সেটা ১৯৮৮র নভেম্বর মাসের কথা। দিল্লিতে তখন কংগ্রেসের সরকার। মজদুরদের রোজগার মাসে ৫৬২ টাকা থেকে বাড়িয়ে কমসেকম ১,০৫০ টাকা করতে হবে – এই দাবিতে সাতদিনের হরতাল ডেকেছিল বামপন্থী শ্রমিক সংগঠন সিটু। হরতালের সমর্থনে পথে নেমেছিলেন অনেক মানুষ। অনেক সংগঠন। তাদের মধ্যে জন নাট্য মঞ্চও ছিলেন। ২২ থেকে ৩০ নভেম্বর হরতাল হবে। তার আগে, হরতালের কার্যকারণ নিয়ে লাগাতার ২১ দিন ধরে দিল্লি তো বটেই, শহরতলির নানান এলাকায় পথনাটক করেছেন জন নাট্য মঞ্চ। হরতাল সফল হয়েছিল। ইতিহাস সাক্ষী যে হরতালকে সফল করার লক্ষ্যে দিল্লির বুকে শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীদের একজোট করতে সক্রিয় ছিল জন নাট্য মঞ্চ। ৩৫টি অভিনয়! পথনাটকের নাম ‘চাক্কা জ্যাম’। দলের নেতা সফদার হাশমি।

হরতালের পর সিটুর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পথনাটকের মহড়া দিতে লাগলেন সফদার ও তাঁর কমরেডরা। ‘চাক্কা জ্যাম’ একটু অদলবদল করে তৈরি হল ‘হাল্লা বোল’। জানুয়ারিতে দিল্লির উপকণ্ঠে গাজিয়াবাদে ভোট। পৌর নির্বাচন। সিটুর ডাকে সাহিবাবাদ শিল্পাঞ্চলের ঝান্ডাপুর বলে একটা এলাকায় আম্বেদকর চৌকে ‘হাল্লা বোল’ করতে এসে কংগ্রেসের পোষা গুন্ডাদের হাতে আক্রান্ত হলেন জন নাট্য মঞ্চের সংস্কৃতিকর্মীরা। লাঠি ছোরা পাথর হাতে ‘হাল্লা বোলে’র কুশীলবদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল তারা। সফদারের কথা মতো কোনওরকমে তল্পিতল্পা গুটিয়ে প্রাণ হাতে করে সিটুর দফতরে ঢুকে পড়লেও শেষরক্ষা হয়নি। সিটু অফিসের দরজা আগলে দাঁড়িয়েছিলেন সফদার আর ব্রিজেন্দ্র সিং। দলের বাদবাকিরা, এমনকি সবার শেষে ব্রিজেন্দ্রও সিটু অফিসের পেছনের দরজা দিয়ে পালাতে পারলেও সামনের দরজা ভেঙে ফেলে দুষ্কৃতীরা হাতে পেয়ে গিয়েছিল সফদারকে। হাত জোড় করে তাদের অভ্যর্থনা করেছিলেন সফদার। ভবি ভোলেনি। সফদারকে টেনে হিঁচড়ে বের করে নিয়ে সেই আম্বেদকর চৌকে এক হাট লোকের সামনে লোহার ডান্ডা দিয়ে তাঁর মাথা ভেঙে দিয়েছিল তারা। আক্ষরিক অর্থে।
মারাত্মকভাবে জখম সফদারকে রামমনোহর লোহিয়া হাসপাতালে আনা হয়েছিল বটে। ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। পরদিন অর্থাৎ ২ জানুয়ারি শেষনিঃশ্বাস ফেলেছিলেন সফদার।
পরদিন হাজার হাজার মানুষ সফদারের শেষযাত্রায় হেঁটেছিলেন। তাদের একটা বড় অংশ ছিলেন শ্রমিক। সেই সব শ্রমিক যাদের ভাবিয়ে তুলতে বাঁচিয়ে রাখতে রাতদিন এক করে বছরের পর বছর ধরে পথনাটক করে গিয়েছেন সফদার ও তাঁর জন নাট্য মঞ্চের কমরেডরা। আর তার পর দিন? সেই ঘাতক আম্বেদকর চৌকে ফিরে গেছিলেন সফদারের কমরেডরা। ‘হাল্লা বোলে’র অসম্পূর্ণ অভিনয় সম্পূর্ণ করতে।
এই তিনটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠেছিল সারা দেশ। প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল দিগ্বিদিকে। পশ্চিমবঙ্গের বুকে সাদরে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল জন নাট্য মঞ্চকে। নিমেষে কলকাতাকে জিতে নিয়েছিলেন তারা। ইডেন গার্ডেন্সে ‘মেশিন’ আর ‘হাল্লা বোল’ দেখতে পঁচিশ হাজার মানুষের জমায়েত হয়েছিল। ক মাস পর ১২ এপ্রিল সফদারের জন্মদিন। দিনটিকে ‘ন্যাশনাল স্ট্রিট থিয়েটার ডে’ হিসেবে উদ্যাপন করার ডাক দিয়েছিলেন ফয়সল আলকাজি। এক কথায় গৃহীত হয় সেই প্রস্তাব। ইতিহাসে আছে যে ১৯৮৯-এর ১২ এপ্রিল সারা ভারত জুড়ে ৩০ হাজারেরও বেশি নাটকের দল ‘হাল্লা বোল’ অভিনয় করেছিল।
সফদার হাশমি নামক কিংবদন্তির জন্ম হয়েছিল সেদিন। মৃত্যুর আগে হয়তো কয়েক হাজার মানুষ তাঁকে চিনতেন। মরণোত্তর পর্বে চিনেছেন লাখো কোটি মানুষ।

তারপর বত্রিশ বছর কেটেছে। কিংবদন্তির ক্ষয় হয়েছে। রক্তক্ষরণ হয়েছে পথনাটক সংস্কৃতির। বাম সাংস্কৃতিক আন্দোলনের হাত ধরে যে পথনাটক একদা দিন বদল ঘটানোর স্পর্ধা রাখত, তা আজকাল অ্যাজিট-প্রপ বা পোস্টার প্লে-র আওতার বাইরে বেরোয় কম। আজ পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনের মরসুমে সিপিআই(এম)-এর সমর্থনে কোনও কোনও জায়গায় সক্রিয়তা দেখাচ্ছেন কিছু নাটকের দল। বিজেপি-র সমর্থনেও পথনাটকের খবর এসেছে। এ সবের পেছনে নিঃশব্দ উপস্থিতি আছে বাদল সরকারের, বা আরও আগেকার পরেশ ধর-পানু পালের, বা বীর সেন-উৎপল দত্তদের। এবং অবশ্যই সফদার হাশমির। পথনাটক যে মেহনতি জনতার রাজনৈতিক আন্দোলনের হাতিয়ার হতে পারে এই অনুভবকে মান্যতা দিয়েছে সফদারের জীবন। তাঁর মৃত্যু এই হাতিয়ারকে মরণজয়ী জীবনের গানে রূপান্তরিত করেছে। ‘হাল্লা বোল’ আজ যে কোনও ধরনের দমনমূলক আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা। জন নাট্য মঞ্চ আজও সক্রিয়। তাদের আরও অন্যান্য নাটক – যেমন ‘মেশিন’ বা ‘আওরত’ – আজও অগণিত আন্দোলনের নিশান। পথনাটক নিয়ে জান কবুল বা মান কবুল করে যারা পথ চলেছেন তাদের কাছে ধ্রুবতারা হয়ে আছেন জন নাট্য মঞ্চ ও সফদার। শুধু ভারতে নয়, বাংলাদেশেও। ১৯৯০-র দশকের গোড়ায় বাংলাদেশের এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনে পথনাটকের যে বড় ভূমিকা ছিল তার পেছনে সফদারের শাহাদাতের অনুপ্রেরণা ছিল উল্লেখযোগ্য। আজও সফদারের স্ত্রী মলয়শ্রী ঢাকায় গেলে আবেগের বান ডাকে।

প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার পথনাটকের গাঁটছড়া বাঁধা পড়েছে কবেই। পেশীশক্তির আস্ফালন বেড়েছে বই কমেনি। হামেশাই নাটক বন্ধ করে দেবার ঘটনা দেখছে এই দেশ। এই রাজ্যও। কদিন আগে দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাসন্তীতে পথনাটক ‘ইঁদুরকল’ করতে গিয়ে এক সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলের হাতে আক্রান্ত হলেন জনগণমন নামে একটি পথনাটকের দল। বছর দেড়েক আগে কল্যাণীর ঋত্বিক সদনের সামনের মাঠে ‘রক্ত উপাখ্যান’ নামে একটা পথনাটক করেছিলেন শান্তিপুর সাংস্কৃতিক। তাতে কলকাতা নোয়াখালি বিহার গোধরা দাঙ্গার ভয়ঙ্কর স্মৃতিকে উসকে দিয়ে হুঁশিয়ার করা হয়েছিল দর্শকদের। এর দুদিনের মাথায় ঋত্বিক সদনে চড়াও হবার হুমকি এসেছিল সেই একই দলের স্থানীয় কেষ্টুবিষ্টুদের তরফ থেকে। রুখে দাঁড়িয়েছিলেন নদিয়া ও উত্তর ২৪ পরগনার নাট্যকর্মীরা। এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে। পরেও ঘটবে। প্রত্যেকবার লড়াকু নাটকওয়ালাদের মধ্যে বেঁচে উঠবেন সফদার হাশমি। তাদের রক্তপ্রবাহে প্রবাহিত হবেন। বছর বছর ১ জানুয়ারি বা ১২ এপ্রিল এলে সবাই নড়েচড়ে বসবেন। চোয়াল শক্ত করে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানোর মহড়া দেবেন সফদারকে মনে রেখে।

মাঝেমাঝে ব্যক্তি সফদারকে নিয়েও কারওর মাথা ব্যথা হতে পারে। তাদের জ্ঞাতার্থে জানিয়ে রাখা যাক যে সফদার জন্মেছিলেন দিল্লিতে। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের ১২ এপ্রিল। ভারতের ছাত্র ফেডারেশনের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি হতেই নাটকের দল জন নাট্য মঞ্চ গড়েন সফদার ও তাঁর কমরেডরা। সেটা ১৯৭৩-এর কথা। প্রথমে সেন্ট স্টিফেন্স কলেজ, পরে দিল্লি ইউনিভার্সিটি থেকে ইংরিজি নিয়ে পড়াশুনোর পাশাপাশি নাটক চালিয়ে যান সফদার। বড় ঘরের ছেলে ছিলেন। তুখোড় পড়ুয়া ছিলেন। চাইলেই বড়সড় চাকরি বগলদাবা করতে পারতেন। পায়ের ওপর পা তুলে থাকতে পারতেন। তার বদলে কালচারাল অ্যাক্টিভিস্টের জীবন বেছে নেন সফদার। শ্রমিক-কৃষকদের মধ্যে গিয়ে বাম রাজনীতির বীজ বুনতে থাকেন। মধ্যবিত্তের অলসস্বপ্নকে নাড়া দিতে থাকেন। তাঁকে সামনে রেখেই দিল্লিতে পথনাটকের পালে হাওয়া আসে। ১৯৭৫এ জরুরি অবস্থা জারি হবার আগে পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির রাজনীতিকে শ্লেষবিদ্ধ করে চলেছেন সফদার। জরুরি অবস্থা উঠে গেলে আবার সক্রিয় হয় জন নাট্য মঞ্চ। কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া (মার্কসবাদী)র সদস্য সফদারের কথায় আর কাজে কোনও ফারাক ছিল না। দল যখনই ডেকেছে তখনই ছুটে গেছেন। বিশেষ করে সিটুর সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকেছেন। খুব কম লোক জানে যে ১৯৮০-র দশকের গোড়ায় কিছুদিন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের চাকুরে ছিলেন সফদার – নয়া দিল্লিতে কর্মরত প্রেস ইনফরমেশন অফিসার হিসেবে।

মাত্র ৩৪ বছর বয়সে সফদার শহিদ হবার পর পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সক্রিয়তা ছিল মনে রাখার মতো। পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমি ও অন্যান্য সহযোগী সংগঠন তাঁকে উৎসর্গ করে পথনাটকের উৎসব করেছেন, বই ছেপেছেন, আলোচনার পরিসর তৈরি করেছেন। তার রেশ একেবারে মিলিয়ে যায়নি। সুদূরপ্রসারী ফল ফলেছে রাজ্য জুড়ে।
আর জন নাট্য মঞ্চের তৎপরতা আগের মতো না থাকলেও এখনও তারা সক্রিয়। সফদারকে উৎসর্গ করে সহমত বা সফদার হাশমি মেমোরিয়াল ট্রাস্ট নামের এক সংগঠন ক বছর আগেও ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামার লাগোয়া কোপারনিকাস মার্গে দফতর চালাতেন। সফদারের মৃত্যুবার্ষিকীকে বড় আয়োজন করতেন। কলকাতার লোক গেলে খাতির হত খুব। রাজরোষে পড়ে তাদের একটু দূরে সরে যেতে হলেও যে কোনও রকমের দমনপীড়নমূলক ক্রিয়াকলাপ নিয়ে তারা গলা তোলেন। সফদারের দেখানো পথে মানুষকে সংগঠিত করেন। সফদারের গুণগ্রাহী নাটককার গোবিন্দ পুরুষোত্তম দেশপান্ডের ছেলে সুধান্য এককালে সফদারের পাশে পথনাটক করেছেন। হালে দিল্লির গুরু নানক নগরে গড়ে তুলেছেন স্টুডিও সফদার। এমন পারফর্মেন্স স্পেস লাখে একটা মেলে। জন নাট্য মঞ্চের ঘাঁটি এখন সেখানেই। সুধান্য ক বছর আগে ‘হাল্লা বোল’ নামে সফদারের এক জীবনী লিখেছেন। যে কোনও সফদার অনুরাগীর কাছে অবশ্যপাঠ্য লেফটওয়ার্ড বুকের এই প্রকাশনা।
অংশুমান ভৌমিকের জন্ম ১৯৭৫-এ কলকাতায়। ছেলেবেলা কাটিয়েছেন মামারবাড়ি নবদ্বীপে। গত চার দশক কলকাতার বাসিন্দা বা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরিজির এমএ হলেও বাবার 'দেশ' বরিশাল আর মায়ের 'দেশ' নদিয়ার মধ্যে দোদুল্যমান তাঁর অস্তিত্ব। পেশায় শিক্ষক, নেশায় কালচারাল কমেন্টেটর। বাংলা ও ইংরেজিতে লেখালেখি করছেন দু'দশকের বেশি। দেশবিদেশ থেকে প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা বারো। 'দ্য টেলিগ্রাফ' ও কৃত্তিবাস-এর নাট্যসমালোচক হিসেবে ইদানীং থিতু।