বিশুর ছেলেবেলার বন্ধু গয়লাপাড়ার ভগবান মারিক। পাড়ার লোকে জগাইমাধাই বলে ডাকত ওদের। রোজ সন্ধেবেলা কীর্তন শুরু হলেই এসে বসত দাওয়ায়। আর আসতো মেঘা। মেঘা শেখ। মুসলমান পাড়ার ছেলে। এসে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকত দাওয়ার সামনে। চোখে পড়ামাত্র উঠে গিয়ে হাত ধরে দাওয়ায় তুলে আনত বিশুর মা সুশীলা।
— ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন রে হতভাগা? আয় আয়। বোষ্টমের আবার জাত কী রে? নিমাইয়ের থানে সবাই এক।
কীর্তন শেষে হরির লুঠ। “পরাণ আনন্দে বল সবে হরি হরি…জয় গোবিন্দ জয় গৌর…” বলে থালা থেকে দাওয়ায় বাতাসা ছুড়ে দিত মা। ভাইবোনদের সঙ্গে কাড়াকাড়ি করে খেত তিন বন্ধু। কীর্তন, নামগান, বাবা, মা, ভাইবোন, বন্ধুরা… চূর্ণীর জলের মত বয়ে যাচ্ছিল সময়। দেখতে দেখতে ষোলোয় পা দিল বিশু। সুঠাম টান টান চেহারা। উজ্জ্বল শ্যাম গায়ের রং। একমাথা ঝাঁকড়া চুল। বড় বড় দু’টো মায়াটানা চোখ। টিকালো নাক। চওড়া কবজি আর হাতের পাঞ্জা। মা আদর করে ডাকত কেষ্ট ঠাকুর। পাড়াপড়শিরা বলত- ‘কানাই সর্দার মরে সুশীলার পেটে জন্ম নিয়েছে।’ সব মিলিয়ে ভালোয় মন্দয় কেটে যাচ্ছিল দিনগুলো। ঘরে অভাব থাকলেও শান্তি ছিল।
এরই মাঝে কোথাও যেন তাল কেটে যাচ্ছিল হঠাৎ হঠাৎ। কারণ, কানাইসর্দারের লাঠি। দাঁড় করানো থাকত ঘরের এক কোণে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে। গভীর রাতে ঘরের পিদিম নিভে গেলে নিশিতে পাওয়া মানুষের মত বিশুকে টানত তেলখাওয়ানো ওই লাঠিটা। বাবা মা ভাইবোন সবাই গভীর ঘুমে অচেতন। চুপিসাড়ে পা টিপে টিপে উঠে গিয়ে ঠাকুরদার ওই লাঠিটায় হাত ছোঁয়াত বিশু। ছোঁয়ামাত্র সারা শরীর জুড়ে শিহরণ খেলে যেত কেমন একটা। যেন একটা কিছুর ভর হয়েছে শরীরে। ঘোর ঘোর ভাব… মুহূর্তে উধাও ছোট্ট কুঁড়েঘর। তার বদলে খোলা মাঠের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে বিশু… উদোম গা, মালকোঁচা মারা ধুতি। লাল ফেট্টি বাঁধা ঝাঁকড়া চুল। হাতে কানাই সর্দারের লাঠি। সারা গা দিয়ে আগুন বেরোচ্ছে যেন। এ কে? নিজেই নিজেকে চিনতে পারছে না। রাতের পর রাত এরকম চলতে চলতে খেপে গেল বিশু। একদিন ভোররাতে লাফ দিয়ে উঠে দেয়াল থেকে টেনে নিল লাঠিটা। দরজা খুলে এক দৌড়ে সোজা চূর্ণীর পাড়।
“দুর হ শালার লাঠি!” জলে ছুঁড়ে ফেলার মুখে অদ্ভুত একটা ঝাঁকুনি লাগল শরীরে। থরথর কেঁপে উঠলো বিশু। চূর্ণীর শনশন বাতাসে কে যেন বলে উঠল- “ফেলিস না বিশে! ওটা তোর নিয়তি। একদিন ওই লাঠির দাপে গোটা বাংলা চিনবে তোকে।” উন্মাদের মত ছুটতে ছুটতে বাড়ি ফিরে এসেছিল বিশু। ভোরের আলো ফোটেনি তখনও। বাড়ির পিছনে বুনো ঝোপঝাড়ের জঙ্গলে একহাত মাটি খুঁড়ে পুঁতে দিয়েছিল লাঠিটাকে। যাঃ শালা, আপদ বিদায়। এবার নিশ্চিন্তি। কিন্তু ওই যে, কথায় বলে নিয়তি! সেই নিয়তিই আর খুব বেশিদিন নিশ্চিন্ত থাকতে দিল না বিশুকে।
শীতকাল। বিকেলবেলা কুঞ্জপুরের রাসমেলা দেখতে যাচ্ছিল তিনবন্ধু। বিশু, সঙ্গে মেঘা আর ভগবান। গড়ভাতছালার পাশে আসাননগর। আলপথ ঘুরে বাঁ দিকে পড়তেই বিশাল মাঠ। “কে যায়?” দুর থেকে বাজখাই গলায় হাঁক পাড়ল কেউ। একটু এগিয়ে গিয়ে ঠাহর করতেই নজরে পড়ল হাত নেড়ে ওদের ডাকছে পাঁচকড়ি সর্দার। পাঁচকড়ি, আশপাশের দশবিশটা গাঁয়ের লোক থরথর করে কাঁপে ওর নামে। দুনিয়ার যত বাঘা বাঘা লেঠেলদের সর্দার। প্রবাদ আছে, পাঁচুর হাতে লাঠি থাকলে বাঘও নাকি ঘুরপথে অন্য রাস্তা দিয়ে চলে যায়। জমিদার আর নীলকুঠির সাহেবদের সঙ্গে খুব দহরম মহরম ওর। প্রয়োজনে ওকে ডেকে পাঠান বাবুরা। দলবল নিয়ে গিয়ে কাজ হাসিল করে দেয় পাঁচু। এগোতে যেতেই পাশ থেকে বিশুর হাত ধরে টানল ভগবান, “গিয়ে কাজ নেই বিশে, লোকটা ভয়ানক তে-এঁটলে। কে জানে কী মতলব আছে শালার মনে। তার চে’ চল তাড়াতাড়ি পা চালাই। অত দুর ছুটে এসে ধরতে পারবে না।” ভগবানের দিকে তাকিয়ে হাসল বিশে। “ধুর গাধা। নিশ্চয়ই কিছু বলবে বলেই ডাকছে। বাঘ ভাল্লুক তো আর নয়, যে খেয়ে ফেলবে।” বলতে বলতে পা বাড়াল বিশু। অগত্যা বাধ্য হয়েই পিছু নিল বন্ধুরা।
মাঠের মাঝখানে পাঁচকড়ি সর্দারের আখড়া। মাটি মেখে কুস্তির দাঁওপ্যাঁচ কষছে চার-পাঁচজন। বাকিরা লাঠি খেলছে। আখড়ার ধারে একটা অশথ গাছ। গাছের তলায় বেদিতে হেলান দিয়ে বসে আছে পাঁচকড়ি। বয়স চল্লিশের কোঠায়। ভীমকায় চেহারা। সরষের তেল মাখিয়ে দলাই মলাই করে দিচ্ছে দুই চ্যালা। পায়ের কাছে বসে ছিলিমে গাঁজা সাজছে একজন। “ঘর কোথায়?” লাল লাল চোখ দু’টো তুলে জিজ্ঞেস করল পাঁচু। “গড়ভাতছালা।” শান্ত গলায় জবাব দিলো বিশু। “নাম?” ফের প্রশ্ন করল পাঁচকড়ি। “বিশ্বনাথ বাউরি।” উত্তরটা শোনামাত্র বিদ্রূপমাখা একটা হাসি খেলে গেল পাঁচুর চোখের কোণে। “তুই নিরে বোষ্টমের ব্যাটা না? চোদ্দপুরুষের লাঠিবাজির পেশা ছেড়ে ভেকবাবাজি সেজেছে শালা।” পাঁচকড়ির কথায় হো হো করে হেসে উঠলো ওর চ্যালারা। হঠাৎই চড়াৎ করে মাথায় রক্ত চড়ে গেল বিশুর। “খবর্দার! আমার বাপকে গাল দেবে না বলে দিচ্ছি!”
শোনামাত্র বেদি ছেড়ে উঠে এসে বাঘের মতো পাঞ্জায় খপ করে বিশুর গলাটা চেপে ধরল পাঁচকড়ি। “একশোবার দেব, কী করবি তুই?” বিশাল থ্যাবড়া মুখখানা থরথর করে কাঁপছে রাগে। ঠান্ডা চোখে পাঁচকড়ির দিকে তাকাল বিশু। “গলা ছাড়ো। কথা দিচ্ছি কাল ভোরবেলা ঠিক একপ্রহরে এসে দেখা করব তোমার সাথে। আমার বাপের নাম নিরাপদ বাউরি। জীবনে কোনওদিন একটাও মিছে কথা বলেনি। আমি তার ব্যাটা বিশ্বনাথ বাউরি। নড়চড় হবে না আমার কথার।” সেদিকে তাকিয়ে পাঁচকড়ির মত পালোয়ানও একটু অবাক হয়ে গেল যেন। মুখে কিছু না বলে গলাটা ছেড়ে দিল। “চল।” বন্ধুদের নিয়ে মাঠ ধরে এগিয়ে গেল বিশু।
পরদিন ভোরবেলা। আগে থেকেই দলবল সমেত মাঠে এসে হাজির পাঁচকড়ি। শীতের সূর্য পূবপানে উঠিউঠি করছে। “কী রে, ছোঁড়াটা তো এখনও এল না?” পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ছিদাম বাউরিকে জিজ্ঞেস করল পাঁচু। ঠিক তখনই পাঁচুর আর একপাশে কালো হাড়ি আঙুল তুলে দেখাল পূবদিকে। দূরে আলপথ ধরে হেঁটে আসছে বিশু। হাতে লম্বা একটা লাঠি। পিছনে ভগবান আর মেঘা। দেখতে দেখতে এসে মাঠের মধ্যে ঢুকে পড়ল দলটা। হাতের লাঠিটা আখড়ার ঠিক মাঝখানে ছুঁড়ে দিলো বিশু। তারপর চোখ তুলে তাকাল পাঁচকড়ি সর্দারের দিকে। “এটা আমার ঠাকুরদা কানাই সর্দারের লাঠি। কাল রাতে মাটি খুঁড়ে বের করে এনেছি। মরদের বাচ্চা হও তো একা এসে তুলে নাও।” আখড়ার উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেল পাঁচকড়ি। একটা তিনপুটকে ছেলে। দুধের চোঁয়া কাটেনি মুখ থেকে। এত্তবড় সাহস! পাঁচকড়ি সর্দারের মহড়া নিতে চাইছে?
বিস্ময়ের ঝটকাটা কাটতে সময় নিল বেশ কিছুক্ষণ। বিশুর চোখে তাকিয়ে ক্রুর একটা হাসি হাসল পাঁচকড়ি। “প্রথমেই বাঘের সঙ্গে লড়তে চাইছিস? কিন্তু বাঘের সঙ্গে লড়তে গেলে যে আগে বাঘের বাচ্চার সঙ্গে মহড়া নিতে হয় বাপ। বলেই ঘুরে গিয়ে গর্জন ছাড়ল- “মেগাই!” ভিড় ঠেলে এগিয়ে এল মেগাই সর্দার। জ্ঞাতিসম্পর্কে পাঁচু সর্দারের ভাগ্নে। পাল খাওয়ানোর ষাঁড়ের মত চেহারা। মিশকালো গায়ের রঙ। ইয়া চওড়া বুকের আড়া। ঘাড় থেকে পিঠের মাঝ বরাবর টানা একটা সড়কির দাগ। কাঁধ আর হাতের গুলি পাকানো পেশিগুলো শরীর ফেটে বেরতে চাইছে যেন। পাঁচকড়ির দিকে তাকিয়ে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল মেগাই- “শেষ অবধি বোষ্টমের ব্যাটার সঙ্গে লড়তে হবে মামু। পাইক সর্দারের জাতধম্মো বলে কিছু রইল না আর।” বলতে বলতে আখড়ার ধুলোর ঝড় তুলে ভীমবেগে ছুটে এল সামনে আর পরমুহূর্তেই উড়ে আসা সটান একটা জোড়াপায়ের লাথিতে ছিটকে পড়লো দশহাত দূরে। আখড়ার সবাই তো বটেই, এমনকি পাঁচকড়ি সর্দারেরও পা জোড়া যেন জমে গেছে আখড়ার মাটিতে। বিস্ময়ে ঝুলে পড়া চোয়াল। কোটর ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে বিস্ফারিত দু’টো চোখ।
কী ঘটে গেছে সেটা বুঝতেই কেটে গেল কয়েকমুহূর্ত। হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে মত্ত হাতির মত ফের ছুটে এলো মেগাই। শেষমুহূর্তে বিড়ালের গতিতে একপাশে সরে গিয়ে ধাক্কাটা এড়াল বিশু। পরমুহূর্তেই ডানহাতের পাঞ্জাটাকে খুলে কাটারির মত কোপ বসাল মেগাইয়ের কুঁদোর মত ঘাড়ে। রদ্দার ঘায়ে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ল মেগাই। ঘাড় ঘুরিয়ে পাঁচকড়ির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল বিশু। “সর্দার, অন্তরে বোষ্টম হলেও কানাই বাউরির নাতি আমি। লাঠি সড়কি আর হাত-পায়ের দাওপ্যাঁচ আমার রক্তে। জাতপেশাটা ভুলিনি এখনও। ঠাকুরদার লাঠির আগাটুকুও ছুঁতে দিইনি তোমার চ্যালাকে।” একদৃষ্টে বিশুর দিকে তাকিয়ে ছিল পাঁচকড়ি সর্দার। হঠাৎই ঝটিতি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল পাশে। টলতে টলতে উঠে দাঁড়িয়েছে মেগাই। হাতে তুলে নিয়েছে আখড়ার এককোণে পড়ে থাকা সড়কিটা। বিশুর গলা তাক করে ছুঁড়ে মারার অপেক্ষায়। “মেগাই!” বাজপড়া গলায় গর্জে উঠলো পাঁচকড়ি। সঙ্গে সঙ্গে মেগাইয়ের হাত থেকে খসে পড়ে গেল সড়কিটা। সামনে এগিয়ে গেল পাঁচকড়ি। মেগাইয়ের ঘাড় ধরে প্রবল ঝাঁকুনি দিল একটা। “বাঘের সঙ্গে বাঘের মত লড়তে হয়। ফেউয়ের মত নয়, বুঝেছিস!”
ধমক খেয়ে মাথা নিচু করে রইল মেগাই। বিশুর সামনে এসে ওর কাঁধে একটা হাত রাখল পাঁচকড়ি। “সাবাশ, অনেকদিন হয়ে গেল এই লাঠিবাজির কারবারে। কিন্তু তোর মত এরকম একটা খাপ ঢাকা তলোয়ার খুবই কম দেখেছি জীবনে। ঘরে সারাদিন তো ওই বাপের সঙ্গে ক্ষেতখামারির কাজে হাত জোগাড় দেওয়া আর সন্ধে হলে সেই ন্যাড়ানেড়ির কেত্তন…তার চে’ মাঝে মাঝে চলে আয় না আমার আখড়ায়। মারপ্যাঁচের যা তাগবাগ তোর…” দূরে তালগাছটার দিকে আঙুল তুলে দেখাল পাঁচকড়ি “একদিন ওর চাইতেও উঁচুতে ছাড়িয়ে যাবে তোর মাথা। মহাকালীর দিব্যি, এই লাঠির জোরে একদিন সাতমহলা বাড়ি হবে তোর।”
পরের পর্ব – শোণিতমন্ত্র (পর্ব ৯)
আগের পর্ব – শোণিতমন্ত্র (পর্ব ৭)
জন্ম ও বেড়ে ওঠা উত্তর কলকাতার পুরোনো পাড়ায়। বহু অকাজের কাজী কিন্তু কলম ধরতে পারেন এটা নিজেরই জানা ছিল না বহুদিন। ফলে লেখালেখি শুরু করার আগেই ছাপ্পান্নটি বসন্ত পেরিয়ে গেছে। ১৪২১ সালে জীবনে প্রথম লেখা উপন্যাস 'দ্রোহজ' প্রকাশিত হয় শারদীয় 'দেশ' পত্রিকায় এবং পাঠকমহলে বিপুল সাড়া ফেলে। পরবর্তীতে আরও দুটি উপন্যাস 'জলভৈরব' (১৪২২) এবং 'বৃশ্চিককাল' (১৪২৩) প্রকাশিত হয়েছে যথাক্রমে পুজোসংখ্যা আনন্দবাজার এবং পত্রিকায়। এছাড়া বেশ কিছু প্রবন্ধ এবং দু চারটি ছোটগল্প লিখেছেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকা আর লিটিল ম্যাগাজিনে। তার আংশিক একটি সংকলন বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে 'ব্যবসা যখন নারীপাচার' শিরোনামে। ২০১৭ সালে পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি পুরস্কার।
এই বিস্তার, বিস্তৃতি, ছোট ছোট মূর্খীয়া , এই বিবরণ, এই বয়ান , পাওয়া আজকাল বড়োই মুশকিল। এই হারিয়ে যাওয়া মনি মানিক্য কে মাটির তলায় পুঁতে রেখেছিলো কোম্পানেরও ? উফফ কি যে একটা উপন্যাস হতে চলেছে , মাইরি তুমি অনেক অনেক বড়ো হবে কি শালা , হয়ে রয়েছো। এই অসাধারণ গদ্য ছন্দ, এই টঙ্কার – এবারের তা ভোলার নয়।
Mahasoy, ami apnar lekha gulo amar sangra-hay rakhtay chai jodi aap ni anu-mati dayn