বসন্ত ব্যাপারটা এখন যেন বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গেছে। বসন্ত নিয়ে এত আহ্লাদ করার কী আছে বোঝা দায়! বসন্তের শুরুটা তো এখন হয়ে যায় ভ্যালেন্টাইনস ডে-র অহেতুক আদিখ্যেতা দিয়ে। প্যাচপ্যাচে প্রেম, অতি মিষ্টির ঠেলায় গা গুলোতে থাকে। সেই শুরু ন্যাকা বসন্তের। তার হাওয়া, তার গন্ধ, তার রোদেলা দিন, তার গাছের কচি কচি পাতা, প্রতি বছর তার উঠতি প্রেমিকযুগল, সব সঅঅঅব সহ্য করতে হয়।

উঠতিদের কাছে যাহা কাঙ্ক্ষিত, তা তিরিশোর্ধদের কাছে বুক চিনচিন, আর মধ্য চল্লিশের কাছে রাগের কারণ। উঠতিদের বসন্ত-হরমোন বেগে বয়। তখন, চরাচরের প্রতি খেয়াল না রাখলেও চলে। তখন গন্ধমাখা বসন্তের বাতাসে এলোমেলো চুলই মন ভুলিয়ে দিতে যথেষ্ট। সুতরাং তাদের কাছে কোনটা বসন্ত আর কোনটা প্রেম, তা বোঝার সময় বা ইচ্ছে কোনওটাই থাকে না। বসন্তের ভেক ধরে প্রেম আসছে না প্রেমের পূর্বরাগ হয়ে বসন্ত আসছে, তা যাচাইয়ের প্রশ্নই ওঠে না। তিরিশ পেরোনোর পর চাকরি, কখনও কখনও সংসার-ধর্ম, গুচ্ছের দায়িত্ব সামলে “মাঝে মাঝে তব দেখা পাই” মডেলে বুড়ি ছুঁয়ে আসা যায়, ছুঁয়ে আসা চাই। সে ভাবেই বসন্ত টিঁকিয়ে রাখা জীবনে। তখনও মন অফিসে-ফেরতা বিকেলে আটকা পড়ে যায়, তখনও বাস থেকে পুরনো দেখা করার জায়গা পেরিয়ে গেলে মন চিনচিন করে ওঠে। তখনও বাড়িতে এটা-ওটা বলে এক দিন প্রেমিক-যুগল, যারা কিনা অধুনা দম্পতি, এমনি এমনি হাতে কাঠি আইসক্রিম নিয়ে খিলখিল করে হেসে ওঠে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফুচকা খায়। মনে বসন্ত ঈষৎ চাঙ্গা হয়।

এ তো গেল বসন্তকে পাওয়া-না-পাওয়ার আখ্যান। উঠতিরা সব সময় মিস করে, মাঝারিরা মাঝে মাঝে দেখা পায়। তাই এই দুই পক্ষের কাছে বসন্তের খুব কদর। কিন্তু বসন্ত নিজে ফাঁপরে পড়ে যায় চল্লিশ পেরনোদের কাছে। একেবারে জব্দ যাকে বলে। এই বিশেষ স্পিশিজ়টি বসন্তকে একেবারে জাপটে ধরে রাখতে চায় এবং তা সব সময়। মিড-লাইফে পৌঁছে তাদের শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা-হেমন্ত, কোনও জ্ঞানই থাকে না। তারা কেবল চোখে-নাকে-মুখে এমনকী শরীরেও বসন্তকে ধরে রাখতে চায়। আর বিড়ম্বনা সেখানেই। বসন্ত রিটার্ন টিকিট কেটেই এসেছিল, কিন্তু এখন তার মহাবিপদ। নানা অছিলায় তার যাওয়া ক্যানসেল করতে চায় এই গোষ্ঠী। কখনও পরকীয়ায় আঁচিয়ে নিতে চায়, কখনও বোটক্স ট্রিটমেন্টের দ্বারস্থ হয়। কখনও সোলো ট্রিপের বাহানায় নিজেকে ও বসন্তকে খোঁজার অছিলা করে। কখনও দেদার আড্ডায় তরুণীর চোখ টানার আপ্রাণ চেষ্টা, যা শেষ অবধি ব্যর্থই যায়। আর সেই না পাওয়া, ব্যর্থতা আর নিত্য বুকের টনটনানির রোষ গিয়ে পড়ে বেচারা বসন্তের ওপর, অন্যের জীবনে তার ঝলমলে বেপরোয়া আনাগোনা তখন আদিখ্যেতার খেতাব পায়।

আর ঋতুরাজ! সে তার কোয়ালিটি কম্প্রোমাইজ না করে ফি-বছর একই রং-রূপ-গন্ধ পেশ করে চলে একই ঘরানায়, একই তীব্রতায়। আসলে আধার বদলায় কিনা, তাই বসন্তও বদলে যায়। যে নিজের মতো করে ধরে রাখতে পারে, বসন্তের কেল্লাও তার, ফতে ও তার। অন্যরা তো কেবল সেপাই মাত্র।

সঞ্চারী মুখোপাধ্যায় হাসিখুশি, এমনকী যখন সেই মোড-এ থাকেন না, নিজেকে ঠেলে হিঁচড়ে হিহিহোহো’তেই ল্যান্ড করানোর চেষ্টা করেন। জাপটে ভালবাসেন আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, সিরিয়াল, গান, রাস্তায় নেড়িবাচ্চার লটরপটর কান। পড়াশোনার সময় ফিল্ড করেছেন, হাতুড়ি দিয়ে পাথর ভেঙেছেন, গ্রামবাসীদের তাড়া খেয়েছেন, এক বার পাহাড় থেকে অনেকটা হড়কে পড়ে মুচ্ছো গেছিলেন, উঠে দেখেন, কবর! এক বার ম্যানেজমেন্ট কোর্সের অঙ্গ হিসেবে চিন গেছিলেন, রাত্তির দুটোয় সাংহাইয়ের রাস্তায় হারিয়ে গিয়েও কাঁদেননি। ফিউজ সারাতে পারেন, পাখার কার্বন বদলাতে পারেন, কাগজের চোঙ পাকিয়ে গাড়িতে পেট্রল ঢালতে পারেন, চিনেবাদাম ছুড়ে দিয়ে মুখে নিপুণ লুফতে পারেন। ব্যাডমিন্টন খেলার ইচ্ছে খুব, কিন্তু জায়গা ও র‌্যাকেট নেই। অরোরা বোরিয়ালিস যারা দেখেছে, তাদের একাগ্র ভাবে হিংসে করেন। দেশের বাড়িটা উনি বড় হওয়ার পর ছোট হয়ে গেছে বলে, আর আমির খান এক বার কার্টুন এঁকে দিয়েছিলেন— সে কাগজ হারিয়ে গেছে বলে, জেনুইন কষ্ট পান। এক বার ঈগলের রাজকীয় উড়ান আগাগোড়া খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *