চৌরঙ্গির বিশাল বন ছোট হয়ে আসছে একটু একটু করে। লাটসাহেবের প্রাসাদের পর থেকে উত্তরের দিকে সায়েবসুবোদের শহরপত্তনি হচ্ছে। মেঠো রাস্তা ধরে ঘোড়া, উট চলে। চলে গোরুর গাড়ি, সঙ্গে পালকিও। কেল্লার গায়ে জমিদার চৌধুরী বাবুদের বানিয়ে দেওয়া রাস্তাটা ধরে ওখানে কুচকাওয়াজ করে গড়ের সেপাইরা। কিন্তু এদিকটায় এখনও ঘন নিশ্ছিদ্র জঙ্গল। ঘোর অন্ধকার চারদিকে। দেউলের চাতালে বসে ভীমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন জঙ্গলগিরি ভৈরব। একটু দূরে শুয়ে রয়েছে একটা বাঘিনী। কোলের কাছে বেড়ালের মত ক্ষুদে ক্ষুদে তিনটি ছানা। চোখ ফুটেছে সবে। চুকচুক করে দুধ খাচ্ছে একমনে।

হঠাৎই কান খাড়া করে উঠে বসল ভীমা। সতর্ক টানটান শরীরটা, মুহূর্তের মধ্যে। একটু আগে আদুরে ঝিমানো চোখগুলো জ্বলছে ভাঁটার মতো। জঙ্গলের পথে দূর থেকে এগিয়ে আসা পায়ের শব্দ। মশালের আলো। দেখতে দেখতে সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল দলটা। সামনে মনোহর আর বিশ্বনাথ। মাঝখানে চার বেহারার একটা পালকি। পিছনে বিশ পঁচিশজনের একটা দল। দেখতে দেখতে দেউলের পাশে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল দলটা। একদৃষ্টিতে ওদের মাপছিল ভীমা। গলার গরগরানিটা বাড়ছে ক্রমাগত। হাত দিয়ে ভীমার মাথায় ছোট একটা চাপড় মারলেন চৌরঙ্গিবাবা।
– চুপ মার বেওকুফ। ওরা তোর দুশমন নয়। তুই বরং বউ বাচ্চা নিয়ে জঙ্গলে যা এখন। ওদের সঙ্গে একটু কথা আছে আমার।
বিশাল শরীরটা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল ভীমা। সামনে গিয়ে বাঘিনীর পিঠে জালার মত মাথাটা দিয়ে ঢুঁ মারল একটা। তারপর দু’জনে মিলে লাফ দিয়ে দেউল থেকে নেমে হাঁটা লাগাল জঙ্গলের দিকে। লেজ নাড়তে নাড়তে পিছু নিল ছানাগুলো।

দেউলের চাতালে বসে ভীমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন জঙ্গলগিরি ভৈরব। একটু দূরে শুয়ে রয়েছে একটা বাঘিনী। কোলের কাছে বেড়ালের মত ক্ষুদে ক্ষুদে তিনটি ছানা। চোখ ফুটেছে সবে। চুকচুক করে দুধ খাচ্ছে একমনে।

দলটার দিকে ঘুরে তাকালেন জঙ্গলগিরি। সামনে এগিয়ে গিয়ে চৌরঙ্গী বাবাকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করল বিশ্বনাথ। আশীর্বাদের ভঙ্গীতে বিশ্বনাথের মাথায় হাত ঠেকালেন ভৈরব।
– জিতা রেহ বেটা। আমার রাজা বিশ্বনাথ। মা কালীকা পেয়ারা বাচ্চা। অনেকদিন ধরেই ভাবছিলাম তোর কথা। কবে আসবি তুই। সেই এলিই যখন এত দেরি করে কেন এলি বেটা। কত বাতচিত করার ছিল তোর সঙ্গে।
ততক্ষণে পালকির দরজা খুলে নেমে এসেছে দুর্গা। সামনে গিয়ে গড় হয়ে জঙ্গলগিরিকে প্রণাম করল সেও।
– পেন্নাম যাই বাবা।
– জিতি রহো বেটি।
ফের বরাভয়ের ভঙ্গীতে হাত তুললেন বিশ্বনাথ।
– এটি আমার পরিবার বাবা।
একটু আমতা আমতা করে বলল বিশ্বনাথ।
– অনেকদিন আগে নিরাশ্রয় হয়ে এসেছিল আমার কাছে। আজ মাকে সাক্ষি রেখে ওর সঙ্গে ঘর বাঁধলাম আমি।
শোনামাত্র উচ্ছসিত হয়ে উঠলেন ভৈরব।
– শাবাশ বেটা! এহি তো মরদ কা মাফিক কাম। বহত পুণ্য মিলেগা তুঝকো। এত ভাল একটা কাজ করেছিস তুই আর সেটা বলতে এরকম শরমাচ্ছিস বাচ্চো কা মাফিক।
লজ্জায় অধোবদন হল বিশ্বনাথ। ওর বুকে একটা আঙুল ছোঁয়ালেন চৌরঙ্গীবাবা।
– চুপ করে বসে থাক। ভাল করে তোর সবকিছু একটু দেখতে দে আমাকে।
চোখ বন্ধ করলেন ভৈরব। পাথরের মত স্থির হয়ে গেল শরীরটা।

অনেকগুলো পিশাচ শক্তি তোকে ঘিরে ঘুরপাক খাচ্ছে বেটা। ক্রমশঃ ছোট হচ্ছে বলয়টা। ধ্বংস করতে চাইছে তোকে। তার সামনে একটা পালটা বাঁধ তুলে দেওয়ার চেষ্টা করছি আমি। জগৎজননী মহাশক্তির সন্তান তুই। গরীবের দুঃখহরণ। তোর জিন্দা থাকাটা খুব জরুরী। তারপরও যদি তোর কিছু ঘটে যায় তাহলে বুঝব এতদিনের সাধনা, জপতপ সবকিছু ঢং, সবকিছু বেকার আমার। কালী বেটির দরবারে বিচার বলে কিছু নেই।

অনেকক্ষণ বাদে চোখ খুলে বিশ্বনাথের দিকে তাকালেন ভৈরব।
– অনেকগুলো পিশাচ শক্তি তোকে ঘিরে ঘুরপাক খাচ্ছে বেটা। ক্রমশঃ ছোট হচ্ছে বলয়টা। ধ্বংস করতে চাইছে তোকে। তার সামনে একটা পালটা বাঁধ তুলে দেওয়ার চেষ্টা করছি আমি। জগৎজননী মহাশক্তির সন্তান তুই। গরিবের দুঃখহরণ। তোর জিন্দা থাকাটা খুব জরুরি। তারপরও যদি তোর কিছু ঘটে যায় তাহলে বুঝব এতদিনের সাধনা, জপতপ সবকিছু ঢং, সবকিছু বেকার আমার। কালী বেটির দরবারে বিচার বলে কিছু নেই।
উদাস চোখে সাধুবাবার দিকে তাকাল বিশ্বনাথ।
– বাবা, যেদিন এ পেশায় এসেছিলাম, সেদিনই এই লাল ফেট্টিটার সঙ্গে মৃত্যুকেও বেঁধে নিয়েছিলাম মাথায়। তাই মরতে একতিলও ভয় নেই আমার। শুধু একটাই প্রার্থনা আপনার কাছে, আমি চলে গেলেও গরিব মানুষের যেন কোনও ক্ষতি না হয়। ওদের দুঃখে কাঁদার মতো বেশি কেউ একটা নেই এ পোড়া দেশে।
বলতে বলতে অঝোরধারায় জল গড়িয়ে নামছিল বিশ্বনাথের দু’গাল বেয়ে। সেদিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন জঙ্গলগিরি।

**

সন্ধের মুখে ঘাটের গায়ে বাঁধা বজরাটা। কিছুক্ষণ আগে ছিপ নিয়ে বেরিয়ে গেছে নলে।
– এই তাড়াতাড়ি বাঁধাছাদা কর সব। এখনই নাও ছাড়লে কাল ভোর ভোর ঢুকে পড়তে পারবো নদে।
হাঁকডাক করে দলের লোকেদের নির্দেশ দিচ্ছিল পীতাম্বর আর সন্ন্যাসী। ঘাটলার সিঁড়ির ধারে বেদিটায় বসা মনোহর আর বিশ্বনাথ। অনেকক্ষণ ধরেই উশখুশ করছে মনোহর।
– কিছু বলবে?
মনোহরের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল বিশ্বনাথ।
– ডাকাতিটা আমি ছেড়ে দিতে চাই রে বিশুভাই। রাতদিন এই মারকাট, খুনজখম। এসবের মধ্যে দিয়ে দৌড়তে দৌড়তে খুব ক্লান্ত হয়ে গেছি আমি।
ভারি বিষণ্ণ একটা দৃষ্টি মনোহরের চোখে।
– নাকি ভয় পেয়েছ সর্দার?
পাল্টা প্রশ করল বিশ্বনাথ। জবাবে ক্লান্ত একটা হাসি মনোহরের মুখে,
– তা যদি বলিস, পেয়েছি। তবে নিজের জন্যে নয়। হারুটার জন্যে। সবে সাতে পা দিল ও। ঘরে আর কেউ বলতে তিনকাল গিয়ে এককেলে ঠেকা ওই বুড়ি পিসি। আমার কিছু একটা হয়ে গেলে হারুটার কী হবে, সেই চিন্তায় রাতের পর রাত ঘুম আসে না আমার।

শোক, শোক আর শোক। ঝড়ের মত ধেয়ে আসা শুধু শোকের খবর চারদিক থেকে। কপালের দু’পাশের রগদু’টো টিপে ধরে গড়ের বারান্দায় মাথা নিচু করে বসেছিল বিশ্বনাথ। গতকাল রাতেই খবরটা এনেছে মেঘা। সমুদ্রগড়ের এক বাবুদের বাড়িতে ডাকাতি করে ফেরার পথে কালো দমনের দলকে একটা ধানক্ষেতের মধ্যে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে কোম্পানির ফৌজ। ফৌজের গুলিতে ঘটনাস্থলেই মারা পড়ে দুই ভাই আর ওদের দলের বেশিরভাগ লোক।

শান্তভাবে মনোহরের কাঁধে একটা হাত রাখল বিশ্বনাথ।
– যে কাজে মন দেয় না, সে কাজ কোরও না সর্দার। আমি কিছু মনে করব না তাতে। সৃষ্টিধররা যদি নতুন করে দল চালাতে চায়, চালাতে পারে। তবে ‘দলের আধা আর গরিবের আধা’- এই নিয়মটা যেন মেনে চলে ওরা। আর একটা কথা। তোমার ওই পুষ্যিপুত্তুর হারাধন। সোনার টুকরো ছেলে। এতটুকু বয়স, কিন্তু কী বুদ্ধিমান। তেমনি ভদ্র ব্যাভার। শুনছি পাদ্রি সায়েবরা নাকি এখানকার ছেলেদের শিক্ষেদীক্ষের জন্য স্কুল খুলছে ভবানিপুরের ওদিকটায়। সেখানে ভরতি করে দিও ওকে। দেখবে, একদিন অনেক বড়মানুষ হবে ও।  মনোহর ডাকাতের ব্যাটা বলে কেউ আর ডাকবে না ওকে।
– উঠে এস সর্দার, বজরা তৈয়ার।
ডেক থেকে হাঁক পাড়ল সন্ন্যাসী। উঠে দাঁড়িয়ে সপাটে পরস্পরকে বুকে জড়িয়ে ধরল দু’জন। আর একটিও কথা না বলে বজরায় উঠে গেল বিশ্বনাথ। একদৃষ্টে সেদিকে তাকিয়ে রইল মনোহর যতক্ষণ না বজরাটা চোখের আড়ালে চলে যায়।

শোক, শোক আর শোক। ঝড়ের মত ধেয়ে আসা শুধু শোকের খবর চারদিক থেকে। কপালের দু’পাশের রগদু’টো টিপে ধরে গড়ের বারান্দায় মাথা নিচু করে বসেছিল বিশ্বনাথ। গতকাল রাতেই খবরটা এনেছে মেঘা। সমুদ্রগড়ের এক বাবুদের বাড়িতে ডাকাতি করে ফেরার পথে কালো দমনের দলকে একটা ধানক্ষেতের মধ্যে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে কোম্পানির ফৌজ। ফৌজের গুলিতে ঘটনাস্থলেই মারা পড়ে দুই ভাই আর ওদের দলের বেশিরভাগ লোক। সামান্য দু’চারজন যারা বেঁচে ছিল সবাই ধরা পড়ে গেছে ফৌজের হাতে।

শোকের শেষ এখানেই নয়। পীতাম্বর, সেই ছোটবেলার বন্ধু বিশ্বনাথের। প্রথম যখন দল গড়ে বিশ্বনাথ, তখন যে পাঁচ-ছ’জন এসে প্রথম হাত মিলিয়েছিল ওর সঙ্গে, তার মধ্যে পীতাম্বর একজন। নিজের পাঁচ আঙুলের চেয়ে ওকে বেশি বিশ্বাস করত বিশ্বনাথ। মেঘা আর ভগবানের পরেই দলে জায়গা ছিল ওর। মাছ ধরার শখ ছিল প্রচণ্ড। ডাকাতির কাজকম্ম না থাকলে একতিল সময় নষ্ট না করে বসে পড়ত ছিপ নিয়ে। চ্যাংল্যাটা থেকে দেড়মণি কাতলা, যাই ধরুক না কেন ছিপে তুলে ডেরায় ফিরে এসে নিজে হাতে কেটেকুটে রেঁধেবেড়ে সবাইকে খাওয়ানোতেই ছিল ওর আনন্দ। রান্নার হাতটাও ছিল দুর্দান্ত। ওর রকমসকম দেখে হাসত বিশ্বনাথ।
– তুই শালা হাড়ির কুলে না জন্মে রাঁধুনি বামুন কিংবা বাগপাড়ার মেছোদের ঘরে জন্মাতে পারতিস। দিব্যি পশার জমে যেত। ডাকাতির কারবার করে খেতে হত না।
শুনে হেসে কুটিপাটি হত সবাই। পীতাম্বরের মাছ ধরার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা ছিল রাজপুরের বড় বিল। ডেরা থেকে ক্রোশখানেক দূরে। মাঝে মাঝে মাছ ধরার নেশায় দু’তিনদিন থেকেও যেত ওখানে। বিলের পাশেই ছোটখাটো কুঁড়ে তুলে নিয়েছিল একটা। এক বাগদি বুড়ি দেখাশোনা করত কুঁড়েটার। বুড়ির বানানো পচুই খেত হাঁড়ি হাঁড়ি আর বসে বসে মাছ ধরত রাতদিন।

সেদিন রাতে পচুইয়ের নেশায় বেহুঁশ হয়ে ঘুমোচ্ছিল পীতাম্বর। কোনওভাবে খবরটা পেয়ে যায় পাঁচকড়ি। দলবল নিয়ে পৌঁছে যায় বড়বিলে। বুড়ির গলায় তলোয়ার ঠেকিয়ে চুপ করিয়ে রাখে সাঙ্গোপাঙ্গরা। বেড়ালের মত চাল বেয়ে উঠে খড় ফাঁক করে বর্শার এক ফোঁড়ে পীতুকে গেঁথে ফেলে পাঁচু। চোখ খুললে নাকি পাঁচুর দিকে তাকিয়ে হেসেছিল পীতু।
– ঘুমন্তে মারলি?
– আমার মেগাইকে কি জীয়ন্তে ধরেছিলি?
জবাব দিয়েছিল পাঁচকড়ি। তারপর চাল থেকে নেমে অন্ধকারে মিলিয়ে গেছিল দলবল নিয়ে।

বুড়ির মুখে খবর পেয়ে ক্ষ্যাপা বাঘের মত বড় বিলে ছুটে গেছিল বিশ্বনাথ। বিছানায় শোয়া পীতাম্বর। বুকে গাঁথা শুলুপি। চিরকেলে বেপরোয়া সেই হাসিটা তখনও লেগে রয়েছে ঠোঁটের কোণে। এতদিনের বন্ধুত্ব, একসাথে যাওয়া কত অভিযানে। এক ঝটকায় শেষ হয়ে গেল সবকিছু। ‘আর নেই’-এর দলে চলে গেল পীতু। ওর দেহ বিষমকুল গড়ে নিয়ে এসে চন্দনকাঠের চিতায় দাহ করেছিল বিশ্বনাথ।

বাপ মা চেয়েছিল আমি নবদ্বীপের আখড়ায় গিয়ে দীক্ষে নি। তা আমার কপালে তো আর বোষ্টম হওয়া হল না। তুই কিন্তু বাপের ধারাটা বাঁচিয়ে রাখিস। বাড়িটা পাকা করবি। চাতালে বড় করে রাধা-মাধবের মন্দির গড়বি একটা। ধানী জমি কিনবি আরও বিঘে পঞ্চাশেক। শুনলাম সদুটার নাকি সম্বন্ধ দেখছে মা। তোরও তো সতের পেরিয়ে আঠারো হল। পারলে দিন দেখে একসঙ্গেই যেন দু’টো শুভকাজ লাগিয়ে দেয়। দেনাপাওনা ওসব নিয়ে ভাববি না একদম। সারাজীবন তোদের জন্য কিছু করতে পারিনি আমি। শেষবেলায় কিছু করে যেতে পারলে ভাল লাগবে আমার।

পীতাম্বরের ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই আর একটা দুঃসংবাদ। মথুরাপুরের বাড়িতে বেশ কয়েকমাস রোগভোগের পর দেহ রেখেছেন বিনোদ মুখুজ্জেমশাই। বিধবা হয়েছে বিজয়া। এত অল্প বয়স। জীবনে কোন সুখই পেল না মেয়েটা। বুড়ো দোজবরে শয়তান স্বামীর ঘর। তবুও তো আশ্রয় একটা। ভাল করে শুরু করার আগেই শেষ হয়ে গেল সবকিছু। এদিকে গাঁয়ের বাড়িতে বাবার অবস্থাও ভাল না। খবর পেয়ে দু’তিনটে জেলার সব সেরা সেরা হেকিম-কোবরেজদের পাঠিয়েছিল বিশ্বনাথ। যত টাকা খরচা হোক বাঁচাতেই হবে বাবাকে। দেখেশুনে একযোগে নিদেন দিলেন সবাই। গলায় কর্কট রোগ। সারানো শিবেরও অসাধ্যি। ওষুধপত্তর দিয়ে যে কটা দিন টিঁকিয়ে রাখা যায়।

শোনার পর গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিল বাবাকে দেখতে। সারা ঘর জুড়ে রোগ রোগ গন্ধ। বিছানায় পড়ে থাকা বাবা। কোটরে ঢুকে যাওয়া দু’টো চোখ। চামড়া ঠেলে বের হওয়া পাঁজরার হাড় কটা গোনা যাচ্ছে স্পষ্ট। কথা বলার ক্ষমতা চলে গেছে। শুকিয়ে পাখির ছানার মত হয়ে গেছে শা-জোয়ান শরীরটা। বিশ্বনাথকে দেখে কাঁপা কাঁপা হাতটা তুলে বলার চেষ্টা করছিল কিছু একটা। তার বদলে কফ বসা একটা ঘড়ঘড় শব্দ ছাড়া আর কিছুই বের হচ্ছিল না মুখ দিয়ে। অনেকক্ষণ বাবার হাতটা ধরে বসেছিল বিশ্বনাথ। তারপর চুপচাপ বেরিয়ে এসেছিল।

ঘরের বাইরে দাঁড়ান মা, ছোট বোন সৌদামিনী আর দিদি অন্নপূর্ণা। পাশের গাঁয়েই বিয়ে হয়েছে। চোখে জল সবার। বিশ্বনাথের গায়ে পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল মা।
– হ্যাঁরে বিশে, সারাজীবন শুধু অপরের কথা ভাবলি। নিজের জন্য কিছু করলিনে। শুনলুম কদিন আগে ওই কুলীনের মেয়েটাকে নাকি বে করেছিস। তা একবার বউ দেখিয়ে নিয়ে গেলিনে বাপ-মাটাকে? আর কিছু না পারি আশীর্বাদটুকু তো করতে পারতুম।
অবাক চোখে মার দিকে তাকিয়েছিল বিশ্বনাথ। অশিক্ষিত গাঁয়ের বউ। দুর্গার ইতিহাসটা জানে। তবু কী অবলীলায় মেনে নিল ওকে। মায়ের দেওয়া মান্যতা। সেটা পেয়ে গেছে দুর্গা। আর কী চাই জীবনে। এরপর কোম্পানির গুলি, দুশমনের লাঠি-সড়কি, মরে গেলেও পরোয়া নেই শালা। সপাটে একযোগে মা বোনেদের বুকে জড়িয়ে ধরল বিশ্বনাথ।

পিছনে দাঁড়ান ছোটভাই হরনাথ। বয়স সতের-আঠারোর মত। হাতের ইশারায় ভাইকে কাছে ডেকেছিল বিশ্বনাথ। কাঁধে হাত দিয়ে নিয়ে গেছিল একটু দূরে।
– শোন, এ বাড়িতে আমার আর আসা হবে না বোধহয়। এলে তোদের বিপদ হতে পারে।
একটা দীর্ঘশ্বাস পড়েছিল বুক থেকে।
– বাপ মা চেয়েছিল আমি নবদ্বীপের আখড়ায় গিয়ে দীক্ষে নিই। তা আমার কপালে তো আর বোষ্টম হওয়া হল না। তুই কিন্তু বাপের ধারাটা বাঁচিয়ে রাখিস। বাড়িটা পাকা করবি। চাতালে বড় করে রাধা-মাধবের মন্দির গড়বি একটা। ধানি জমি কিনবি আরও বিঘে পঞ্চাশেক। শুনলাম সদুটার নাকি সম্বন্ধ দেখছে মা। তোরও তো সতেরো পেরিয়ে আঠারো হল। পারলে দিন দেখে একসঙ্গেই যেন দু’টো শুভকাজ লাগিয়ে দেয়। দেনাপাওনা ওসব নিয়ে ভাববি না একদম। সারাজীবন তোদের জন্য কিছু করতে পারিনি আমি। শেষবেলায় কিছু করে যেতে পারলে ভাল লাগবে আমার। দু’দিনের মধ্যে মেঘা আর ভগবান এসে হিসেবপত্তর বুঝিয়ে দিয়ে যাবে তোকে। আর হ্যাঁ, বাপের চিকিচ্ছেপত্তর করবি ভালো করে। যতদিন বেঁচে থাকবে যেন রাজার হালে বাঁচে।
– দাদা!
কথা শেষ হওয়ার আগেই ডুকরে উঠেছিল হরনাথ। ভাইয়ের গালে হাত বুলিয়ে সান্তনা দিয়েছিল বিশ্বনাথ।
– দূর বোকা, কাঁদছিস কেন? তুই, আমার বাপ, মা, বোনেরা, সবাই ভালমানুষ। জীবনে কোনওদিন কোন অন্যায়, অধর্ম করিসনি। যত অধর্ম তো আমার। সেই সব পাপ আমি নিলাম। পুণ্যিটুকু তোদের থাক।
কথাগুলো শেষ করেই প্রায় ছুটে বেরিয়ে গেছিল বিশ্বনাথ। কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে।

ধপ ধপ। দরজায় ভারী পায়ের শব্দ। সামনে এগিয়ে এল দুর্গা। ওর গর্ভে বেড়ে উঠছে দু’জনের সন্তান। তার সঙ্গে তাল রেখে ওজন বাড়ছে চলাফেরার। আজকাল ওপর-নিচ করলেই হাঁফ ধরে ওর। কণ্ঠস্বরেও সেই ক্লান্তিটা ধরা পড়ল,
– নিচে দলের সবাই অপেক্ষা করছে।
– যাচ্ছি।
বলে উঠে দাঁড়ালো বিশ্বনাথ। তারপর ধীরপায়ে নেমে গেল সিঁড়ি দিয়ে।

শোণিতমন্ত্র পর্ব ২২

জন্ম ও বেড়ে ওঠা উত্তর কলকাতার পুরোনো পাড়ায়। বহু অকাজের কাজী কিন্তু কলম ধরতে পারেন এটা নিজেরই জানা ছিল না বহুদিন। ফলে লেখালেখি শুরু করার আগেই ছাপ্পান্নটি বসন্ত পেরিয়ে গেছে। ১৪২১ সালে জীবনে প্রথম লেখা উপন্যাস 'দ্রোহজ' প্রকাশিত হয় শারদীয় 'দেশ' পত্রিকায় এবং পাঠকমহলে বিপুল সাড়া ফেলে। পরবর্তীতে আরও দুটি উপন্যাস 'জলভৈরব' (১৪২২) এবং 'বৃশ্চিককাল' (১৪২৩) প্রকাশিত হয়েছে যথাক্রমে পুজোসংখ্যা আনন্দবাজার এবং পত্রিকায়। এছাড়া বেশ কিছু প্রবন্ধ এবং দু চারটি ছোটগল্প লিখেছেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকা আর লিটিল ম্যাগাজিনে। তার আংশিক একটি সংকলন বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে 'ব্যবসা যখন নারীপাচার' শিরোনামে। ২০১৭ সালে পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি পুরস্কার।

One Response

  1. এবার শালা তোমাকে চরম ঈর্ষা হচ্ছে , এতো ভালোবাসা, বুক জুড়ে এতো কান্না, এতো মমতা তুমি রাখতে পারলে কি করে? মানুষ তুমি যা সঙ্গে করেছো তার তুলনা হয় না , পরিমাপ হয় না , তবে তাই বলে প্রত্যেকের ভালোবাসা কি এতটাই দোয়া করেছে তোমায় ? কমরেড পুশকিন, লু সুন্ , বিভূতি ভূষণ কে যে তুমি ছাড়িয়ে যাচ্ছ , একেবারেই বাড়িয়ে বলা এটা নয়। লোরকা আর নেরুদা র মতো বলতে বুক ফাটে ” কি নিদারুন কষ্ট পেয়েছো , কি অসম্ভব ভালোবেসেছো !”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *