স্কুল থেকে বাঁদিকে গেলে অনেক দূর পর্যন্ত নদীর সঙ্গে হাঁটা যায়। তারপর শ্মশান, জঙ্গল। আর যাওয়া যায় না। শ্মশানের একটু আগে শিবমন্দির। তবে ও মন্দিরে বহুকাল কেউ পুজো দেয় না। সেই মন্দিরের সামনে আজ সারা গ্রাম ভেঙে পড়েছে। সেখানে খোঁড়াখুঁড়ি চলেছে পুরোদমে। ইতিমধ্যেই কিছু মুদ্রা পাওয়া গিয়েছে, খুব পুরনো কিছু নয়। ইয়ং হেড অর্থাৎ ভিক্টোরিয়ার তরুণী মুখচ্ছবিওলা মুদ্রা। এখনও হয়তো অনেকেরই সংগ্রহে পাওয়া যায়। সে যাই হোক, অবন্তীনগরের মানুষজন খুব, খুবই উত্তেজিত। তাদের পায়ের নীচে এমন গুপ্তকথা লুকিয়ে থাকতে পারে, সেটাই তাদের বিস্ময়ের কারণ।
মিথিলেশ ক্লাসে আজ একজনও ছাত্রকে না পেয়ে অবাক হয়ে গেছিল। খোঁজ নিয়ে সে জানতে পারে শুধু তার ছাত্ররা নয়, মাস্টারদেরও, বস্তুত গোটা গ্রামটাকেই পাওয়া যাবে শিবমন্দিরের মাঠে। সে খানিকটা কৌতূহলে, খানিকটা ছাত্রদের ধরে আনবার তাগিদে মাঠে এসে হাজির হল। জায়গাটা ইতিমধ্যেই একটা মেলার চেহারা নিয়েছে। প্রতিটি গ্রামে নিষ্কর্মা কিছু লোক থাকেই, যে কোনও উপলক্ষে ভিড় বাড়াতে তাদের জুড়ি নেই। কিন্তু মিথিলেশ লক্ষ করল অত্যন্ত ব্যস্ত, কর্মঠ লোকেরাও হাজির। ক্ষেতে কাজ করতে করতে, বাড়িতে রান্না করতে করতে, বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াতে খাওয়াতে সবাই ছুটে এসেছে। পাড়ায় সবার হাতেই ফোন। মাটির নিচ থেকে কী উঠে আসে, তার ছবি তুলে রাখার জন্যে সবাই তাক করে আছে।
মিথিলেশ শুনেছে কয়েকবছর আগে এ গ্রামে কারও হাতেই মুঠোফোন ছিল না। গ্রামে দুটিমাত্র ল্যান্ড ফোন ছিল। বিন্দু খাটুয়ার খাটুয়া অয়েল মিলে আর নিত্য বেপারির ভুসিমালের দোকানে। দুই দোকানেই পয়সা দিয়ে ফোন তো করা যেতই, এমনকী সেখানে দেশ-বিদেশ থেকে কারও ফোন এলে ডেকেও দেওয়া হত এবং বলাই বাহুল্য ডেকে দেওয়ার জন্যে টাকাও নেওয়া হত। তাতে গ্রামের কোনও লোকেরই কোনও আপত্তি ছিল না। এই গ্রামের বাইরেও যে তাদের ডাকখোঁজ করার লোক আছে, সেটা এই ফোন আসার মাধ্যমে সবাইকে জানিয়ে দেওয়া যেত। এমনকী মাসে কার কটা ফোন এল, সেই নিয়ে সবার মধ্যে একটা অলিখিত প্রতিযোগিতাও ছিল। বিশেষ করে বোম্বাই (মুম্বই বলতে কারও বয়ে গেছে) বা দুবাইয়ের ফোন হলে তো আর কথাই নেই। দুই দোকানেই সবার কমবেশি ফোন আসত। কিন্তু ব্যবসাবুদ্ধিতে বিন্দু খাটুয়া নিত্য বেপারিকে ছাপিয়ে গেছিল। কারও ফোন এলে নিত্য বেপারি তাকে খানিক পরে আবার ফোন করতে বলে, দোকানের ফাইফরমাশ খাটা ছেলেটিকে, যার ফোন এসেছে তাকে দেকে আনতে পাঠাত। ছেলেটি এই সুযোগে প্রায়ই ডান্ডাগুলি খেলে, পঞ্চার দোকানে তেলেভাজা খেয়ে ডেকে আনতে আধঘণ্টা সময় লাগাত। অনেক সময় ফিরে এসে বলত লোকটাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।

বিন্দু খাটুয়ার কৌশলটা ছিল অনেক বেশি কার্যকর। সে তার খাটুয়া অয়েল মিলের মাথায় একটা মাইক টাঙাল। ফোন এলেই তারস্বরে ডাক বাজে ‘হ্যালো হ্যালো নন্দরানি মিদ্দা, তোমার ছেলে দুলাল মিদ্দা বম্বে থেকে ফোন করছে, খর খর এসো, হ্যালো টোকাই মান্না, তোমার দিদি রূপালি মান্না তার সল্টলেকের কাজের বাড়ি থেকে ফোন করেছে, শিগগির এসো…।’ অমনি পুকুরঘাটে আধমাজা বাসন ফেলে পড়িমড়ি দৌড়ে আসে নন্দরানি মিদ্দা, ঘুড়ি ফেলে দৌড়ে হাজির হয় টোকাই। সারা গ্রামে যে যেখানে থাক, কেষ্টর বাঁশির মতো তাকে ডেকে আনে মাইকের হাঁক।
বিন্দু খাটিয়ার এই কৌশলের কাছে প্রথম রাউন্ডে হেরে ভূত নিত্য বেপারি ‘ফোন করলে লজেন্স ফ্রি’ অফারে চলে গেল। তবে দুজনের টক্কর বেশিদিন চলার আগেই গ্রামের বেশিরভাগ লোকের হাতে চলে এল মোবাইল। ফোন নিয়ে দুই ব্যবসায়ী ব্যবসা ফেঁদে গ্রামসমাজে যে যশ প্রতিপত্তি লাভ করেছিল তার ওখানেই শেষ। মিথিলেশ দেখল, বিন্দু খাটুয়া আর নিত্য বেপারি দু’জনেই ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। টিফিন টাইমে স্কুলের মাঠে আলুকাবলি, ঘুগনি ও আচার বেচা ফেরিওলারাও এসে হাজির। তাদের ভালো বিক্রিও হচ্ছে। আসেনি তবে কে? একেবারে অথর্ব বৃদ্ধ বৃদ্ধারাও নাতি নাতনির হাত ধরে এসেছে। তবে সত্যিই আসেননি গ্রামীণ ব্যাংকের ম্যানেজার আর তাদের স্কুলের হেড মাস্টারমশাই। হেড মাস্টারমশাইয়ের অবশ্য আসার উপায় ছিল না। সেক্রেটারির ডাকে তাঁর বাড়িতে ছুটতে হয়েছে। সেই হিসেবে সেক্রেটারিও আসেননি।
মিথিলেশ বাংলার মাস্টার। তবু তার আনমনা স্বভাবের জন্যে সে ছাত্রমহলে বেশ সম্ভ্রম কুড়িয়েছে। তার মাঝে মাঝে পড়ানো থামিয়ে জানলা দিয়ে বৃষ্টি দেখা, ফি দুপুরে নদীর ধারে গিয়ে দাঁড়ানো, এসব দেখে ছেলেদের ধারণা হয়েছে মিথিলেশ স্যার একজন কবি এবং তাঁর মাথায় কিঞ্চিৎ ছিট আছে। ছিট না থাকলে, তাদের চিড়িয়াখানা নিয়ে যেতে পারছেন না বলে নিজের ছেলের চিড়িয়াখানা যাওয়া বাতিল করেন? এহেন দুর্বোধ্য লোককে ছেলেরা রাস্তা করে দিল সামনে দাঁড়ানোর জন্যে। বলতে গেলে জমায়েতের পুরোভাগে এখন মিথিলেশ। তার সামনে বিনোদনের লাইভ ব্যবস্থা। কলকাতার কাছেপিঠে হলে এতক্ষণে দু’চারটে চ্যানেলের ওবি ভ্যান আসত এবং তারা নির্ঘাত স্থানীয় স্কুলের শিক্ষক মিথিলেশের মুখ থেকে দু’ একটা বাইট নিতে ছাড়ত না। মিথিলেশকে টিভিতে দেখানো হলে ঝিল্লির কি চোখে পড়ত না?

ঝিল্লির কথা ভাবলে মিথিলেশের মনের মধ্যে খোড়াখুঁড়ি শুরু হয়ে যায়। বিশেষত চিড়িয়াখানা নিয়ে সে যা ডিগবাজি খেয়েছে, তাতে ঝিল্লির কাছে তার অপরাধ জমা হয়েছে অনেক। তার কথামতো ঝিল্লি সময়মতো চিড়িয়াখানার সামনে ছেলেকে নিয়ে টিকিট কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়েছিল। কাঁধের সাইড ব্যাগ ছাড়াও হাতের দুটো কাপড়ের ঝোলায় নিয়েছিল শতরঞ্চি আর প্রচুর চিপস, ঝুরিভাজা, আরও নানাবিধ স্ন্যাক্স। ফ্লাস্কে কফি ছিল আর হটপটে ছিল তার বানানো একরাশ ফ্রেঞ্চ টোস্ট। কিন্তু নরাধম মিথিলেশ, ছেলেকে নিয়ে বেরনোর আগের মুহুর্তে তার মনে ভেসে ওঠে ক্লাস সিক্সের ছাত্রদের মুখ। তারা কেউ ময়ূর দেখেনি। তাদের বাদ দিয়ে সে নিজের ছেলেকে চিড়িয়াখানায় নিয়ে যেতে পারবে না। সে বলল তার প্রচণ্ড মাথা ধরেছে, জ্বর আসছে। ছেলে কেঁদেকেটে একসা। বৌ একরাশ কথা শোনাল। আর ঝিল্লি তো ময়ূর পর্যন্ত শুনেই রেগে ফোন কেটে দিয়েছিল। তারপর থেকে ফোনের পর ফোন করছে, ঝিল্লি ধরেনি। শুধু একটাই মেসেজ পাঠিয়েছে ‘গেট লস্ট’।

সেই থেকে মিথিলেশ লস্ট হয়েই আছে। তার অন্যমনস্কতা আরও বেড়েছে, নদীর ধারে গিয়ে দাঁড়ানোও অব্যহত আছে। কিন্তু কেউ কি জানে, মিথিলেশ ফোন করে, সে ফোন কেউ ধরে না। ‘ইসসসস’ একটা সমবেত আক্ষেপ, বিস্ময়, ভয় মেশানো ধ্বনি ছড়িয়ে পড়ছে চতুর্দিকে। মিথিলেশ চমক ভেঙে দেখে মাটির নিচ থেকে একটা কঙ্কাল তুলে আনছে লোকগুলো। কংকালের দুহাত ভর্তি চুড়ি দেখে অনুমান করা যায় ওটা একসময় নারী শরীর ছিল। সঙ্গে সঙ্গে সবার মোবাইল ঝলসে ওঠে। মিথিলেশকে তার এক ছাত্র ঠেলা দ্যায় ‘তুলুন না স্যার, তুলে ফেলুন।’ মিথিলেশের কী যে হয়, সে কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনের ক্যামেরা অপশনে ক্লিক করে। চুড়ি পরা এক প্রেতিনীর হাত তার পিকচার গ্যালারিতে জায়গা করে নেয়।
তারপর তার সম্বিত ফেরে। কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে সে। ‘চলো চলো ক্লাসে চলো’। মজা যখন সবে জমে উঠেছে, তখন তার এমন ডাকে কেউই কর্ণপাত করে না। এরপর আরও কী বেরবে তার জন্যে রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা করে সবাই। মিথিলেশ নিজেকে সেই নেশাতুর জনতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে নদীর তীর বরাবর স্কুলের দিকে হাঁটে। ভিড় পেছনে ফেলে অনেকটা চলে আসবার পর সে একটা খাঁ খাঁ জায়গায় এসে দাঁড়ায়। ঝিল্লির নম্বর ধরে। ফোন বেজে বেজে থেমে যায় যথারীতি। বাজতে বাজতে নো আন্সার হয়ে তার কাছেই ফিরে আসে। মিথিলেশের অস্থির লাগে, যদি কোনও উপায়ে ঝিল্লির কাছে পৌঁছে দেওয়া যেত তার জীবনযাপনের একটু টুকরো। সীমার সঙ্গে তার কেজো সম্পর্ক, এই নদীতীর, অনিয়মিত বাস, যে কোনও দিন রুট বন্ধ হবার ভয়, সেক্রেটারির প্যাঁচালো বুদ্ধি, ময়ূর না দেখা ছেলেগুলো কিংবা আজকের এই কঙ্কাল। কিছু না ভেবে ধাঁ করে মিথিলেশ ঝিল্লিকে পাঠিয়ে দ্যায় তার সদ্য তোলা ছবিটি, চুড়ি পরা নারী কঙ্কাল। (চলবে)
পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২২
ছবি সৌজন্য: Gallerist
যাদবপুর বিশববিদ্যালয় থেকে বি.ই‚ এম.টেক । সরকারি মুদ্রণসংস্থায় প্রশাসনিক পদ‚ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিদর্শী অধ্যাপনা তাঁর লেখনীকে বিশেষ স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে।গল্প‚ উপন্যাস, কবিতার পাশাপাশি ছোটদের জন্য কল্পবিজ্ঞান লিখে থাকেন নিয়মিত। প্রকাশিত হয়েছে বহু বই। নামজাদা পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন উত্তর-সম্পাদকীয়। সাম্প্রতিকতম কাব্যগ্রন্থ: 'লাইব্রেরি শার্ট খোলো'।
খুব জমে উঠেছে।মিথিলেশের চরিত্রটি খুব সুন্দর।