ডি-লা-গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস
খবরের কাগজে, বা বলা ভাল মিডিয়ার জগতে কয়েকটা অদ্ভুত পরিভাষা চালু আছে। যেমন খবরকে বলা হয় ‘স্টোরি‘! হার্ড নিউজ, তবু নিয়মমাফিক সেটা স্টোরি, ‘গল্প’!
খবরের মধ্যে কল্পনা মেশানোর প্রশ্নই ওঠে না। খবর হল, নিজের চোখে যা দেখেছ, তাই। নিজের কানে যা শুনেছ, যাচাই না করে লিখে দিয়েছ কি মরেছ। খবর গল্পের মতো করে লিখলে চাকরি যাবে। তবু সেটাকে বলতে হবে ‘স্টোরি’! কেউ এর কারণ জানে না, উৎসের সন্ধান করেও লাভ হয়নি। বড়দের জিজ্ঞেস করে সদুত্তর মেলেনি। শেষ পর্যন্ত আমরা, কচিকাঁচা ট্রেনি জার্নালিস্টরা স্টোরিতেই অভ্যস্ত হয়ে গেলাম।
রিপোর্টাররা প্রতিদিন যে সব খবর জোগাড় করে আনেন, তা সে রুটিন খবর হোক, কিংবা স্পেশাল বা এক্সক্লুসিভ, ইদানিং কালের ‘ব্রেকিং নিউজ’— সবই ‘স্টোরি’। তবে প্রত্যেকটা খবর জোগাড় করার পেছনেও নানান কাহিনি থাকে, যেগুলোকে বলা যায় ‘গল্পের পেছনে গল্প‘! আমার রিপোর্টিং জীবনের এরকম কয়েকটা গল্পের কথা একে একে বলব। সবক‘টাই এতদিন ছিল অলিখিত। কাগজে মূল স্টোরি, মানে খবরটা বেরিয়েছে। কিন্তু তার পেছনে, সেই খবর করতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা, যে পরিশ্রম, মজা, বেদনা এগুলো ছিল, সে সবই অলিখিত থেকে গিয়েছে। ওই সব কাহিনিই আমার ‘স্টোরির নেপথ্যে গল্প’...
আমি তখন আনন্দবাজার পত্রিকার রিপোর্টার। একটা খবরের আশায় বউবাজার অঞ্চলে বার বার গিয়েছি, নিউজ় এডিটর তাড়া দিচ্ছেন, আমি এদিক ওদিক নানান দিক থেকে চেষ্টা করছি খবরটাকে দাঁড় করাতে। যে সোর্সের কাছে প্রথম খবরটা পেয়ে ছুটে গিয়েছিলাম, দেখলাম সেই সোর্সের মধ্যেই ভূত। ওটা দাঁড়াল না। চিৎপাত হয়ে পড়ল। শেষ পর্যন্ত তিনদিনের মাথায় খুব মনখারাপ, হতাশ হয়ে অফিসে ফিরছি। হঠাৎ দেখি রাস্তার একটা ল্যাম্পপোস্টের গায়ে জ্বলজ্বল করছে ছোট্ট একটা বোর্ড, ‘পটলডাঙা স্ট্রিট’। অ্যাঁ! পটলডাঙা, মানে চারমূর্তির পটলডাঙা! টেনিদার সেই পটলডাঙা দিয়ে হাঁটছি!
মনে পড়ে গেল আমার বন্ধু সহকর্মী তরুণ গোস্বামী একবার বলেছিল, টেনিদা বেঁচে আছেন। তবে ওর যতটুকু জানা আছে, খুবই অসুস্থ। ভাবলাম একবার খোঁজ নিয়ে দেখা যাক! টেনিদা বলে কথা! সবাই নিশ্চয়ই চিনবে! তাই হল। দুপুরবেলা, পাড়ায় লোকজন বেশি নেই। তার মধ্যেই একে তাকে জিজ্ঞেস করতে টেনিদার বাড়ি সবাই দেখিয়ে দিল।
আছেন? হ্যাঁ অবশ্যই আছেন! দ্বিগুণ উৎসাহে বাড়ির কাছে গিয়ে দেখি সামনে সেই চাটুজ্জেদের রক, যেখানে টেনিদা তার তিন চ্যালার সঙ্গে রাজা-উজির মারত! তার পাশ দিয়ে বাড়ির দরজা। দোতলা পুরনো বাড়ি। নীচে দেখলাম ছাপাখানার কিছু কাজ টাজ হচ্ছে, বই বাঁধাই চলছে। একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, “টেনিদা কি আছেন?” বললেন, “ওপরে চলে যান।” সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে দেখি, একটা ফাঁকা ছাদ, মাঝখানে রেলিং দিয়ে ঘেরা। নীচে উঠোনটা দেখা যাচ্ছে। এরকম ডিজাইনের বাড়ি কলকাতায় আগেকার দিনে আকছার হত। আজকাল নতুন বাড়িতে জায়গার অভাবে নানা রকমের চাহিদার কথা মাথায় রাখতে গিয়ে এই ধরনের ‘নষ্ট’ করার মতো জায়গা আর রাখা হয় না।
“টেনিদা টেনিদা” বলে ডাক দিতে লম্বা এক ভদ্রলোক, টিকোলো নাক, ধুতির উপর হাফহাতা গেঞ্জি পরা, বেরিয়ে এলেন। চোখে প্রশ্ন। আমাকে কোনওদিন দেখেননি, কিন্তু হাসিমুখ।
“টেনিদা! কী মজা, আপনাকে পেয়ে গেলাম!” নিজের পরিচয় দিয়ে বললাম, “আপনার সঙ্গে একটু কথা বলব, আপনাকে নিয়ে একটা স্টোরি করব।” উনি রাজি হয়ে গেলেন খুব খুশি হয়েই। এরই মধ্যে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন বাসন্তী বৌদি, টেনিদার পঞ্চাশ বছরের জীবনসঙ্গিনী। মিষ্টি হাসি, মাসি-পিসি ধরনের চেহারা, লালপেড়ে সাদা শাড়ি পরা। কোনও কাজ করছিলেন, হাত মুছতে মুছতে এলেন। তারপর সেই ছাদেই আমাদের গল্প শুরু হল।
কীভাবে ‘টেনিদা’ চরিত্রের জন্ম? নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ওঁদের ভাড়াটে ছিলেন, আর টেনিদা ছিলেন বাড়িওয়ালা। ১৯৪৬ সালে টেনিদার বাবা ওই বাড়ি কেনার পর পরই নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ওঁদের বাড়িতে দোতলায় ভাড়াটে হয়ে আসেন। ওঁর স্ত্রী আশা দেবী আর এই বাসন্তী বৌদি, দু’জনের গলায় গলায় ভাব হয়ে গেল এবং কথায় কথায় নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের সরস কলমে জন্ম নিল টেনিদার গল্প।
জানা গেল, টেনিদার চরিত্র সত্যি ওরকম কিছু নয়। চেহারাটা তো দেখেই বোঝা যায় নিতান্তই নিরীহ। কিন্তু সাহিত্যিকের হাতে পড়ে গল্পের গরু গাছে উঠে গেল! সেই চেহারা এবং সেই চরিত্রই হয়ে গেল দুর্ধর্ষ টেনিদা, থেকে থেকে হাঁক– ‘ডি-লা-গ্র্যান্ডি মেফিস্টোফিলিস, ইয়াক্ ইয়াক্’! কোনও মাথামুন্ডু নেই, তবে ওই হাঁক শুনলেই পটলডাঙায় থাকা আর পটল দিয়ে শিঙ্গি মাছের ঝোল খাওয়া বেচারা প্যালারামের পিলে চমকে ওঠে।
বাসন্তী বৌদি হাসতে হাসতে বললেন, সবটাই নারায়ণদার বানানো। টেনিদা বাদে বাকি তিন মূর্তিই যেন সুকুমার রায়ের বকচ্ছপ। পরিচিতদের এর থেকে একটু, ওর থেকে একটু খামচা মেরে নিয়ে গড়ে তুলেছেন। নিজে হয়েছেন প্যালারাম। মজা করেছেন নিজেকে নিয়েও। টেনিদার গল্পের চাটুজ্জেদের রক আসলে মুখুজ্জেদের রক। এখনও লাল সিমেন্টের ওই রকে বসে পাড়ার লোকে আড্ডা মারে। টুকটাক নাম বদল করা হয়েছে বাকি তিন মূর্তিরও। নাম বদল হয়নি শুধু টেনিদার। ওঁর ডাক নাম যা ছিল, তাতেই বিখ্যাত হয়ে গেলেন।

জিজ্ঞেস করলাম, “আর, গড়ের মাঠে গোরা পেটানো? সেটাও গল্প?”
লাজুক হাসি দিয়ে টেনিদা বললেন, “ওটাতে সামান্য সত্যির মিশেল রয়েছে। গড়ের মাঠে আমাদের অফিসের ফুটবল খেলা ছিল, বাঙালি বনাম গোরার দল। আমাকে জোর করে গোলকিপার দাঁড় করিয়ে দিল। পর পর দুই গোল খেয়ে সেই যে মাঠ থেকে পালিয়ে বাড়িতে গিয়ে লুকোলাম, তিন দিন আর অফিসে যাইনি।” এবার বৌদি ধরলেন, “সবটাই নারায়ণদার বানানো নয়। উনি (টেনিদা) এমন ‘হ্যান করেঙ্গা ত্যান করেঙ্গা’ করে চেঁচাতেন, মনে হত সত্যিই বুঝি কিছু করে ফেলবেন। যেই বলতাম, ‘কর না দেখি, কত মুরোদ!’ তখন চুপচাপ এসে ছাদের ওপর বসে থাকতেন। নামার আর নাম নেই। এ সব ব্যাপার তো নারায়ণদা লক্ষ্য করতেন! তাই ওঁকে ও ভাবেই লিখেছেন।”
বউকে একটা ‘ব্রুটাস, তুমিও!’— টাইপ চাউনি দিয়ে টেনিদা সত্যিই তখন মুখ লুকোতে ব্যস্ত। বললাম “আপনার সেই সময়কার একটা ছবি দিন।” পুরনো অ্যালবাম থেকে বেরল টেনিদার ওই সময়ের ছবি।
“আমি ফটোটা নিয়ে যাচ্ছি, আনন্দবাজারের একজন ফটোগ্রাফার আসবেন আপনার এখনকার ছবি তুলতে। তাঁর হাতে আবার এটা পাঠিয়ে দেব।” উনি রাজি। অফিসে গিয়ে আমার সহকর্মী ফটোগ্রাফার শ্যামল চক্রবর্তীকে অনুরোধ করলাম, “এই ছবিটা যেমন দেখছ, ঠিক এইভাবেই এই পোজ়ে এখনকার একটা ছবি তুলে নিয়ে আসবে।” ও গিয়ে ছবি তুলল এবং পরদিন আনন্দবাজারের প্রথম পাতায় হইহই করে অ্যাঙ্কর স্টোরি বেরিয়ে গেল– ‘পটলডাঙার সেই টেনিদার বয়স এখন ৭৫’...
যে খবর করতে গেছিলাম সেই খবর শেষ পর্যন্ত যদি বা হত, কেমন হত কে জানে! কিন্তু এই একটা খবর, একটা ‘স্টোরি’ পাঠকদের কাছে আনন্দবাজারকে আর সেইসঙ্গে আমাকে অনেকখানি তুলে দিয়েছিল।
আরও পড়ুন: আলপনা ঘোষের কলমে: সংবাদজগতের উত্তমকুমার
এর দিনদুয়েক পরে আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশক বাদল বসুর ফোন। বললেন, “কী যে কর তুমি ঝামেলা, দীপংকর!” আকাশ থেকে পড়লাম। “কেন, কী হয়েছে?” বাদলদা বললেন, “আরে আমরা যে ‘টেনিদা সমগ্র’ বের করছি, তার ছাপাও শুরু হয়ে গেছে। এখন আসল টেনিদার সঙ্গে তোমার ইন্টারভিউ পড়েই সম্পাদক বলে দিয়েছেন, স্টপ প্রেস! টেনিদাকে নিয়ে বইয়ে ওই ইন্টারভিউ না থাকলে চলবে না। কর্তার নির্দেশ, এখন ওটা করতেই হবে। তুমি রাজি তো?”
আমি তো রাজিই। “ভালই হল! খবরের কাগজে বেরনো লেখা তো পরদিনই ঠোঙা! কিন্তু ‘টেনিদা সমগ্র’ বহু দিন থেকে যাবে!” বাদলদা স্বীকার করলেন, “তা বটে”.. এবং সেটা বেরল। টেনিদা সমগ্র-তে শেষ ভাগে আমার নেওয়া ওই সাক্ষাৎকারটাই ছবিটবি সহ ঠাঁই পেয়েছে।
দুই পুরুষের সাংবাদিক দীপংকর চক্রবর্তীর চার দশকের পেশাগত জীবনের শুরু ও শেষ আনন্দবাজার পত্রিকায়। মাঝে এক দশক বেতার সাংবাদিকতা জার্মানিতে ডয়চে ভেলে, আর ওয়াশিংটন ডিসিতে ভয়েস অফ আমেরিকায়। প্রিন্ট মিডিয়া থেকে অবসর নিলেও মাল্টিমিডিয়ায় এখনও পুরোপুরি সক্রিয়। করেছেন বই সম্পাদনার কাজও। দেশে বিদেশে তাঁর অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারও বিচিত্র ও চিত্তাকর্ষক।