শঙ্খদার সঙ্গে আমার আলাপ প্রায় তিরিশ বছরের। মনে পড়ছে, ১৯৯৫ সালে বছর পঁচিশ পর বিড়লা অ্যাকাডেমিতে আমার একটা বড় প্রদর্শনী হয়েছিল। তার আগে শেষ বড় প্রদর্শনী হয়েছিল ১৯৬৯ সালে। মাঝে যদিও অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসে একটি প্রদর্শনী করি ৮১ সালে। কিন্তু সেটা ততটা বড় ছিল না। তো, ‘৯৫ সালের প্রদর্শনীটি বিশেষ ছিল, কারণ মাঝের পঁচিশ বছরের বিরতিতে আমি আসলে দূর থেকে এই শিল্পসংস্কৃতির জগতটা দেখছিলাম। তারপর এই ফিরে আসাটা তাই আমার কাজের একটা ব্রেক-থ্রু বলতে পার।

আমার সঙ্গে সুবিমল লাহিড়ির আলাপ ছিল। সুভাষ চৌধুরীর ইন্দিরা গোষ্ঠীর সূত্রেই তাঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। তো, সুবিমলদাই বললেন, শঙ্খদাকে প্রদর্শনী উদ্বোধনের জন্য বলা যাক! বলা বাহুল্য, এর চেয়ে ভাল প্রস্তাব আর হয় না। উল্লেখ্য, ১৯৯৪ সালে আমার একটি বই প্রকাশিত হয় আমার ছবি-লেখানামের। সে বইটি শঙ্খদাকে দিয়েছিলাম। সেটি পড়েই উচ্ছ্বসিত হন তিনি। এক কথায় রাজি হয়ে যান উদ্বোধনের প্রস্তাবে। এই উদ্বোধন অনুষ্ঠানও ছিল অভিনব। কোনও ফিতে কাটা বা প্রদীপ জ্বালানো হয়নি অনুষ্ঠানে। শঙ্খদা স্বভাবমতোই বেশ কিছুটা আগেই চলে এলেন। সবার সঙ্গে কথা বলে একটি কবিতাও লিখলেন শেষে, সেটাই হল উদ্বোধন। সে কবিতাটা ছিল এ রকম-

হারিয়ে যাওয়া দেশের মধ্যে
হারিয়ে যাওয়া সময়ের মধ্যে
নিজেকে ফিরে ফিরে পাওয়া
দৃশ্যে স্পর্শে ভালো লাগবার
সম্পূর্ণ এক অনুভব

তিনটে ভাগ ছিল এই প্রদর্শনীর। একটা ভাগে ছিল বড় বড় ক্যানভাস, আর একটা ভাগে ছিল আমার ছবি-লেখাবইয়ের স্মৃতিচারণমূলক বাড়ি ভেঙে যাওয়ার নানা দৃশ্য। এই ছবিগুলো শঙ্খদার বিশেষভাবে ভাল লেগেছিল। আর পোর্ট্রেটের একটা সিরিজও ছিল প্রদর্শনীতে যা ওঁর খুব ভাল লেগেছিল, কারণ সেখানে ওঁর প্রিয় অনেক মানুষের ছবি ছিল। তাঁদের মধ্যে ছিলেন দীপক মজুমদারও। শঙ্খদার ঘুমিয়ে পড়া অ্যালবামবইতে দীপকদার কথা আছে আইওয়ার স্মৃতিচারণে। প্রদর্শনীর শেষ ভাগটায় ছিল নানা ফটোগ্রাফ। তখনও চিত্রপ্রদর্শনীতে ফটোগ্রাফ রাখার চল ছিল না কলকাতায়। আমরা প্রথা ভেঙেছিলাম নানাভাবেই। আর সেভাবেই শঙ্খদা আমাদের সমর্থন করেছেন আজীবন।

Shankha Ghosh

২০০২-০৩ সালে সম্ভবত শঙ্খদার ৭২ বছর বয়সে দেবেশ রায় একটি বইয়ের পরিকল্পনা করেন দেজ পাবলিশিংয়ের সঙ্গে। বইটির নাম ছিল শতসানুদেশ। বইটির প্রচ্ছদ ও অলংকরণ আমাকেই করতে বলেন দেবেশদা। শঙ্খদাকে না জানিয়েই এই পরিকল্পনা করা হয়, কারণ উনি এসব বিশেষ পছন্দ করতেন না। তবু দেবেশদা এই উদযাপনকে মেলে ধরতে একটি মিছিলেরও আয়োজন করেন। সে মিছিল শঙ্খদার বাড়ি পর্যন্ত গিয়েছিল। তারপর বইটি উপহার দেওয়া হয় শঙ্খদাকে। বইতেই শঙ্খদার একটা পোট্রেট আঁকি। এই আঁকাটা আমি ওঁর সামনে বসে আঁকতে চেয়েছিলাম। সেই মতো, দেবেশদাকে বলি ওঁকে কথা বলে ব্যস্ত রাখতে। 

আমাদের কৌশল ধরে ফেলেছিলেন শঙ্খদা। কিন্তু উনি তো অসম্ভব ভদ্র, তাই কিচ্ছু বলেননি মুখে। মানে ওঁকে যদি না দেখানো হয়, উনি সে পোর্ট্রেট তো দেখতেও চাইবেন না। যেমন না লিখে দিলে উনি কোনও বইও উপহার নিতেন না। সেই পোর্ট্রেট আমি এই লেখার সঙ্গে দিলাম। এবং তার সঙ্গে একটি লেখাও আমি লিখেছিলাম সেই সংকলনে, সেটাও এখানে তুলে দিলাম-

এই ছুঁয়ে যাওয়া যাদু-ক্রিয়া কি কখনো অস্ত যায়? অথবা চোখের আড়ালে। সূর্য্যের মতো। যার আসলে কোন অস্ত যাওয়া নেই। আড়ালে চলে যাওয়াই শুধু আছে। আর আছে অন্ধকার। আলোর নিশানা।

কোন এক সাক্ষাৎকারে কেউ বলে ওঠে- তাঁর সংগ্রহের আমার আঁকা এক ছবি, এক সকালে হঠাৎ বাতিল করলে। কোন ঘৃণা থেকে নয়, না-ভাল লাগা থেকে নয়, হঠাৎ-ই বাতিল করা হলো।- আমার প্রতিক্রিয়া?

আমরা দৃশ্য থেকে দৃশ্য পরিত্যাগ করে চলে যেতে থাকি। তা তো এক রকম বাতিলই। দৃশ্য-র পর দৃশ্য। ছায়ার পর ছায়া। পট পাল্টানো। কেমন ছিল সেই বাতিল-কাহিনী? যে বাহির-ঘরে অনেকের আনাগোনায় সে ছবিতে চোখ আটকে যেতো, সরিয়ে দেওয়া হলো কোন ভিতর নিভৃতে। ফাঁকা উঠোনে রোদ জল আসে। ফেলে রাখা হলো আরও কিছু কাল। সেই উঠোনে। রঙে বয়স ধরলো। চিড় খেলো। ঔজ্জ্বল্য গেলো। ধুলো, রোদ, জল, কাদা, তারা সার সার দাঁড়িয়ে। কোন এক সকালে বাঁশি বাজে। পচাকাঠের ফ্রেম, ভেজা ক্যানভাস পরস্পরের দিকে তাকায়….

Shankha Ghosh

নিজেকে ফিরে ফিরে পাওয়া

দৃশ্য নিজেকেফিরিয়ে দেয়। রেখাগুলোর চলন সিসমোগ্রাফের মত কম্পনের তেজ বুঝিয়ে দেয়৷ মৃদু অথবা তীব্র। আনমনা সময় সেও কখনও কখনও থাকে। রক্তক্ষরণ তাও দেখেছি আমরা। কালো ভাস্কর্য্যগুলো লোহার পাতের। মোটা তুলির আঁচড়ের মতো যখন মাটি থেকে উঠে দাঁড়ায়, তাঁর শরীরে আঁকা থাকে প্রাচীন সংকেত। সেও বাতাসকে সময় দিয়ে আলিঙ্গন করে। মরচে রঙা রেখা সেও অপেক্ষায় আছে। বহুকাল পরেও তার পাঠ নিতে গিয়ে আমরা হারিয়ে যাই সেই সময়ে, সেই বয়সে, সেই শরৎকাল। 

এখানেই ছবিতে কাল আসে

কাল রেখা হয়। নগ্ন রেখা। রেখা কখনও চিকন। তীক্ষ্ণ, নরম শরীরে নখের দাগ ফেলে জমাট বেঁধেছে রক্ত। কখনও সুডৌল। সুডৌল নিতম্বের মত উরু বেয়ে নীচে নেমে যায়। রেখা স্তনকে দু ভাগে চিরে নাভিকে প্রণাম করে। রেখা চুল হয়ে নেমে যায় পীঠভূমি মেরুদণ্ডে। রেখা শরীরের প্রান্ত হাঁটা আনমনা অচঞ্চল বেগুনিরঙা পিঁপড়ের মতো বয়ে যায়। রেখা ধ্যানে। রেখা সমাধিতে।

… ‘দৃশ্যে স্পর্শে ভালো লাগবার
    সম্পূর্ণ এক অনুভব

অনুভব তখন স্মৃতিতে। লোক কথায়। কথা-পরম্পরা জিইয়ে রাখে স্মৃতি। যেমন মার চিতা থেকে উঠে আসা আগুনের হল্কা জোনাকীর মত উড়ে বেড়ায়। পরস্পর চুম্বন করে। কালো আঁধারে। 

ভাস্কর মীরা মুখার্জির ঢালাই কাজে যে টিনের পাতগুলো আগুন ঢেকে রাখতো তাতে দেগে ছিলো নানা পোড়া সংকেত। অদ্ভুত আকৃতি, কল্প-গাথা। পুকুর পাড়ে ভোরের আলো ফোটার সাথে ভেসে উঠছিল শরীরের মত ভাস্কর্য্যের অজস্র বলিরেখা। সময় ঘিরে। অনুভবই অনুভবে হাত রাখে।

দোলের আগের রাতে আগুন- উৎসবের পাশে, চৌরঙ্গী ধরে হেঁটে যেতে যেতে দেখি, অনামা এক বারবনিতা কৈশোর ফিরে পায়। দু-হাত পাখির মত মেলে, ইটের সারির উপর ব্যালেন্সের খেলা খ্যালে, একা, আনমনা। 

হারিয়ে যাওয়া দেশের মধ্যে
হারিয়ে যাওয়া সময়ের মধ্যে

২০০৯ সালে আর একটি কাজের সুবাদে শঙ্খদার সঙ্গে যোগাযোগ হয়। অক্ষর কখনও ঘুমোয় নানামের একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করি দিল্লিতে। তাতে অংশগ্রহণ করতে অনেক কবিকে আমরা আহ্বান জানাই। প্রায় মাসখানেক সেই সময় আমরা দিল্লিতে ছিলাম। আমি নানা সময় কবিতা নিয়ে কাজ করেছি। কিন্তু এই প্রজেক্টে ঠিক উল্টোটা করা হয়। অর্থাৎ, আমার ত্রিশটা ছবি বড় প্রিন্ট করে কবিদের দেওয়া হয়। ছ’মাসের ব্যবধানে এই ছবি থেকে কবিতা লিখতে অনুরোধ করা হয় তাঁদের। শঙ্খদা, সুনীলদা, শরৎদা, উৎপলদা, বিজয়াদি, জয় সকলেই ছিলেন। এ ছাড়াও রাহুল পুরকায়স্থ, চৈতালী চট্টোপাধ্যায়রাও ছিলেন। শঙ্খদাকে দিয়ে শুরু হয়েছিল কাজটা। একটা লেখা লিখেছিলেন তিনি এভাবেই আমার ছবি থেকে। 

Shankha Ghosh

২০১৭-১৮ সালে ‘অহর্নিশ’ পত্রিকা আমাকে একটি সম্বর্ধনা দেয়। সে অনুষ্ঠানেও উপস্থিত ছিলেন শঙ্খদা। অনুষ্ঠানে বিশেষ কিছু না বললেও, শেষে আমাকে আলাদাভাবে কয়েকটা কথা বলেন। তিনি জানান, ‘আমার ছবি-লেখা’ বইটি পড়ে ওঁর মনে হয়েছিল, কেন লেখেন! শঙ্খদার ওই মানের গদ্য বা কবিতার পরেও ওঁর মনে হচ্ছে, ‘কেন লিখি‘! এ বিস্ময়ের কারণেই কখনও ছবিকে ঘিরে ওঁর উৎসাহের কমতি দেখিনি। ইচ্ছে হলেই ওঁর বাড়িতে ছবি নিয়ে চলে গেছি দেখাতে। উনি সব সময় পাশে থেকেছেন, কখনও বিরূপ হননি। সাহিত্যের লোকেরা সাধারণ এত ছবি নিয়ে উৎসাহ দেখান না। কিন্তু শঙ্খদা ব্যতিক্রমী ছিলেন। আমার ছবির সঙ্গে বহু সময় কাটিয়েছেন তিনি।

১৯৯৭ সালে তথ্যকেন্দ্রের আরও একটি প্রদর্শনীতে শঙ্খদা এসেছিলেন। কবিতা না পড়লেও তিনি আসতেন সব সময়, শেষ-পর্যন্ত থাকতেনও। কখনও বুঝতে দেননি, উনি সাংস্কৃতিকভাবে আমাদের আভাঁ-গার্দ সংস্কৃতির বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে। বারবার নিজের আগ্রহে, শরীর খারাপ সত্ত্বেও আসতেন, আমাদের বুঝতে চাইতেন, কথা বলতেন আমাদের সঙ্গে। মনে আছে, ভূমেনদার প্রয়াণের কিছুদিন আগে ওঁর কবিতা সংগ্রহ উদ্বোধন করবেন শঙখদা। অনুষ্ঠানটা রাহুল পুরকায়স্থের বাড়িতে হচ্ছিল। যথাসময়ে এলেন তিনি। অনুষ্ঠানের শেষে পান-ভোজনের ব্যবস্থাও ছিল। শঙ্খদার সামনে কীভাবে আমরা পান করব? এদিকে তিনি আড্ডায় মশগুল। রাহুল ওঁকে শেষে জিজ্ঞেস করল, ‘আমরা পান করলে আপনার কি অসুবিধে হবে?’ তার জবাবে তিনি পাল্টা জানালেন, ‘আমি থাকলে কি তোমাদের অসুবিধে?’ এটা কিন্তু ওঁর প্রজন্মের আর কারও কাছে আশা করা যায় না।

Shankha Ghosh

আসলে এখানটাতেই শঙ্খদা ছিলেন সাঁকোর মত। দীপকদা-সন্দীপনদাদের সঙ্গে সাংস্কৃতিক যত দূরত্বই থাকুক, উনি কিন্তু সংযোগ রাখতেন, প্রশ্রয় দিতেন। এ জন্যেই অন্তর থেকে সকলে ওঁকে অভিভাবক ভাবত। শঙ্খ ঘোষকে তাই সহজেই শঙ্খদা বলতেও পারতাম। কুন্ঠা বোধ হত না। এখানেই তাঁর সঙ্গে আমার শিল্প ও জীবনের অন্তরের যোগ, আজীবনের।

প্রধান স্কেচ ও লেখার ভিতরে ব্যবহৃত সব স্কেচ লেখকের করা। লেখকের সৌজন্যে প্রাপ্ত।

হিরণ মিত্রের জন্ম ১৯৪৫ সালে খড়গপুরে। মধ্য কৈশোরেই কলকাতাবাসী এবং আর্ট কলেজের পাঠ। তাঁর ছবি বরাবরই বিমূর্ত অথচ বাঙ্ময়। চলচ্চিত্র থেকে টেলিভিশন, মঞ্চ থেকে সাহিত্য, কাজ করেছেন সব ক্ষেত্রে। সমসাময়িক বাংলা প্রচ্ছদ জগতে হিরণ মিত্রের নাম একমেবাদ্বিতীয়ম। বাস্তবতা ও সময়ের গোধূলিলগ্নে দাঁড়িয়ে তুলি হাতে সতেজ টান দিয়ে সৃষ্টি করে চলেছেন একের পর এক মাস্টারপিস।

One Response

  1. ঝিনুক, তোমায় পেয়ে আমার ভেতরে বিত্তের ধারণা জেগে ওঠে
    আরো বেশী সমৃদ্ধি জীবনে জুড়তে চেয়ে
    লালসার শিখা কেঁপে ওঠে…প্রতিকৃতি ভেঙে যায়…
    খেয়ালই থাকেনা আমার অন্দর থেকে জেগে ওঠে অন্য কেউ!
    হিরণ মিত্র একজন অসম্ভব গুণী মানুষ আপামর সংস্কৃতিবান মানুষজনই জানেন। তাঁর ছবি, লেখা বহুল সমাদৃত বহু আগে থেকেই। কিন্তু এমন একটি স্মৃতিচারণ, যার কোন বহির্মুখ নেই, চিরাচরিত গলিপথে হাঁটা নেই, দেখনদারি নেই…শুধু আত্মকথন, আর সেই শব্দ-যতির চিরকুটগুলি হাওয়াকে দিয়ে দেওয়া সুদূরে অচিনে কোথাও নিয়ে চলে যেতে, আমাদের হিসেবের চৌখুপ্পি থেকে স্থানান্তরিত করতে অন্য কোন লোকে…লেখাতেও এমন হয়! হয়। আর হয় বলেই, এ লেখা পাঠের পর স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে সময়, তার গা থেকে মুহূর্তরা আলগা হয়ে গিয়ে আসঞ্জনের ঘোর হারিয়ে ফেলেছে সম্ভবত, সেই অন্তর্লীনের সাথে দেখা হল…
    সম্ভ্রান্ত পত্রিকার শিরোস্ত্রাণে ঝলসে উঠল আরো একটি মহার্ঘ্য পালক অলীক মন্তাজে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *