“না মন লাগে না… এ জীবনে কিছু যেন ভালো লাগে না…”
আমাদের বসবার ঘর গমগম করছে যাঁর কণ্ঠস্বরে, তিনি আর কেউ নন, স্বয়ং গানটির স্রষ্টা স্বনামধন্য সঙ্গীতকার সলিল চৌধুরী। বাবার আবদারে হারমোনিয়াম নিয়ে যখন গেয়ে উঠলেন গানটি, তার আগে আমার এ গানটা হয়তো কয়েক হাজারবার শোনা। খুব ছোট্টবেলায় সেই রেকর্ড প্লেয়ারে আর তারপর বহু বহুবার ক্যাসেটে রিওয়াইন্ড ফরোয়ার্ড করে করে কত নিখুঁত করে গলায় তুলে নেওয়া যায়, তার চেষ্টা। অথচ সেই মুহূর্তে ওই অদ্ভুত সুরের জাদুকরের গলায় গানটির আবেদনই যেন পাল্টে গেছে! আর আমি সেই স্কুলে পড়া বালিকাটি যে অবাক বিস্ময়ে সেই সময়টার সমস্ত ম্যাজিক আত্মস্থ করে নিতে চাইছে।
গত ১৯ নভেম্বর ছিল সেই অপ্রতিম মানুষটির জন্মদিন। এই আবহে গল্পটা নৈবেদ্যের মতো করে সাজিয়ে বলতে ইচ্ছে যায়। এ ঘটনার আগেরদিন সকাল সকাল হঠাৎ ফোন। বাবার সেদিন প্রচণ্ড জ্বর। আমার গোটা জীবনে যে হাতে গোনা কয়েকবার বাবাকে অসুস্থ হতে দেখেছি, এটা তার মধ্যে অন্যতম ঘটনাবহুল দিন বলা যেতে পারে। যাইহোক, বাবা ফোনটা রেখে বললেন “দূরদর্শনের জন্য “শেষ প্রশ্ন” থেকে হিন্দি সিরিয়াল হচ্ছে। তাতে সলিলদা সুর করছেন। আমাকে দিয়ে একটা গান গাওয়াতে চান।” এইটুকু বলে একটা স্মিত হাসি দিয়ে থামলেন বাবা আর আমার উত্তেজনা তখন চরমে! তারপর বললেন “আমি আবদার করেছি যেন এ বাড়িতে একটু পায়ের ধুলো দেন। কাল বিকেলে আসছেন সলিলদা।”
আমার তো তখন আনন্দে আত্মহারা অবস্থা! ছোটবেলা থেকে কত গান, কত গল্প যে শুনেছি ওঁর! অনেকেই জানেন না, খুব অল্পবয়সে বাবার ইচ্ছা ছিল সঙ্গীত পরিচালক হওয়ার। অসংখ্য গান বাঁধা চলত দিনরাত আসরে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত গাইবার পাশাপাশিই। কিন্তু দাদুর অকালপ্রয়াণের পর কোটালী ঘরানার সঙ্গীতের অবয়বকে পূর্ণতা, প্রতিষ্ঠা দেওয়ার ও আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার তাগিদে সেই স্বপ্নের জগৎকে ব্যক্তিগতই রেখে দেন। কিন্তু সেইসময় যে ক’জন ভারতীয় সঙ্গীত পরিচালককে বাবা গুরুসমান মানতেন, তার মধ্যে সলিল চৌধুরী ছিলেন অন্যতম। কত কত গান যে খুঁজে খুঁজে এনে আমায় দিতেন শুনতে এবং তুলতে, আর কত কত দিন সেইসব গান গাইতে গাইতে সেইসব গানের মধ্যে কর্ডের বিভিন্ন চমকপ্রদ প্রয়োগ আর অ্যারেঞ্জমেন্ট, বিভিন্ন যন্ত্রের নতুন ধরনের প্রয়োগ আর ওঁর অনন্যসাধারণ প্রতিভা নিয়ে আলোচনা করতেন, তার ইয়ত্তা নেই।
অতএব সেই মানুষটা আসবেন এবং তাঁর সঙ্গে কাজ করা হবে, এই আনন্দটা যে কতখানি ছিল বাবার কাছে, সেটা সহজেই অনুমেয়। এইদিকে গায়ে যে অত জ্বর তা যেন ভুলেই গেলেন মুহূর্তে। পরেরদিন ঠিক বিকেল পাঁচটায় গাড়ি এসে থামল আমাদের বাড়ির সামনে। বাবার তখনও খুব জ্বর। মায়ের সঙ্গে সঙ্গে আমিও গিয়ে ওঁদের নিয়ে এলাম ওপরে। সলিল জেঠুর সঙ্গে অন্তরাদিও এসেছে আর ওঁরা সঙ্গে নিয়ে এসেছেন আমারই আর এক গুরুভাই তেজেনদা-কে (তেজেন্দ্র নারায়ণ মজুমদার)। বাবা পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বললেন “সলিলদা আপনি আমার বাড়িতে পায়ের ধুলো দিলেন এ আমার পরম সৌভাগ্য।” সঙ্গে সঙ্গে বাবার হাতদুটো ধরে বললেন “এই বাড়ি তো তীর্থ! এখানে আসা তো আমার কাছেই সৌভাগ্যের মানস!” আমরা সবাই এসে বসলাম গানের ঘরের ফরাসে।

কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর বাবা বললেন “কাজের কথা পরে হবে সলিলদা, আগে আমার একটা অনুরোধ আপনাকে রাখতেই হবে।” সলিলজেঠু হেসে উঠে বললেন “বলে ফেলো!” বাবা ওমনি হারমনিয়ামটি টেনে সামনে রেখে বললেন “না মন লাগে না-টা আপনার গলায় একবার শোনার খুব ইচ্ছে, যদি একটু শোনান–” সলিলজেঠু হেসে উঠলেন। তারপর একমুহূর্তও দেরি না করে হারমোনিয়াম টেনে নিয়ে চারটি আঙুল ফেললেন রিডের ওপর। আমরা সবাই স্তব্ধ হয়ে শুনছি তখন আর প্রত্যক্ষ করছি স্রষ্টার গলায় গানের রূপটি কেমন অন্যরকম সৌন্দর্য নিয়ে খুলছে। এরপর সময় যে কোথা দিয়ে গড়িয়ে গেল! একের পর এক গান, একের পর এক গান তৈরির পেছনের গল্প, সারারাত জেগে আসরে দাদু এবং কিশোর বাবাকে শোনার গল্প, কোন গানে কোন যন্ত্র কোথায় অসাধারণভাবে ব্যবহার করেছেন সেইসব নিয়ে বাবা তারিফ করছেন, সেই প্রভাবে কোন গান বানিয়ে ফেলেছিলেন অল্পবয়সে, সেইসব বলছেন। তারই মধ্যে চা-জলপান সারা চলছে। পৃথিবীতে যে ঘড়ি নামে একটি বিষয়বস্তু আছে তা যেন ভুলেই গেছে সবাই।
তারপর হঠাৎ যখন খেয়াল হল, তখন গপ্পো থামিয়ে যে কাজে আসা সেই দিকে মন। হারমোনিয়াম নিয়ে দেখাতে লাগলেন বাবাকে গানটা, সঙ্গে সঙ্গে অন্তরাদিও গাইছে আর আমিও মনে মনে গুনগুন। অন্তরাদিরও গানটার একটি অংশে বাবার সঙ্গে গলা মেলাবার কথা। গানটির কথা লিখেছেন কৃষ্ণ রাঘব– “মেঘ ঘনে গেহেরায়ে”। রাগাশ্রয়ী কম্পোজিশন। অথচ তাতে সুরকার সলিল চৌধুরীর আঙুলের ছাপ ছত্রে ছত্রে।
বাবা গান তুলতে তুলতে মাঝে মাঝেই তারিফ করে উঠছেন। এদিকে জ্বরে গলা ভারী হয়ে আছে। বাবা তার মধ্যেই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে গানটা দেখে নিয়ে হঠাৎ আমার দিকে দেখিয়ে বললেন “সলিলদা আমার সমস্ত গান ওর কণ্ঠস্থ। আমি কখনও কোনও লাইন ভুলে গেলে ও-ই আমায় মনে করিয়ে দেয়। ওকে আপনি গানটা ভালো করে তুলিয়ে দিন। ওর সৌভাগ্য হবে সেটা। ” সলিলজেঠু তৎক্ষণাৎ বললেন “বাহ! আমারও কিন্তু মেয়েই ভরসা! ” বলে আমার দিকে ফিরে বললেন ” আয় মা! আমার পাশে এসে বোস!”

আমার তখন বুকের ভেতরে ড্রাম বাজছে যেন! কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, অত বড় একজন মানুষ, ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুরকার-গীতিকার সলিল চৌধুরী, অথচ এমনভাবে কাছে টেনে নিলেন, যে আমিও সহজ হয়ে গেলাম। একটুও দ্বিধা হল না! একটু একটু করে স্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারীর খুঁটিনাটি, সরগম সমস্ত তুলে নিচ্ছি আর উনি দেখি বাবার দিকে চেয়ে মিটিমিটি হাসছেন আর বাবাকে নিচুস্বরে বলেছেন “ছুটকি শার্প আছে কিন্তু!” বাবারও মুখে হাসি। আমার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পাওয়া ওই প্রশংসার শব্দ তিনটে আমি এখনও কান পাতলে একই কণ্ঠস্বরে, একই টোনে শুনতে পাই। এরপর যখন সন্ধে গড়িয়ে রাতে বাড়ি ফেরবার সময় হয়ে এল, যাওয়ার সময় বাবাকে বললেন “এই গানটা তোমার হাতে দিয়ে এখন আমি নিশ্চিন্ত মানস। আবার স্টুডিওতে দেখা হচ্ছে।”
এর কয়েকদিন পর “মেঘ ঘনে গেহেরায়ে” রেকর্ড হল। স্টুডিওর সেইসব গল্পের জন্য অন্য একদিন বরাদ্দ রইল। ১৯৯৩ সালে দূরদর্শনের হিন্দি ধারাবাহিক “শেষ প্রশ্ন”-তে গানটিকে স্ক্রিনে কণ্ঠে ধারণ করেছিলেন যিনি, সেই তরুণ অভিনেতার নাম– ইরফান খান। তবে সবশেষে একটাই কথা মনে হয়, এমন শিল্পীর আসলে জন্মদিন হয় না, মৃত্যুদিন হয় না। কারণ তাঁদের কাজ একটা যুগপরিবর্তন ঘটিয়ে দিয়ে চিরসত্য আর চিরস্মরণীয় হয়ে থেকে যায়।
*ছবি সৌজন্য: Learningandcreativity, Quint, Facebook
সঙ্গীতজ্ঞ মানস চক্রবর্তীর সুযোগ্যা কন্যা শ্রীদর্শিনী উত্তর ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে তালিম নিয়েছেন এক্কেবারে শিশুবয়স থেকে। সঙ্গীত তাঁর শিরা-ধমনীতে। টাইমস মিউজিক থেকে বেরিয়েছে গানের সিডিও। মুম্বইয়ের ইন্ডিয়ান আইডল অ্যাকাডেমিতে মেন্টরের ভূমিকা পালন করেন শ্রীদর্শিনী। লেখালিখিও তাঁর পছন্দের বিষয়।তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ 'শীতের অব্যর্থ ডুয়ার্স', 'এসো বৃষ্টি এসো নুন', 'রাজা সাজা হল না যাদের' এবং 'জ্বর-জ্বর ইচ্ছেগুলো' পাঠকমহলে সমাদৃত।
Khub bhlo laglo,kichhu ajana tathya janlam.
Around lekho Amador Samariddha Koro.shubhechchha roilo bhalo theko.. Namta chhoto kore shree bolchhi karon sreeta bad debar upay nei,tahole jodi bishree hoysei bhoye