আগের পর্বের লিংক: খলিল জিব্রানের দ্য প্রফেট-এর অনুবাদ: [কথামুখ] [প্রেম] [বিবাহ] [সন্ততি] [দান ও দাক্ষিণ্য] [পান-ভোজন] [কাজ-কারবার] [দুঃখ ও সুখ] [ঘর-বসত] [পরিধেয়] [বিকি কিনি] [অপরাধ ও শাস্তি] [আইনসম্মত] [স্বাধীনতা] [যুক্তি ও আবেগ] [সময়] [ভাল ও খারাপ] [প্রার্থনা] [সুখ] [সৌন্দর্য] [ধর্ম] [মৃত্যু]

আগামী

এবার, ঝুঁকে আসছে সন্ধে ।

অন্তর্যামীর মতো সাধ্বী সেই আলমিত্রাই বলে উঠল, আশীর্বাদে ধন্য হোক আজকের এই দিনটি, এই স্থান এবং আপনার সত্তাটিও, যা ভাস্বর হয়ে উঠল আপনারই কথায়। 

তিনি বললেন, এ কি সেই আমি, যে শুধুই কথা বলে গেল? 

শ্রোতা হয়ে আমি কি আমার শ্রবণটিও পেতে রাখিনি?

ক্রমে তিনি নামতে লাগলেন, মন্দিরের সিঁড়ি পথে এবং সঙ্গে চলল অনুসরণকারীর দলও। তিনি পৌঁছলেন তাঁর জাহাজটির কাছে, উঠে দাঁড়ালেন পাটাতনে।

আরও একবার সকলের দিকে তাকিয়ে সজোরে সম্ভাষণ করলেন তিনি:

ওহে অরফালেসবাসী, তোমাদের থেকে যোজন দূরত্বে, বাতাস আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। 

যদিও বাতাসের ওই দ্রুতি আমার নেই, তবুও যেতে তো আমাকে হবেই।

আমরা যারা এই যাত্রীর দল, সব সময় খুঁজে চলেছি একার এক নিজস্ব পথ, তাদের না কোনও দিন, বা না কোনও দিনান্ত; কোনও সূর্যোদয়ই তো সে হদিশ রাখেনা , যে কখন কোন সূর্যাস্তে সে আমাদের ছেড়ে গিয়েছিল।

এমনকি পৃথিবীও যখন ঘুমে – বিশ্রামে আমরা কিন্তু তখনও ভ্রামক।

আমরা তো সেই নাছোড় গাছেরই বীজ, যা আমদেরই অন্তর্গত পরিপক্কতায় এবং হৃদয়ের  সম্পূর্ণতার স্মরণে, একদিন বাতাসকে বিলিয়ে দিই আর সেই বীজ-রাশিই তো ক্রমে ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে।

খুব স্বল্প সময়ই কাটালাম তোমাদের সঙ্গে এবং আরও সংক্ষিপ্ত আমার বলে চলা কথাগুলি।

আমার এই স্বর,  যদি কখনও ম্লানও হয়ে আসে তোমাদের শ্রবণে, বা আমার  ভালবাসার উত্তাপ, স্মৃতি থেকে উবে যদি নিশ্চিহ্নও হয়ে যায়, তখন না হয় আবার ফিরে আসব তোমাদেরই কাছে।

তখন গভীরতর হৃদয় প্রাচুর্যে এবং আরও মর্মস্পর্শী অনুভবে কথা বলে উঠবে আমার ঠোঁট।

জোয়ারেই ভেসে আসব আবার – হ্যাঁ, এই আমিই।

মৃত্যু যদিও আমাকে লুকিয়ে ফেলবে এবং আরও এক বৃহত্তর নীরবতা মুড়ে রাখবে আমার স্বর, তবুও আমি খুঁজে বেড়াব তোমাদেরই  মর্মস্থল।

এবং আমি তা কখনওই খুঁজব না, কোনও অসফল ব্যর্থতায়। 

সত্য যদি কিছুমাত্র বলে থাকি, তবে তা নিজেই উন্মোচিত হয়ে আরও সহজ স্বরে কথা বলে উঠবে এবং সেই শব্দগুলিও আরও অধিক মর্মস্পর্শীও হবে তোমাদের কাছে। 

ওহে অরফালেসের মানুষ, বাতাসে ভর দিয়ে ছেড়ে যাচ্ছি তোমাদের, কিন্তু তা শূন্য মনে নয়।

আমার এই ভালবাসা, তোমাদের চাহিদার কাছাকাছি এসে, আজকের এই দিনটিতেও পরস্পরকে যদি স্পর্শেই না পায়, তা হলে তা চিহ্নিত হয়ে থাক প্রতিশ্রুতি হিসেবেই, অন্তত আরও একটি নতুন দিন শুরু হয়ে যাবার আগে।

মানুষের চাহিদা বদলায়, কিন্তু না বদলায় তার সেই ভালবাসা, আর না সেই  আকাঙ্ক্ষা, যে একদিন সেই ভালবাসাই পূরণ করবে তার যাবতীয় যা চাহিদা। 

তাই এমনই বিশ্বাস রাখ যে, এক বৃহত্তর নীরবতার মধ্যে দিয়েই আমি আবার ফিরব। 

ঠিক সেই ভাবে, ভোরবেলা যেমন কুয়াশা কেটে গেলেও তারই চিহ্ন স্বরূপ রেখে যায় শিশির-কণা, যা পরে বাষ্প হয়ে মেঘ জমায় এবং আবার যা ঝরে পড়ে বৃষ্টিতে। 

আমিও কি একরকমই  এক কুয়াশা নয়? 

নিথর রাত্রিতে হেঁটে গিয়েছি তোমাদেরই পথ গুলিতে এবং তোমাদের এই ঘর বসতে যে প্রবেশ করেছে, সে তো আমারই সত্তা।  

তোমাদের হৃদি স্পন্দনের ধুকপুকই তো ছিল আমারও হৃদয়ে, আর তোমাদেরই নিঃশ্বাস পড়েছিল আমার এই মুখে এবং এ ভাবেই তো তোমাদের সকলকে আমি চিনেছিলাম।

হ্যাঁ, আমি জানি তোমাদের বিষাদ ও হর্ষ এবং ঘুমের মধ্যে তোমাদের স্বপ্নগুলিও তো আমারও স্বপ্ন।

সময়ের বেশির ভাগটাই আমি তোমাদেরই মধ্যে ছিলাম, যেমন পাহাড়গুলির মধ্যে সেই হ্রদ।

প্রতিচ্ছবিতে ধরে রেখেছিলাম, তোমাদের মধ্যে থাকা পর্বত চূড়াগুলি, নীচে গড়িয়ে আসা সানু যত পথ, এমনকি ভাসমান সেই বকপাঁতির মতো তোমাদের ভাবনা ও আকাঙ্ক্ষাগুলিও। 

এবং আমারই নীরবতায় ঝর্ণার মতো ঝরেছিল তোমাদের সন্ততির হাসি আর নদীতোড়ে তোমাদেরই যৌবনের তীব্র কামনা।

আর যখনই সেই ঝর্ণা আর নদীগুলি আমার গহনে পৌঁছে যায়, তখন গান না গেয়ে তো তারা পারেওনা। 

তাই তখনই কিন্তু তারা হাসির থেকেও মধুর আর কামনা ছাপিয়েও সুতীব্র হয়ে এসেছিল।

তোমাদের মধ্যেই তো এ যে নিঃসীম।

এমনকি সেই প্রবল এবং বিরাট মানুষটির কোষ ও পেশী-তন্তুও কিন্তু তোমারই।

ইনিই সেই জন, যাঁর প্রার্থনা সঙ্গীতেই তোমাদের গান এক শব্দহীন ধুকপুক মাত্র। 

তিনি বৃহৎ বলেই তোমরাও বিরাট।

আর তাঁকে আঁকড়ে ধরেই আমিও তোমাদের জড়িয়েছিলাম এবং ভালবেসেছি।

এই বিরাট চরাচরে কি এমন দূরত্ব আছে, যেখানে ভালবাসা পৌঁছোয় না?

কী সেই দৃষ্টি, কিই বা সেই প্রত্যাশা এবং কী সেই মাতব্বরি যা উড়ানকে বাধা দেবে? 

ঝাঁপাল এক বিশাল ওক গাছের মতো, ফলন্ত আপেলে মোড়া সেই বিরাট মানুষটি তোমাদের মধ্যেই আছেন।

এ তাঁর সেই শক্তি যা তোমাকে মর্ত্যে বেঁধেছে, তাঁরই সুগন্ধি তোমাকে তুলে ধরেছে শূন্যে এবং তাঁর মধ্যে নিহিত ওই চিরত্বেই তো তুমি মৃত্যুহীন।

তোমাদের তো আগেই বলেছি যে ওই শিকড়েরই মতো, জোড়ের মুখে তুমি দুর্বলের চেয়েও দুর্বল।

কিন্তু এও এক অর্ধসত্য। কারণ ওই শিকলটির জোড়ের মুখেই তুমি আবার শক্তিমানও বটে এবং তুমিই তখন আরও শক্তিশালী এক জোড়। তাই তোমার ক্ষুদ্রতম কাজ দিয়ে তোমাকে মাপতে যাওয়ার চেষ্টাই হল, ঢেউয়ের মাথায় পলকা ফেনা দেখে সমুদ্রের শক্তি স্থির করবার মতো এক ভ্রম।

তাই ব্যর্থতা দিয়েই তোমাকে যদি মাপতে হয় তো দুষবো, সামঞ্জস্যহীন সেই  দুঃসময়কেই। 

ওহে, তুমি যে ঠিক ওই সাগরেরই মতো।

ভারী জাহাজগুলি ভরা স্রোতের অপেক্ষায় বেলাভূমিতে অচল হয়ে আছে জেনেও তো তুমি  সমুদ্রেরই মতো অপেক্ষা কর এবং তড়িঘড়ি জোয়ার ডেকেও আনো না।

এবং তুমি যে ঋতু বিবর্তনেরই মতো। 

তাই তোমার শীতেও তুমি অগ্রাহ্য কর বসন্তকে।

তোমার মধ্যে অপেক্ষারত যে বসন্ত সে তাই আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েও হাসে, আর অপমানিতও বোধ করেনা কখনও। 

ভেব না যে, সুসামঞ্জস্য রাখতেই  আমি এমন কিছু বলেছি যে, এ ওকে বলবে,   “তিনি আমাদের দারুণ প্রশংসাই করেছেন এবং আমাদের ভালটুকুই দেখেছেন”।  

আসলে কিন্তু, তোমাদের কাছে সেটুকুই আমি উচ্চারণ করেছি মাত্র, যা তোমরা তোমাদের ভাবনায় নিজেরাও জান।

শব্দজ্ঞান কি নিঃস্বর জ্ঞানেরও ছায়া নয়?

তোমাদের ভাবনা এবং আমার ওই বলা কথাগুলি আসলে, সেই মোড়কে জড়ানো এক স্মৃতির ঢেউ যা নথিবদ্ধ করে রাখল আমাদের বিগত দিনগুলিকেই।  

এবং তা সেই প্রাগৈতিহাসিক সময়েই যখন এ পৃথিবী না চিনত আমাদের, বা সে না চিনত  নিজেকেও। 

আর সেই সব রাত্রিবেলায়, যখন নানা বিভ্রান্তিতে ক্ষুব্ধই হয়ে থাকত পৃথিবীও।

জ্ঞানীরা এসেছেন তোমাদের কাছে, তাঁদের প্রজ্ঞা দান করতে, আর আমি তো  এসেছি তোমাদের কাছ থেকেই তা গ্রহণ করতে। 

এবং দেখলাম যে, আমি যা পেয়েছি তা তো জ্ঞানেরও অধিক। 

তোমাদের মধ্যে এ সেই উজ্জ্বল সত্তা যা নিয়ত নিয়োজিত, নিজেকেই আরও সমৃদ্ধ করবার অপেক্ষায়।

এবং যখন তুমি এর বিস্তারে অমনোযোগী , তখন দিনের শেষে বিলাপই করে চলেছ।

আর জীবনের খোঁজে এই যে জীবন, তা তুমি খুঁজে চলেছ সেই শরীরগুলিতেই যারা কবরকেও ভয় পায়।

কিন্তু এটাই জানবে, যে এখানে কোনও কবর নেই।  

এই যে পর্বতগুলি আর এই যে সমতলের বিস্তার, এগুলি-তো আসলে সেই দোলনা এবং পা রাখারও ধাপ। 

যখন পার হয়ে যাও ওই শস্যখেত, যেখানে তুমি শুইয়ে রেখেছ তোমার পূর্বপুরুষদের, সেই দিকে ভাল করে একবার তাকালেই দেখবে যে, তুমি ও তোমার সন্ততি, কেমন হাত ধরাধরি করে নেচে চলেছ।  

অবশ্য এত কিছু না জেনেই  তো তুমি, বারে বারেই মাতামাতি কর।

যে স্বর্ণময় প্রতিশ্রুতি তুমি দিয়েছ তোমার আমর্ম বিশ্বাস থেকে, তা নিতে যখন অন্যেরা তোমার কাছে আসে, তখন তো তোমার সম্পদ, শক্তি ও গৌরব তুমি তাদের দাও।  

কিন্তু আমি তো প্রতিশ্রুতির ধারে কাছেও দাঁড়ায় এমনও কিছু দিতে পারিনি, অথচ আমার প্রতি কী অপরিসীমই না বদান্য তোমরা,

তোমারাই তো, জীবন অতিক্রমী এক বিপুল তৃষ্ণা জাগিয়েছ আমার মনে।

যে কোনও মানুষের কাছেই এর থেকে সর্বোত্তম উপহার নিশ্চিত আর কিছুই হতে পারেনা, যখন তার সমস্ত উদ্দেশ্য চরিতার্থ হয় তার ঝলসান ঠোঁটে, আর জীবনও হয়ে যায় ঝর্ণার নির্ঝর।  

তাই এর মধ্যেই তো রয়েছে আমার সম্মান এবং পুরস্কারও।

জল চেয়ে যখনই ঝর্ণার কাছে অঞ্জলি পেতেছি, এটাই তো দেখেছি যে,  সে নিজেই ছটফট করছে তৃষ্ণায়;

তাকে যখন আমি পান করেছি, সে ও তো পান করেছে আমাকে।

তোমাদের মধ্যেই কেউ কেউ তো আমাকে অহংকারী ভেবেছ, বা ভেবেছ যে তোমাদের দেওয়া উপহার গ্রহণে আমি খুবই অপ্রতিভ।

আসলে, উপহারের চেয়েও পারিশ্রমিক পাওয়াতেই আমার অধিক গর্ববোধ হয়। 

আতিথ্যে তোমাদের ঘর বসতে আহার্য দিয়েছ আমাকে , তবুও তো পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়িয়ে, সংগ্রহ করেই খেয়েছি বুনো ফল।  

সাগ্রহে আশ্রয় দিয়েছ তোমাদের গৃহস্থীতে, তা সত্ত্বেও তো আমি ঘুমিয়েছি মন্দিরের ওই চাতালটিতেই।

কিন্তু, দিনে রাতে তোমাদের ওই সচেতন আতিথ্যই কি খাবার কে স্বাদুতর করেনি আমার রসনায়, আর কোমর বন্ধের মতোই আমার ঘুমকেও কি জড়ায়নি দূরগামী এক দৃষ্টি?

আজ, এই জন্যেই তো আমি সেই সর্বোত্তম আশীর্বাদই করছি।

করুণাও তো প্রায়শই, আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে দেখতে পাথরই হয়ে যায়।

আর সেই সুকর্মগুলিও তো পরস্পরকে নানা আদুরে নামে ডাকাডাকি করেও শেষে শুধুই জন্ম দিতে থাকে অভিশাপের।

এমন তো তোমরা ভাবতেই পার, যে আমি খুবই নির্লিপ্ত এবং নিজেরই একাকীত্ব পান করে মাতাল।

এও তো বলেছ যে, “মানুষগুলিকে নিয়ে নয়, লোকটা আসলে মন্ত্রণা-পরিষদ গড়েছে, বনভূমির ওই গাছেদের নিয়েই”।  

বলেছ, “একলাটি বসে থাকে টিলার মাথায় এবং তুচ্ছ জ্ঞান করে আমাদের এই নগরকেও।”

সত্য বটে, ডিঙিয়েছি অনেক পাহাড় এবং হেঁটেছি বিস্তর দূরধিগম্য স্থানে।

কিন্তু বিশাল এক উচ্চতা আর যোজন দূরত্ব ছাড়া আর কী ভাবেই বা আমি দৃশ্যমান হব? 

আর দূরে না গেলে সেই বা কি করে নিকটবর্তী হবে? 

আর তোমাদের মধ্যে যারা কোনও শব্দ খরচ না করেও, আমার প্রতি দৃকপাত করেছ, তারাও তো বলেছ,

“লোকটা অদ্ভুত এবং এক আগন্তুকই বটে, যে ভালবাসে অগম্য পাহাড় চূড়া; কেনই বা বাস করে  সেই তুঙ্গে, যেখানে শুধু ঈগলই বাসা বাঁধে”। 

বলেছ, “কেনই বা সে এক অধরা – সন্ধানী”?  

“কোনও ঝড়কেই বা সে ধরতে চায় তার ফাঁদে”?  

“এবং কী সেই মায়া – কল্পনার পাখি, যাকে তল্লাশি করে চলে আকাশে”?

এমনও বলেছ, “ এসো এবং আমাদেরই একজন হও”।

“স্বাভাবিক দিনাতিপাতে নেমে এসে, খিদে মেটাও আমাদের রুটিতে আর তৃষ্ণায় পান কর আমাদেরই মদিরা”।

তারা অবশ্য এসব বলেছে, তাদের নিজেদেরই আত্মার নিভৃতিতে; 

কিন্তু তারা কি জানে যে, তাদের এই একাকীত্ব আরও কত গভীর এবং যা আমি খুঁজেছিলাম, তাদেরই গহন সুখ আর নিহিত অব্যক্ত দুঃখেও,  

আমার নিশানায় শুধু ছিল, তোমাদের সত্তার সেই বিশালতা, যা আকাশেও পা চালিয়ে হাঁটে। 

কিন্তু ওই শিকারিটি যে নিজেই বিদ্ধ হয়ে আছে!  

কারণ, আমার ধনুক থেকে ছুটে গেছে অসংখ্য তীর এবং তা আমারই পাঁজর বিঁধতে চেয়ে।

এবং সেই উড়ন্ত ধাবকও কিন্তু আবার একই সঙ্গে, আঁকড়ে ধরা লতাটিও।

আমার ডানাগুলি সূর্যের আলোয় যখন বিস্তার পায়, পৃথিবীর ওপর এসে পড়া সে ছায়াই যেন কচ্ছপের শরীর।  

আর এই আমি, যে বিশ্বাসী আবার একই সঙ্গে কিন্তু অবিশ্বাসীও বটে।

আমার এই আঙুলগুলি, প্রায়শই যখন ক্ষতের ওপর বোলাই , তখনই বুঝতে পারি যে কত প্রগাঢ় ভাবে বিশ্বাস করি তোমাদের এবং একই সঙ্গে তোমাদের বৃহত্তর জ্ঞানকেও।

আর এই বিশ্বাস ও জ্ঞানের নির্ভরেই আমি বলছি যে,

শুধুমাত্র তোমার দেহের মোড়কে তুমি যেমন আটক নয়, তেমনই বন্দিও নয়, কেবলমাত্র ঘর বসতের সীমা বা শস্যখেতের ফসলে।

পর্বত চূড়ারও চূড়ায় তোমার বসত, আর তোমার গতিও তো ওই এলোমেলো বাতাসে। 

সত্তা তো এমন কিছু নয় যে, সূর্যের কাছে উত্তাপ চেয়ে শুধুই হামাগুড়ি দিয়ে চলেছে বা সুরক্ষা চেয়ে গর্তই খুঁড়ে চলেছে অন্ধকারে।

এ এমন  কিছু যা একেবারেই মুক্ত এবং এমনই এক উদ্দীপন যা পৃথিবীকেও মুড়ে রাখে, আবার একই সঙ্গে তা ওই মহাশূন্যেও সঞ্চরণশীল।

এসব কথা যদি হেঁয়ালির মতো শোনায়, তো সেই অস্পষ্টতার জাল ছিঁড়ে স্বচ্ছতর করে খুঁজতে চেওনা তাকে।

কারণ এই অস্পষ্ট ও ধোঁয়াশাতেই যে সব কিছুর শুরু বা শেষ তা কিন্তু একেবারেই নয়।

তাই খুশি হব, আমাকেও যদি তোমরা ওই সূচনামাত্র হিসেবেই গ্রহণ কর।

জীবন এবং জীবিত দু’ই জন্ম নেয় কুয়াশায় যা কিন্তু স্ফটিক বা স্বচ্ছ নয়।

আর কে বলতে পারে যে, এই স্ফটিকটিই সেই ক্ষয়ে যাওয়া কুয়াশাই নয়?

এইসব মনে করিয়ে দেবার মধ্যে দিয়েই আমাকেও মনে পড়বে তোমাদের:

তোমার শরীরে যা বলহীন এবং বিভ্রান্তিকর, সেটাই কিন্তু এক চরম একরোখা শক্তি।

তোমার শ্বাসবায়ুও তো , নির্গত হয়েও শরীর কাঠামোর হাড়গুলিকে মজবুত করেই  গড়ে তোলে।

আর এটাও কি স্বপ্ন নয়, যা তোমরা কেউই মনেও করতে পারোনা যে , কোনও স্বপ্নাভাসেও দেখেছ বলে; অথচ এই স্বপ্ন দিয়েই তো এক সফল বিশিষ্টতায় গড়ে তুলেছ তোমাদের এই নগর? 

সেই শ্বাসটুকুই কি জোয়ারের মতোই অনুভব করনি, তোমাদের  এই প্রতিনিয়ত নির্গত শ্বাসেও? 

স্বপ্নের ফিসফিসানিতে শ্রবণ যখন উপচে থাকে, তখন তো আর কারও স্বরই শুনতে পাওনা। 

তবে, এটাই  মঙ্গলের যে কিছুই শোননি তোমরা, আর দেখতেও পাওনি কিছুই।

যে ওড়নাটির আড়াল মেঘাচ্ছন্ন করেছে তোমার দৃষ্টি, জানবে যে আবার তা সরিয়ে দেবে সেই দু’টি হাতই, যার আঙুলে বোনা ওই আচ্ছাদন।

এবং যে আঙুলগুলি  মাটির মণ্ড বানিয়ে, তা দিয়ে লেপে বুজিয়ে রাখছে তোমার  শ্রুতি, একদিন কিন্তু সেই আঙুলগুলিই কানে গুঁজে পরিষ্কার করে দেবে তোমার শ্রবণ পথ।

আর তখনই তুমি দেখবে,

এবং তখনই শুনতেও পাবে।

অন্ধত্বের এই অভিজ্ঞতায় তাই ভেঙে পড়োনা, বা আক্ষেপও করোনা বধির হয়ে ছিলে  বলে।

কারণ, এই অকর্মণ্য অবস্থাটাই তো জানান দিয়ে গেল, সর্ব ক্ষেত্রে ব্যাপিত সেই গূঢ় উদ্দেশ্যের কথা। 

তাই অন্ধকার যেমন তোমার আশীর্বাদ, তেমনই তো আলোও।

এই কথাগুলি বলা শেষ করে , এবার তিনি জাহাজ চালকটির খোঁজে তাকালেন এবং  দেখতে পেলেন যে, সে দাঁড়িয়ে আছে হালের পাশেই; এখন একদৃষ্টে দেখতে লাগলেন পাল তুলে ভেসে আসা সেই জাহাজটিকে আর তার দূরত্বটুকুও। 

এবং তিনি বললেন,

আমার জাহাজ চালকটি নিতান্তই সুস্থির ও অতিমাত্রায় ধৈর্যশীলও বটে।

বাতাস বইছে আর তাই পালগুলিও অস্থির;

এমনকি নির্দেশ ভিক্ষা করছে, জাহাজের ওই হালটিও।

নিঃশব্দে, তবুও অপেক্ষা করে আছে জাহাজ চালকটি, যে কখন আমি কথা থামাবো। 

আর আমার ওই নাবিকের দল, সমুদ্রের বিপুল স্বর কানে নিয়েও আমার কথাগুলিই শুনে চলেছে। 

তবে, ওরা কিন্তু আর অপেক্ষা করবেনা।

আর আমিও তো প্রস্তুত।  

ঝর্ণা এসে পৌঁছেছে সাগরে এবং সেই শাশ্বত মা, আরও একবার সন্তানকে তাঁর বুকে জড়িয়ে ধরে, স্পর্শে নিলেন সন্তানের পিপাসা।

শুভেচ্ছায় বিদায়, হে অরফালেসের মানুষ।

এই দিনটিও তবে ফুরিয়ে শেষ হল। 

কিন্তু আমাদের এই অবসানেও শালুকটি যেন ফুটে উঠেছে, অন্য আরও একটি আগামীর সূচনায়। 

এসো, আজ আমরা এখানে যা পেলাম, তাকে ধরে রাখি।

আর যদি তা সত্যিই অপর্যাপ্ত, তখন না হয় আমরা আবার মিলিত হব যৌথতায়, আর তা হতেই থাকব, যতক্ষণ না আমাদের বাড়িয়ে দেওয়া ভিক্ষুর অঞ্জলি, সেই বিরাট দাতার কাছে , তাঁর দানের স্পর্শটি না পায়।  

ভুলো না যে , তোমাদেরই কাছে আবার ফিরব আমি। 

অবশ্য আর কিছু ক্ষণ পরই, মিলিত হওয়ার জন্যে আমার এই কাতরতাও তো ধূলিকণা আর ফেনা সংগ্রহ করতে থাকবে অন্য আর একটি দেহের জন্যে।  

অচিরেই বাতাসে বিশ্রাম এঁকে, অপর এক নারী তার গর্ভে ধারণ করবে আমাকে।

সবাইকেই বিদায় জানাচ্ছি; বিদায় সেই যৌবনময় সময়, যা আমি কাটিয়ে গেলাম এই তোমাদেরই সান্নিধ্যে। 

আসলে আমরা তো  মিলিত হয়েছিলাম গত রাতের স্বপ্ন ও সম্ভাবনায়।

আমার এই একাকীত্বে তো গান গেয়েছ তোমরাই। আর সেও তো তোমাদেরই কাতরতায় আমি আকাশে গড়েছি ওই সৌধ।

এখন তো আমাদের সকলেরই ঘুম ছুটে গিয়েছে এবং  শেষ হয়ে গেছে স্বপ্নও, আর তা ছাড়াও ভোরও তো মিলিয়ে গিয়েছে অনেকক্ষণ।

এখন তো আমরা মধ্যাহ্ন জোয়ারে এবং আমাদের আধো জাগরণও এখন বদলে গিয়েছে দিনেরই পূর্ণমানে; আমাদের তাই এখনই উচিৎ, একেবারে বিচ্ছিন্নই হয়ে যাওয়া। 

স্মৃতির গোধূলিতে যদি আরও একবার আমাদের দেখা হয়, তখনই না হয় আবার শুরু হবে আমাদের বলা কওয়া, আর তখন তোমারাই আমাকে শোনাবে তোমাদের সেই গভীরতর সঙ্গীত। 

আর আমাদের হাতগুলি যদি ভিন্ন কোনও এক স্বপ্নে আবার পরস্পরে লগ্ন হতে থাকে, তাহলে আরও একটি সৌধ আবারও আমরা গড়ে তুলব আকাশে।  

এই কথাগুলি বলা শেষ করেই, ইঙ্গিতে তিনি সংকেত পাঠালেন, সমুদ্র নাবিকদের কাছে; আর কালমাত্র ক্ষয় না করেই ভারি নোঙ্গরগুলিকেও তুলে নিল তারা এবং  জাহাজের কাছিগুলিকেও আলগা করে দিয়েই ভেসে চলল পুবমুখে।  

তখন সকলের সেই উত্তাল কান্না, যেন একটাই উদ্বেল হৃদয়; এবং ছায়াচ্ছন্ন আকাশে উৎক্ষিপ্ত হতে লাগল সেই কলরোলের উচ্ছ্বাস, ক্রমে যা শিঙার আওয়াজের মতো বিছিয়ে পড়তে লাগল সমুদ্র বিস্তারে।   

শুধু সেই আলমিত্রাই, যে একেবারে বোবা বনে গেছে, নিষ্পলক চাহনিতে তাকিয়েই  রইল, যতক্ষণ না জাহাজের শেষ বিন্দুটুকু অদৃশ্য হয়ে যায় কুয়াশায়।

এবং একে একে সকলেই অদৃশ্য হয়ে গেলেও, সে তখনও সাগর দেওয়ালে হেলান দিয়ে একা একাই দাঁড়িয়ে; আর তার মনে পড়তে লাগল, হৃদয় গভীরে গেঁথে যাওয়া তাঁর বলা সেই কথা:

“আর অল্পক্ষণ পরেই, মুহূর্তের জন্য স্থির হবে বাতাস এবং আমাকেই ধারণ করবে অন্য আর এক নারী, তার গর্ভে”। 

Mandar Mukhopadhyay

আড্ডা আর একা থাকা,দুটোই খুব ভাল লাগে।
লিখতে লিখতে শেখা আর ভাবতে ভাবতেই খেই হারানো।ভালোবাসি পদ্য গান আর পিছুটান।
ও হ্যাঁ আর মনের মতো সাজ,অবশ্যই খোঁপায় একটা সতেজ ফুল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *