‘কিররর’- ঝোপঝাড়ের আড়াল থেকে একটানা ভেসে আসছে ঝিঁঝিঁর ডাকের আওয়াজ। শীতের সন্ধ্যে এরমধ্যেই দ্রুত নামতে শুরু করেছে গাছগাছালি, খড়ের চাল, কুয়োতালা আর মড়াইঘরের গা বেয়ে। পায়রাডাঙ্গা শ্মশানের ধারে একটা গোপন আস্তানায় গম্ভীর মুখে বসে রয়েছেন দারোগা খোদাবক্স খান। সামনে রাখা একটা লম্ফ। হাতের ছোট রুলটা দু’ আঙুলের নিপুণ ওঠানামায় চরকির মত পাক খাচ্ছে বনবন করে। সামনে বসা হীরা, লাটনা আর বোদে।
– ওদিকে অবস্থা কী রকম?
চোখ নামিয়ে বোদেকে জিজ্ঞেস করলেন খোদাবক্স।
– সে আর কহতব্য নয় দারোগা সায়েব। মেগাইয়ের মৃত্যুর পর থেকে অন্নজল ছেড়ে দিয়েছে পাঁচু সর্দার। কথাই বলছে না কারও সঙ্গে। সারাদিন ভোম মেরে বসে থাকে বিছানায়। কী যে হবে কিছুই মাথায় ঢুকছে না কত্তা।
আঙুলের ওঠানামা বন্ধ হওয়া মাত্র থেমে গেল রুলের ঘূর্ণিটা। রুলটা কোমরে চামড়ার খাপে গুঁজে উঠে দাঁড়ালেন খানসাহেব।
– চল, ওর সঙ্গে একটু কথা বলে আসা যাক।

আস্তানার পিছনে একটা সোঁতা খাল। চওড়ায় বড় জোর গজ পঞ্চাশেক হবে। ওপারেই শ্মশান। একখানা চিতা জ্বলছে দাউ দাউ করে। একটা পাথরের বেদীর ওপর বসে উদাস চোখে সেদিকে তাকিয়ে রয়েছে পাঁচু সর্দার। পাশে গিয়ে বসলেন খোদাবক্স।
– ক্যামন আছ সর্দার?
অনেকক্ষণ স্থিরচোখে দারোগা সাহেবের দিকে তাকিয়ে রইল পাঁচু।
– বুকের ভেতর থেকে কলজেটা উপড়ে নেওয়ার পর মানুষ যেমন থাকে ঠিক তেমন আছি।
বলে ফের ঘাড় ঘুরিয়ে চিতার দিকে তাকিয়ে বসে রইল। চুপ করে রইলেন খোদাবক্স। এই সময় ধৈর্য ধরতে হয়। নিজে থেকে কথা শুরু করার সময় দিতে হয় অপর পক্ষকে। আর হলও ঠিক তাই। খোদাবক্সের অনুমান সত্যি করে মুখ ঘুরিয়ে তাকাল পাঁচকড়ি।
– তিন তিনটে মেয়ে ঘরে। হাজার চেষ্টা চরিত্তির করেও একটা ছেলে হয়নি। মেগাইকে পুষ্যি নিয়েছিলুম দিদির ঘর থেকে। হয়ত নিজের নয়, কিন্তু আপন ছেলের বাড়া ছিল ও। সবসময় মামু আর মামু। একদিনের জন্যও মামার কথার অন্যথা করেনি…”
দম চেপে কান্নার দমকটা সামলাল পাঁচকড়ি।

দ্যাখো সর্দার আমি জানি মেগাইয়ের মওতে কতটা শোক পেয়েছ তুমি। তোমাকে তসল্লি  দেওয়ার কোন লফজ আমার জানা নেই। একই সঙ্গে এটাও ঠিক মেগাইয়ের মওতের জন্য জিম্মেদার ওর বুঝদিলের  মত হিম্মত। তোমাদের সবাইকে মানা করেছিলাম আমি, কখন একা একা কোথাও না যেতে। ও শোনেনি সে কথা। ভেবেছিল মান্সুরেদের ওপর হামলার পর বিশে বাগদীর কোমর ভেঙ্গে গেছে। ধারণাটা যে কত বড় ভুল সেটা ওর জান দিয়ে সাবিদ করেছে মেগাই। বিশে যে পাল্টা ঘুরে মারতে পারে, জিতের খুশিতে সেটা ভুলে গিয়েছিল ও। তবে এতসব খারাপ কিছুর মধ্যেও বহত বড়া একটা জিত হাসিল হয়েছে আমাদের।

কিছুক্ষণ পর আবার শুরু করল। কণ্ঠস্বর মৃত মানুষের মত শীতল।
– শুনেছি মেগাইয়ের দেহটা টুকরো টুকরো করে খড়ে চূর্ণীর জলে ভাসিয়ে দিয়েছিল ওরা। একটু চিতার আগুন বা গঙ্গাজল জোটেনি ওর কপালে। নিঘ্ঘাত ঘোড়েল বেঁশেল ছিঁড়ে খেয়েছে…উফফ!
মৃদু অথচ তীক্ষ্ণ যন্ত্রণার শব্দ বেরিয়ে এল সর্দারের বুক চিরে। যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে ছিঁড়ে খাওয়ার দৃশ্যটা। এটাই হাতুড়ি মারার মোক্ষম সময়।
– মেগাইয়ের খুনের বদলা নেবে না?
পাঁচুর চোখে চোখ রেখে ঝটিতি প্রশ্ন করলেন খোদাবক্স। মুহূর্তে খালের ওপার থেকে চিতার আগুনের ঝলকটা উড়ে এসে যেন ঢুকে গেল পাঁচুর দু’চোখে।
– পীতাম্বরের রক্ত খাব আমি। হাড়হিম করা গলায় বলে উঠল পাঁচু।
– এই তো মরদ জ্যায়সা বাত!
সোৎসাহে পাঁচকড়ির কাঁধে একটা চাপড় মারলেন খোদাবক্স।
– কিন্তু সেটা তো আর এখানে বসে হা হুতাশ করলে হবে না। বলতে বলতে আরও এগিয়ে এলেন পাঁচকড়ির সামনে।
– দ্যাখো সর্দার আমি জানি মেগাইয়ের মওতে কতটা শোক পেয়েছ তুমি। তোমাকে তসল্লি দেওয়ার কোনও লফজ আমার জানা নেই। একই সঙ্গে এটাও ঠিক মেগাইয়ের মওতের জন্য জিম্মেদার ওর বুঝদিলের (নির্বোধের) মত হিম্মত। তোমাদের সবাইকে মানা করেছিলাম আমি, কখনও একা একা কোথাও না যেতে। ও শোনেনি সে কথা। ভেবেছিল মানসুরেদের ওপর হামলার পর বিশে বাগদীর কোমর ভেঙ্গে গেছে। ধারণাটা যে কত ভুল সেটা ওর জান দিয়ে সাবিদ করেছে মেগাই। বিশে যে পাল্টা ঘুরে মারতে পারে, জিতের খুশিতে সেটা ভুলে গিয়েছিল ও। তবে এতসব খারাপ কিছুর মধ্যেও বহত বড়া একটা জিত হাসিল হয়েছে আমাদের।

খোদাবক্স বলে চলেন
– বিশের দলটা আসলে একটা চৌপাইয়ের মত। সেই চৌপাইয়ের চারটে পায়া হল হুগলির কালো-দমন দুই ভাই, মনোহর সর্দার, মানসুরেরা আর বিশে নিজে। মানসুরেদের খতম করে ওই চৌপাইয়ের একটা পায়া কেটে দিয়েছ তোমরা। এতে চৌপাইটা নড়বড়ে হয়ে গেছে। এবার বাকি দু’টো কাটতে হবে এক এক করে। এরমধ্যেই হুগলি আর কলকাতায় কোম্পানির কাছে এত্তেলা পাঠিয়ে দিয়েছি আমি। ব্লাকুয়ার আর এলিয়ট সাহেব দু’জনেই সিলমোহর দিয়েছেন এই দরখাস্তে। ওখানকার জমিদার আর কোম্পানির সিপাইদের নিয়ে খাস ফৌজ তৈরি করা হবে আরও দু’টো।

একটু থামেন খোদাবক্স। তারপর বলেন
– বহত জলদি কাম শুরু করে  দেবে ওরা। ও দুটো পায়া কাটতে পারলেই জমিনে পড়ে যাবে চারপাইটা। তোমাদের কাজ হবে শুধু বিশের পতা লাগান। এ কাজে কোম্পানির মদত যেমন পাচ্ছিলে সে রকমই পাবে তোমরা। জরুরত হলে সেটা আরও বাড়ান হবে। কোম্পানির দু’জন সেপাইকে খতম করেছে বিশে। আটঘড়ার চৌধুরীবাবুদের দুই ভাইকে গুলি চালিয়ে ছাল্লি করে দিয়েছে। পুরা কোম্পানি বিশের ওপর গুসসায় পাগল হয়ে গেছে একেবারে। পুরা তাকত নিয়ে ওর ওপর হামলা চালাবে ওরা। আমার হিসাব ঠিকঠাক কাজ করলে একসালের মধ্যে বিশের কাম তামাম। শুধু বিশে কেন, ওর দলের এক এক একটাকে গুনে গুনে মারার সুযোগ পাবে তুমি। জবান দিচ্ছি আমি।

শোনামাত্র এক ঝটকায় বেদী ছেড়ে উঠে দাঁড়াল পাঁচকড়ি সর্দার। চোখে আগুনের আঁচটা বেড়ে গেছে কয়েকগুণ।
– জো হুকুম হুজুর! এক বছরের মধ্যে বিশুকে মেরে কোতোয়ালিতে আপনার পায়ের সামনে এনে ফেলব। জবান দিচ্ছি আমিও।
– জয় পাঁচু সর্দারের জয়! জয় দারোগা সাহেবের জয়!
পেছন থেকে হেঁকে উঠল বোদে। ওর সঙ্গে গলা মেলাল বাকিরা।

মধ্যরাত। আজ অমাবস্যা। চাঁদ নেই আকাশে। ঘুরঘুটি অন্ধকার চারদিকে। একটু দূরে পতিতাপল্লী আর চোলাইভাটির হৈ হল্লাও থেমে গেছে। কালীঘাট মন্দিরের উল্টোদিকে বুড়িগঙ্গার ঘাটের সিঁড়িতে দাঁড়িয়েছিল মনোহর সর্দার। পাশে কালো রায় আর দমন রায়। দু’টো জ্বলন্ত মশাল। মশালের আলোয় উত্তেজনায় চকচক করছে সবার মুখ। একদৃষ্টে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে রয়েছে সবাই। ঘন কুয়াশা আর অন্ধকারে ঠাহর হচ্ছে না কিছুই। এই সময় দূরে একটা ছোট আলোর ফুটকি। জলে কেটে কেটে ক্রমশ সামনে এগিয়ে আসছে আলোটা। দেখতে দেখতে ঘাটে এসে ভিড়ল তিন দাঁড়ের ছোট একটা ছিপ নৌকো।

ওর দৃষ্টিকে অনুসরন করে সামনে তাকাল সবাই। কুয়াশা আর অন্ধকার ভেদ করে চার-পাঁচটা মশালের আলো। কিছুক্ষণ বাদে ঘাটে এসে দাঁড়াল বিশ্বনাথের বিশাল বজরাটা। বজরার ডেকে দাঁড়ান বিশ্বনাথ। পরনে মস্লিনের আচকান আর কাঁচিপাড়ের ধুতি। একমাথা ঝাঁকড়া চুল। পরিপাটি করে তেল দিয়ে আঁচড়ান। পাশে দাঁড়ানো দুর্গা। পরনে ডুরেপাড় শান্তিপুরী তাঁতের শাড়ি একখানা। দু’জনের পিছনে দলের আট-দশটা ছেলে। চার পাঁচজন মাল্লা মিলে ধরাধরি করে লম্বা মজবুত একটা কাঠের পাটাতন নামিয়ে দিল ঘাটে। দুর্গার হাত ধরে পাটাতন বেয়ে নেমে এল বিশ্বনাথ।

ছিপ থেকে লাফ দিয়ে নেমে এল নলে ডোবা। পিছন পিছন সন্ন্যাসী মণ্ডল আর দলের আরও একটা ছেলে। সামনে এগিয়ে গেল মনোহর আর কালো, দমন দুই ভাই।
– বিশে এল না?
প্রশ্ন করল মনোহর। গলায় উদ্বেগ।
– আসছে একটু পিছনে। মুচকি হাসল নলে।
– শালা চারদিকে যা অবস্থা। ভাগীরথী থেকে চূর্ণী হয়ে গঙ্গা, পুরো নদী জুড়ে ভন ভন করছে মাছি আর কোম্পানির ফৌজ। তাই আগুপিছু পাহারা দিয়ে নিয়ে আসতে হচ্ছে সর্দারকে। ওর বজরার আধমাইল আগে আমরা। আধ মাইল পেছনে দু’জনকে নিয়ে রয়েছে পীতু।
– পেমা, মেঘা, ভগবান ওরা সব আসবে না? পাশ থেকে প্রশ্ন করল কালো।
– নাঃ,কালোদা। বিষণ্ণ ভাবে হাসল নলে।
– কোম্পানি, জমিদার, পেঁচো, বোদে সবাই মিলে একসঙ্গে যেভাবে পোঁদে লেগেছে তাতে ডেরা একদম খালি রেখে আসাটা নিরাপদ নয় মোটেই। তাই ওরা সবাই রয়ে গেছে ওখানে। বলতে বলতে গঙ্গার দিকে ঘুরে তাকাল নলে।
– সর্দার আসছে।

ওর দৃষ্টিকে অনুসরন করে সামনে তাকাল সবাই। কুয়াশা আর অন্ধকার ভেদ করে চার-পাঁচটা মশালের আলো। কিছুক্ষণ বাদে ঘাটে এসে দাঁড়াল বিশ্বনাথের বিশাল বজরাটা। বজরার ডেকে দাঁড়ান বিশ্বনাথ। পরনে মসলিনের আচকান আর কাঁচিপাড়ের ধুতি। একমাথা ঝাঁকড়া চুল। পরিপাটি করে তেল দিয়ে আঁচড়ান। পাশে দাঁড়ানো দুর্গা। পরনে ডুরেপাড় শান্তিপুরী তাঁতের শাড়ি একখানা। দু’জনের পিছনে দলের আট-দশটা ছেলে। চার পাঁচজন মাল্লা মিলে ধরাধরি করে লম্বা মজবুত একটা কাঠের পাটাতন নামিয়ে দিল ঘাটে। দুর্গার হাত ধরে পাটাতন বেয়ে নেমে এল বিশ্বনাথ।

পরস্পরের সঙ্গে আলিঙ্গন কুশল বিনিময়ের পালা চলল বেশ কিছুক্ষণ।
– কী ব্যাপার বিশে ভাই! বিশ্বনাথের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল মনোহর।
– এত পাহারা দিয়ে তো বড়লাটকেও নিয়ে আসা হয় না। শুনে হো হো করে হেসে উঠল বিশ্বনাথ।
– আর বল না। আমি দুর্গাকে নিয়ে কালীঘাট যাব শুনে মেঘা শালারা তো ভেবেই অস্থির। ওদের বল্লুম কাউকে লাগবে না। দু’-চারদিনের তো ব্যাপার। দুর্গা আর গোটাচারেক মাল্লাকে নিয়ে ছোট একটা নৌকায় চলে যাব আমি। তা কিছুতেই শুনল না এঁড়েগুলো। পথে যদি বিপদ আপদ হয়। জোরজবরদস্তি একগাদা লোকলস্কর দিয়ে পাঠিয়ে দিল আমাকে। আরে দূর দূর, আমার কি এসব পোষায় নাকি। বিপদের ভয়ই যদি করব তাহলে এ পেশায় না এসে হাল ঠেলেই তো খেতে পারতুম।

মনোহরের পাশে দাঁড়ান কালো। গলায় উদ্বেগের সুর।
– মেঘারা নেহাৎ ভুল ভাবেনি বিশুভাই। শুনছি তোমার নামে পাঁচ হাজার টাকার হুলিয়া জারি করতে চলেছে কোম্পানি। কোতোয়ালির সেপাইদের নজরদারিও বেশ ভালো রকম বেড়ে গেছে সব এলাকায়। নদে-মুর্শিদাবাদ থেকে কলকেতা হয়ে হাওড়া, হুগলি, সবকটা জেলার গাঁয়ে গাঁয়ে ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে নাকি খবরটা ছড়িয়ে দেবে ওরা।
– তোমাদের সর্দারকে শুধু বোঝাও সে কথা। কালোর কথা শেষ হবার আগেই পাশ থেকে বলে উঠল দুর্গা।
– ওরে বাবা! ছদ্মভয়ের সুর বিশ্বনাথের গলায়।
– একে মা মনসা, তার মধ্যে তোরা আর ধুনোর গন্ধ দিসনে কালো। ধুন্ধুমার লেগে যাবে এরপরে।
কথাবার্তার মাঝখানে ঘাটে এসে লাগল পীতাম্বরদের নৌকোটা। হৈ হৈ করে সেদিকে এগিয়ে গেল সবাই। মনোহরের কাঁধে একটা হাত রাখল বিশ্বনাথ।
– কালকের সবকিছু ঠিক আছে তো মনাদা? জিজ্ঞেস করল নিচু গলায়।
– কোনও চিন্তা নেই বিশুভাই। বড় পুরুতমশাইকে বলে রেখেছি আমি। মায়ের সামনে উনি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে চার হাত এক করে দেবেন তোদের। হালদার পাণ্ডাদের বড় তরফদেরও খবর দেয়া আছে। সবকিছু আয়োজন করে রাখবে ওরা। এবার চল রওনা দেয়া যাক। ডেরায় গিয়ে দু’টো মুখে দিতে হবে। দল বেঁধে মনোহরের আস্তানার দিকে রওনা দিল সবাই।

অন্যান্য আচার অনুষ্ঠান শেষে দেবীমূর্তিকে প্রণাম জানিয়ে মন্দির থেকে বেরিয়ে এল বিশ্বনাথ। সঙ্গে দুর্গা। অবাক চোখে দুর্গাকে দেখছিল বিশ্বনাথ। প্রায় ছ’ বছর হতে চলল ওর সঙ্গে রয়েছে মেয়েটা। কিন্তু এ রকম লজ্জাবনত মুখ-চোখের ভাব আগে কোনওদিন দেখেনি। মাথা নিচু করে ওর পাশে পাশে চলেছে দুর্গা।

পরদিন সন্ধে। বড় বড় পঞ্চপ্রদীপের আলো। সামনে যজ্ঞকুণ্ডের আগুন। আলো আর ধোঁয়ায় আছন্ন কালীঘাট মন্দিরের গর্ভগৃহ। দেবীর সামনে দাঁড়িয়ে গম্ভীর কণ্ঠে মন্ত্রোচ্চারণ করছেন প্রৌঢ় পুরোহিত। পাশে জোড়হাতে দাঁড়ান বিশ্বনাথ আর দুর্গা। পিছনে দাঁড়ান দলের লোকজন আর পাণ্ডারা। পাণ্ডাদের সবাইকে নগদ একশো আর পুরোহিতকে দু’শো এক টাকা দক্ষিণা দিয়েছে বিশ্বনাথ। দেবীমূর্তির পায়ে প্রণামী চড়িয়েছে হিরের টায়রা, সোনার বিল্বপত্র আর বহুমূল্য একটি মসলিন শাড়ি। মালাবদল আর অন্যান্য লোকাচার।
– এরপর সিঁদুরদান।
মন্ত্রোচ্চারণ শেষে আদেশ দিলেন পুরোহিত। পাশে দাঁড়ানো তন্ত্রধারকদের মধ্যে একজনের হাতে বেলপাতায় মাখান প্রসাদি সিঁদুর। বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের ডগায় তুলে নিয়ে দুর্গার সিঁথেয় টেনে দিল বিশ্বনাথ। সঙ্গে সঙ্গে মন্দির কাঁপিয়ে আওয়াজ উঠলো, “জয় মা কালী!”

অন্যান্য আচার অনুষ্ঠান শেষে দেবীমূর্তিকে প্রণাম জানিয়ে মন্দির থেকে বেরিয়ে এল বিশ্বনাথ। সঙ্গে দুর্গা। অবাক চোখে দুর্গাকে দেখছিল বিশ্বনাথ। প্রায় ছ’ বছর হতে চলল ওর সঙ্গে রয়েছে মেয়েটা। কিন্তু এ রকম লজ্জাবনত মুখ-চোখের ভাব আগে কোনওদিন দেখেনি। মাথা নিচু করে ওর পাশে পাশে চলেছে দুর্গা। মন্দিরের গলি আর চত্বর জুড়ে সার দিয়ে দাঁড়ান ভিখারি-কাঙ্গাল-আতুরের দল।
– মাকালীর নামে কিছু দাও বাবা।
পীতাম্বর আর সন্ন্যাসীর হাতে বড় বড় দু’টো ধামা বোঝাই চাল-ডাল-ফলমূল আর রাশি রাশি খুচরো চাঁদি ও তামার পয়সা। মুঠোয় ভরে তুলে দিচ্ছে হাতে হাতে।

মন্দিরের বাইরেই চটি। দলের সবার জন্য মহাভোজের আয়োজন হয়েছে সেখানে। দাদখানি চালের ভাত আর বলির মাংস। শেষপাতে পয়োধি আর মিষ্টান্ন। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সবকিছুর তদারক করছিল বিশ্বনাথ। সবকিছুর পাট চুকতে চুকতে প্রায় মাঝরাত। মনোহর সর্দারকে কাছে ডাকল বিশ্বনাথ।
– কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিক সবাই। মাঝরাতে রওয়ানা দেব আমরা।
– ঠিক আছে, আমি জানিয়ে দিচ্ছি সবাইকে।
বলে চলে গেল মনোহর।

শোণিতমন্ত্র পর্ব ২১

জন্ম ও বেড়ে ওঠা উত্তর কলকাতার পুরোনো পাড়ায়। বহু অকাজের কাজী কিন্তু কলম ধরতে পারেন এটা নিজেরই জানা ছিল না বহুদিন। ফলে লেখালেখি শুরু করার আগেই ছাপ্পান্নটি বসন্ত পেরিয়ে গেছে। ১৪২১ সালে জীবনে প্রথম লেখা উপন্যাস 'দ্রোহজ' প্রকাশিত হয় শারদীয় 'দেশ' পত্রিকায় এবং পাঠকমহলে বিপুল সাড়া ফেলে। পরবর্তীতে আরও দুটি উপন্যাস 'জলভৈরব' (১৪২২) এবং 'বৃশ্চিককাল' (১৪২৩) প্রকাশিত হয়েছে যথাক্রমে পুজোসংখ্যা আনন্দবাজার এবং পত্রিকায়। এছাড়া বেশ কিছু প্রবন্ধ এবং দু চারটি ছোটগল্প লিখেছেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকা আর লিটিল ম্যাগাজিনে। তার আংশিক একটি সংকলন বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে 'ব্যবসা যখন নারীপাচার' শিরোনামে। ২০১৭ সালে পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি পুরস্কার।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *