আগের পর্বের লিংক: [১]

কিরণবালা মুক্তাগাছার মিত্রবাড়ির মেয়ে৷ তার চেয়ে বড়ো পরিচয়, উকিলবাড়ির একমাত্র মেয়ে৷ বাবা অমলকান্তি৷ বড়দা অরুণকান্তি৷ ছোড়দা অর্ণবকান্তি৷ তিনজনই উকিল৷ বাবার রমরমা পসার ছেলেরাও পেতে শুরু করেছে৷ সকাল থেকে মক্কেল৷ দুপুরে কাছারি৷ ফিরতে ফিরতে সন্ধে হয়ে যায়৷ কোনও কোনও দিন হ্যাজাক জ্বেলে রাত পর্যন্ত বিবাদের বিবরণ আর আইনের প্যাঁচপয়জার৷ ঢালাও প্রজননের পরিবারে চাষজমি বাসজমির ভাগ নিয়ে শরিকি বিবাদ কৃষিপ্রধান বাংলার তেপান্তর জুড়ে৷ কার কত ছটাক জমি কে বেদখল করেছে, কে জাল দলিল দেখিয়ে কার বসতভিটায় ভাগ বসিয়েছে, কে জজসাহেবের রায়কে কলা দেখিয়ে জমি কায়েম রেখেছে, আরও কত মামলা৷ সম্পত্তির ঝগড়া-অশান্তি অস্ত্রশস্ত্র, রক্তারক্তি, খুনখারাবিতে পৌঁছয়৷

বাড়ির ছোট মেয়ে কিরণবালার অতশত বোঝবার কথা নয়৷ বৈঠকখানা আর বারান্দা জুড়ে বাবা-দাদাদের রাজত্ব৷ কিরণের রাজত্ব উঠোন থেকে মায়ের কোল৷ বাবা-দাদাদের সঙ্গে দেখা হলে একটু আদরের পরই ‘পড়তে বোস’, ‘স্কুলে পড়া কেমন হচ্ছে’, ‘পরীক্ষা কবে’ ইত্যাদি৷ ছোড়দা অবশ্য বোনের সঙ্গে কিৎকিৎ খেলেন৷ কানামাছি হয়ে বোনকে ধরতে গিয়ে ইচ্ছে করে পড়ে যান, নাচতে নাচতে উঠে দাঁড়ান৷ বোন বেজায় খুশি৷ কিছুটা বড়ো হলে, এন্ট্রান্স পরীক্ষার আগে ছোড়দার সঙ্গে সম্পর্কটা বন্ধুর মতোই, তবু কেমন যেন একটু অন্যরকম, আগের মতো নয়৷ ছোড়দা নাকি তখন গোপনে স্বদেশির দল করছেন৷ একদিন বলেছিলেন, 

‘বড়ো হও, তোমারে বুঝায়ে বলুম, হাজার হাজার মামলার মধ্যে আছে আমাগো অনৈক্য, আমাগো হিংসা বিদ্বেষ৷ আমরা টুকরা টুকরা হইয়া আছি৷ বাইরে থিক্যা কেউ ডাক দিল আর ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু হইয়া গেল, এমনটা হবার নয়৷ বইনরে আমার, আমাগো নিজেগো ভিতর কত লড়াই৷ জমি লইয়া, ফসল লইয়া, কর্ম লইয়া, ধর্ম লইয়া৷ মীমাংসা নাই৷ ভাইয়েরা নিজেগো মইধ্যে খুনাখুনি করে৷ একদিন দেখুম, নিজেগো ভাগের লড়াই আর রাগের লড়াইয়ের ফাঁক দিয়া আসল শয়তান হাজির হইছে৷ আমাগো জমি হইব৷ দেশ হইব না৷ আমরা নাইআত্মীয় নাইস্বজন নাইছায়া খরখর জমিতে কুকুর-বিলাইয়ের মতো বাঁচুম৷’   

ছোড়দাকে খুব মনে পড়ে কিরণবালার৷ বালক নাতিকে তিনি বলেছেন অর্ণবকান্তি মিত্রের কথা৷ কিরণ যেমন সেই বয়সে বোঝেননি ছোড়দা কী বলতে চাইছেন, তেমনি বালকও বোঝেনি তার দিদিমা কী বলতে চাইছেন৷ পরে কুয়াশা হয়তো কিছু আবছা হয়েছে৷ হয়েছে কি? অন্ধকার কখনও আলো বলে বিভ্রম হয়৷ বালক মনে করতে পারে, অর্ণবকান্তি খুন হন৷ গ্রামের লোকজন বলে, হাসু ফকির তাঁকে খুন করেছে৷৷ কিরণবালা বলেছেন, হাসু জমিদারদের ভাড়া খাটত৷ তার দল ছিল৷ দল নিয়ে ডাকাতি করত৷ তিনবার তাকে লম্বা মেয়াদে কয়েদখাটা থেকে বাঁচান উকিল অমলকান্তি৷

‘কৃষ্ণদাস, বাবায় বিশ্বাস করত হাসু খুন করতে পারে না৷’ কারণ সে গান গায়৷ সে পালা গায়৷ তার মনে কোমলভাব বেশি৷ খুনের মতো পাশবিক কাজ সে করতে পারে না৷ 

‘কৃষ্ণদাস, ছোড়দা যখন খুন হইল, ভান্ডারার খালে ছোড়দার গলাকাটা দেহ পাওয়া গেল, বাবায় তখনও বিশ্বাস যায় নাই৷ বাবায় কইছিল, ছোটকা মানে অর্ণব যে কথাগুলা কয় তাতে পক্ষপাত নাই৷ সব পক্ষরেই সে সমালোচনা করে৷ ভুল-ত্রুটি ধরে৷ সুতরাং সে একা৷ একা মানুষের বিপদ বেশি৷ পুলিশেও তারে পছন্দ করে না৷ ছোটকারে সাবধান করছি৷ শুনে নাই৷ তোমরা বিশ্বাস যাইতে কও যে হাসু ফকিরে মারছে? এইটা ঠিক যে সে জমিদারের ভাড়া খাটে৷ খাজনা আদায়ে বাড়াবাড়ি করে৷ এইটাও ঠিক যে সে ডাকাতি করে৷ আমার কাছে স্বীকার গেছে৷ কিন্তু বাইদ্যা গানের মানুষ সে৷ ওস্তাদ মানুষ৷ সে খুন করতে পারে না৷ তার চোখের জল দিয়া সে আমাগো চোখে জল আনে৷ সেই চোখের জল মিথ্যা? এত বড়ো মিথ্যা আমি বিশ্বাস যাই কী প্রকারে?’

দিদিমা বলতেন, ‘কৃষ্ণদাস, সব মীমাংসা খুঁজতে নাই৷’ বালকের একটা নাম আছে৷ কিন্তু সেই নামে ডাকেন না দিদিমা৷ তিনি ডাকেন ‘কৃষ্ণদাস’৷ কেন ডাকেন? পুণ্যের লোভে৷ ‘কৃষ্ণ’ নামে পুণ্য, তিনি বিশ্বাস করেন৷ যতবার ডাকবেন, পুণ্যের তত সঞ্চয়৷ মিত্র পরিবারে ধর্ম বরাবরই গৌণ বিষয়৷ ধর্মের এজেন্সিতে পুণ্যের সঞ্চয়ে আস্থা নেই৷ ঠাকুরদেবতার নাম পরিবারের কারও পরিচয়-চিহ্ন হয়নি কখনও৷ মূর্তি-ছবি ঘরে কয়েকটা আছে, যেমন বেশিরভাগ হিন্দুর ঘরে থাকে৷ সেসব নিয়ে ফুলমালা, ধূপধুনো, বাতাসা-নকুলদানার আদিখ্যেতা নেই৷ মিত্রবাড়িতে পয়লা বৈশাখ হয়, পৌষপার্বণ হয়, দোলযাত্রা হয়, গান-পালা হয় কাছারির ছুটিতে, বর্ষার জলবন্দি দিনগুলোতে৷ ঠাকুরপূজা নাই৷ অমলকান্তির বাপঠাকুরদার আমল থেকে নাই৷ কেন নাই সে কথা কেউ ভাবেনি৷ 

Zamindar House
বড় বাড়ির বৈঠকখানা আর বারান্দা জুড়ে বাবা-দাদাদের রাজত্ব

কিরণবালা কীভাবে ধর্মাশ্রয়ী হন, বালক তা জানত না৷ এটুকু জেনেই খুশি থেকেছে যে সে দিদিমার কৃষ্ণদাস৷ বড়ো হয়ে দু-একজন আত্মীয়ের বিবরণ থেকে অনুমান করবে ‘বন্দে মাতরম’ আর ‘আল্লা-হু-আকবর’ আওয়াজের যুদ্ধমাতনের মধ্যে বড়ো হতে হতে একসময় তিনি ঈশ্বরভরসা হয়ে পড়েন৷ বিশেষ করে ছোড়দা তখন নেই৷ বাবা আর বড়দা তো দূরের মানুষ৷ মায়ের সব ভরসা বাবা৷ একা মেয়ে ঠাকুরদেবতার ভরসায় নিজের নির্ভয় বেঁচে থাকা খোঁজে৷

গোবরার বস্তিতে রাত্রি গাঢ় হয়৷ গুরুদাস চটি ফটফটিয়ে ফিরে হাঁকডাক শুরু করেছে৷ সারাদিন অপমানিত হবার প্রতিক্রিয়া৷ নির্মল রুটি বেলছে৷ বেলনচাকির খটখট শব্দ আসে৷ দাদা বিমল ট্রাম কোম্পানির কন্ডাক্টর৷ ফিরতে রাত দশটা-এগারোটা হয়৷ দু’ভাই একঘরে থাকে৷ উষামাসির ঘর থেকে গোলারুটি ভাজার গন্ধ আসছে৷ কুপির আলোয় তিন পুত্রকন্যা বাটি নিয়ে বসে উনুনের কাছাকাছি৷ বাড়িওলার ঘরে সাবেক দারোগার হুকুমের অভ্যাস হঠাৎ হঠাৎ গর্জে ওঠে, সঙ্গে ছোটবউয়ের পুরুষ্টু হাতের ভারি ঘণ্টাধ্বনি৷ এবং সিঁড়িতে বসে-থাকা বড়োবউয়ের দীর্ঘশ্বাস৷ রানিবউদির ছেলে কাঁদে৷ শিশুকে জানোয়ার বলে তার মা, শিশু জানে না৷৷ রুক্মিনীদির ঘরে লোক আসে৷ দুপুরে আসে৷ রাতেও৷ তারা নাকি মুলুকের বা দেশঘরের আপনলোক৷ এলে ঘরে ধুপধাপ ও আরও কিছু শব্দ হয়৷ দিদিমা বলেন, ওইদিকে যাইস না, কৃষ্ণদাস৷ ঘরের দরজা খোলার শব্দ হয়৷ হয়তো একজন চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বেরিয়ে যাবার পথে গেয়ে গেল, দো হংসো কা জোড়া বিছড়ো গয়ো রে৷ 

ছোড়দাকে খুব মনে পড়ে কিরণবালার৷ বালক নাতিকে তিনি বলেছেন অর্ণবকান্তি মিত্রের কথা৷ কিরণ যেমন সেই বয়সে বোঝেননি ছোড়দা কী বলতে চাইছেন, তেমনি বালকও বোঝেনি তার দিদিমা কী বলতে চাইছেন৷ পরে কুয়াশা হয়তো কিছু আবছা হয়েছে৷ হয়েছে কি? অন্ধকার কখনও আলো বলে বিভ্রম হয়৷ বালক মনে করতে পারে, অর্ণবকান্তি খুন হন৷ 

দিদিমা যখন গল্প বলেন, গল্প তো নয়, নিজের জীবনের কথা, ছবি হয়ে উঠতে থাকে৷ হ্যাজাকের আলোয় বৈঠকখানা আর বারান্দা, ভেতরবাড়ির উঠোন, রান্নাঘরে রামিপিসির কুটনো কোটা আর মশলা বাটা, পুকুরের শাপলাফুলে কিরণের মুখ জাগিয়ে ভেসে থাকা, পেয়ারা গাছে টিয়াপাখির ঝাঁক, বাসকের ছায়ায় টুনটুনিদের ঝগড়াঝাটি, কাছারিফেরত তিন উকিলকে নামিয়ে ঘোড়াগাড়ির চলে যাওয়া, বর্ষায় ব্যাঙের ডাকের সঙ্গে হুমরা বাইদ্যার গান, 

আইল রে শিকারি বাইদ্যা
তীরের কাডি লইয়া নারে
শরের কাডি লইয়ারে,
ভানুমতী বলে, তামাশা করিতে আইলাম
বাইদ্যার নারী
রূপেতে উজ্জ্বলা লইতে
নইদ্য ঠাকুরের বাড়ি… 

তিনদিক গোরস্থান-ঘেরা বস্তিপ্রান্তর জুড়ে ঘন সবুজ নীরবতা নামে, পুকুরের জল ছপছপিয়ে কেউ যায়, কুকুর ডাকে, শেয়াল ডাকে, সাইকেলের ঘণ্টা বাজে, রাত্রিমাতাল বংশী গান গেয়ে গেয়ে টাল খায়, একপাশে দুটো বালতি-কড়া আর অন্যপাশে উনুন-ঘুঁটে-কয়লার একটুকু জায়গায় লণ্ঠনের আলোয় দিদিমাকে চাঁদের দেশের একা মানুষ মনে হয়৷

সেদিনের বালকের দেখা কিরণবালার আর-একটি মূর্তি কোনওদিন ঝাপসা হবারও নয়৷
– মোতির মায়ে কইছে, ঘুইট্যা এইখানে ভালো দামে বেচা যায়৷ চিত্তরঞ্জন হাসপাতালের উলটাদিকের খাটাল থেইক্যা গোবর আনুম৷ মালগাড়ি লাইনে ঘুইট্যা শুকামু৷ তারপর বেচুম৷ তুই আমার লগে থাকবি, কৃষ্ণদাস৷ মালা গাইথ্যা, ঠোঙা বানাইয়া কয় পয়সা পাই? ঘুইট্যায় অনেক বেশি পামু৷ তরে একটা নতুন প্যান্ট দিমু৷ 

গোবরা রোডের উকিলবাড়ির ভাঙা পাঁচিল গলে সহজেই ঢুকে পড়া যায় খাটালে৷ ঘুরে গেলে ক্যালকাটা ফ্যান কারখানার অনেকটা পথ৷ গোবরভরতি ভারি বালতি টেনে আনতে দম ছুটে যায়৷ কিরণবালার হাতে একটা টিনের বালতি আর কৃষ্ণদাসের হাতে ছোটো একটা৷ গোবর এনে ঘাস আর কাঠের গুঁড়ো দিয়ে মাখা৷ তারপর মালগাড়ি লাইনের ঢালে থুবিয়ে থুবিয়ে ঘুঁটে দেওয়া৷ মিত্রবাড়ির সবার আদরের মেয়ে-বোন কোনওদিন কি ভেবেছিলেন ঘুঁটে দিয়ে বেচতে হবে তাঁকে? 

Cowdung cakes
শীর্ণ শরীরে দেশভাগের শাড়ি, দু’হাতে গোবর, খালি পা, দু মুঠো অন্ন খুঁজছেন কিরণবালা

বালক বড়ো হয়ে বুঝেছে, দেশভাগের মার৷ দ্বিজাতিতত্ত্বের মার থেকে কৃষ্ণ তাঁকে বাঁচাতে পারেনি৷ ফরসা মুখ রোদে লাল, কাঁচাপাকা চুলে কাঠের গুঁড়ো আর শুকনো ঘাস, শীর্ণ শরীরে দেশভাগের শাড়ি, দু’হাতে গোবর, খালি পা, দু মুঠো অন্ন খুঁজছেন কিরণবালা৷ মুক্তাগাছার উকিলবাড়ির একমাত্র কন্যা৷ পিতা অমলকান্তি মিত্র৷ কিশোরগঞ্জের কবিরাজ নলিনীকুমার বসুর স্ত্রী৷ এমন দিন আসবে যখন ঢালের জমির দখল নিয়ে মারমুখো বিহারি মহিলাদের সঙ্গে তাঁকে ঝগড়া করতে হবে৷ তিনি ঝগড়া জানেন না৷ অন্যায়ের বিরুদ্ধে বলতে শিখবেন অল্পস্বল্প৷ বিহারি মহিলাদের গালাগালের তোড়ের মুখে তিনি নীরব হয়ে যাবেন৷ বসে থাকবেন দু হাতে মাটি আঁকড়ে৷ ঘুঁটে বেচে কিরণবালা কিনবেন কপালকুণ্ডলা, আনন্দমঠ, দেবী চৌধুরাণী, পল্লীসমাজ, পথের দাবি, নিজের জন্য৷ আর কৃষ্ণদাসের জন্য বুড়ো আংলা, রামের সুমতি, আবোল তাবোল৷ 

চারদিক অন্ধকার৷ শুকনো পেয়ারাপাতা পড়ছে টালির চালে৷ নর্দমায় ছুটোছুটি ছুঁচোদের৷ রানিবউদির দরমা-ঘেরা বারান্দায় হুটোপাটি৷ কিরণবালা পড়েন, বনমধ্যে বন্দি নবকুমার আর কপালকুণ্ডলার কথোপকথন৷ কাপালিকের পদশব্দ শোনা যায়৷ জলের শব্দ, তীর ভাঙার শব্দ৷ ছোড়দা মারা যাবার কিছুদিনের মধ্যে অমলকান্তি কন্যার বিবাহের জন্য তৎপর হয়ে ওঠেন৷ 

‘ইস্কুলের শেষ পরীক্ষা দ্যাওয়ার পর ইচ্ছা ছিল আরও পড়ুম৷ মায়ে কইল, পড়৷ বাড়িতে কত বই৷ আমিও তো পড়ি৷ তর বাবারে কমু, আরও বই আনবেন সদর থিকা৷ পড়তে সমস্যা কি? তুমি যদি চাও তোমার বাবা বাড়িতে লাইব্রেরি কইরা দিবেন৷ সুধন্য মাস্টারে ইংরাজি পড়াইব৷ তোমার বাবার ইচ্ছা৷ তিনি তোমার বাইরে যাওয়া পছন্দ করবেন না৷ এক বছর যাইতে না যাইতেই মামাবাবু বিজয় সরকার সম্বন্ধ নিয়া হাজির৷ পাত্র কিশোরগঞ্জের৷ কবিরাজ পরিবার৷ দুই ভাই পাশ-করা কবিরাজ৷ ভালো পসার৷ বাড়িতে ওষুধ প্রস্তুতের সরঞ্জাম আছে৷ বাবা পাত্র দেইখ্যা আইলেন৷ তাঁর পছন্দ৷ সেইটাই শেষকথা৷ বড়দাও গেছিলেন দেখতে৷ কইলেন, গায়ের রঙ একটু কালা৷ তুই হইলি টকটইকা ফরসা৷ সে তেমন নয়৷ তবে নাক-চোখ কাটাকাটা৷ লম্বা৷ কথাবার্তা সুন্দর৷ কৃষ্ণদাস, তরে কী কমু, বিয়ার পর গায়ের রঙ দেইখ্যা মাথা ঘুইরা পইড়া যাওনের উপক্রম৷ কী কালা কী কালা, এমুন কালা আগে দেখি নাই৷’ 

ঘরের ভেতর থেকে জবাব আসে অন্ধকার ফুঁড়ে,
– তখন তো আমারে কৃষ্ণঠাকুর ভাবতেন, মনে পড়ে? বলতেন, ঠাকুর আমার মনস্কামনা পূরণ করছেন৷
– রাখেন৷ আমারে আপনে রাধা ভবতেন৷ তাই দুই-একবার ওইকথা কইছি৷ কইতে হয়৷ আপনে খুশি হইবেন৷

নদীর দেশের মেয়ে কিরণবালা জলের খোঁজে শেষরাতে জেগে ওঠেন৷ নারকেলমালা দিয়ে ঘষে ঘষে জল তোলেন চৌবাচ্চা থেকে৷ শব্দ হয় খুলুপ খুলুপ৷
– দেশভিখারির দেশ নাই৷ জলও নাই৷
– কেন নাই? কোন দোষে আমরা দেশভিখারি? আপনে জানেন? আপনেগো লেখাপড়া কী কয়?
– আমাগো লেখাপড়া কয়, ধর্মের মাইর যে কোনও হিংস্র জন্তুর থেইক্যা অনেক বেশি হিংস্র৷ তুমি তো বিশ্বাস যাও না, কিরণ৷ তোমার ধর্মটাই তোমার শত্রু৷ অন্য ধর্মের শত্রুপক্ষ৷

পদ্মযোনি নাম রাখে অনাদির আদি
নটনারায়ণ নাম রাখিল সম্বাদি
আয়ান রাখিল নাম ক্রোধ নিবারণ
চণ্ডকেশী নাম রাখে কৃতান্ত শাসন৷

Camp Buildings
বস্তির চৌবাচ্চায় পুরসভার ফাটা পাইপ চুঁইয়ে জল পড়ে সারারাত

খুলুপ খুলুপ৷ চৌবাচ্চা ছেঁচে জল তোলেন কিরণবালা৷ নিচু করে তৈরি বস্তির চৌবাচ্চায় পুরসভার ফাটা পাইপ চুঁইয়ে জল পড়ে সারারাত৷ আর-কেউ জেগে ওঠবার আগে কিরণ সেই জলে কাপড় কাচেন, ঘর মোছেন, স্নান করেন, বালতি ভরে রেখে দেন৷ মুখে কৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনাম৷ কলপাড়ের ঘরে রানিবউদি ভাঙা ঘুমের গলায় বিরক্তি জানায়,
– ছুঁচিবুড়িটা আপদ হইছে৷ রোজ ঘুম ভাঙাইয়া দেয়৷ অসুখ-বিসুখেও ধরে না বুড়িটারে! 
নলিনীকুমার বলেছিলেন,
– কিরণের জলবাতিক পূর্ববঙ্গে কখনও দেখি নাই৷ বাপের বাড়িতে পুকুর৷ আমাগো বাড়িতেও পুকুর৷ হাত বাড়াইলেই জল৷ আমার মনে হয়, বস্তিতে জলের অভাব থেইক্যা কিরণের জলবাতিক হইছে৷ জল যদি না থাকে সেই ত্রাসে ভোগে৷ আরও একটা কারণ হইতে পারে৷ শিয়ালদা স্টেশনে পায়খানা প্রস্রাবখানা আর নর্দমার পাশে আমরা থাকছি খাইছি শুইছি একমাসের উপর৷ সেই দূষিত জায়গা আর দুর্গন্ধ কিরণের মধ্যে ধোয়া-পাখলানোর বাতিক আনতে পারে৷ আগে এইসব অর ছিল না৷

বালক বড়ো হয়ে বুঝেছে, দেশভাগের মার৷ দ্বিজাতিতত্ত্বের মার থেকে কৃষ্ণ তাঁকে বাঁচাতে পারেনি৷ ফরসা মুখ রোদে লাল, কাঁচাপাকা চুলে কাঠের গুঁড়ো আর শুকনো ঘাস, শীর্ণ শরীরে দেশভাগের শাড়ি, দু’হাতে গোবর, খালি পা, দু মুঠো অন্ন খুঁজছেন কিরণবালা৷ মুক্তাগাছার উকিলবাড়ির একমাত্র কন্যা৷ পিতা অমলকান্তি মিত্র৷ কিশোরগঞ্জের কবিরাজ নলিনীকুমার বসুর স্ত্রী৷ এমন দিন আসবে যখন ঢালের জমির দখল নিয়ে মারমুখো বিহারি মহিলাদের সঙ্গে তাঁকে ঝগড়া করতে হবে৷ তিনি ঝগড়া জানেন না৷

– কৃষ্ণদাস, গঙ্গায় যাবি৷ ওঠ৷
তখনও অন্ধকার৷ গোরস্থানের গা দিয়ে হেঁটে রেললাইন পেরিয়ে, গোরাচাঁদ দত্ত রোড ধরে, চিত্তরঞ্জন হাসপাতাল বাঁ-দিকে রেখে পার্ক সার্কাস৷ কী বড়ো মাঠ৷ বড়ো হয়ে বালক এই মাঠে খেলবে৷ পার্ক সার্কাসের পুজো দেখতে আসবে দল বেঁধে৷ সার্কাস আসবে, কিন্তু দেখা হবে না৷ আরও বড়ো হয়ে বাবলির জন্যে অপেক্ষা করবে মাঠের গেটে৷ লেডি ব্রাবোর্ন কলেজ থেকে বেরবে বাবলি৷ কিন্তু চিনতে পারবে না তাকে৷ আরও বড়ো হয়ে সে আসবে দরগা রোডে কবি ভূমেন্দ্র গুহ তথা ডক্টর বিএন গুহরায়ের চেম্বারে৷ পার্ক সার্কাস ট্রাম ডিপো থেকে বালক উঠেছিল৷ আবছা রাত ভেঙে ট্রাম চলেছে৷ মাথার ওপর বাজছে আশ্চর্য একতারা৷ মল্লিকবাজার নোনাপুকুর ইলিয়ট রোড, ওয়েলিংটন স্কোয়ার ধর্মতলা স্ট্রিট হয়ে ট্রাম এল গুমটিতে৷ এইসব নাম বালক জেনেছে অনেক পরে৷ সেখান থেকে আবার হেঁটে বাবুঘাট৷ কোনওদিন ট্রামে যেতে যেতে দিদিমা বলেছিলেন,

সমোঅহং সর্বভূতেষু ন মে দ্বেষোঅস্তি ন প্রিয়৷
যে ভজন্তি তু মাং ভক্ত্যা ময়ি তে তেষু চাপ্যহম৷
অপি চেৎ সুদুরাচারো ভজতে মামনন্যভাক৷
সাধুরেব স মন্তব্যঃ সম্যগব্যবসিতেহি সঃ৷

মানে কী কৃষ্ণদাস? আমি সর্বভূতে সমদর্শী, আমার অপ্রিয় নেই, প্রিয়ও নেই; কিন্তু যারা আমাকে ভজনা করে, তারা আমাতে থাকে, আমিও তাদের অন্তরে থাকি৷ যদি অতিদুরাচার ব্যক্তিও অনন্যচিত্ত হয়ে আমাকে ভজনা করে, সে সাধু বলেই গণ্য, কারণ, সে সম্যক স্থিরসংকল্প৷   
কী বুঝলা? ছোড়দারে হাসু ফকিরে মারছিল৷ বাবায় বিশ্বাস যায় নাই৷ সব কথার মীমাংসা নাই৷ মীমাংসা হয় না৷  (চলবে)

 

পরবর্তী পর্ব ২৮ এপ্রিল প্রকাশিত হবে
*ছবি সৌজন্য: লেখক

Madhumoy Paul

মধুময়ের জন্ম ১৯৫২ সালে পূর্ববঙ্গের ময়মনসিংহে, কিশোরগঞ্জে। লেখাপড়া কলকাতায়। শৈশব-যৌবন কেটেছে স্টেশনে, ক‍্যাম্পে, বস্তিতে। গল্প লিখে লেখালেখি শুরু। পরে উপন‍্যাস। বই আখ‍্যান পঞ্চাশ, আলিঙ্গন দাও রানি, রূপকাঠের নৌকা। অনুসন্ধানমূলক কাজে আগ্রহী। পঞ্চাশের মন্বন্তর, দাঙ্গা-দেশভাগ, নকশালবাড়ি আন্দোলন নিয়ে কাজ করেছেন। কেয়া চক্রবর্তী, গণেশ পাইন তাঁর প্রিয় সম্পাদনা। প্রতিমা বড়ুয়াকে নিয়ে গ্রন্থের কাজ করছেন চার বছর। মূলত পাঠক ও শ্রোতা।

2 Responses

  1. সেই নিদারুণ দিন গুলো। বেঁচে থাকার জন্য কি আপ্রাণ চেষ্টা। আমাদের পূর্বপুরুষদের কষ্ট, দুঃখ, যন্ত্রনা ,,, এসবের একটুখানি যদি ভাগীদার হয়ে চলি তাহলেই ওনাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *