হিঙ্গন জমাদার লেনের কাঁচাগলি থেকে পিচপথ ধরে প্রাপ্তবয়স্ক কুড়ি পা হাঁটলে রংকলের মাঠ৷ বালকের সেদিন হয়তো তিরিশ বা পঁয়তিরিশ পা লাগত৷ পাল্লাভাঙা দরোজার ওপারে তেমন বড়ো-নয় মাঠ৷ ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিশাল বিশাল মাটির গামলা৷ ওঁরা বলতেন ‘চারা’৷ গামলার গায়ে লাল নীল সবুজ হলুদ দাগ৷ চুঁইয়ে পড়ে পড়ে রং গাঢ় হয়ে আছে৷ সার সার ত্রিভুজের মতো বাঁধা দুটো করে বাঁশের মাথায় টাঙানো দড়ি প্রায় গোটা মাঠ জুড়ে৷ কাপড় রাঙানো ও শুকনোর ব্যবস্থা৷ কোনওকালে খুব চালু রংকল তখন মাসের বেশিরভাগ সময় মাঠ জুড়ে ঝিমোত৷
এই রংকলে এক দরোয়ান ছিলেন৷ কেউ ‘দরোয়ানজি’ বললে তিনি শুধরে দিতেন৷ ‘রামজি সিকোরিটি’৷ দরোজার পাল্লা নেই, দিনরাত হাটখোলা, তবু এক সিকিউরিটি আছেন৷ সাজোয়ান নন, তবে শক্তপোক্ত৷ হাফপ্যান্টের বাইরে প্রবল পেশি-শিরাময় পা৷ আদিনিবাস নেপাল৷ নাম রামবাহাদুর৷ তিনি নিজে বলেছেন চেনাজানাদের, আগে বড়ো জুটমিলের স্টাফ সিকিউরিটি ছিলেন৷ নদীর ধারে মিল৷ মিলের জেটি৷ বিরাট বিরাট নৌকো৷ সাহেব মালিকদের টাইমে স্টিমার এসে লাগত জেটিতে৷ বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে সাহেব-মেমরা ঘুরতে যেত, ঘুরে ফিরত৷ ‘রম’-এর খাতির ছিল ওই টাইমে৷
পরে শুধু পাটের নৌকা, চটের নৌকা৷ সাজানো বাগান বাবুকোয়ার্টার ঘিরে৷ সেগুন আর মেহগনি গাছে ভরা৷ রামবাহাদুরের ডিউটি ছিল কোয়ার্টারে৷ মিলের গেটে যারা ডিউটি করে, তারা ফালতু লোক৷ দরোয়ান৷ কোম্পানিকে ভালোবাসে না৷ সাহেব মালিকরা চলে গেছে৷ মাড়োয়ারিরা গদিতে বসেছে৷ মিলগেটের দরোয়ানগুলোর সঙ্গে সাঁট করে চোট্টামি করছিল কিছু লোক৷ গাছ চুরি, চট চুরি, মেশিনের পার্টস চুরি এইসব৷ একবার দুবার নয়, কয়েকবার এই চোট্টামি ধরে ফেলে স্টাফ সিকিউরিটি রামবাহাদুর৷ এবং বদমাশ লোকজন দলবেঁধে ওকেই ‘চোর’ বানিয়ে চাকরি থেকে তাড়িয়ে দেয়৷ নিজেরা চুরি করবে আর যে বাধা দেবে তাকেই চোর বানাবে৷ আজব দুনিয়া৷ রামবাহাদুর বলেছেন, সাহেব মালিক হলে অ্যায়সা কভি নহিঁ হোতা৷ নয়া মালিক খুদ হি চোট্টা হ্যায়৷ রামবাহাদুর সত্যি বলে কি? সন্দেহ ছিল অনেকের৷ ভোলানাথ বলত,
– চোট্টামি করলে সমস্যা নাই৷ ধরলেই সমস্যা৷ চোরের বন্ধু পুলিশ আছে, যে ধরে তার বন্ধু নাই৷
আরও পড়ুন: ঋভু চট্টোপাধ্যায়ের ছোটগল্প: কিস্তি
বালকের প্রায় সমানবয়সী ভোলানাথ৷ সে দেখেছে,
– চোট্টামি লাভ দেয়৷ কত কমু তোমারে, রিফুজিগো রিলিফের মাল চুরি কইরা বড়লোক হইছে, ক্যাম্পের মাল সাবাড় করছে চোট্টারা৷ দিনে ‘বন্দে মাতরম’ আর রাইত হইলেই ‘বস্তা পাচারম’৷ শুধু বস্তা কি, নতুন পায়খানার টিন খুইলা বেইচা দিছে ‘বন্দে মাতরম’রা৷ বাবায় কইছে, এইসব কথা কাউরে বলবা না৷ চুপ থাকবা৷ আমরা এই দেশে থাকুম না৷ চাইরদিকে চোট্টামি৷
ভোলানাথ আরও বলে, চোট্টামি করলে রংকলের মাঠে পড়ে থাকতে হত না রামজিকে৷ উকিলবাড়ির মেয়েদের স্কুলে নিয়ে যাওয়া-আসার কাজে পাঠাতে হত না মালাভাবিকে৷ রামজি হেড সিকিউরিটির কোয়ার্টারে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরত, আর স্যালুট পেত৷ ভোলানাথ বালকের চেয়ে তিন ক্লাস বড়ো, জানে দশ ক্লাস বেশি৷
ভোলানাথরা শালবনির ক্যাম্পে ছিল ছ’মাস মতন৷ শেয়ালদা স্টেশন থেকে ওদের তুলে নিয়ে যায় সরকারি লরি৷ মাথাখোলা গাড়িতে দশটা পরিবার টানা আড়াইদিন রোদে হিমে পুড়ে ভিজে যেখানে উঠেছিল সেখানে কোনও মানুষ থাকতে পারে না৷ তিন মাইল দূরে জল৷ পায়খানা-প্রস্রাব জঙ্গলে৷ সন্ধে হলে মেঘের মতো মশার ঝাঁক৷ রিলিফের এক বাবু ভোলানাথের বাবার কাছ থেকে গোপনে নগদ টাকা নেন এই প্রতিশ্রুতিতে যে ভালো ক্যাম্পের ব্যবস্থা হবে৷
– সুন্দর জায়গা হইব কইয়া সে একশো টাকা নিছে৷ রামচোট্টা৷ ক্যাম্পে ভোলানাথ সব ধরনের অপকর্ম দেখেছে, যা দেখার বয়স তার নয়৷ তার ঠাকুমা সারাদিন মন্ত্রের মতো জপতেন,
– ভোলা, সুনিল্যারে জিগাইস ত আমরা কিয়ের লেইগ্যা দেশ ছাড়লাম৷ মেনকা, তর বাপেরে জিগাইস ত ক্যাঠা কইছিল দেশ ছাড়তে৷ এইহানে ত মইরা যামু৷
ঠাকুমা ক্যাম্পেই মারা গেলেন৷ আরও অনেকেই মরেছে৷ ভোলানাথের কাছে শুনেছে বালক৷ এও শুনেছে, বর্ডারের আগের স্টেশনে মায়ের গলা থেকে মটরদানা হার খুলে নিয়েছে আনসাররা৷ পাকিস্তানে ওদের সোনার দোকান, একদিন ফিরে যাবে বলে সঙ্গে ছোট্ট পোঁটলায় চারগাছা চুড়ি আর দুল ছাড়া কিছু আনেনি৷ পথে খোয়া যেতে পারে৷ দোকানে সিন্দুকে রক্ষিত আছে৷

আরও একটা কারণে ভোলানাথ বেশি জানে৷ ও হরিপদদার চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে বড়োদের তর্ক বা ঝগড়া শোনে৷ পাকিস্তান সরকার হিন্দুদের তাড়াতে চায়, দিল্লির সরকার বাঙালিদের ঘিন্না করে, বিধান রায়ের পুলিস উদ্বাস্তুদের লাঠিপেটা করে, তবু বিধান রায় ভালো কিছু করতে চায়, কমিউনিস্টরা রোজ মিছিল করে থেকে ট্যাঁশপট্টির দু-নম্বরি ধান্দা, রাতে লিজাদের বাড়িতে বাইরের লোক ঢোকা ইত্যাদি চায়ের দোকানের টিনের চালে ঠনাঠন বাজে৷ ভোলানাথ হরিপদদার কয়লা ভেঙে দেয়, কাপ-ডিশ-কেটলি-ডেকচি ঘষে মেজে ধুয়ে দেয়৷ কান পেতে শোন নতুন দেশের ভোরবেলাকার কথাবার্তা৷ বালকের মনে আছে, ভোলানাথ প্রায়ই বলত,
আমরা এই দেশে থাকুম না৷ দেশটা ভালা না৷ এইখানে কাম নাই৷ হাবিজাবি কাম৷ পয়সা দিতে চায় না৷ মাগনায় সারনের মতলব৷ বার বার চাইতে হয়৷ য্যান ভিক্ষা দেয়৷ বাবায় কইছে, দেশেই ফিরা যামু৷ নিজেগো স্বর্ণালয় আছে৷ আবার খুলুম৷ নিজেগো কোঠাবাড়ি৷ ভাড়া লাগে না৷ কারও দয়া লাগে না৷ এই দেশ আমাগো মানুষ মনে করে না৷ কয়দিন আগে দাসবাড়ির পিসিমা মায়েরে কইল, আমাদের টুকিটাকি হালকা কাজের লোক দরকার৷ যদি তোমার বড়ো মেয়েকে পাই ভালো হয়৷ দু-বেলা খাবার পাবে৷ মাসের শেষে টাকাও পাবে হাতে৷ বছরে দু-বার জামাপ্যান্ট পাবে৷ মায়ে জবাব দিছে, আমাগো বাড়িতে একজন রান্ধনি ছিল, এখনও আছে৷ একজন ঝি, এখনও আছে৷ আমরা ঘরে ফিরে যাব৷ মাসিমা, আমরা রিফুজি না৷ খেদা খাইয়া আইছি৷ দিনকাল সুবিধার হইলেই ফিরা যামু৷
রংকলের মাঠে বালককে নিয়ে এসেছিল ভোলানাথই৷ কোমরে কুকরি বাঁধা দরোয়ানের কাছে ঘেঁষার সাহস নেই বালকের৷ গাঁট্টাগোঁট্টা৷ কুৎকুতে চোখ৷ হাড়হাড্ডি চোয়ালের কোথাও হাসি নেই৷ রেগে গেলে ঝাঁপিয়ে পড়ে টুটি টিপে ধরতে পারে৷ মিলের চাকরি গেলেও সিকিউরিটির খাকি উর্দি মজুত তাঁর শরীরে৷ ভোলানাথ ‘রামজি’ বলে ডাকতেই সাড়া এসেছিল ‘খখাবাবু, চলে আও’৷ কীভাবে এই চেনাজানা, বালক জানে না৷ রংকলের মাঠ তার কাছে যে খুলে গেল, এটাই বড়ো ব্যাপার৷ মাঠের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে সাদা করবীর গাছ৷ তার গায়ে রামবাহাদুরের সংসার৷ সংসারে রঙিন ফুলছাপ শাড়ির ‘মালাভাবি’, যে তার স্বামীর চেয়ে অনেক তরুণী, চোখমুখ হাসিতে ভরপুর, দু’পায়ে খেলার দোল৷
সাহেব মালিকরা চলে গেছে৷ মাড়োয়ারিরা গদিতে বসেছে৷ মিলগেটের দরোয়ানগুলোর সঙ্গে সাঁট করে চোট্টামি করছিল কিছু লোক৷ গাছ চুরি, চট চুরি, মেশিনের পার্টস চুরি এইসব৷ একবার দুবার নয়, কয়েকবার এই চোট্টামি ধরে ফেলে স্টাফ সিকিউরিটি রামবাহাদুর৷ এবং বদমাশ লোকজন দলবেঁধে ওকেই ‘চোর’ বানিয়ে চাকরি থেকে তাড়িয়ে দেয়৷ নিজেরা চুরি করবে আর যে বাধা দেবে তাকেই চোর বানাবে৷ আজব দুনিয়া৷ রামবাহাদুর বলেছেন, সাহেব মালিক হলে অ্যায়সা কভি নহিঁ হোতা৷ নয়া মালিক খুদ হি চোট্টা হ্যায়৷
রংকলে যখন কাজ হয়, কয়েকদিন নীল লাল সবুজ হলুদ কাপড় টানা ঝুলে থাকে, ঢেউয়ের মতো মেঘের মতো দোল খায়, ওড়ে৷ দরোয়ান এখানে কেন লাগে, কে জানে৷ যারা কাজ করে তারাই কাপড় পাহারা দেয়৷ শুকিয়ে গেলে ভাঁজ করে হাতে-টানা ছোট দু’চাকায় তুলে নিয়ে যায়৷ আজ, ছাপ্পান্ন-সাতান্ন বছর পর, পূর্ব কলকাতার গ্রাম-গ্রাম ভাবের প্রান্তিকে, এখানে সেখানে পুকুর, সার দিয়ে উড়ে যায় বক, সন্ধে হলে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে গলা ছেড়ে ডাকতে ডাকতে ঝোপের ভেতর ঘরে ফেরে পানকৌড়ি, সারা দুপুর ডাহুক আর কুবো পাখির ডাক, শিরীষগাছে চড়ুয়ের ঝাঁক বিকেলের ঝোঁকে, মই কাঁধে হেঁটে হেঁটে গ্যাসের আলো জ্বেলে দেয় বাতিওয়ালা। আকাশে নক্ষত্র স্পষ্ট হতে না হতেই ভীষণ নির্জন হয়ে যায় গোবরা রোড। বাংলা গোয়েন্দা বইয়ের মলাটের মতো আবছায়া-ঘেরা টালির চাল-জানালা-বন্ধ দরোজার লোকালয়ে একটা দুটো সাইকেলের ঘণ্টা– লোপাট হয়ে-যাওয়া সেই সময়ের রংকলের কথা কতটা বিশদে মনে থাকে? তবু যে কিছুটা মনে আছে তা রামবাহাদুর আর মালাভাবির জীবনের বিষাদ পরিণামের জন্য৷”
ভোলানাথের গলা পেলেই বেরিয়ে আসত মালাভাবি৷ পড়ে থাকত ঘরের কাজ৷ ভুলে যেত সবজি-রোটি, টাইমকলের জল৷ যেন বহুদূরের ছোট ভাইটি এসেছে বহুদিনের পর৷ ভাষার পাঁচিল ভেঙে দু’জনের দেশ-গাঁয়ের কথা দু’জনকে একাকার করে দেয়৷ কোথাও পাহাড়-ঝরনা, কোথাও মাঠ-নদী৷ কথা থেকে একসময় শুরু হয় ছুটোছুটি৷ ধর ধর ধর ধরতে পারে না-র খেলা৷ রামবাহাদুরও খুশি হতেন৷ কখনও বউয়ের পক্ষ নিতেন, কখনও খখাবাবুর৷ কোমরে কুকরি বেঁধে গুটি গুটি ছুটতেন৷ এই ‘ভালা না’ দেশে ভোলানাথ অন্তত একটা ভালো জায়গা পেয়েছিল৷ বালক নিজেরই মুদ্রাদোষে কখনও এই সম্মিলনে ইনসাইডার হতে পারেনি৷
হঠাৎই সব ভেঙে গেল৷ একেবারেই হঠাৎ৷ ভোলানাথরা খেদা খেয়ে পাকিস্তান থেকে ইন্ডিয়ায় এসেছিল৷ দু’চারবার ফিরে যাবার চেষ্টা করেন ওর বাবা৷ পারেননি৷ ইন্ডিয়ায়ও তাঁদের জায়গা নেই৷ প্রথমে উৎখাত হলেন ক্রিস্টোফার রোডের পাকাবাসা থেকে৷ সঙ্গে আনা চারগাছা চুড়ি আর দুল বেচে খাওয়া হয়েছে৷ ভাড়া না দিতে পারায় বাড়িওলা ঘর খালি করে নেয় জিনিসপত্র ফেলেফুলে দিয়ে৷ সেখান থেকে গোবরার কাঁচা ঘর৷ আবার সেই ঘটনা৷ এবার বাড়িউলি সাদা কাপড়ের ভেতর মালা জপতে জপতে দাঁড়িয়ে থেকে ভোলানাথদের বাস্তুহীন করে দেন৷ সে দৃশ্য কোনওদিন ভুলতে পারবে না বালক৷ তারপর আর ভোলানাথের খবর নেই৷ ওরা কি ধ্বংস হয়ে যায়, আরও অনেক অনেক পরিবারের মতো?
কোমরে কুকরি বাঁধা দরোয়ানের কাছে ঘেঁষার সাহস নেই বালকের৷ গাঁট্টাগোঁট্টা৷ কুৎকুতে চোখ৷ হাড়হাড্ডি চোয়ালের কোথাও হাসি নেই৷ রেগে গেলে ঝাঁপিয়ে পড়ে টুটি টিপে ধরতে পারে৷ মিলের চাকরি গেলেও সিকিউরিটির খাকি উর্দি মজুত তাঁর শরীরে৷ ভোলানাথ ‘রামজি’ বলে ডাকতেই সাড়া এসেছিল ‘খখাবাবু, চলে আও’৷ কীভাবে এই চেনাজানা, বালক জানে না৷ রংকলের মাঠ তার কাছে যে খুলে গেল, এটাই বড়ো ব্যাপার৷ মাঠের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে সাদা করবীর গাছ৷ তার গায়ে রামবাহাদুরের সংসার৷ সংসারে রঙিন ফুলছাপ শাড়ির ‘মালাভাবি’, যে তার স্বামীর চেয়ে অনেক তরুণী।
মালাভাবিও এক দুপুরে চলে গেল৷ যে উকিলবাড়িতে সে কাজ করত, সেখানকার এক মক্কেলের সঙ্গে৷ রামবাহাদুর খোঁজাখুঁজি করেছিল৷ থানায় গিয়েছিল৷ যে বউ নিজের ইচ্ছায় ঘর ছেড়েছে, তাকে কে খুঁজবে? হয়তো সে এতদিনে নিজের ঘর পেয়েছে৷ হরিপদদার চায়ের দোকানে আপন মনের মাধুরী বা গরল মিশিয়ে সরস গপ্পে মাতে ভদ্রজন৷ বালক আর রংকলে যায় না৷ পাল্লাভাঙা দরোজার এপার থেকে কখনও চোখে পড়ে রামবাহাদুর একা একা হাঁটছেন৷ পরনে খাকি উর্দি৷ হাফপ্যান্টের বাইরে প্রবল পেশি-শিরাময় পা৷ ভারি জুতো৷ নেপালি টুপি৷ কোমরে বাঁকানো কুকরি৷
এই ছবিটাই দীর্ঘস্থায়ী হতে পারত৷ কিন্তু এক সূর্যোদয়ের ভোরে রংকলের মাঠে পাওয়া গেল মালাভাবির গলাকাটা দেহ৷ সবুজ ঘাসের ওপর পড়ে আছে রক্ত ছড়িয়ে৷ সাদা করবীগাছ আর তার সংসারের কাছে৷ এপাশে ওপাশে রঙিন গামলা৷ মাথার ওপরে নীল আকাশ৷ তার নীচে বাঁশে বাঁশে টানা দড়ি৷ জানাজানি হতে ভিড়৷ বালক উঁকি মেরে দৃশ্যটা দেখেছিল৷ রামবাহাদুর তখন মালাভাবির দেহ ঘিরে কুচকাওয়াজ করছে৷ মালাভাবি কি ফিরে এসেছিল? বাজে লোকের খপ্পর থেকে পালিয়ে আবার আশ্রয় করতে চেয়েছিল রামজিকে? রামজি তাকে ক্ষমা করেনি৷ নাকি অন্য কিছু?
পুলিশ এল৷ খোলা লরির পেটে লোহার পাইপ লাগানো হল্লাগাড়ি চেপে৷ লালপাগড়ি পুলিশের সাদা উর্দির কোমরে চওড়া বেল্ট, হাঁটুর নীচ থেকে গোড়ালি পর্যন্ত কালো চামড়ার স্ট্র্যাপ, ওজনদার বুট৷ ভিড় সরে গেল৷ মার্ডার কেস৷ বডি নিয়ে যাবে৷ রামবাহাদুরকে অ্যারেস্ট করা হবে৷ পুলিশ তাঁকে কিছু জিজ্ঞেস করে৷ রামজি উত্তর দেন না৷ কাউকে ছুঁতে দেবেন না তাঁর বউয়ের শরীর৷ কোলে নিয়ে দেহ শুইয়ে দেন রংকলের দু’চাকা গাড়িতে৷ বেঁধে দেন৷ সব কাজ নিজের হাতে৷ কারও প্রশ্নে কোনও জবাব নেই৷ এক ফোঁটা জল নেই কুৎকুতে চোখে৷ দু’চাকা গাড়ি নিজে টেনে নিয়ে যান রাস্তা ধরে৷ পরনে সিকোরিটি৷ কোমরে কুকরি৷ রক্তের ছিটেদাগ ছিল কি তাঁর পোশাকে কোথাও? কে প্রশ্ন করবে? উত্তরই বা দেবে কে? গাড়ি কোথায় যাবে? চিত্তরঞ্জন হাসপাতাল, নাকি বেনেপুকুর থানা? তখনকার পুলিশ বোধহয় একটু অন্যরকম ছিল৷ একটু মানবিক৷ তাদের চলার তালে তালে লালপাগড়ির ওপর দুলছিল কালো ঝালর৷ (চলবে)
পরবর্তী পর্ব ১৩ মে ২০২২।
মধুময়ের জন্ম ১৯৫২ সালে পূর্ববঙ্গের ময়মনসিংহে, কিশোরগঞ্জে। লেখাপড়া কলকাতায়। শৈশব-যৌবন কেটেছে স্টেশনে, ক্যাম্পে, বস্তিতে। গল্প লিখে লেখালেখি শুরু। পরে উপন্যাস। বই আখ্যান পঞ্চাশ, আলিঙ্গন দাও রানি, রূপকাঠের নৌকা। অনুসন্ধানমূলক কাজে আগ্রহী। পঞ্চাশের মন্বন্তর, দাঙ্গা-দেশভাগ, নকশালবাড়ি আন্দোলন নিয়ে কাজ করেছেন। কেয়া চক্রবর্তী, গণেশ পাইন তাঁর প্রিয় সম্পাদনা। প্রতিমা বড়ুয়াকে নিয়ে গ্রন্থের কাজ করছেন চার বছর। মূলত পাঠক ও শ্রোতা।
পড়তে পড়তে চোখের জল ধরে রাখতে পারছি না! এ ও এক অমূল্য দলিল!!