আগের পর্বের লিংক: [১] [] [] [] [] [] [] []

অমল দত্ত ফাস্ট বোলার হতে চেয়েছিল। বাংলা দলের হয়ে মাঠে নামতে চেয়েছিল। স্বপ্ন দেখেছিল ভারতীয় ক্রিকেট দলের ছবিতে সে দাঁড়াবে। ভ্রাতৃ সঙ্ঘ গলির ছেলে অমল। উঠোনহীন আট ঘরের বাসিন্দা। পিতৃদেব ক্ষিতীশ দত্তের বইয়ের দোকান। মথুরানাথ-জগদীশ বিদ্যাপীঠের গায়ে। বইখাতার সঙ্গে পাওয়া যায় স্লেট, চক-পেন্সিল, কাঠপেন্সিল, জলছবি, খোসাওলা বাদাম, নানারকম বিস্কুট— একআনায় ষোলোটা হাতিঘোড়াপাখিগাছ, কিসমিস লাগানো আনারকলি, আর লজেন্স নানা রঙের নানা স্বাদের, অবশ্যই ছিল টিকটিকির ডিমের মতো দেখতে লালসবুজনীলসাদা, ভেতরে একটা মৌরিদানা। বইয়ের দোকান চলেনি। রিফিউজি ছেলেরা বই কেনে কই। আদর্শলিপি, বর্ণপরিচয়, ছড়া ও ছবিতে অআকখ, ENGLISH RHYMES ইত্যাদি ঝোলানো টিনের ঝাঁপ কবে যেন বন্ধ হয়ে গেল।

অমল বালকের স্কুলের বন্ধু ছিল না। যেমন ছিল শঙ্কর বা চন্দন। সে ছিল মাঠের বন্ধু। যতদূর মনে পড়ে, ফুটবল মাঠে তাকে বেশি পাওয়া যায়নি। কখনও সখনও দল তৈরি করবার জন্য ডাকা হলে মাঠে নেমেছে। খেলেছে দায়সারা। ছোট জায়গার মধ্যে প্রায় নট নড়ন-চড়ন দাঁড়িয়ে থাকত। পায়ে বল এলে দুম্ করে উড়িয়ে দিত। ফুটবলের ছন্দে সে স্বচ্ছন্দ ছিল না। সেটা ছিল ক্রিকেটে। শীতের দুপুরে গভর্নমেন্ট কোয়ার্টারের গায়ে পিচের রাস্তায় ইটের উইকেটে টেনিস বলে বালকের দলের যে ক্রিকেটের আয়োজন, সেখানে অমল গোড়ার দিকে ছিল। কিন্তু বেশিদিন নয়। হঠাৎই সে বড়ো হয়ে গেল। বন্ধুদের চেয়ে অনেক বড়ো। তখন সে ডিউস বলে দুরন্ত গতিতে বল করে, ফাস্ট বোলার, ব্যাট করে গ্লাভস-প্যাড পরে। এবং সেটা ঘাসের মাঠে। সাদা ফুলপ্যান্ট আর সাদা ফুলহাতা জামা। বালকদের বালখিল্য খেলায় সে নেই। খুব বেশি ধরাধরি করলে গুরুগম্ভীর মুখে আম্পায়ারিং করতে রাজি হয়।

Fast Bowler
তখন সে ডিউস বলে দুরন্ত গতিতে বল করে, ফাস্ট বোলার।

স্কুলে পড়ার সময়েই অমলের ময়দানে ঘোরাঘুরি শুরু। এ তাঁবুতে সে তাঁবুতে। স্পোর্টিং ইউনিয়ন, কালীঘাট ক্লাব, এরিয়ান্স, ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান, গ্রিয়ার স্পোর্টিং। আরও কত নাম। ভ্রাতৃ সঙ্ঘের গলির উলটোদিকে ক্রিশ্চিয়ান বাড়ির রোয়াকে বসে বালক শুনেছে তার মুখে। বালক তখনও ময়দান চেনে না। ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান, মহমেডান, ইস্টার্ন রেল, এরিয়ান্স, বিএনআর, উয়াড়ি নামগুলো জানে কাগজে ফুটবলের খবর পড়া আর রেডিয়োয় বেরি সর্বাধিকারী ও পিয়ার্সন সুরিটার ধারাবিবরণী শোনার সুবাদে। হরিপদদার চায়ের দোকানে কাগজ আসত। সেখানে খবর পড়া যেত দুপুরে দোকান নির্জন হলে এবং ঝাঁট দেবার সময়ে। রেশনের দোকানের কর্মী চিত্তদার ট্রানজিস্টর সেটে ধারাবিবরণী শোনার সুযোগ ছিল। ক্রিশ্চিয়ান বাড়ির ছেলে সদাহাসিখুশি চিত্তদা রানিং কমেন্ট্রি শুনতেন। বালক সামান্যই বুঝত ইংরেজি, তবে নামগুলো চেনা এবং গোল হলে বুঝে নিতে পারত। সে শুনেছে বলরাম, চুনি গোস্বামী, পিকে ব্যানার্জি, অরুণ ঘোষ, রামবাহাদুর, বীরবাহাদুর, কেম্পিয়া, নরসিয়া, জার্নেল সিং, থঙ্গরাজ, সনৎ শেঠ, সুকুমার সমাজপতি, সুনীল নন্দী, প্রশান্ত সিনহা, অরুময়নৈগম, আপ্পালারাজু এইসব নাম। অমল সেইসব ক্রিকেটারের নাম প্রায়ই বলত, যাঁদের সে কাছ থেকে দেখেছে, যেমন দাত্তু ফাড়কার, সুব্রত গুহ, দিলীপ দোশি, প্রশান্ত সরখেল, প্রকাশ পোদ্দার, শ্যামসুন্দর মিত্র, দুর্গাশংকর মুখার্জি, অম্বর রায়। বালক এঁদের কথা শুনেছে এবং অমলের বলা তার মনে একটা অজানা দুনিয়ার ঘোর তৈরি করেছে।

অমল দত্ত ফাস্ট বোলার হতে চেয়েছিল। বাংলার ক্রিকেট দলে খেলতে চেয়েছিল। ভারতীয় দলের ছবিতে নিজেকে দেখতে চেয়েছিল। সেদিনের অমলের কথা যতটুকু মনে করা যায়, তাতে এই সত্যটা জোর দিয়ে বলতেই হবে, তার সাধনায় পরিশ্রমের খামতি ছিল না, নিজেকে উজাড় করে দিত একা একা প্র্যাকটিসে। আজও মনে পড়ে, ভোর থেকে তালতলার মাঠে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তার প্র্যাকটিস। বর্ষার কাদা শুকিয়ে গেলে ক্রিকেটের পিচ তৈরি হয়। শুকনো মাটি পড়ে, রোলার ঘোরে। বেজায় ভারি রোলার দিয়ে যায় কর্পোরেশনের গাড়ি। নিলুদা-অপুদার নেতৃত্বে ছেলেপুলেদের রোলার নিয়ে হইচই-ভরা টানাটানি। মাঠটা ক্রিকেট খেলার মতো বড়ো ছিল না। ফাস্ট বোলারের রানআপের যে জায়গা দরকার হয়, সেটা তো ছিলই না। অমল সেই মাঠে বল করত ছোট রানআপে। নিলুদা-অপুদা স্পিনার, তাদের সমস্যা নেই। 

শীতের দুপুরে গভর্নমেন্ট কোয়ার্টারের গায়ে পিচের রাস্তায় ইটের উইকেটে টেনিস বলে বালকের দলের যে ক্রিকেটের আয়োজন, সেখানে অমল গোড়ার দিকে ছিল। কিন্তু বেশিদিন নয়। হঠাৎই সে বড়ো হয়ে গেল। বন্ধুদের চেয়ে অনেক বড়ো। তখন সে ডিউস বলে দুরন্ত গতিতে বল করে, ফাস্ট বোলার, ব্যাট করে গ্লাভস-প্যাড পরে। এবং সেটা ঘাসের মাঠে। সাদা ফুলপ্যান্ট আর সাদা ফুলহাতা জামা। বালকদের বালখিল্য খেলায় সে নেই। খুব বেশি ধরাধরি করলে গুরুগম্ভীর মুখে আম্পায়ারিং করতে রাজি হয়।

অমল তার ক্রিকেট খেলাকে নিছক পাড়াগত খেলার মজার ফ্রেমে দেখেনি কখনও। বহু দূর যাবার স্বপ্ন ঘনিয়ে তুলেছে নিজের মধ্যে।। বন্ধুরা হাসাহাসি করত তার রকম-সকম দেখে। ফাস্ট বোলার হতে হলে শরীরকে মজবুত করতে হয়। সে ভ্রাতৃ সঙ্ঘের ব্যায়ামাগারে ডন-বৈঠক থেকে শুরু করে ওয়েট লিফটিং— যত রকমের ব্যায়াম আছে সবই করেছে কয়েক ঘণ্টা ধরে, দিনের পর দিন। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পেশির মাপ দেখেছে। টিপে দেখেছে বাইসেপ ট্রাইসেপ শোল্ডার কতটা শক্ত হল। প্রাত্যহিক হাঁটার ভঙ্গিতে সে অদ্ভুতভাবে জুড়ে দিয়েছে ক্রিকেটীয় গাম্ভীর্য। ভ্রাতৃ সঙ্ঘের কাঁচাগলি থেকে পিচের রাস্তায় যখন সে পা রাখত, মনে হত ইডেন গার্ডেনে ঢুকছে। বালক তখনও ইডেন গার্ডেন চেনে না। অমলের কাছে ইডেনের ছবি দেখেছে। বাংলার হতদরিদ্র রিফিউজি ঘর থেকে ফাস্ট বোলার হওয়া প্রায় অসম্ভব জেনেও কেন সে ওই পথে হেঁটেছিল, তার ব্যাখ্যা সেদিনের বালকের কাছে নেই। অমল দত্ত— উচ্চতায় গড় বাঙালি, ভুষো কালো গাত্রবর্ণ, চোখ কুঁতকুতে, নাক চাপা, তলার ঠোঁট মোটা ও ঝুলে পড়া, চওড়া চোয়াল, কাঁধে গেঁথে-যাওয়া মাথা, ছোটো করে ছাঁটা চুল, ব্যায়াম-গঠিত শরীর— ভারতের হল-গ্রিফিথ হতে চেয়েছিল হয়তো। ইন্ডিয়ান টিমে তখন বোলিং ওপেন করেন রমাকান্ত দেশাই, যিনি সাধারণ মানের মিডিয়াম পেসার। বালক শুনেছে অমলের কাছে।

Bowling Run up
অমল বলেছিল, ময়দানে খেলবি?

বালকদের ক্লাব— পূর্ব ইন্টালি ছাত্র সংসদের কোনো মাঠ ছিল না। ফাইভ সাইড কি সেভেন সাইড ফুটবল খেলা যায়, এমন কোনো ছোট মাঠও তারা পায়নি। পার্ক সার্কাস মাঠে বড়োরা খেলতে দেয়নি। বলেছে, খেলতে হলে চারটের আগে। এমনও হয়েছে গ্রীষ্মের দুপুর দুটোয় তারা মাঠে নেমেছে। খালি গায়ে। কপাল গলা বুক পিঠ ভরে গিয়েছে ঘামাচিতে। ওই দুপুরে বেশিদিন খেলা সম্ভব হয়নি। অসুস্থ হয়ে পড়ে অনেকে। ন্যাশনাল মেডিকাল কলেজের ছাত্রাবাসের উলটোদিকে যে লেডিস পার্ক, সেখানেও খেলতে দেয়নি বড়োরা বা অন্য ক্লাবের ছেলেরা। ছাত্রাবাসের পেছন দিকে একফালি ঘাসজমি ছিল। হাড়গোড় ছড়ানো। সেখানে দু-চারদিন খেলতে না খেলতেই সাদা ধবধবে বেঁটে রোগা এক বুড়ো লাঠিহাতে এসে ইংরেজিতে গাল পেড়ে ভাগিয়ে দেয় বালকদের। তারা ওই বুড়োর নাম দিয়েছিল ‘মারকাটারি সাহেব’। ছাত্র সংসদের ছেলেদের একটুখানি মাঠ নেই। কর্পোরেশন স্কুলের ছোট্ট মাঠে অবশেষে বল নিয়ে নামা গেল। রোজ বিকেলে খেলার ব্যবস্থা হল। কিছুদিনের মধ্যে আপদও জুটে গেল। ভ্রাতৃ সঙ্ঘের গুণ্ডাপ্রকৃতির কিছু ছেলে চড়াও হল ছাত্র সংসদের ছেলেদের ওপর। মারামারিতে খেলা বন্ধ। ওই মাঠে খেলবার অধিকার চেয়ে, যে কোনো সময় মাঠ ছেড়ে দেবার শর্তসহ, ছাত্র সংসদের সদস্যরা মেয়র গোবিন্দ দে, ডেপুটি মেয়র গণপতি সুর, স্থানীয় কাউন্সিলর সুশীল মোতায়েদ এবং আরও অনেকের কাছে গিয়েছে। সবাই হাসিমুখে ফিরিয়ে দিয়েছেন। কেউ ভাবেননি এই ছেলেরা কোথায় খেলবে।

অমল বলেছিল, ময়দানে খেলবি? দিলীপদাকে (ঘোষ, ব্যাডমিন্টন অ্যাসোসিয়েশনের একদা সচিব) বলা যেতে পারে। ওনার জানাশোনা অনেক। ময়দান? সে তো অনেক দূর। বাসে যেতে হয়। বালকের দল ভাড়ার পয়সা পাবে কোথায়? মাঠের অভাব ছিল অমলেরও। বাংলা টিমে এবং ইন্ডিয়ান টিমে খেলবে বলে, ফাস্ট বোলারের লম্বা রানআপ পাবার জন্য সে তালতলা মাঠে হাজির হত ভোর হবার সঙ্গে সঙ্গে। বাবু মাইতিদের বাড়ির পাঁচিলে তিন দাগের উইকেট ছিল। সেটাকে নিশানা করে বল ছুড়ত একা একা। ডিউস বল দেয়ালে লেগে শব্দ হত— খাট। নিজেই কুড়িয়ে আনত। হেঁটে যেত দৌড় শুরু করার প্রান্তে। আবার…। ভোরের স্তব্ধতা ভেঙে— খাট্। এভাবেই একা একা, ক্লান্তি নেই, বিরক্তি নেই, চারদিক সম্পর্কে খেয়াল নেই। 

বছরখানেক আগে অমলের সঙ্গে দেখা। সে এখন কী করে? অর্ডার সাপ্লাইয়ের বিজনেস। জমির দালালিও করে। উন্নয়নের জন্য জমির চাহিদা বাড়ছে। তালতলা মাঠের দালালি সে করছে কি? জিজ্ঞাসা করা হয়নি। অমল কি জানে এই মাঠ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে দিয়ে গেছেন হরেন্দ্রকুমার মুখোপাধ্যায়? 

 

*পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ১২ অগস্ট ২০২২
*ছবি সৌজন্য: লেখক, Dreamstime, Shutterstock
Madhumoy Paul

মধুময়ের জন্ম ১৯৫২ সালে পূর্ববঙ্গের ময়মনসিংহে, কিশোরগঞ্জে। লেখাপড়া কলকাতায়। শৈশব-যৌবন কেটেছে স্টেশনে, ক‍্যাম্পে, বস্তিতে। গল্প লিখে লেখালেখি শুরু। পরে উপন‍্যাস। বই আখ‍্যান পঞ্চাশ, আলিঙ্গন দাও রানি, রূপকাঠের নৌকা। অনুসন্ধানমূলক কাজে আগ্রহী। পঞ্চাশের মন্বন্তর, দাঙ্গা-দেশভাগ, নকশালবাড়ি আন্দোলন নিয়ে কাজ করেছেন। কেয়া চক্রবর্তী, গণেশ পাইন তাঁর প্রিয় সম্পাদনা। প্রতিমা বড়ুয়াকে নিয়ে গ্রন্থের কাজ করছেন চার বছর। মূলত পাঠক ও শ্রোতা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *