সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের শ্বশুরমশাই চন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় আমার মা-বাবার চেয়ে বয়সে বড় হলেও ছিলেন বন্ধুস্থানীয়। ওরকম সুপুরুষ খুব কমই দেখা যায়। জামাই সৌমিত্রর থেকে কোনও অংশে কম ছিলেন না দেখতে। সেই সুবাদেই দীপা চট্টোপাধ্যায়কে খুব ছোটবেলা থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল। যতদূর মনে পড়ে ওঁদের লেক টেম্পল রোডের বাড়িতেই দীপামাসিকে প্রথম দেখি। তবে সেই সময় অবশ্য আমার প্রধান আকর্ষণ ছিল সোনার কেল্লার ফেলুদা অর্থাৎ সৌমিত্রকাকুকে সামনে থেকে দেখা।

আরও অনেকগুলো যোগসূত্রেই তাঁদের পরিবারের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ বা সম্পর্ক। আমার দাদু অপূর্বকুমার মৈত্রের সঙ্গে কৃষ্ণনগর বা দার্জিলিংয়ে সৌমিত্রকাকুর বাবা মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের বন্ধুত্ব ছিল।

C N Chatterjee
দীপামাসির বাবা শ্রী চন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় যিনি সি. এন চ্যাটার্জি নামেই পরিচিত ছিলেন

লেক টেম্পল রোডের বাড়ির খুব কাছেই থাকতেন দীপামাসির বাবা চন্দ্রনাথবাবু। সার্দান অ্যাভেন্যুর ওপরেই ছিল ফ্ল্যাট। নিজেদের নয়, কর্মসূত্রে থাকতেন ওখানে। শুনেছি তারও আগে থাকতেন আমাদেরই এক আত্মীয়র বাড়িতে সি. আই. টি রোডে। সেই ফ্ল্যাটে প্রায়ই সন্ধেবেলায় মা-বাবার সঙ্গে যাওয়া হত। মাঝে মধেই সেখানে দীপামাসিরা ছাড়াও আসতেন তাঁর অন্যান্য ভাই-বোনেরা। সেই বয়স থেকেই দেখেছি, খুব দরাজ মনের মানুষ ছিলেন দীপামাসি। আমাকে খুব স্নেহ করতেন।

বেশ কয়েক বছর বাদে ইন্ডিয়ান অক্সিজেনের চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পরে মিস্টার চ্যাটার্জী (দীপামাসির বাবাকে ওই নামেই আমার বাবা-মা সম্বোধন করতেন) চলে যান সল্টলেকের নিজস্ব বাড়িতে। ছোটবেলাতেই মার কাছে শুনেছিলাম দীপামাসি খুব ভাল ব্যাডমিন্টন খেলতেন। ব্যাডমিন্টনে রাজ্য চ্যাম্পিয়নও হয়েছিলন।

খেলার পাশাপাশি দীপামাসি সুচিত্রা মিত্রর ‘রবিতীর্থ-তে গানও শিখতেন। মায়ের মুখে শুনেছি, রোজ গানের ক্লাস শেষ হলে সৌমিত্রকাকু যেতেন দীপামাসিকে আনতে। সেই সময় চলছিল ওঁদের প্রেমপর্ব।

আমার কৈশোরে মাসির বাপের বাড়ির অনেক সামাজিক অনুষ্ঠানেই গিয়েছি। সেই সব অনুষ্ঠানে দেখেছি এক আন্তরিক দীপামাসিকে। দেখেছিলাম ওঁদের ছেলে বুবুদা আর মেয়ে মিটিলদিকে। পরবর্তীকালে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করার পরে এক নতুন সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল আমার কাজকে ঘিরে। ততদিনে ওঁরা চলে এসেছেন নিজেদের গল্ফগ্রিনের বাড়িতে।

Soumitra and Deepa Chatterjee with children
দুই ছেলেমেয়ে (নীচের সারিতে) ও সৌমিত্র-দীপা

প্রায়ই বিভিন্ন কাজে, কারণে, অকারণে সৌমিত্রকাকুর কাছে গিয়ে নানা কথা আলোচনা করে চলে আসতাম। পরে দীপামাসির সঙ্গে দেখা হলে অনুযোগের সুরে বলতেন, ‘তুই তো খালি তোর কাকুর সঙ্গে কাজ করে চলে যাস, কিছু খাসও না।’ তখন আবার বসিয়ে খাওয়াতেন। আমাকে জিজ্ঞাসা করতেন মা-বাবার কথা। মা মাঝে-সাঝে কিছু রান্না করলে আমার হাত দিয়ে মাসিকে পাঠিয়ে দিত।

যোগাযোগ আরও বেড়ে গেল যখন আমার কন্যা মিটিলদির কাছে নাচ শিখতে শুরু করল। সৌমিত্রকাকু নিয়মিত মিটিলদির কাছে খোঁজ নিতেন ও কেমন শিখছে। আমাকে বলতেন, ‘মিটিল প্রায়ই বলে অরিজিতের মেয়ে কিন্তু খুব ভাল নাচে, ও যদি সিরিয়াস হয়, তাহলে আরও উন্নতি করবে।’

Soumitra and Deepa Chatterjee family pic
সপরিবার সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

মনে আছে সৌমিত্রকাকুর বেশ কয়েকটি জন্মদিনে মিটিলদি আমাদের তপন সিংহ ফাউন্ডেশনকে দায়িত্ব দিয়েছিল অনুষ্ঠানে সহযোগিতা করার জন্য। তখন ওঁদের বাড়িতে যাওয়া আরও বেড়ে যায়। সেই দিনগুলোতে আমাকে দেখতে পেলে ডেকে অনেক গল্প করতেন এবং নানারকম পুরনো পারিবারিক কথা বলতেন। আমার ব্যক্তিগত জীবনের ওঠাপড়া নিয়েও চিন্তিত ছিলেন। মায়ের সঙ্গে সেই নিয়ে ফোনেও কথা বলতেন।

কিন্তু নাতি রণজয়ের দুর্ঘটনাটা দীপামাসি কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি। ওঁর শরীর বেশি করে ভাঙতে শুরু করে। শেষ বছরগুলিতে খুব কমই বেরতে পারতেন। আমার চোখে দীপামাসি ছিলেন একজন নিপাট, সহজ, সরল, সোজা কথার মানুষ। স্পষ্টবাদী ছিলেন। কোনও অন্যায় দেখলে সোজাসুজিই বলে দিতেন। স্বামীর সাফল্যে তৃপ্তি পেতেন, গর্বিতও হতেন। কিন্তু কোনও মেকি অহংকারের আবরণ তৈরি করে নিজেকে আড়াল করে রাখেননি কখনও।

Soumitra and Deepa Chatterjee with grandchildren
দুই নাতি নাতনির সঙ্গে দাদু দিদা

অনেকেই হয়তো জানেন না, সৌমিত্রকাকু পরিচালিত অনেক নাটকের জন্য বিদেশি সাহিত্য অনুবাদ করেছেন দীপামাসি। ‘এক্ষণ’ পত্রিকা সম্পাদনা করার জন্য স্বামীকে অনুপ্রাণিত করেছেন। গ্ল্যামারের আড়ালে থেকেছেন সৌমিত্রজায়া হয়ে। নিজের কোনও গুণ বাইরে কোনওদিনও জাহির করেননি। জনপ্রিয় নায়কের ঘরনী হয়ে সংসার সামলেছেন, মানুষ করেছেন ছেলে-মেয়েকে। পাশাপাশি বাগান করা, ঘর সাজানোয় ছিল বিশেষ নৈপুণ্য। সৌমিত্রকাকুকে অনেক সাক্ষাৎকারে বলতে শুনেছি যে ‘দীপা চট্টোপাধ্যায় আমাদের বাড়ির অভিভাবক।’

দীপামাসির শখ ছিল নানা দেশের বুল সংগ্রহ করার। গল্ফগ্রিনের বাড়ির একটি ঘরে এখনও হয়তো শোভা পাচ্ছে কাচের আলমারিতে রাখা দেশি-বিদেশি নানান ধাতুর বুল। এই সংগ্রহের সঙ্গে কিন্তু কোনও সংস্কার জড়িয়ে ছিল না। শুধুমাত্র শখের কারণেই ছিল এই সংগ্রহ। তাঁর সেই সংগ্রহকে বিশেষ মূল্য দিতেন সৌমিত্রকাকু। কাচের আলমারির চাবি রেখে দিতেন নিজের কাছে।

বয়স অনেক হলেও করোনায় আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হতে হতেও আরও বেশি অসুস্থ হয়ে প্রায় হঠাৎই চলে গেলেন সৌমিত্রকাকু। তারপর থেকে বোধহয় জীবনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলেন মাসি। বয়সজনিত কারণে অসুস্থ থাকলেও সৌমিত্রকাকু চলে যাওয়ার মাত্র সাড়ে চার মাসের মধ্যে যে দীপামাসিও চলে যাবেন, এ কথা এখনও ভাবতে কষ্ট হয়।

শেষ কয়েকটা মাস বয়ে বেড়িয়েছেন নিজের বিরহ-বেদনা। তপন সিংহ ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত ক্যালেন্ডারটি তাঁর হাতে দিলে পাতা উল্টিয়ে কাকুর সঙ্গে নিজের অদেখা ছবি দেখে নীরবে চোখ মুছেছেন। অবশ্য সেই বিরহ তাঁকে খুব বেশিদিন বয়ে বেড়াতে হল না।  কয়েক মাসের মধ্যেই অন্য কোথা, অন্য কোনওখানে মিলিত হলেন সৌমিত্রকাকুর সঙ্গে। পেছনে পড়ে থাকল অনেকগুলো বছরের অসংখ্য স্মৃতি আর ছেলেমেয়েরা।        

 

*সব ছবি লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে 

অরিজিৎ মৈত্র পেশায় সাংবাদিক। দৈনিক যুগশঙ্খ পত্রিকায় সিনিয়র সাব-এডিটার পদে কর্মরত। তপন সিংহ ফাউন্ডেশনের সম্পাদক অরিজিৎ পুরনো কলকাতা নিয়ে চর্চা করতে ভালবাসেন। নিয়মিত লেখালিখি করেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। প্রকাশিত বই: অনুভবে তপন সিনহা, ছায়ালোকের নীরব পথিক বিমল রায়, চিরপথের সঙ্গী - সত্য সাঁই বাবা, বন্দনা, কাছে রবে ইত্যাদি।

2 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *