সাফল্যের শর্টকাট না হোক, ভাষার হয়। এবং তা শুধু হোয়াটস্অ্যাপ বা মেসেঞ্জারেই সীমাবদ্ধ হয়ে নেই। রীতিমতো বুক বাজিয়ে স্কুল-কলেজের লেকচার থেকে শুরু করে অফিশিয়াল ইমেল পর্যন্ত তার অবাধ আনাগোনা। অন্য দেশের কথা জানি না , তবে অন্তত অস্ট্রেলিয়াতে এমনটাই হয়। আমি এই আজব ইংরিজির নাম দিয়েছি ‘পিকোলো ইংরিজি!’ দিব্যি লাগে শুনতে। ইটালিয়ান ‘পিকোলো’ (Piccolo) শব্দের অর্থ ছোট। পিকোলো কফি অর্থাৎ খুদে কাপ ভরা দুধ কফি এদেশে সবাই বড় ভালবাসে, তাই এদেশীয় আজব ইংরিজির নামও দিয়েছি তেমনি।ডাউন আন্ডারে পাকাপাকি পাড়ি জমাচ্ছি জানা মাত্রই বাবা বলেছিলেন,“ওখানকার ইংরিজিটা কিন্তু একদম আলাদা। একটু পড়াশোনা করে যাস, নইলে বিপদে পড়বি।” কিন্তু সুপরামর্শ শোনা আমার ধাতে নেই। তাই বাবার কথাও কাজে লাগাইনি। ফলে যা হওয়ার তাই হল। প্রথমদিন একা একা ঘুরতে গিয়েই কুপোকাত হলুম। কফিশপে একজন জিজ্ঞাসা করল,“ডিডিয়া হ্যায়োর ব্রেকীই?” ড্যাবড্যাব করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলুম। মনে মনে ভাবছি, হ্যাঁ বাছা সাহেবের পো, কী বললে বুঝলুম না। মাথার ভেতর ভোকাবুলারি হাজারবার হাতড়েও মনে পড়ল না “ডিডিয়া” মানে কী? “হ্যায়োর” শব্দটা আগে শুনেছি বলে মনে হয় না। “ব্রেকী”-টাই বা কী বস্তু ! কয়েক সেকেন্ড পর নিতান্ত বেকুবের মতো বললুম,“ স্যরি, আই ডিড নট গেট ইউ।“সাহেব খোকা গাঁক গাঁক করে আবার একই প্রশ্ন করল,“ডিডিয়া হ্যায়োর ব্রেকীই ?”পরিষ্কার বুঝতে পারছি প্রশ্নসূচক সেনটেন্স, কিন্তু মাথার ভেতর ডালকাঁটা দিয়ে ঘেটেও ওই শব্দ তিনটের কিনারা কত্তে পারলুম না। কী লজ্জা! কী লজ্জা! সায়েব ব্যাটার সামনে অপমানের একশেষ! বাধ্য হয়ে দু’বার ঢোঁক গিলে সাধাসিধে ইংরিজিতে বললুম, “বুঝতে পারছি না ভাই। এক কাপ কফি আর একটা ড্যানিশ পেস্ট্রি অর্ডার করব, আমার ব্রেকফাস্ট।“ছোকরা অর্ডার নিয়ে হাসতে হাসতে চলে গেল, আর আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলুম। পরে এখানকার বন্ধুবান্ধবদের মুখে শুনলুম যে, ও অবস্থা শুধু আমার নয়, অন্য দেশ থেকে আসার পর সব মানুষেরই হয়।
***
ব্যাপারটা একটু খুলেই বলি।পৃথিবীতে কমবেশি পঞ্চাশখানা দেশে লোকজন ইংরিজিতে কথা বলে। না, চিন-জাপান-ফ্রান্স-রাশিয়ার কথা বলছি না। ওসব দেশের লোকজন বড় ঠ্যাঁটা! প্রাণ যাবে তাও তাঁরা ইংরিজিতে কথা কবেন না। ভারতের দক্ষিণপ্রান্তের লোকজন যেমন হিন্দিকে হেলাফেলা করেন, ওসব দেশগুলোতে ইংরিজির অবস্থাও ঠিক তেমনি। তা ছাড়া সেইসব দেশগুলোতে মোটামুটি ভাবে প্রচলিত একটিই ভাষা। ভারতবর্ষের মতো একই বৃন্তে শ’খানেক কুসুম তো তারা নয়। তাই কোথাও কোথাও স্থান বিশেষে অ্যাকসেন্ট আলাদা হয় ঠিকই, কিন্তু বর্ণমালা এক। কাজেই পুরো দেশের সরকারি কাজকর্ম ও পড়াশোনার জন্য একটিই ভাষা যথেষ্ট। অতএব ইংরিজি শিক্ষার প্রয়োজনও নেই।এবার আসি ইংরিজির ব্যাপারে। ভাষাতত্ত্বের যৎসামান্য ধারণা রাখা প্রত্যেক ব্যক্তি জানেন, ইংরিজির এহেন জনপ্রিয়তার পেছনের আসল কারণটি হল দু-আড়াইশো বছর আগেকার ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ। ইংরেজ চলে গেছে কিন্তু সেসব দেশে ইংরিজির জনপ্রিয়তা আজও কমেনি। অক্সফোর্ড ইংরিজির সাবেকি ধারা থেকেই জন্ম হল আমেরিকান ইংলিশের, যা অচিরেই নিজের জন্মদাতার ছত্রছায়ার বাইরে বেরিয়ে এসে সাবালকত্ব অর্জন করে বসল। কারণটা খুব সোজা, ইউ.কে ইংরিজির তুলনায় আমেরিকান ইংরিজি অনেকগুণে সহজ এবং ভাষাতত্ত্বের নিয়মনীতিও সেখানে অনেকাংশে শিথিল। এরপরে এল অস্ট্রেলিয়ান ইংরিজি। এই ধারাটি যেন বনেদি বড়লোক বাড়ির অলস সন্তান। বাপ-ঠাকুরদায় অনেক রেখে গেছেন, অতএব তিনি যা নয় তাই করে দিন কাটাচ্ছেন। সাক্ষাৎ পিপুফিশু। সব কিছুতেই গড়িমসি। শর্টকাটে কাজ সেরে পালাতে পারলেই বাঁচেন। ভাষার বেলায় এদেশীয় লোকজনের আলসেমি লজ্জাজনক। এদেশে বার্বি মানে ছোটদের খেলার পুতুল বার্বি ডল নয়, বার্বি অর্থাৎ বারবার (পরামানিক)। লিপি মানে লিপস্টিক, সিগি মানে সিগারেট! নিতান্ত বাড়াবাড়ি রকমের প্রয়োজন না হলে অজ়ি-রা দুইয়ের বেশি সিলেবল কখনও একসঙ্গে উচ্চারণ করবে না। সামান্য বড় শব্দ হলেই তার হাত-পা ভেঙে, দুমড়ে মুচড়ে তাকে বামন করে দেওয়া হয়। উদাহরণ দিচ্ছি, মিলিয়ে নিন,আফটারনুন – আর্ভোব্রেকফাস্ট –ব্রেকী কাপ অফ টি / কফি – কাপ্পামসকিউটো – মজিস্চকোলেট– চকিপোস্টঅফিস বা পোস্টম্যান – পোস্টিডেফিনিটলি – ডেফো পৃথিবী জুড়ে যে এই যে এমন সেল্ফি তোলার হিড়িক পড়েছে, সেই সেল্ফি শব্দটিও কিন্তু এই দেশেরই উপহার। “সেল্ফ পোর্ট্রেট”-এর অপভ্রংশ, সেল্ফি! ২০১৩ সালে সেল্ফি শব্দটি অক্সফোর্ড ডিক্শনারিতে পাকাপাকিভাবে নিজের জায়গা করে নেয় এবং ওই একই বছর নভেম্বর মাসে শব্দটিকে “ওয়ার্ড অফ দ্য ইয়ার” – এর সম্মানে ভূষিত করা হয়। সবচাইতে বড় কথা হল “অস্ট্রেলিয়া” শব্দটিকেও রেহাই দেওয়া হয়নি। আগামুড়ো ছেঁটে তিনি হয়েছেন “স্ট্রায়া।”বুঝুন, ঝামেলা কী কম! ডার্লিং হারবার থেকে সিডনি সৈকত এবং বিখ্যাত অপেরা হাউস। ছবি লেখকের তোলাতারপর “A”বর্ণটির উচ্চারণ নিয়েও নবাগত যে কোনও মানুষ ধন্দে পড়তে বাধ্য। এদেশে “A”-এর উচ্চারণ হয় “I” – এর মতো। অর্থাৎ “A”-কে “এ” না বলে এরা বলে “আই”; এবং সেই নিয়মমতো “গেট” হয় “গাইট”, “ মেট” হয় “মাইট”, “ডেট” থেকে “ডাইট” এমনিধারা চলতে থাকে। এছাড়া এদেশি ইংরিজির বাক্যবিন্যাসও যথেষ্ট আলাদা ধরনের। যেমন মনে করুন বিল এবং টম প্রতিবেশী। বিলের সঙ্গে টমের দেখা হয়েছে। বিল হাই-হ্যালো করার পর বলল যে টম তার বাড়িতে এক কাপ চা খেয়ে যাক। সে কথা শুনে টম বলল, ঠিক আছে। পনেro মিনিটের মধ্যে আসছি। এই ব্যাপারটাকে সাধারণ ভাবে ইংরিজিতে আপনি আমি লিখব এভাবে,Bill: Hello Tom, how are you?Tom: Hello Bill. I’m fine. How are you?Bill: Very good, thanks. I was just calling to see if you would like to come over for a cup of tea?Tom: That sounds wonderful. I’ll be there in 15 minutes.কিন্তু অস্ট্রেলিয়ান ইংরিজিতে ব্যাপারটা দাঁড়াবে অন্যরকম,Bill: G’day mate!Tom: G’day.Bill: Would ya like to pop around for a cuppa?Tom: Sure, mate. See ya in 15.বলাই বাহুল্য, ভাবতে বসলাম যে কেন এরা এমন কাণ্ড করে?আমেরিকান ইংরিজি পৃথক তার কারণ আমেরিকা দেশটি এবং তার সংস্কৃতি দুটোই এককথায় বলতে গেলে জগাখিচুড়ি। ইংরিজিতে যারে কয় “মেল্টিং পট।“ কাজেই আমেরিকানদের পাল্লায় পড়ে চাঁচাছোলা নাক উঁচু ব্রিটিশ ইংরিজি কাছাখোলা ইয়াংকি রূপ ধারণ করলে তাতে অবাক হওয়ার কিস্যু নেই। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ায় এমন কাণ্ড ঘটল কেন? তাদের দেশ তো মেল্টিং পট নয়। সেদিক থেকে দেখতে গেলে অজ়ি-রা তা ব্রিটিশদেরই তুতো ভাই। তবে ভাষাতত্ত্বে এদের এমন পদস্খলন কেন?
তারপর “A”বর্ণটির উচ্চারণ নিয়েও নবাগত যে কোনও মানুষ ধন্দে পড়তে বাধ্য। এদেশে “A”-এর উচ্চারণ হয় “I” – এর মতো। অর্থাৎ “A”-কে “এ” না বলে এরা বলে “আই”; এবং সেই নিয়মমতো “গেট” হয় “গাইট”, “ মেট” হয় “মাইট”, “ডেট” থেকে “ডাইট” এমনিধারা চলতে থাকে।
কারণটা বেশ মজার। অষ্টাদশ শতাব্দীতে অস্ট্রেলিয়ার রুক্ষ-শুকনো ভূমিতে যে সাহেবদের পা পড়েছিল তাদের মধ্যে বেশির ভাগই ছিল আইরিশ, ড্যানিশ, স্কটিশ, আফ্রিকান বিপ্লবীদের দল এবং তারই সঙ্গে এসেছিল বাপে খেদানো, মায়ে তাড়ানো কতক ইংরেজ ছেলেপুলে (যারা নিজের দেশে কল্কে পাচ্ছিল না।) ব্রিটেনের উপচে পড়া জেলখানাগুলির ভার লাঘবের জন্যই এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। ফলস্বরূপ নিউ সাউথ ওয়েলসে একের পর এক ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠল জেল কলোনি। আজব অস্ট্রেলিয়ান ইংরিজির জন্ম হয় এই পাঁচমিশালি জেল কলোনিতেই। কাজেই বুঝতেই পারছেন, পাঁচজনের দয়া-দাক্ষিণ্যে বেড়ে ওঠা অনাথ অজ়ি ইংরিজির মধ্যে তার বাপ-পিতেমোর (অর্থাৎ অক্সফোর্ড ইংলিশ) শুদ্ধতা ও কৌলীন্য আশা করাই অবান্তর।এছাড়া জাতিগতভাবে অস্ট্রেলিয়ানরা অত্যন্ত কর্মচঞ্চল। বাঙালি হিসেবে আড্ডা মারা এবং গল্পের বই পড়া যেমন আমাদের মজ্জাগত অভ্যাস, অজ়িদের কাছে ঠিক তেমনি অবসর কাটানোর উপায় হল খেলাধুলো। সে ক্রিকেট, সমুদ্রে সার্ফিং, ফুটবল, বাস্কেট বল যাই হোক না কেন। এদেশে খেলতে না জানা এবং কোনও খেলার সঙ্গে যুক্ত না থাকাটা ভয়ানক লজ্জার ব্যাপার। কথা বলাটাকে এরা স্রেফ সময় নষ্ট বলে মনে করে। তাই যত কম শব্দ বলে কাজ চালান সম্ভব, ততই ভাল। মতলবখানা হল এই যে, কথা কম বলে যদি দিনে দুটো মিনিট বেশি বাঁচানো যায় তাহলে সেই সময়টুকু খেলার মাঠে খরচা করা যাবে। নবলব্ধ জ্ঞানার্জনের পরে বুঝলুম কফিশপের ছেলেটা সকালবেলা কী বলছিল। “ডিডিয়া হ্যায়োর ব্রেকীই!”-র অর্থ হল,“ডিড ইউ হ্যাভ ইয়োর ব্রেকফাস্ট?”পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পেরে একা একাই খুব হেসেছিলাম। এরপর প্রায়ই ওই কফিশপে যাই। এখন সেই ছেলেটির নামধাম সব জানি আমি। ওর নাম রায়ান, পুরো নাম রায়ান টেয়লর। আমি ওকে হিন্দি শেখাই আর ও আমাকে শেখায় “স্ট্রায়ান” ইংরিজি। দু’জনই দু’জনকে নিয়ে চূড়ান্ত রকমের হতাশ হয়ে যাই, কিন্তু তবুও হাল ছাড়ি না।
এদেশে বার্বি মানে ছোটদের খেলার পুতুল বার্বি ডল নয়, বার্বি অর্থাৎ বারবার (পরামানিক)। লিপি মানে লিপস্টিক, সিগি মানে সিগারেট! নিতান্ত বাড়াবাড়ি রকমের প্রয়োজন না হলে অজ়ি-রা দুইয়ের বেশি সিলেবল কখনও একসঙ্গে উচ্চারণ করবে না। সামান্য বড় শব্দ হলেই তার হাত-পা ভেঙে, দুমড়ে মুচড়ে তাকে বামন করে দেওয়া হয়।
এই তো সেদিনের কথা। রায়ান বলল, “সিস্টা (‘র’-টাও বাদ) বলো ‘গাইট’।“ আমি চোখ কান বুজে বললুম, “গেট।“ মুখ থেকে এ-র বদলে আই কিছুতেই বেরোয় না। খালি মনে হয় ছোটবেলায় শেখা ফোনেটিক্সের শিক্ষার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছি। রায়ান অবশ্য বড় ভাল ছেলে। সে নাছোড়বান্দা। আমাকে শিখিয়েই ছাড়বে। তার অক্লান্ত সাধনার ফলস্বরূপ আজকাল আমি সুযোগ পেলেই একটু আধটু স্ট্রায়ান ইঞ্জিরিতে কথা কই। ও যেখানে কাজ করে সেই কফিশপে সকালবেলা ঢুকে বলি, “গুড ডে মাইট।“ রায়ান সেকথা শুনে মুচকি হাসে, “ডিডিয়া হ্যায়োর ব্রেকীই? ” আমি বলতে যাই, নট রিয়েলি ডিয়ার। ক্যান ইউ প্লিজ় অর্ডার হোয়াট আই ইউজুয়ালি গো ফর? কিন্তু পরমুহূর্তে নিজেকে সামলে নিই। তারপর মিষ্টি হেসে গুরুমশাইটিকে চমকে দিয়ে বলি,
“ন্যাহ্, গিম্মি দ্য ইউজুয়াল!”
শিষ্যার সাফল্যে গর্বিত সায়েব গুরুমশাইটির মুখখানা হয় দেখার মতো…।
যূথিকা উত্তরবঙ্গের মেয়ে। পেশায় রেস্তোরাঁ ম্যানেজার। ভারতবর্ষের পাঁচটি শহরে বড় কিছু গ্রুপের সঙ্গে কাজ করার পর অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি দেন। ঘুরতে ঘুরতেই লেখালিখির সূত্রপাত। আপাতত মেলবোর্নে একটি নামী রেস্তোরাঁর দায়িত্বে আছেন। যূথিকা বিভিন্ন দেশের খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনযাত্রা নিয়ে দুই বাংলার বেশ কিছু পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। প্রথম বই "আশাবরী" দুই বছর আগে প্রকাশ পেয়েছে। ভ্রমণ সম্পর্কিত লেখা ছাড়াও মুক্ত গদ্য এবং গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ লিখতে ভালোবাসেন।
ভালো লাগল। খুব হাসলামও। তবে ঔপনিবেশিকতার কারণেই অবশ্য, বিশ্বের অধিকাংশ বইপত্র ইংরেজিতে লেখা বা অনুদিত বলেও এই ভাষার গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে।
খু ভা লা ।