দ্বিতীয় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন। 
তৃতীয় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন। 

বাবু কলকাতার শেষ উত্তরসূরি যাঁকে বলা হয়, সেই রসিক পণ্ডিত গবেষক চিন্তক এবং বুভুক্ষু পাঠক শ্রী রাধাপ্রসাদ গুপ্ত ওরফে আরপি ওরফে শাঁটুলবাবু পা দিলেন শতবর্ষে। ১৯২১ সালের ১৪ ডিসেম্বর তাঁর জন্ম। তাঁর লেখক পরিচয়টি মুখ্য নয়, কারণ বই লিখেছেন মাত্র তিনটে– কলকাতার ফিরিওয়ালার ডাক ও রাস্তার আওয়াজ, মাছ ও বাঙালি, স্থান-কাল-পাত্র। তাঁর কোন পরিচয়টি যে মুখ্য, তা নিয়ে আজও মাথা খুঁড়ে চলেছে বাঙালি। তিনি আড্ডাকে নিয়ে গিয়েছিলেন শিল্পের পর্যায়ে। তিনি ছিলেন বই ও শিল্পের সংগ্রাহক এবং কলকাতা শহরের ইতিহাস ঘেঁটে চলা একজন ‘ক্রনিকলার’। তাঁকে ঘনিষ্ঠভাবে দেখেছেন আর এক বিশিষ্ট বাঙালি সাংবাদিক-সাহিত্যিক শংকরলাল ভট্টাচার্য। তিনি লিখছেন তাঁর শাঁটুলদার কথা। আজ প্রথম পর্ব। 

রাধাপ্রসাদ গুপ্তকে চার-চারটে নামে ডাকত, চিনত বাঙালি। প্রথমত, অবশ্যই, রাধাপ্রসাদ গুপ্ত নামে, যাতে ওঁর বাংলা লেখাপত্তর, লেখা বই, গবেষণাদি পড়া হত। দ্বিতীয়ত আর পি গুপ্ত, যে নামে ওঁর ইংরেজি লেখালেখি বের হত, যে নামে টাটা স্টিলে পাবলিক রিলেশনস ম্যানেজারের কেতাবি চাকরি করেছেন এবং মস্ত মস্ত দেশি-বিদেশি মানিগণ্যিরা ওঁকে চিনতেন, জানতেন, উল্লেখ করতেন। তৃতীয়ত শুধু আর পি, যেভাবে ওঁর বন্ধুবান্ধব, ইয়ারদোস্ত, সহকর্মী, সহমর্মী, সহযোগীরা ওঁকে উদ্দেশ করতেন আর ওঁকে নিয়ে বলতেন। এবং চতুর্থত শাঁটুল, যা ওঁর ডাকনাম এবং ঘনিষ্ঠরা আদর ও সমাদরে ডেকে ডেকে, বলে বলে (সংগীত ও ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় তো ওঁকে এই নামেই ডেকে গেলেন ওঁর গান আর ক্রিকেট মেলানো বইয়ে) নামটাকে পাঁচকান, পাঁচঠোঁট করে দিলেন। 

আর এই চার নামে, ডাকে ‘কলকাতার ফিরিওয়ালার ডাক আর রাস্তার আওয়াজ’-এর ডাকসাইটে লেখক এক অপূর্ব ব্যক্তিত্ব হয়ে আশি বছরের (১৯২১-২০০০) দুরন্ত জীবনটা দিব্যি কাটিয়ে গেলেন ওঁর প্রাণের শহর, ধ্যানের শহর কলকাতায়। যে-কলকাতার পথঘাট ঘুরে ঘুরে, পাঠাগারে পাঠাগারে ঢুঁ মেরে, বই ঘেঁটে, ছবি ঘেঁটে প্রায় নিজের এবং সবার জন্য কিছুটা কিছুটা পুনরাবিষ্কার করলেন শহরটাকে। ফলত একসময় ‘আর পি’ বলতে কলকাতা আর কলকাতা চেনাতে ‘আর পি’ বোঝাতে লাগল। কলকাতার তিনশো বছর উদযাপনে কী টানামানি খেলা বেচারি নম্রস্বভাব পণ্ডিতকে নিয়ে। আজ এখানে লেখা, কাল ওখানে লেকচার, পরশু সেখানে ফিতে কাটা। ওঁর অনুরাগী আমরা আদরের ঠাট্টায় বলতাম, এ তো আর পি-রই ট্রাইসেন্টেনারি!

সেই রাধাপ্রসাদ গুপ্ত ১০০-য় পড়ছেন ১৪ ডিসেম্বর। যাঁরা ওঁর নিজস্ব লাইব্রেরির বই ছুঁয়ে দেখেছেন, তাঁদের কাছে এই একশো কোনও সংখ্যাই নয়। যে কোনও বই নামালেই চমকে উঠতে হয়। একশো, সোয়াশো, দেড়শো, দুশো বছরের পুরনো সংস্করণ সব। অথচ ধুলোধূসর নয়। ঝাড়পোঁছ, নতুন বাঁধাই মোহ্যার লেদারে মোড়ানো অনেক কিতাবই একেবারে কেতাবি চালে সংরক্ষিত। শাঁটুলদা বলতেনও, 
– বইয়ের যত্ন করা বই পড়ার চেয়ে কিছু কম এক্সারসাইজ নয় গো। বই পড়ে বুঝতে না পারলে তাকে তুলে রাখা যায়। তবে তার যত্নআত্তিতে ঢিলে দেওয়া যায় না। 

At his drawing room - Sanjeet
যাঁরা ওঁর নিজস্ব লাইব্রেরির বই ছুঁয়ে দেখেছেন, তাঁদের কাছে এই একশো কোনও সংখ্যাই নয়। ছবি সৌজন্য: সঞ্জিৎ চৌধুরী

বলতে বলতে হয়তো ওঁর কালেকশানের ফার্স্ট এডিশন ‘দ্য পিকউইক পেপার্স’ নামিয়ে দেখালেন। কোথায় কত দরদাম করে কিনেছেন শোনালেন, প্রথম প্রকাশের বছরটা দেখালেন, তারপর একটা অসাধারণ জায়গা থেকে সমানে মুখস্থ বলে যেতে লাগলেন। বই আমার হাতে ধরা, যেখান থেকে বলছেন সেই পাতাও খোলা, আর মন থেকে গড়গড় করে বলে যাচ্ছেন আর পি, যেন বই উনিই পড়ছেন। ‘দ্য পিকউইক পেপার্স’ ছাড়া সের্ভান্তেসের ‘দন কিহোতে’ থেকেও ওঁকে গজগজ মুখস্থ বলতে শুনেছি। কারণ দুটি বই-ই অতি রসময় এবং ওঁকে নাকি রসেবশে রাখে। আর বলেই বলতেন,
রামকেষ্টর এই কথাটা ইদানীং বড্ড মুখে চলে আসে। বেড়ে কথা গো।
কথা শেষ করে দু’পাত্তর রাম ঢেলে জল মিশিয়ে বললেন,
– নাও খাও গো; কথামৃত পড়ে দেখো গিরিশকে কীভাবে রসেবশের মন্তর দিতেন। ওঁকে গুরু মানো আর নাই মানো ওঁর শিক্ষে তোমায় নিতেই হবে।

ডিকেন্স থেকে সের্ভান্তেস হয়ে রামকৃষ্ণদেব— শাঁটুলবাবুর এই কথার চলন অনায়াসে বুঁদ করত শ্রোতাকে। কথায় কথায় ট্যাঁকঘড়ি বার করে দেখানোর মতো পণ্ডিতি চাল নয়; তুলনা খুঁজতে, উপমা দিতে, আইডিয়ার সাজুয্য বোঝাতে ভদ্রলোক বই থেকে বই, লেখক থেকে লেখক, চিন্তা থেকে চিন্তায় ছড়িয়ে পড়তেন। সত্যি বলতে কী, raconteur বলতে যা বোঝায় তাঁর এক অসাধারণ নমুনা ছিলেন আর পি। যে কোনও বিষয়ে অসাধারণ সব অ্যানেকডোট শোনানোর ক্ষমতা ধরতেন। কাজেই ওঁর সঙ্গে ঘণ্টা দেড়-দুই সময় কাটালে দু’চারটে নতুন জিনিস না শিখে ফেরা ছিল না।

RPG in Paris
প্যারিসে শাঁটুলদা। ছবি সৌজন্য: উত্তরা ঘোষ ও গার্গী গুপ্ত

যেমন একবার প্যারিস নিয়ে কথা হচ্ছে, উনি জিজ্ঞেস করলেন,
প্যারিসের ওভেল দ্য ভিল বা টাউন হলটা ভাল করে দেখেছ? 
বললাম, 
– হ্যাঁ। ওর কাছেই তো আমাদের জার্নালিজ়মের কলেজ ছিল। আর ওর সামনেই কাফেতে কফি নিয়ে বসা হত।
– বাহ্, তাহলে তো টাউন হলের মাথায় সারি দিয়ে দাঁড় করা বিখ্যাত সব ফরাসিদের মূর্তিগুলোও নজর করেছ?

In Paris with his wife Moni Gupta
প্যারিসে, স্ত্রী মণি গুপ্তের সঙ্গে। ছবি সৌজন্য: উত্তরা ঘোষ ও গার্গী গুপ্ত

যেই বললাম ‘হ্যাঁ’ অমনি শাঁটুলদা শুরু করলেন, 
– আরে ওই রকম একটা কাফেতে বসে স্ট্যাচুগুলো আইডেন্টিফাই করছিলাম। দারুন দারুন ঐতিহাসিক ক্যারেক্টার সব। তার মধ্যে মার্ভেলাস ওই ছোকরাটাও আছে। 
জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘কার কথা বলছেন?’’ 
– আরে ভিক্তর জাকমঁ। মাত্র একত্রিশ বছর বয়সে মরে গেল ছোকরা। প্যারিস থেকে বটানিস্ট হিসেবে ভারতের গাছপালা নিয়ে চর্চা করতে এদেশে এল। এসে পঞ্জাব, তিব্বত, লাহোর, কাশ্মীর সব ঘুরে বেড়ালো। এমনকী কলকাতাতে এসে নেমেছিল। গাছপালা, ফুল বাগিচা নিয়ে তো রিসার্চ করলই, পাশাপাশি ভারতের লোকজন, রাজারাজড়া নিয়ে কী অপূর্ব সব চিঠি লিখে পাঠাত দেশে। লাহোরে দেখা করেছিল রাজা রঞ্জিত সিংহের সঙ্গে। সেই সব করেসপন্ডেস ‘লেটার্স ফ্রম ইন্ডিয়া’ বলে বেরিয়েছিল। কী যে আরাম হয় পড়লে! ছবির মতো। এখানকার ইতিহাসের সিলেবাসে কেন যে ঢোকায় না কে জানে! প্যারিস কিন্তু ওদের ছেলেকে ভোলেনি। দেশের সব হিরোদের পাশে বসিয়ে দিয়েছে। তবে এত সত্যি যে এখনকার ফরাসি ছেলে-ছোকরারাও ভিক্তর জাকমঁর নাম শোনেনি বড় একটা।

সত্যজিৎ রায় বা বসন্ত চৌধুরীর মধ্যে যেটা সর্বক্ষণ নজরে আসত, সেটাই বেশ বড়রকমে ছিল রাধাপ্রসাদের মধ্যে— বাঙালিয়ানা আর সাহেবিয়ানার এক জম্পেশ মিশেল। সত্যজিৎবাবু যেমন পাজামা-পাঞ্জাবিটাকে বাড়ির পোশাক করে রেখে গেলেন চিরকাল, বসার ঘরের প্রিয় পরিধান। আর সেই পোশাকেই সেরার সেরা ইংরেজি ডিকশনে মোৎসার্ট, বেঠোফেন কি আইজেনস্টাইন নিয়ে ডিটেলে ব্যাখ্যা করলেন। তেমনি ‘মাছ আর বাঙালি’-র লেখক রাধাপ্রসাদের সঙ্গে আকাশবাণীতে প্রোগ্রাম রেকর্ড করে বেরিয়ে ট্যাক্সি ধরব, যখন বুশ শার্ট, ট্রাউজার্স আর হাতের ছাতাকে ওয়াকিং স্টিকের মতো ধরে ফিটফাট শাঁটুলদা বললেন, 
– ট্যাক্সি বাদ দাও। চলো গঙ্গার ধারের গুমটির থেকে ট্রাম ধরে ফিরি, দেখি শহরটার কী হাল হল। 

ট্রামগুমটি তো বাবুঘাটের উল্টো ফুটে। সেখানে পৌঁছে শাঁটুলদা বললেন,
– এত কাছে এলাম যখন বাবুঘাটটাও ঘুরে যাই।
সেখানে গিয়ে বাঙালি সাহেব শুরু করলেন রামকৃষ্ণদেবের কথা। বললেন,
– ভাবো তো এই গঙ্গায় স্টিমারে করে যেতে যেতে রামকেষ্ট কীরকম ভক্তি আর বিশ্বাসের কথা শোনালে কেশব সেন আর ওঁর ব্রাহ্ম সাঙ্গপাঙ্গদের। সব্বাই বুঁদ হয়ে শুনছে আর রামকেষ্ট নিজেও নিজেতে বুঁদ হয়ে ওই সব কথা কইছেন। একবার চলো রামকেষ্টর কথামৃত পড়তে পড়তে স্টিমারে চড়ে গঙ্গা বেড়াই।

With Mulk Raj Ananad at his residence sanjeet
শাঁটুলদার পরম সুহৃদ মূলক রাজ আনন্দের সঙ্গে। ছবি সৌজন্য: সঞ্জিৎ চৌধুরী

সেদিন ট্রামে করে গড়িয়াহাট ফিরতে ফিরতে রাধাপ্রসাদ কার্যত রামকৃষ্ণ (ওঁর বুলিতে রামকেষ্ট) হয়ে গেলেন। কী সুন্দর বলে যাচ্ছেন কলকাতার রাস্তাঘাট, বাড়িঘরদুয়োর, ময়দান, গোরা সাহেবদের ক্রিকেট হকি ফুটবলের গল্প, খালাসিটোলার বাংলা মদের ঠেক, রিপন স্ট্রিট, রয়েড স্ট্রিটের অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের নিয়ে। আমি বুঁদ হয়ে ওঁর কলকাতা কথামৃত শুনেছি। একসময় রাস্তার ভিড় দেখে বললেন,
– আগের সেই ফাঁকা ফাঁকা ভাবটা চলে গেল। বড্ড গ্যাঞ্জাম করে দিলে গা। ডক্টর জনসন বলতেন না?— সে লন্ডনের রাস্তায় হাঁটে না, সে লন্ডন চেনে না। মস্ত খাঁটি কথা। আমরাও তো স্যান্ডেল ফাঁসিয়ে, জুতোর সুকতলা খসিয়ে হেঁটে বেড়িয়েছি কলকাতা। তবে সে কলকাতা হেঁটে মারার শহরই ছিল। টিকিট কেটে মেট্রো সিনেমার ফয়ারে দাঁড়ালে ভাবতাম লন্ডন এসে গেছি।

শাঁটুলদার সঙ্গে কথামৃত পড়তে পড়তে স্টিমার চড়া হয়নি ঠিকই, তবে ‘জলসাঘর’ নামের সাংগীতিক প্রতিষ্ঠানের হয়ে ‘গঙ্গাবক্ষে জলসাঘর’ নামক অনুষ্ঠানে ওঁকে প্রধান অতিথি করে নিয়ে যেতে পেরেছিলাম। সারাদিন স্টিমারে করে গঙ্গায় ভেসে সে ছিল এক অপূ্র্ব কবিতা গদ্যপাঠ ও গানের আসর। সভাপতি ছিলেন সন্তোষকুমার ঘোষ। শাঁটুলদা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন ওঁর বন্ধু ইংরেজি ভাষার ঔপন্যাসিক মূলকরাজ আনন্দকে, যিনি ইংরেজি একটি গল্প পড়লেন। কবিতা পড়লেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, দাউদ হায়দার। শাঁটুলদা ওঁর ভাষণে সাহেবদের বর্ণনায় কলকাতার পাশ দিয়ে বয়ে চলা গঙ্গার বর্ণনা শোনালেন। শেষে পকেটে করে নিয়ে আসা, ওঁর পরম বন্ধু কমলকুমার মজুমদারের লেখা গঙ্গা বিষয়ে প্রবন্ধটা পড়ে শোনালেন।   (চলবে)

Sankarlal Bhattacharya Author

শংকরলাল ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট, কলকাতায়। ইংরেজি সাহিত্যে স্বর্ণপদক পাওয়া ছাত্র শংকরলাল সাংবাদিকতার পাঠ নিতে যান প্যারিসে। তৎপরে কালি-কলমের জীবনে প্রবেশ। সাংবাদিকতা করেছেন আনন্দবাজার গোষ্ঠীতে। লিখেছেন একশো ত্রিশের ওপর বই। গল্প উপন্যাস ছাড়াও রবিশংকরের আত্মজীবনী 'রাগ অনুরাগ', বিলায়েৎ খানের স্মৃতিকথা 'কোমল গান্ধার', হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিমালা 'আমার গানের স্বরলিপি'-র সহলেখক। অনুবাদ করেছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা থেকে সত্যজিৎ রায়ের চিত্রনাট্য পর্যন্ত।

2 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *