আগের পর্ব পড়তে: [] [] [] [] [] [] [] []

অনেক, অনেকদিন পর ঝিলি আজ রান্নাঘরে এলো। নিজের হাতে একটা জম্পেশ ব্রেকফাস্ট বানাবার ইচ্ছে ছিল। কড়াইশুঁটির কচুরি আর ঝাল ঝাল ছোট আলুর দম। বাজারে এখন প্রচুর কড়াইশুঁটি আর ছোট আলু উঠেছে। পারল না। কড়াইশুঁটি বেটে পুর ভরবার পুরো প্রক্রিয়াটা ভাবতেই তার মাথা ঝিমঝিম করতে শুরু করল। শরীর এখনও খুব দুর্বল। তবু হাল ছাড়ল না। পেঁয়াজ, লঙ্কা, ক্যাপসিকাম, ধনেপাতা কুঁচিয়ে ডিম গুলে একগাদা ফ্রেঞ্চ টোস্ট বানিয়ে ফেলল। তারপর তার মনে হল এগুলো আদৌ করল কেন? কে খাবে?

অরুণাভ কাল রাতে বাড়ি ফেরেনি। আজকাল এরকম প্রায়ই করছে। প্রথম প্রথম বলত বিজ়নেস ট্রিপ, এখন খোলাখুলি বলে যায় রায়ার সঙ্গে বাইরে থাকতে যাচ্ছে। ঝিল্লি অসুস্থ হয়ে পড়ায় বিচ্ছেদ ও স্থানান্তর ব্যাপারটা পেছতে পেছতে অনির্দিষ্ট হয়ে পড়েছে। রায়া তাতে প্রচণ্ড বিরক্ত। সে অরুণাভর ওপর ক্রমশ চাপ বাড়াচ্ছে। এরকম পরিস্থিতিতে অরুণাভর হতাশ হয়ে পড়াই স্বাভাবিক। সে যেহেতু ঘাড় ধরে ঝিল্লিদের বাইরে বার করে দিতে পারছে না, তাই নিজেই বাইরে থাকতে শুরু করেছে।

কিন্তু এটা তো সবে ডিসেম্বর মাস। এমনিতেই ছেলের পরীক্ষা পর্যন্ত তার থেকে যাওয়ার কথা ছিল। মানে ফেব্রুয়ারি। ওহো, অরুনাভ তো বলেছিল পয়লা বৈশাখ নতুন ফ্ল্যাটে যাবার কথা। সামনে একরাশ ফ্রেঞ্চ টোস্ট, গরম গরম। একটু পরে ঠান্ডা হয়ে এদে স্বাদ চলে যাবে। চায়ের সঙ্গে বিস্কিট না খেয়ে ঝিল্লি সেগুলো খেতে শুরু করল একটার পর একটা। আজকাল তার খুব খিদে পায়। একনিঃশ্বসে সে গোটা আষ্টেক ফ্রেঞ্চ টোস্ট খেয়ে ফেলল। তারপর অতিভোগের পর অনুতাপের মতো তার বুক জ্বলতে লাগল। অ্যাসিড হয়ে গিয়েছে। সকালে ঘুম থেকে উঠেই অভ্যেসমতো চায়ের সঙ্গে বিস্কুট না খেয়ে সোজা একেবারে ডিম পাঁউরুটি খেলে এরকমই হয়ে যায়, ভুলে গেছিল সে কথা।

এরকম অনেক কথাই, নিজের শরীর মনের ছোট ছোট সীমাবদ্ধতা, চাহিদার কথা ভুলে ছিল সে এতগুলো বছর। ছোট ছোট সতর্কীকরণ, সাবধানতা কেন সে ভুলে গেছিল? কিংবা ভোলেনিভেবেছিল এগুলো আর মানার দরকার নেই তার। এগুলোকে পাশ কাটিয়েই তার জীবন দিব্যি এগিয়ে চলবে। চলল না তো। ঘুম থেকে উঠে ডিম খাওয়ার মতো সামান্য ঘটনাই মেনে নিতে পারে না তার শরীর। সেই শরীর কেন অরুণাভকে মেনে নেবে? এমনকী রায়ার সঙ্গে সম্পর্কিত জেনেও সেই শরীরকে বিশুদ্ধ জৈবিক চাহিদায় কেন সে গ্রহণ করল কয়েক মাস আগে? সেই চিহ্ন ধারণ করে ফেলেছিল তার শরীর, বইতে পারল না, মিসক্যারেজ হয়ে গেল। তার জের কতদিন বইতে হবে কে জানে। এভাবে অবাঞ্ছিত হয়ে কাটাতে হবে আরো কত দিন! যতদিন না তার শরীর মন একা চলার সামর্থ্য খুঁজে পায়। অ্যান্টাসিডের পাতা খুঁজতে খুঁজতে ঝিল্লি একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। এই কয়েকমাস সে মায়ের কাছে গিয়ে থাকবে। ট্রেন আর মেট্রো করে স্কুল যাতায়াতে একটু কষ্ট হবে ঠিকই, তবু সে পারবে। মার কাছে থাকলে রেঁধে খাওয়ার ঝামেলা থাকবে না। সময়টা পুরোপুরি সে নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় দিতে পারবে। কিছু একটা উপার্জনের পথ তাকে এই দু’মাসের মধ্যে খুঁজে নিতে হবে।

পৃথিবীতে এমন কোনও জায়গা নেই যেখানে সে একটুও ছোট না হয়ে, না গুটিয়ে থাকতে পারে?

এ কথা কেন এতদিন ভাবেনি ঝিল্লি? আসলে বহু বছর সে মায়ের কাছে গিয়ে এক রাতও কাটায়নি। শুধু দাদা-বউদির সংসারে অবাঞ্ছিত হয়ে গিয়েছে বলে নয়। আসলে সে ক্রমশ শহরের জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। মায়ের কাছে গিয়ে দু-তিন ঘণ্টার বেশি থাকতে পারেনি। মফসসলের পরিবেশের মধ্যে যে অতি-ঘনিষ্ঠতা থাকে, সেটা তার আর সহ্য হতে চায় না। সেই কারণেই সে ওখানে গিয়ে থাকার কথা ভাবেনি। তবে, তার থেকেও যেটা বড় কারণ, তা তো তার জীবনের এই বড় বদল নিয়ে মায়ের তীব্র আপত্তি এবং অসহযোগ। সে যেন ইচ্ছে করে অরুণাভর থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছে। অরুণাভ নয়, সে-ই যেন পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে সংসার শেষ করছে। ওদের ব্যাপারটা জানার পর থেকে মায়ের একটাই বুলি ‘এরকম করিস না ঝিল্লি, আমি কারও কাছে মুখ দেখাতে পারব না।’ দাদা-বউদি মুখে কিছু না বললেও তীব্র বিদ্বেষ ফুটে উঠছে ওদের ব্যবহারে। এমন অবস্থায় মায়ের কাছে ফিরে গিয়ে তাদের লজ্জা ও অস্বস্তি বাড়াতে চায়নি ঝিল্লি।

কিন্তু আজকের ভাবনায়, সেটা ছাড়া তার আর উপায় নেই। এখানে তারা আর কতদিন রায়া আর অরুণাভর চক্ষুশূল হয়ে থাকবে? পরীক্ষার আগে এই নাড়াচাড়ায় ছেলের রেজাল্ট খারাপ হবে। হোক। আনলাকি বাচ্চা। আনলাকি না হলে এমন ঘরে জন্মাবেই বা কেন? ওকে এখন থেকে সহ্য করা শিখতে হবে। আর আতুপুতু করা চলবে না। ভাবল বটে, কিন্তু ঝিল্লির চোখ দুটো জলে ভরে এল। মায়ের কাছে গিয়ে থাকার সমস্ত অশান্তি আর অসুবিধের কথা ভেবে তার মন আরও ভার হয়ে উঠল। পৃথিবীতে এমন কোনও জায়গা নেই যেখানে সে একটুও ছোট না হয়ে, না গুটিয়ে থাকতে পারে?

অবন্তীনগর। নামটা মাথায় আসতেই চায়ের কাপ নিয়ে জানলায় দাঁড়াল। বড় রাস্তা থেকে ভেতরে, লেক রোডের গলির এই ফ্ল্যাট থেকে আকাশ আদৌ দেখা যায় না। নীচে তাকিয়ে দেখল পাড়াটা এখনও মোটামুটি নিঝুম। কোণের ইস্ত্রিওলা শুধু তার কাজ শুরু করে দিয়েছে। কাজের লোকেরা ব্যস্ত পায়ে চলেছেরাতের শিফটের আয়া বেরিয়ে যাচ্ছে, দিনের শিফটের আয়া ঢুকছে। এ ছাড়া  জনমানুষের চিহ্ন নেই বললেই চলে। পেছনে তাকিয়ে দেখল ছেলে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। এই বিশ্ব চরাচরে সে-ই কি একা জেগে আছে? এখন কি মিথিলেশকে ফোন করবে একটা? সেও তো নিশ্চয় ঘুমোচ্ছে। এই শীতে রবিবারের ঘুমের সুখ কে-ই বা ছাড়তে চায়? মিথিলেশের পাশে বৌ ছেলে। সে কল্পনাও করতে পারবে না ঝিল্লি কীভাবে, কত নিঃসঙ্গতায়, কত অপমানের মধ্যে বেঁচে আছে।

করবে না, করবে না করেও মিথিলেশের নম্বরে রিং করল ঝিল্লি। ফোন বাজতে বাজতে থেমে গেল। স্বাভাবিকভাবেই মিথিলেশ এখনও ঘুমোচ্ছে। মিথিলেশকে সে একবার একটা মিথ্যে মেসেজ পাঠিয়েছিল। লিখেছিল সে এখন একটা নতুন ফ্ল্যাটে থাকে, মিথিলেশ যেন এক রাতে এসে থেকে যায়। সেই মিথ্যে মেসেজ নিয়ে ঝিল্লির অপরাধবোধ আছে। ঝিল্লি ফোনটা জানলায় রেখে ছেলের পাশে এসে শুলো। ছেলে মাখন বা ডাল দিয়ে ভাত খায়, সঙ্গে মাছ, মাংস বা ডিম। খাওয়ার আগে গরম গরম ডালভাত করে নিলেই চলবেকারও জন্যে পাঁচ পদ রাঁধার, রেঁধে চমকে দেবার দায় নেই আর।

তার জীবনের এই বড় বদল নিয়ে মায়ের তীব্র আপত্তি এবং অসহযোগ। সে যেন ইচ্ছে করে অরুণাভর থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছে। অরুণাভ নয়, সে-ই যেন পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে সংসার শেষ করছে। ওদের ব্যাপারটা জানার পর থেকে মায়ের একটাই বুলি ‘এরকম করিস না ঝিল্লি, আমি কারও কাছে মুখ দেখাতে পারব না।’ দাদা-বউদি মুখে কিছু না বললেও তীব্র বিদ্বেষ ফুটে উঠছে ওদের ব্যবহারে।

ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম ভাঙল একইসঙ্গে ডোরবেল আর ফোনের শব্দে। ফোন হয়তো মিথিলেশ করেছে, দেখে নিয়ে পরে রিং ব্যাক করলেই চলবে। সে দরজা খুলতে গেল। অরুণাভ! দরজা খুলতেই সে ঝিল্লির হাতে দুটো ঠোঙা ধরিয়ে দিয়ে বলল ‘গরম কচুরি, জিলিপি আছে। ছেলেকে ওঠাও। সবাই তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও।’ বলেই সে আর একটা ব্যাগ রান্নাঘরে রাখতে চলে গেল। বোঝাই যাচ্ছে বাজার করে এনেছে। মাছ, মাংস, সবজি। ঝিল্লির দেখেই ক্লান্ত লাগল। একটু আগেই কারও জন্যে রাঁধার নেই বলে তার কষ্ট হচ্ছিল। এই মুহূর্তে রান্নাবান্না ব্যাপারটাই তার কাছে অসহ্য মনে হল। সে অরুণাভর পেছন পেছন রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল।
– এত সব এনেছ কেন? তুমি কি এখানে খাবে?
– হ্যাঁ। ভালো কথা। রায়াও এখানে খাবে। তোমার অসুবিধে হবে না তো?
অসুবিধে! রান্নাঘরটা দুলে উঠল চোখের সামনে। দরজাটা প্রাণপণে চেপে সে বড় করে শ্বাস নিল। অরুণাভ সিংকে মাছ মাংস ঢালছিল। সে দেখতে পেল না ঝিল্লির অবস্থা। সে আবার বলল,
– চিতলমাছের মুইঠ্যা করো। আমি মাছ কুরে দিচ্ছি চামচ দিয়ে। আর খাসির মাংস। ব্যস।
ঝিল্লি বড় বড় চোখ করে দেখছিল। এ বড় আশ্চর্য সময় যখন আকাশ থেকে একসঙ্গে বোমা আর চকোলেট পড়ে। সে আরও কিছুক্ষণ সময় নিল। তারপর গলা পরিষ্কার করে বলল,
– অরুণাভ, আমরা যে আজই চলে যাচ্ছি!
– আজ?
অরুণাভর হাত মাছ-মাংসের রক্তের ওপর স্থির হয়ে গেল।
– আগে বলোনি তো?
– সকালেই ঠিক করেছি।
– আজকের দিনটা থেকে যাও ঝিল্লি।
এইটুকুই বলে আর কিছু বলতে পারল না অরুণাভ। ও বলতে পারল না এত বাজার কে ধোবে, কে রাঁধবে, রায়াই বা এসে কী খাবে– এই অনুচ্চার্য কথাগুলো ভেবে খুব হাসি পেল ঝিল্লির। সে ছেলেকে ডাকতে চলে গেল। ঠিক সেই সময় ফোন বাজল আবার, ঝিল্লির মনে পড়ল জানলাতে ফোনটা রেখেছিল সে। মিথিলেশ।
– ফোন করেছিলি, না?
– হ্যাঁ, অনেকদিন কথা হয় না।
– শোন না, ছেলেটা অনেকদিন ধরে বায়না করছে চিড়িয়াখানা দেখবে। ওর মা পারবে না। শরীরটা ভালো নেই। তুই আসবি তোর ছেলেকে নিয়ে? সারাদিন একসঙ্গে ঘুরব। 

ঝিল্লি একটু আগে যখন বলেছিল ও চলে যাবে, তা আদৌ সত্যি কথা নয়, রায়াকে রেঁধে খাওয়ানোর হাত থেকে ও মুক্তি চাইছিল। ও এখুনি ঠিক করল, মায়ের কাছেও যাবে না। এই ফ্ল্যাটেই দাঁতে দাঁত চেপে থেকে বৈশাখে নতুন ফ্ল্যাটে চলে যাবে। এই মুহূর্তে মিথিলেশের প্রস্তাব ওর কাছে পাখির ডানায় চেপে এল। ও সম্মতি জানিয়ে ফোন ছেড়ে দিল। দেখল রান্নাঘরের দরজায় একরাশ উৎকণ্ঠা নিয়ে অরুণাভ ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
– শোনও, একটু পরে আমি ছেলেকে নিয়ে বেরব।তোমার আনা কচুরি জিলিপি খেয়ে। একগাদা ফ্রেঞ্চ টোস্ট বানিয়েছি, ওগুলো হটপটে নিয়ে নিচ্ছি। তোমরা রেঁধে বেড়ে খেয়ে সন্ধের আগে চলে যেও। রান্নাঘর ধুয়ে মুছে যেও কিন্তু। বেরোবার আগে একটা মিসড কল দিও। আমরা তারপর ফিরে আসব। আর ভবিষ্যতে লোক নেমন্তন্ন করার আগে আমার শিডিউলটা জেনে নিও।
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে ঝিল্লি একটা জিলিপিতে কামড় দিল। আঃ, এখনও গরম আছে।   (চলবে)

 

পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ১২ সেপ্টেম্বর ২০২২
ছবি সৌজন্য: Saatchi Art

যাদবপুর বিশববিদ্যালয় থেকে বি.ই‚ এম.টেক । সরকারি মুদ্রণসংস্থায় প্রশাসনিক পদ‚ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিদর্শী অধ্যাপনা তাঁর লেখনীকে বিশেষ স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে।গল্প‚ উপন্যাস, কবিতার পাশাপাশি ছোটদের জন্য কল্পবিজ্ঞান লিখে থাকেন নিয়মিত। প্রকাশিত হয়েছে বহু বই। নামজাদা পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন উত্তর-সম্পাদকীয়। সাম্প্রতিকতম কাব্যগ্রন্থ: 'লাইব্রেরি শার্ট খোলো'।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *