সন্ধের মুখে দশ গাঁয়ে সাপ খেলিয়ে ফিরছিল লখাইবেদে। রাস্তাতেই ওকে ধরে ফেলেছিল বিশুর দলবল। সোজা তুলে নিয়ে গিয়েছিল পোড়াদেউলের নির্জন মাঠে। মন্দিরের দাওয়ায় বসা বিশু। পাথরের মত মুখখানা। ঠাণ্ডা চোখে তাকিয়েছিল লখাইয়ের দিকে। “কী হয়েছিল সত্যি করে বল। সত্যি কথা বললে কম কষ্টে মরবি।” কাঁপতে কাঁপতে সব খুলে বলেছিল লখাই। সেই রাতে পাঁচকড়ির টাকা খেয়ে জঙ্গল থেকে সদ্য ধরে আনা তাজা একটা খড়িশ কেউটে জানলা গলিয়ে ছেড়ে দিয়েছিল তরুর বিছানায়। কথা শেষ হবার আগেই সড়কির একপোঁচে লখাইয়ের গলাটা দুফাঁক করে দিয়েছিল বিশু। তারপর রক্তমাখা সড়কি তুলে হুঙ্কার ছেড়েছিল অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে “আজ রাতে। জয় ভবানী!”
সেই রাতেই দলবল নিয়ে পাঁচুর বাড়ি আক্রমণ করেছিল বিশু। দরজার সামনে পাহারায় থাকা দশ বারোজন পাহারাদার লেঠেল। ঘুমচোখ কচলে উঠে লড়াই শুরু করার আগেই কচুকাটা হয়ে গেল বিশুর দলের সামনে। বাড়ির মধ্যে ঢুকে দেখা গেল মেগাইকে নিয়ে পিছনের খিড়কি দরজা দিয়ে পালিয়েছে পাঁচকড়ি। একটা ঘরে মেয়েদের নিয়ে এককোণে জড়সড় হয়ে থরথর করে কাঁপছে পাঁচকড়ির বউ। বিশুর পাশে দাঁড়ানো বোদে। গড়গড় করে উঠেছিল হুঁড়ারের মত “এগুলোকেও মায়ের পায়ে চড়িয়ে দে বিশে। শত্তুরের শেষ রাখতে নেই।” “চুপ!” বোদের দিকে তাকিয়ে হুমকে উঠেছিল বিশু। “মেয়েরা মহামায়ার অংশ। কেষ্ট হাত তুলবে না ওদের গায়ে। আমার শত্রুতা পাঁচকড়ির সঙ্গে। ওর পরিবারের সঙ্গে নয়।” বলেই ঘুরে তাকিয়েছিল পাঁচুর বউয়ের দিকে। “তুমি নিশ্চিন্ত থাকো খুড়ি। আমি থাকতে কোন ক্ষতি হবেনা তোমাদের। কিন্তু সর্দার যেন এবাড়িতে না ঢোকে। জানতে পারলে ফল ভালো হবেনা।” আশ্বাস পেয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠেছিল পাঁচকড়ির স্ত্রী, “বিশ্বাস করো বাপ, আমি ওকে হাতে পায়ে ধরে মানা করেছিলুম একাজ করতে। আমার কথা শুনলো না কিছুতেই…।” বলতে বলতে অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়ছিল মাটিতে।
ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল বিশু। নীচে দাওয়ায় দাঁড়ানো দলের ছেলেরা। হাতে লাঠি সড়কি। উত্তেজনায় টানটান প্রত্যেকে। মশালের আলোয় জ্বলছে সবার চোখগুলো। রক্তচোখে সেদিকে তাকালো বিশু। “তোদেরকে আমার কটা কথা বলার আছে। পাঁচু সর্দার গরীব মানুষের ওপর জুলুম করে জমিদার আর কোম্পানির পেট ভরাত। আমরাও সেই পাপের ভাগীদার। এর প্রায়শ্চিত্তির করতে চাই আমি। এখন থেকে আমি শুধু জমিদার আর কোম্পানির টাকা লুটব। পেট চালাবার জন্য যেটুকু দরকার সেটুকু রেখে বাকিটা বিলিয়ে দেব গরীব মানুষের মধ্যে। আমি আমার রাস্তা ঠিক করে ফেলেছি। এবার তোরা তোদের কথা বল। আমার কথায় রাজি থাকলে হাত তোল, আর না থাকলে বাড়ি ফিরে যা। আমি কিছু মনে করব না তাতে।” “জয় রাজা বিশ্বনাথের জয়”, বিশুর কথা শেষ হওয়ার আগেই হাতের লাঠিটা আকাশে তুলে গর্জে উঠলো ভগবান। “জয় রাজা বিশ্বনাথ!” লাঠি উঁচিয়ে স গর্জনে প্রত্ত্যুত্তর দিল সবাই।
“তোদেরকে আমার কটা কথা বলার আছে। পাঁচু সর্দার গরীব মানুষের ওপর জুলুম করে জমিদার আর কোম্পানির পেট ভরাত। আমরাও সেই পাপের ভাগীদার। এর প্রায়শ্চিত্তির করতে চাই আমি। এখন থেকে আমি শুধু জমিদার আর কোম্পানির টাকা লুটব।
সেই শুরু। বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার আগে বাপ মায়ের সঙ্গে দেখা করতে গেছিল। সে এক বুকফাটা দৃশ্য। ঘরের বাইরে দাঁড়ানো দলের ছেলেরা। বিশুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে মা বাপ ভাইবোনেরা। “বিশে, বাপ আমার। তুই যে নবদ্বীপের আখড়ায় গিয়ে বোষ্টম হবি, রাধামাধবের পায়ে স্মরণ নিবি বলেছিলিস। সে পিতিজ্ঞের কি হবে বাপ?” করুণচোখে হেসেছিল বিশু। “তোমাদের রাধামাধব আমার তরুকে বাঁচাতে পারেনি বাবা। ওতে আর বিশ্বাস নেই আমার। এখন আমার সামনে শুধু মহামায়া দেবী কালী। সেই মহাশক্তি মা আমার আদেশ দিচ্ছে আমাকে। বলছে-“ মানুষ খুব কাঁদছে রে বিশে। বড় কষ্টে আছে ওরা। তুই কিছু কর।” কথাটা বলেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছিল বিশু। আর একবারও পিছনে না তাকিয়ে।
এর কিছুদিনের মধ্যেই জমিদারদের বৈঠকখানায়, নীলকুঠিতে, কোম্পানির দফতরে কথাবার্তা আর আলোচনায় বারবার ভেসে উঠতে লাগল নামটা। বিশে বাগদী, বিশে ডাকাত। ধনীর যম আর গরীবের ভগবান। দেশগাঁয়ের গরীবগুর্বো মানুষ বিশ্বনাথবাবু, রাজা বিশ্বনাথ নামে ডাকে ওকে। নদে, মুর্শিদাবাদ, ২৪ পরগণা… দেখতে দেখতে গোটা বাংলায় দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ল বিশের দলের নাম। একসময় অবস্থা এমন দাঁড়াল যে সবক্ষেত্রে ডাকাতি করতে যাওয়ারও প্রয়োজন পড়তো না। বিশ্বনাথবাবুর সই করা স্রেফ একখানা চিঠি। সুড়সুড় করে গিয়ে নির্ধারিত স্থানে টাকা রেখে আসতো জমিদারবাবুদের লোকজন। বাবুদের এই দুর্দশায় স্পষ্টতই খুশি সাধারণ মানুষ। ফুট কাটতো আড়ালে। “হুঁ হুঁ বাবা, এ হল বিশ্বনাথবাবুর রাজকর। ফাঁকি দিয়ে পালাবে কোথায় জমিদারের পো? এবার দ্যাখ ব্যাটারা কেমন লাগে।”…গাঁয়ে গাঁয়ে শুধু বিশুর নামে জয়ধ্বনি। কোথায় কোন গাঁয়ে কোন বিধবার বিয়ে হচ্ছেনা। কোন গরীবের ঘরে মৃতদেহ সৎকারের টাকা নেই, খাজনা আর দেনার দায়ে করে ভিটেমাটি চাটি হয়েছে…একবার রাজা বিশ্বনাথের দরবারে আর্জির হাত পাতলেই হল। প্রার্থনাপূরণ সঙ্গে সঙ্গে।
তবে প্রথম প্রথম অবস্থাটা ঠিক এরকম ছিলনা। আরও অনেকগুলো ডাকাতদল সেসময় দাপিয়ে বেড়াত বাংলার বিভিন্ন জায়গায়। যেমন হুগলী জেলার দুই ভাই কালো রায় আর দমন রায়, কোলকেতা-গোবিন্দপুরে মনোহর সর্দার আর ২৪ পরগণার মানসুরে ডাকাতের দল। কেউ বলে মনসুর নামে দলের একজন নেতার নামেই নাকি ওদের এই নাম। আবার কারো মতে ওরা ঠগিদের মত গলায় ফাঁস লাগিয়ে মানুষ মারত, সেই থেকে ফাঁসুড়ে হয়ে মানসুরে। এদের সবার কাছে বার্তা পাঠাল বিশ্বনাথ। বাংলায় করেকম্মে খেতে গেলে এখন থেকে বিশুর কথা মেনে চলতে হবে। ডাকাতি করা ধনসম্পত্তির অর্ধেক বিলিয়ে দিতে হবে গরীবের মধ্যে। ওর ডাকে হুগলীর রিষরে গ্রামে এসে জড়ো হল সবকটা ডাকাতদল। বিশুর শর্ত না মানলে কারবার গোটাতে হবে, তেমন হলে পৈতৃক প্রাণটাও খোয়াতে হবে- এটা বুঝতে দেরি হয়নি অন্য দলগুলোর সর্দারদের। একবাক্যে বিশুর প্রস্তাব মেনে নিল মনোহর, কালো-দমন আর মানসুরেরা। মানল না শুধু একদল। উপরগস্তি ডাকাতরা। দুর্ধর্ষ এক যোদ্ধাগোষ্ঠী। বুনো নেউলের মত হিংস্র। সেই শের শাহর সৈন্য হিসেবে বাংলায় এসেছিল এরা। শের শাহর আমল শেষ হবার পরেও থেকে যায় এই বাংলাতেই। চিরটাকাল ফৌজে থাকার জন্য যুদ্ধটা রক্তেই ছিল। এবার সেটা ডাকাতি আর লুঠতরাজে কাজে লাগাল। এহেন উপরগস্তিরা বিশুর কর্তৃত্ব স্বীকার করে নিতে পারল না কিছুতেই। বেধে গেল ধুন্ধুমার লড়াই। বছরখানেক এরকম চলার পর একটু একটু করে পিছু হটতে শুরু করল উপরগস্তিরা। বিশ্বনাথের দলবলের সামনে হার মেনে সরে গেল নদে মুর্শিদাবাদের উত্তরে দুর্গম অঞ্চলে।
কিছুদিনের মধ্যেই জমিদারদের বৈঠকখানায়, নীলকুঠিতে, কোম্পানির দফতরে কথাবার্তা আর আলোচনায় বারবার ভেসে উঠতে লাগল নামটা। বিশে বাগদী, বিশে ডাকাত। ধনীর যম আর গরীবের ভগবান। দেশগাঁয়ের গরীবগুর্বো মানুষ বিশ্বনাথবাবু, রাজা বিশ্বনাথ নামে ডাকে ওকে।
গোটা বাংলায় ডাকাতদের একছত্র সর্দার হয়ে উঠলো বিশ্বনাথ। দিনে দিনে লোক বাড়তে লাগল দলে। বোদেকে আলাদা দল খোলার অনুমতি দিল বিশু। তারপর তো জীবনে দুর্গা এল। তরুকে হারানোর বিষক্ষতে প্রলেপ পড়লো খানিকটা। তবে সবচেয়ে দুঃখ পেয়েছিল যখন প্রাণাধিক প্রিয় বন্ধু ভগবান, গয়লাপাড়ার ভগবান মারিক দল ছেড়ে চলে যেতে চাইল। মেঘা আর ভগবান। দলে বিশুর দুই হাত। এর মধ্যে ভগবান, দুর্ধর্ষ যোদ্ধা। লাঠি সড়কি কথা বলে ওর হাতে, ও পাশে থাকলে পুরো একটা ফৌজের মহড়া নিতে পারতো বিশু। আসলে এত ডাকাতি খুনখারাপির মাঝখানেও কোথাও সেই একটা চিরকেলে বোষ্টম রয়ে গেছিল ভগবানের মধ্যে। সেটা বুঝতে পেরেছিল বিশ্বনাথ। যাবার সময় হেসে হাত রেখেছিল বন্ধুর কাঁধে। উদাস চোখে বলেছিল-“আমার তো আর বোষ্টম হওয়া হল না রে। তুই-ই বন্ধুর মানটা বাঁচিয়ে রাখিস।” দল ছেড়ে গোবরডাঙ্গার হাটে একটা মিষ্টির দোকান খুলেছিল ভগবান। সারাদিন দোকানে বিকিকিনি। সন্ধে হলে কীর্তন আর পালাগান। এই নিয়েই আছে ও। এদিকে বোদেটারও কোন খবর নেই বেশ কিছুদিন হল…উদাস চোখে জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল বিশ্বনাথ। বৃষ্টিটা ধরে এসেছে বেশ কিছুক্ষণ। বুনো গাছপালা আর ভেজা মাটির একটা সোঁদাটে গন্ধ চারপাশে।
ঠিক এইসময় একতলার সিঁড়িতে গানের গলা-‘জীব দুঃখ দেখে মোর হৃদয় বিদরে/ সর্বজীব পাপ প্রভু দেহ মোর শিরে…।” শোনামাত্র আনন্দে অপাপবিদ্ধ শিশুর মত চকচক করে উঠলো বিশ্বনাথের চোখজোড়া! সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসছে কীর্তনের সুরটা। পরমুহূর্তেই হাসতে হাসতে ঘরে ঢুকল ভগবান। গলায় কণ্ঠীর মালা। কপাল থেকে নাক অবধি টানা রসকলি। দেখামাত্র লাফ দিয়ে উঠে সপাটে বন্ধুকে জড়িয়ে ধরল বিশ্বনাথ। “ব্যাটা গয়লার পো বোষ্টম। তা এত্তদিন বাদে কি মনে করে অচ্ছুৎ বিশে ডাকাতের ঘরে।” ততক্ষণে ঘরে ঢুকে এসছে মেঘা আর দুর্গা। দুর্গার দিকে তাকিয়ে সোল্লাসে চেঁচিয়ে উঠলো বিশ্বনাথ- “অনেকদিন পরে আমার প্রাণসখা ছিদাম এসেছে দুর্গা! তুই এক্ষুনি গিয়ে ওর দুটো জলবাতাসার ব্যবস্থা কর।” “যাচ্ছি রে বাবা যাচ্ছি।” বলে ভগবানের সঙ্গে দু একটা কুশল বিনিময়ের পর চলে গেল দুর্গা। সিঁড়িতে দুর্গার পায়ের শব্দ মিলিয়ে যাওয়ার পর খাটে এসে বসল ভগবান। এগিয়ে এল মেঘাও। বিশ্বনাথের সামনে ঝুঁকে পড়ল ভগবান।
“একটা খারাপ খবর আছে রে বিশে। দেবীপুর গাঁয়ে এক ব্রাহ্মণ কন্যা। নাম বিজয়া। অবস্থাপন্ন ঘর। বিজয়ার বিধবা মাতাঠাকুরানি গত হয়েছেন মাসখানেক হল। গাঁয়ে নানারকম বদলোকের বাস। রাত হলে বাড়ির চালে ঢিল পড়ে। এই অবস্থায় আর একদণ্ডও বাপের ভিটেয় থাকতে চাইছেনা বিজয়া। ওর স্বামী রাখালচন্দ্র বাঁড়ুজ্জে। গ্রাম মথুরাপুর। সেই চূর্ণী আর গঙ্গা সঙ্গমের কাছে। বাঁড়ুজ্জে মশাই কুলীন বামুন। ঘরে দুটি পরিবার। এছাড়াও পঞ্চাশটি কুলীন ঘরের কন্যাকে উদ্ধার করেছেন। জীবনে কোনদিন সেখানে যায়নি বিজয়া। এখন বিপদে পড়ে সেখানেই যেতে হচ্ছে। প্রচুর টাকাপয়সা আর গয়নাগাঁটি থাকবে ওর সঙ্গে। পথেই ওর নৌকো লুট করার তাক কষেছে বোদে। সেইকারণেই ভূপতি রায়ের খাজনা লুঠের দিন নীলের বনে আসেনি ও। তোকে শরীর খারাপের বাহানা দিয়ে এড়িয়ে গেছে। আজ সকালেই আড়কাঠি এনায়েৎ খবরটা দিল আমাকে।”
“বাচ্চাটাকে মায়ের কোলে ফিরিয়ে দে এক্ষুনি! ফের যদি কোনও মেয়েছেলের ওপর জুলুম করতে দেখি তাহলে মোষের বদলে তোর বলি চড়াব হাড়িকাঠে। বুঝেছিস!”
শোনামাত্র বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল বিশ্বনাথ। দলে তার কড়া নির্দেশ রয়েছে-স্ত্রীলোক আর শিশুদের ওপর কখনও যেন কোনওরকম জুলুম না করা হয়। তা সত্বেও ভগবানগোলায় এক সোনার বানিয়ার বাড়িতে গিয়ে সেই নিয়ম ভেঙ্গেছিল বোদে। বেনেগিন্নির গলায় সাতনরি একটা বিশাল সোনার হার। ধমকেধামকে কাজ না হওয়ায় স্ত্রীলোকটির হাত থেকে তার শিশুপুত্রটিকে কোলে তুলে নিয়ে মেঝেয় আছড়ে মারতে উদ্যত হয় বোদে। সেই মুহূর্তে সেখানে এসে উপস্থিত হয়েছিল বিশ্বনাথ। বোদের দিকে তাকিয়ে গর্জে উঠেছিল বাঘের মত- “বাচ্চাটাকে মায়ের কোলে ফিরিয়ে দে এক্ষুনি! ফের যদি কোনও মেয়েছেলের ওপর জুলুম করতে দেখি তাহলে মোষের বদলে তোর বলি চড়াব হাড়িকাঠে। বুঝেছিস!” “বুঝেছি সর্দার। এমন ভুল আর হবেনা কোনওদিন। এই কালীর কিরে কাটছি।” বলে কাঁপতে কাঁপতে বিশ্বনাথের সামনে থেকে সরে গেছিল বোদে। কিন্তু সেই সাবধানবাণীতে যে কোনও কাজ হয়নি সেটা স্পষ্ট বুঝতে পারছে বিশ্বনাথ। চোখের আড়াল হতেই ফের স্বমূর্তি ধারণ করেছে বোদে। “আরও অনেক টুকরো টুকরো খবর কানে আসে আমার।” হতাশ একটা দৃষ্টি নিয়ে বিশ্বনাথের দিকে তাকাল ভগবান। “ডাকাতির টাকা আর গরীবদের মধ্যে বিলোচ্ছে না বোদে। নিজেই হরফ করে দিচ্ছে।” শুনে বেশ কিছুক্ষণ গুম হয়ে রইল বিশ্বনাথ। তারপর চোখ তুলে তাকাল ভগবানের দিকে।
“কখন রওয়ানা হবে মেয়েটা, খবর পেয়েছিস কিছু?”
“কাল কাকভোরে।” উত্তর দিল ভগবান।
মেঘার দিকে ঘুরে তাকাল বিশু। তুই আমি আর ভগবান তিনজনে যাবো রণপায় চড়ে। দেবীপুর এখান থেকে সাতক্রোশ দুর। নলে, সন্ন্যাসী, পীতু, কেষ্ট আর পেমা যাবে ছিপ নৌকোয়। আমার হিসেব বলছে মথুরাপুরের আগে পরিহারের ঘাট। আমি নিশ্চিত ওখানেই নৌকো লুটবে বোদে। মাঝরাতে রওনা দিলে আমরাও ওই একই সময় পৌঁছে যাব পরিহারে। মেঘা, তুই এক্ষুনি নলে পেমাদের খবর দে। সবাই তৈরি হয়ে আসে যেন। মাঝরাতে বেরতে হবে।” “ঠিক আছে।” বলে চলে গেল মেঘা। কাঁচুমাচু মুখে বিশ্বনাথের দিকে তাকাল ভগবান “আমাকে আবার এসব খুনখারাবির মধ্যে টানছিস কেন বিশে। নবদ্বিপে প্রভুর আখড়ায় কণ্ঠি ছুঁয়ে দিব্যি কেটেছি। আর কোনদিন ওসব অধম্মের পথে যাবনা।” স্থির চোখে ভগবানের দিকে তাকালো বিশ্বনাথ। “আজ অধম্ম করতে নয় অধম্ম রুখতে যাচ্ছি আমরা।সেই পথে তোকে সঙ্গে নিলে পুন্য হবে আমার। বুঝেছিস হতভাগা?…নে নে অনেক দেয়ালা হয়েছে। এবার সেধে একখানা গান ধর দিকিনি” উদাস চোখে অনেকক্ষণ বন্ধুর দিকে তাকিয়ে রইলো ভগবান। তারপর পালঙ্কের ধারে হেলান দিয়ে গান ধরলো করুণ সুরেলা গলায়-“এত যদি পাপ পথে, তবে মনে বল কেন নাহি দিলে/ বিষবল্লরী কেন আপাতরম্য কুসুমভূষণে সাজাইলে…”
আগের পর্ব – শোণিতমন্ত্র (পর্ব ৯)
জন্ম ও বেড়ে ওঠা উত্তর কলকাতার পুরোনো পাড়ায়। বহু অকাজের কাজী কিন্তু কলম ধরতে পারেন এটা নিজেরই জানা ছিল না বহুদিন। ফলে লেখালেখি শুরু করার আগেই ছাপ্পান্নটি বসন্ত পেরিয়ে গেছে। ১৪২১ সালে জীবনে প্রথম লেখা উপন্যাস 'দ্রোহজ' প্রকাশিত হয় শারদীয় 'দেশ' পত্রিকায় এবং পাঠকমহলে বিপুল সাড়া ফেলে। পরবর্তীতে আরও দুটি উপন্যাস 'জলভৈরব' (১৪২২) এবং 'বৃশ্চিককাল' (১৪২৩) প্রকাশিত হয়েছে যথাক্রমে পুজোসংখ্যা আনন্দবাজার এবং পত্রিকায়। এছাড়া বেশ কিছু প্রবন্ধ এবং দু চারটি ছোটগল্প লিখেছেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকা আর লিটিল ম্যাগাজিনে। তার আংশিক একটি সংকলন বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে 'ব্যবসা যখন নারীপাচার' শিরোনামে। ২০১৭ সালে পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি পুরস্কার।
এ গানের কলি কথা পেলে কমরেড, তোমার মতো গল্পকার এখন কে আছে, কি বুনোট? স্তম্ভিত হয়ে পড়তে হয়, কি সাজিয়েছ এই রাজা বিশ্বনাথ কে ? একেবারে প্রতিটি বাঙালীর মনের রাজা যেন ? জিও কমরেড, জোতদার জমিদার বদ বাবু খতমেরলাইন কি ভোলা যায় , এটাই বাংলা ও বাঙালীর অনাবিল মননের অভীপ্সার ইতিহাস। আর ভেতরটা কোন বাঙালীর ভক্তিরসে সঞ্চিত নয়? ভেতরে বৈষ্ণব, বাইরে মা ভবানীর রূহ , এটাই যে আপামর বাঙালীর ঐতিহ্য। ষাষ্টাঙ্গের কুর্নিশ রইলো। সরস্বতী আর রসূলের দোয়া থাকুক তোমার কলমে।
১ থেকে ১০ একটানা পড়লাম। এত জীবন্ত জমিদার লেঠেল ডাকাত সাহেবের চরিত্র এর আগে পড়িনি। সামন্ত যুগ নিয়ে বহু লেখা পড়েছি কিন্তু এই গতি, এই আর্থিক সামাজিক অবস্থা, এই অন্তজ শ্রেণীর অনুপুঙ্খ এর আগে পাইনি। বিশাল ক্যানভাস। এগিয়ে চলুক লেখা বন্ধু।