যুক্তি, তর্ক আর ব্যাখ্যার অসি ধরেন তো? সঞ্জীববাবু সেই অর্থে সেদিন সশস্ত্র অভিযানেই নেমেছিলেন। প্রতিপক্ষ ছিন্নবিচ্ছিন্ন, ধরাশায়ী। উপন্যাসের সংজ্ঞা মিলিয়ে মিলিয়ে ধেয়ে যাচ্ছেন। তরোয়াল উঁচিয়ে ফিরে আসছেন। শ্রীরামকৃষ্ণকে শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের ‘নায়ক’ বলে চিহ্নিত করেই বোধহয় শেষমেশ শান্ত হলেন। শঙ্করীবাবু প্রসন্নচিত্তে বললেন— “মনে হচ্ছে আপনারা পাল্টা আক্রমণের জন্যে তৈরি নন। আর তো সময়ও নেই!”

সাহিত্য সেমিনার প্রসঙ্গে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে কত অনবদ্য অভিজ্ঞতা যে হয়েছে। আজ লেখার শেষ পর্বে এসে সেই বিস্তারিত বিবরণে যাওয়া যাবে না। তবে ২০১০ সালে নিউ জার্সির আটলান্টিক সিটিতে ‘কল্লোল’ ক্লাবের উদ্যোগে যে বঙ্গ সম্মেলন হয়েছিল, তার একটি সাহিত্য আসরের কথা দীর্ঘদিন মনে থাকবে। সে বছর আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার। পত্রভারতীর ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায় এসে বললেন— “ওঃ এ যে দেখছি বাংলা সাহিত্যের ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর উপস্থিত।” তখন কথা উঠল এঁরা কে কোনজন। আমরাই বিচার করলাম— অবশ্যই শীর্ষেন্দুদা মহেশ্বর। নামেই তাঁর পরিচয়। আর, সুনীলদাকে রমণীমোহন শ্রীকৃষ্ণ ছাড়া আর কী বলা যায়? অতএব উনি বসলেন বিষ্ণুর আসনে। আর, সমরেশ মজুমদার? বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ডিপার্টমেন্টে আমার চেয়ে মাত্র এক বছরের সিনিয়র সমরেশকেই কিনা শেষ চয়েস হতে হল পিতামহ ব্রহ্মারূপে। বন্ধু হিসেবে সহাস্যবদনে আমাদের কাজির বিচার মেনেও নিলেন সমরেশ। সেদিন ছিল ওঁদের গল্প পাঠ করার আসর। শ্রোতাদের অনুরোধ, ওঁদের তিনজনের নির্বাচিত গল্প ইত্যাদি মিলিয়ে-মিশিয়ে আসর ক্রমশই উপভোগ্য হয়ে উঠছে। ঘড়ি-টড়ি আর দেখছি না। অথচ সময় বহিয়া যায়। হল ছেড়ে দিতে হবে। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় আশ্বাস দিলেন— আমার কিন্তু গ্যারান্টিড ছোট গল্প। তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাবে।
উনি পড়তে শুরু করলেন ছোট গল্প ‘দেখা হবে’। আটলান্টিক মহাসাগরের ধারে কনভেনশন সেন্টারের সেই হলঘরে এক অপরাহ্নবেলায় নিঃস্তব্ধ শ্রোতাদের কানে শুধু ভেসে আসছে ওঁর মন্দ্র কণ্ঠস্বর— “নকশিকাঁথার মতো বিচিত্র সুন্দর শৈশবের পৃথিবী কোথায় হারিয়ে গেছে। … পৃথিবী বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে ক্রমে। বুড়ো গাছের মধ্যে শুকিয়ে যাচ্ছে আমার ডালপালা। খসে যাচ্ছে পাতা। মহাকালের অন্তঃস্থলে তৈরি হচ্ছে একটি ঢেউ। একদিন যে এই পৃথিবীর তীরভূমি থেকে আমাকে নিয়ে যাবে। বুকের মধ্যে শৈশবের একটি কথা তীরের মতো বিঁধে থরথর করে কাঁপছে আজও। সেই অমোঘ ঢেউটিকে যখনই প্রত্যক্ষ করি, মনে মনে তখনই এ কথাটি বুকের মধ্যে কেঁপে ওঠে। শৈশবের সব ঘ্রাণ, শব্দ ও স্পর্শ ফিরিয়ে আনে। মায়ের গায়ের ঘ্রাণ পেয়ে যেমন ছেলেবেলায় পাশ ফিরতাম, তেমনই আবার পৃথিবীর দিকে পাশ ফিরে শুই। মনে হয়, দেখা হবে। আবার আমাদের দেখা হবে।”
পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ২১ ডিসেম্বর ২০২২
ছবি সৌজন্য: লেখক
দীর্ঘকাল আমেরিকা-প্রবাসী আলোলিকা মুখোপাধ্যায়ের লেখালিখির সূচনা কলকাতার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্বে। আমেরিকার নিউ জার্সির প্রথম বাংলা পত্রিকা "কল্লোল" সম্পাদনা করেছেন দশ বছর। গত আঠাশ বছর (১৯৯১ - ২০১৮) ধরে সাপ্তাহিক বর্তমান-এ "প্রবাসের চিঠি" কলাম লিখেছেন। প্রকাশিত গল্পসংকলনগুলির নাম 'পরবাস' এই জীবনের সত্য' ও 'মেঘবালিকার জন্য'। অন্য়ান্য় প্রকাশিত বই 'আরোহন', 'পরবাস', 'দেশান্তরের স্বজন'। বাংলা সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারের জন্য নিউইয়র্কের বঙ্গ সংস্কৃতি সঙ্ঘ থেকে ডিস্টিংগুইশড সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন।