আমার কর্মগুরু হাফিজ রহমানকে ‘বস’ বলেই ডেকে আসছি আজও। বস রোজা রাখত না, কিন্তু যেহেতু নামের আগে একটা ‘সৈয়দ’ আছে, ওর জন্যে বেশ যত্ন করে একটা ইফতারের প্লেট আসত রোজ। দু’ একদিন সহ্য করে একদিন আমি প্রবল প্রতিবাদ করলাম:
– আপনাকে খাবার দেবে, আমায় দেবে না- এটা কোন দেশের নিয়ম! বস মুখে খেজুর নিয়ে বলার চেষ্টা করল:
– আরে আমি তো মুসলিম!
– খাবারের আবার ধর্ম কী! কালীঘাটের গৌড়ীয় সমাজের রান্না ভাল শুনে আপনি মাটিতে বাবু হয়ে বসে কবজি ডুবিয়ে খাননি? মেহরোত্রাদা-র বাড়ির জন্মাষ্টমীর ভোগ খেতে সবার আগে কে পৌঁছয়? তারপর একটু ভেবে মোক্ষম বাণটা ছুঁড়লাম:
– আপনি রোজা রাখেন না, আমিও না! আপনার জন্যে যদি ইফতারের খাবার আসে, আমার জন্যেও আসতে হবে, পরিষ্কার বলে দিলাম! 

জানতাম এটা বসের দুর্বল জায়গা। পাকিস্তানে দিদির বাড়ি বেড়াতে গিয়ে পালিয়ে এসেছিল রমজান মাসে সব্বার সঙ্গে রোজা করতে হবে দেখে। পরের দিন থেকে বসের অনুরোধে দুটো প্লেট আসতে শুরু করল। আগেই চলে আসত, কিন্তু ছুঁতাম না। ঘড়ি দেখে বসের সঙ্গে প্লেট টেনে নিতাম। প্লেটে নির্দিষ্ট পদ থাকত খেজুর, ভিজে ছোলা, বেশ কিছু কাটা ফল, পেঁয়াজি আর এক গ্লাস কমলালেবুর জ্যুস। হোটেলের কর্মচারীরা নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী ইফতারের থালা সাজাত, কিন্তু হলফ করে বলতে পারি সেই থালার প্রত্যেকটা পদের যেন স্বাদ কিছুটা বেশি হত, তাদের যত্নের জন্যে।

iftar-meal
জমে উঠেছে রেওয়াজি ইফতার

ক্লাস সেভেনে টাইফয়েড হওয়া ইস্তক আমি নিরামিষ খাবারই বেশি পছন্দ করতাম। টাইফয়েডের পর থেকে মায়ের ভাষায় “মাংসাশী প্রাণি” হয়ে গেলাম আর আমিষের ব্যাক্‌লগ কাটাতে সচেষ্ট হলাম। তাই অফিসের পর তক্কে তক্কে থাকতাম। রমজান মাসে বস যেদিন অফিস থেকে ওর কোনও দাদার বাড়ি যাচ্ছে শুনতাম, টুক করে বসের গাড়িতে উঠে পড়তাম- চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয়র লোভে। পরোটা, পোলাও, দুই কি তিন রকমের মাংসের পদ (যার মধ্যে শিক কাবাব থাকবেই!) আর লাচ্ছা সেমাই দিয়ে ডিনার করে পার্ক সার্কাস মোড়ে বর্তমান আরসালানের পাশের দোকান থেকে একটা পান মুখে দেওয়া– একদম রুটিন! 

Nakhoda Mosque
এই নাখোদা মসজিদকে ঘিরেই জমে ওঠে কলকাতার রমজানের খাওয়াদাওয়া

আমাদের সেকালের কলকাতায় ‘টু-বি’ ছিল শহরের শেষ নিয়মিত বাস, দক্ষিণ আর উত্তরের শেষ যোগসূত্র। এক শীতের রাতে, সাড়ে এগারোটা নাগাদ পার্ক স্ট্রিটের মোড়ে বাসের জন্যে দাঁড়িয়ে আছি  আর ময়দান থেকে আগত হাওয়া গায়ে মেখে দাঁতের কোরাস শুনছি, হঠাৎ একটা মোটরবাইক আমার গা ঘেঁসে ঘ্যাঁচ করে থামল। সেই সুনসান রাস্তাতে এই কাণ্ডে বেশ ঘাবড়ে চোখ বন্ধ করলাম। প্রাণভয়ের চেয়ে অপমানের ভয় বেশি, কারণ আমাকে উপুড় করে ঝাড়লেও পঞ্চাশ টাকার বেশি পাবে না। এইসব ভাবছি যখন, আরোহী হেলমেটের ঠুলি ওপরে তুলে ওর পেছনের সিটের দিকে ইঙ্গিত করে বলল “বোস্‌।” 

 

আরও পড়ুন: শ্রুতি গঙ্গোপাধ্যায়ের কলমে: আলু আমার আলু ওগো

 

আশ্বস্ত হয়ে চোখ খুলে ভালভাবে চেয়ে দেখি ইস্কুলের ছোটবেলার বন্ধু বাপ্টু। দক্ষিণ কলকাতায় ওর শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরছে এই রাস্তা দিয়ে, একটা ‘কাজ’ আছে বলে। বাপ্টুর ‘কাজ’ আন্দাজ করে আমি ওকে বললাম “মেট্রোগলি হয়ে চল্।” সেই প্রাক্‌-মোবাইল যুগে মেট্রো গলি অঞ্চলে কিছু টেলিফোন বুথ সারা রাত খোলা থাকত। বাড়িতে ফোন করে বলে দিলাম বাপ্টু’র সঙ্গে দেখা হয়েছে, আর ওর বাড়িতে থেকে যাব, সবাই যেন ঘুমিয়ে পড়ে। কারণ আমি আন্দাজ করেছিলাম বাপ্টুর ‘কাজ’টা কী হতে পারে, যার জন্যে গড়িয়াহাট থেকে শিয়ালদা যেতে চৌরঙ্গী হয়ে যাচ্ছে। বাপ্টু রাতে ঘুমায় না, কলকাতার কোন দোকানে রাতে কী মিষ্টি বানায় ওর মুখস্থ! আর এটা তো রমজান মাস!

বাইক ছুটল শনিবারের রাতের বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট ধরে চিৎপুরের দিকে। নাখোদা মসজিদের পাশের রাস্তায় পৌঁছে আমি তাজ্জব। মনে হল ঘড়ির কাঁটা সন্ধ্যে ছ’টায় থেমে গিয়েছে এখানে। হাজার মানুষের ভিড় আর অসংখ্য খাবারের দোকান। কোনও গোলমাল নেই, কেউ ঘোড়ায় জিন দিয়ে আসেনি। সবাই কেমন যেন একটা খুশির মিলনমেলায় এসেছে। রাস্তায় যেতে যেতে হঠাৎ পরিচিত মানুষের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরছে।

Haleem in Zaqariya Street
জ়্যাকারিয়া স্ট্রিটে হালিমের দোকানে ভিড়

এ কোথায় এলাম রে বাবা! প্রায় সিকি শতাব্দী আগে… তখন নেট-দুনিয়া ছিল না, মার্কেটিংয়ের অস্ত্র ছিল না, তখনও ফুড-ওয়াক জাতীয় কেরামতি চিন্তার মধ্যেই ছিল না… কিন্তু তাতেও কাতারে কাতারে মানুষ। আর কী খাবার নেই সেখানে! হরেক কিসিমের সেমাইয়ের পাহাড়, কিছুটা এগিয়ে বিভিন্ন রকমের কাবাব বিক্রি হচ্ছে। আসার পথেই বাপ্টুকে বলেছিলাম, আমার কাছে পয়সাকড়ি নেই। আর আমাকে সে আশ্বস্ত করেছিল। তাই বায়না ধরলাম, কাবাব খাবো। সেদিন প্রথম সুতোয় বাঁধা টুকরো টুকরো গরুর মাংস কাঠকয়লায় পুড়িয়ে বানানো সুত্‌লি কাবাবের স্বর্গীয় স্বাদ পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। কয়েক কদম এগিয়ে দেখি আমিনিয়া! ধর্মতলা আমিনিয়ার ভাই-বেরাদর কিনা কিনা ভাবতে ভাবতে নজরে এল সামনে একটা মস্ত দেগ্‌ থেকে হালিম বিক্রি হচ্ছে। 

সেই সময় হালিমের একটা আলাদা কৌলীন্য ছিল। হাতিবাগান কি মানিকতলা মোড়ে হালিম বিক্রি হত না। তাই ভিড় ঠেলে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। মৌলালির মোড়ের দরগার অদূরে বসা বৃদ্ধ চাচার কাছ থেকে আরব্ধ জ্ঞান ফলিয়ে ভারিক্কীভাবে জিজ্ঞেস করেছিলাম “এখানে কি হারিস্‌ পাওয়া যায়?” শীতল চোখে আমায় মেপে মালিক উত্তর দিয়েছিলেন “এখানে শুধু আরবি হালিম পাওয়া যায়।” ভড়কে গিয়ে ঘনত্ব না দেখে সোজা এক চুমুক দিলাম। জিভে ছ্যাঁকা লাগার সঙ্গে সঙ্গে মনে একটা প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছিল: অমৃত কি এর চেয়েও সুস্বাদু? বাপ্টুর আবার মাঝরাতে মিষ্টি না খেলে চলে না। তাই ভিড় ঠেলে হাজি আলাউদ্দিনের দোকানে ঢুকে পড়লাম। সেখানে আফলাতুনি হালুয়া আর গুলাবজামুন খেয়ে আমি মোক্ষলাভের দোরগোড়ায় কড়া নাড়ছি, বাপ্টু বলল “এবার চল, আর এক জায়গায় যাব!”

 

আরও পড়ুন: দামু মুখোপাধ্যায়ের কলমে: ঝাঁঝ দিয়ে যায় ইলিশ চেনা

রাত শেষ হতে আর বেশি বাকি নেই। রোজা লেগে যাবে। আমি দ্বিরুক্তি না করে বাপ্টুর সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম। বাইক ছুটল আবার ধর্মতলার দিকে। বাঁ দিকে ঘুরে থামল সাবির-এর সামনে। নেমে বাপটু ঘোষণা করল “এখানে আমরা নিহারি খাব।” ওখানেও তো পাওয়া যাচ্ছিল, এখানেই কেন, জিজ্ঞেস করতে শুধু বলল “খেয়ে বলবি!” রোজাদারদের আগে ছেড়ে দিয়ে আমরা যখন নিহারি হাতে নিলাম, আজান শুরু হয়ে গিয়েছে। জানুয়ারির ভোরের সেই উষ্ণ নিহারি খেয়ে আর অনুভূতি ব্যক্ত করার অবস্থায় ছিলাম না!  

Beef nehari in Sabir
সাবিরের দোকানে নেহারির স্বাদ আবদুল করিমের ঠুমরির মতোই লা-জবাব!

পরে আমার মনে হয়েছিলো ওই ট্যুরটা কি সত্যিই হয়েছিল, না স্বপ্ন! সেটা যাচাই করতে বারবার ফেরত গিয়েছি জ্যাকারিয়া স্ট্রিটে প্রত্যেক বছর রমজান মাসে। যখনই কলকাতায় থেকেছি, চুনা গলির ফুটপাথে গরুর কিমার শিঙাড়া খেয়ে বিভোর হয়েছি। যেদিন সন্ধ্যের পরেই পৌঁছেছি সেখানে, মুর্গ চাঙ্গেজি, মাহি আকবরির মতো খাবার খেয়ে আপ্লুত হয়েছি। ঠাকুরপুকুরের লাল মসজিদ থেকে মেটেবুরুজ,পার্ক সার্কাস থেকে রাজাবাজার বিভিন্ন জায়গায় ইফতারের খাবারের সন্ধানে ছুটে গিয়েছি বারবার, কিন্তু জ্যাকেরিয়া স্ট্রিটের ইফতারের খাবারের মেলা, আবদুল করিম খানের ঠুংরির মতো- অনন্য!

সেই বাপ্টু যখন রমজান মাসে ঢাকা যাচ্ছি শুনে বলল “যে চুলোতেই যা, ‘বড় বাপের পোলায় খায়’ মিস্‌ করিস না।” সেটাকে পাত্তা তো দিতেই হবে! সেটা কী, জিজ্ঞেস করতে বলল “খেয়েই দেখিস!” তারপর বিমর্ষভাবে বলল “বাড়িতে হুজ্জোতি করবে। নয়তো তোর সঙ্গে চলে যেতাম শুধু ওটা খাওয়ার জন্যে!” শুনলাম এটা পুরান্‌ ঢাকা ছাড়া কোথাও পাওয়া যায় না। আর শুধু ইফতারিরা নয়, বাকিরাও এই পদের জন্যে পৌঁছে যায় চকবাজারে।

ঢাকায় পৌঁছে কয়েকদিন বাদে গুলশনে একটা ইফতারের দাওয়াতে গিয়ে কথাটা পারলাম। সেখানে সেই সম্ভ্রান্ত লোকের ভিড়ে ‘বড় বাপের পোলায় খায়’-এর কথা বলতে সব্বাই যেভাবে আমার দিকে তাকালেন, মনে হল এক গর্হিত অপরাধ করে ফেলেছি। বাড়ি ফেরার আগে গৃহকর্তা আমাকে আড়ালে ডেকে বললেন “একদম ওটা খাওয়ার চেষ্টা করবেন না। বিদেশে এসে অসুস্থ হয়ে বিপদে পড়বেন!” বিপদের সঙ্গে আমার বেরাদরি সেই ছোটবেলায় দূরপাল্লার বাসের পেছনের সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে পড়ার সময় থেকেই। তবু সম্মান রাখতে “হ্যাঁ নিশ্চয়! ভাগ্যিস বললেন!” ইত্যাদি বলে পরেরদিনই হাজির হলাম চকবাজারে। তবে হ্যাঁ, একটু ‘খবরাখবর’ নিয়ে ঘোরাঘুরি করতেই কানে এল চিৎকার: “বড় বাপের পোলায় খায়, ঠোঙা ভইরা লইয়া যায়!”

boro_baper_pola in dhaka
বড় বাপের পোলায় খায়, ঠোঙা ভইরা লইয়া যায়

চকবাজারে আসার আগে বাংলাদেশে আমার মুশকিল-আসান, চট্টগ্রাম-নিবাসী পরাগকে গুঁতিয়ে আর তার সুস্মিতা আপার কল্যাণে ইতিমধ্যে জেনে ফেলেছি এক চমৎকার কিসসা। ঢাকার নবাবরা রমজান মাসে তাঁদের রীতি-রেওয়াজ মেনে রোজই ইফতারের সময় এক এলাহি ভোজের ব্যবস্থা করতেন আর তাতে দাওয়াত দিতেন তাঁর ওমরাহ্‌দের আর শহরের রইস, নামজাদা মানুষদের। বিরিয়ানি, কোফতা, কাবাব, মোরগ, কোয়েল, তিতির, পায়রা হরেক পাখির মাংস আর ধর্ম মেনে বিভিন্ন চারপেয়ে জানোয়ারের মাংস ছাড়াও সেখানে থাকত পোলাও, হরেক কিসিমের মিষ্টি।

এককথায় গুপি-বাঘা যুদ্ধের মাঠে যা কিছু খাবারের বৃষ্টি ঝরিয়েছিল ভুতের রাজার আশীর্বাদে, সবেরই দেখা মিলত এহসান মঞ্জিলের ইফতারের দস্তরখানে। এত খাবার মুষ্টিমেয় মানুষের পক্ষে খাওয়া সম্ভব না। আর এমনিতেই বড় মানুষেরা খাবার খান কম, নাড়াচাড়া করেন বেশি। ফলে ভোজসভা শেষ হলে উদ্বৃত্ত সব খাবার আবার ফেরত যেত রসুইখানাতে। ততক্ষণে খাবারগুলো সব মিলেমিশে একাকার, কারণ সব খাবার একসঙ্গে মিশিয়ে মাখিয়ে বেয়ারা বাবুর্চিরা সেগুলো খেত।

এই পাঁচমিশেলি খাবারের স্বাদ আর বাবুর্চিখানায় তার জনপ্রিয়তা দেখে শেখ সুবাহ নামের এক করিৎকর্মা বাবুর্চি আরও কিছু পদ আর মশলা এতে মিশিয়ে ইফতার বাজারের এক কোণে দু আনা দরে বটপাতায় করে এই খাবার বিক্রি করতে শুরু করলেন। আর চোস্ত মার্কেটিং করলেন উচ্ছিষ্ট খাবারকে কৌলীন্য দিতে ‘বড় বাপের পোলায় খায়’ নাম দিয়ে।

 

আরও পড়ুন: শামিম আহমেদের কলমে: মনলোভানি বাকরখানি

 

কী থাকে এই খাবারে? সুতি কাবাব, গরুর ঘিলু, মাংসের কিমা, সিদ্ধ ডিম, মুরগির গিলে আর কলিজা আর মাংসের কুচি, ছোলার ডাল, মটর ডাল, চিঁড়েভাজা, মিষ্টি কুমড়ো, আলু, ঘি, সর্ষের তেল, কাঁচালঙ্কা, শুকনোলঙ্কা- পনেরো রকম পদ আর ষোলো রকম মশলা একটা বড় গামলায় দু’হাত দিয়ে মেখে ঠোঙায় করে বিক্রি হয় ওজন হিসেবে। শেখ সুবাহ-র বংশধরেরা এখন এই খাবার বিক্রি করেন। এখানে একটা বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ দেওয়াটা জরুরি, কোনও স্বাস্থ্যসচেতন বা স্বাস্থ্যবিধি মানা পিটপিটে স্বভাবের মানুষ যেন এই অসম্ভব সুস্বাদু চমকপ্রদ খাবারের আশেপাশে না যান। কলকাতার জ্যাকেরিয়া স্ট্রিটে সব পাওয়া গেলেও পুরান্‌ ঢাকার চকবাজার তাকে হারিয়ে দিয়েছে এক অনন্য পদের জন্যে– ‘বড় বাপের পোলায় খায়।’ 

Shirmal to Bakarkhani
শিরমল থেকে বাকরখানি – কী নেই রমজানের মেনুতে

ঢাকার চকবাজার আর কলকাতার জ্যাকেরিয়া স্ট্রিটের মধ্যে সাঙ্ঘাতিক মিল। অনেকটা পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলাদেশের মতো। এক দেশ কোভিড আক্রান্ত হলে অন্য দেশে মানুষের মৃত্যু হয়, এক দেশে ঝড় হলে অন্য দেশে গাছ পড়ে। আরে বাবা, কাঁটা-তার দিয়ে মানুষ, গরু আটকানো যায়, হাওয়াবাতাস, ব্যাকটেরিয়া, সংস্কৃতি আটকানো যায় কি?

চকবাজারে গরুর মাংসের আধিক্য বাদ দিলে বিস্তর মিল- রকমারি সেমাইয়ের পাহাড় থেকে বাকরখানি / শিরমলের দোকানে বা কাবাবের দোকানে ভিড় থেকে শুরু করে আরও অনেক কিছুতেই। তবে ফারাকও আছে বেশ কিছু। যেমন কলকাতার জ্যাকেরিয়া স্ট্রিটের হাজি আলাউদ্দিনের মিষ্টির দোকানের মতো ঢাকার চকবাজারে আলাউদ্দিনের মিষ্টির দোকান দেখে চমৎকৃত হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম এটা একই গ্রুপের কিনা। অবজ্ঞার চোখে আমাকে মেপে ঢাকার দোকানের মালিক বলেছিলেন “লখনউয়ের আলাউদ্দিন এখানে একটা দোকান দিয়েছিলেন আজ থেকে দেড়শো বছর আগে। সেই আলাউদ্দিনের বংশ আমরা। শুনেছি লখনউয়ের দোকানের কিছু কারিগর কলকাতায় একটা দোকান দিয়েছিল!”

Kebabs at Zaqaria Street
জ্যাকেরিয়া স্ট্রিটের অন্তহীন কাবাব-সম্ভার

‘তুই বড় না মুই বড়’-তে না গিয়ে একটা শাহি জিলিপির অর্ডার দিয়েছিলাম তাড়াতাড়ি। কলকাতায় এটা দেখিনি। জানি না পাওয়া যায় কিনা। এটা ফ্যামিলি দোসা-র মতোই একা খাওয়া অসম্ভব। কমপক্ষে চার-পাঁচ জন লাগবে খেতে। চকবাজারের ইফতারি খাবার অনেকটা পাইকারি দোকানের মতো। ওজন করে কিনতে হয়। সে মুরগির বা কোয়েলের রোস্টই হোক বা খাসি বা গরুর ঠ্যাং! আর সেখানে যতরকম শরবত দেখেছি, তা কলকাতার ইফতারি বাজারে দেখিনি। বেলের শরবত, লেবুর শরবত থেকে শুরু করে তেঁতুল আর গুড়ের শরবত, এমনকি ইসবগুলের শরবত অবধি বিক্রি হয় সেখানে!

shahi Jalebi
শাহি জিলিপি একজনে একখানা পুরোটা খাওয়া অসম্ভব

কলকাতার ইফতারে সাধারণত পাক্কি বিরিয়ানি থাকে, ক্বচিৎ কাচ্চি বিরিয়ানি। ঢাকাতে পাক্কি আর কাচ্চি বিরিয়ানি ছাড়াও হাজী বিরিয়ানি নামে এক সর্ষের তেলে বানানো বিরিয়ানি পাওয়া যায়। পার্টিতেও পরিবেশন করা হয় সেটা। কলকাতায় এই বিরিয়ানি খাওয়ার সুযোগ আমার হয়নি। ঢাকার বনেদী বাড়ির ইফতারে পরিবেশিত কালো ভুনা দেখে আমার শ্যামবাজারের গোলবাড়ির কষা মাংসের কথা মনে পড়েছিল। দুটোর মধ্যে মিল- দুটোই স্বাদে তুলনাহীন। তফাত – কালো ভুনা বড় খাসীর মাংসের তৈরি আর গোলবাড়িরটা ছোটো খাসীর। 

Khiri Kebab
গরুর বাঁটের মাংস দিয়ে তৈরি খিরি কেবাব

কলকাতায় ফেরত আসার দিন প্রায় এসে গিয়েছে। ঢাকায় বিভিন্ন জায়গায় খেয়ে যখন মোটামুটি সুনিশ্চিত ‘বড় বাপের পোলায় খায়’-এর দেওয়া গোলে ঢাকা এক গোলে জিতছে, তখন ঢাকার বিখ্যাত খিরি কাবাব খাওয়ার সুযোগ পেলাম এক অভিজাত ইফতারে। গরুর বাঁটের মাংস দিয়ে বানানো এই সুস্বাদু কাবাব সেখানে খুবই জনপ্রিয়। সেটা না খেলে নাকি ঢাকার ইফতারের ভোজ নিয়ে আমার অভিজ্ঞতা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। খেলাম। খুবই সুস্বাদু। কিন্তু কলকাতার নিউমার্কেটের প্রলেতারিয়েত রেস্টুরেন্ট ‘ইউপি-বিহার’-এর খিরি কাবাবের অপার্থিব স্বাদের সঙ্গে তার তুলনা চলে না। 

অতএব? খেলার স্কোর? কেন মশাই! বেহালা থেকে হাতিবাগান, নিউ আলিপুর-চেতলা থেকে টালা, বনেদী বাড়ি থেকে আকাশঝাড়ু – সব ঘুরে ঘুরে দুর্গা ঠাকুর দেখেও কি দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারেন, কোনটা সবচেয়ে ভাল? তাহলে ইন্দ্রিয়ের আর রসনার এই মিলনমেলাগুলোর মধ্যে তুলনা টানা কেন? তা-ও আবার দুই বাংলার খুশির মহোৎসবের প্রাক্কালে!       

*ছবি সৌজন্য: Youtube, Pinterest, risingbd.com, Facebook

পেশার তাগিদে সার্ভিস সেক্টর বিশেষজ্ঞ, নেশা আর বাঁচার তাগিদে বই পড়া আর আড্ডা দেওয়া। পত্রপত্রিকায় রম্যরচনা থেকে রুপোলি পর্দায় অভিনয়, ধর্মেও আছেন জিরাফেও আছেন তিনি। খেতে ভালোবাসেন বলে কি খাবারের ইতিহাস খুঁড়ে চলেন? পিনাকী ভট্টাচার্য কিন্তু সবচেয়ে ভালোবাসেন ঘুমোতে।

10 Responses

  1. লেখাটি খুবই ভালো লাগলো। বোঝা যাচ্ছে পিনাকী ভট্টাচার্য বেশ ভোজন রসিক। হরেক রকম খাবারের বিষয়ে তাঁর আগ্রহ ও সেগুলোর সঙ্গে পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য সত্যিই তিনি ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। সৈয়দ জিয়া, ঢাকা, ১১/০৫/২০২১।

  2. পিনাকী দাদা, লেখাটা নি:সন্দেহে অত্যন্ত উঁচু মার্গের হয়েছে। অসাধারণ ভাবে উঠে এসেছে পুরোনো ঢাকার সব রসময় লোভনীয় এবং গর্ব করার মতো খাবার। তবে কালা ভুনাটা মূলত গরুর মাংস দিয়ে করা হয় বেশির ভাগ জায়গায় আর এর জন্য বিখ্যাত বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চল। ঢাকার হালিম ও আরেকটি রসনামৃত। ঢাকার আরেকটি সুস্বাদু খাবার হলো গরুর তেহারি আর নান্না মিয়ার আস্ত মুরগির রোস্ট ও লালবাগ কেল্লার মোড়ের কাছে খাসির আস্ত লেগ রোস্ট। তবে একটা খুঁতখুঁত রয়ে গেলো। আপনি যদি ইফতার আর সেহরির খাবারগুলো আরেকটু আলাদা করতেন তাহলে সার্থক হতো আর আমরা মানে পাঠকরা পেতাম পূর্ণাঙ্গ অনাস্বাদিত স্বাদ। ধন্যবাদ আপনাকে।

  3. দু:খিত। বিলম্বের জন্য। । সাবলিল এবং অসাধারন বর্ননায় ইফতারের খাবারগুলো আরো লোভনীয়। লেখার স্টাইলটাও এত মনোগ্রাহী যে মনে হচ্ছিল আমিও সাথে আছি। – ফারুক

  4. অসাধারণ একটি লেখা পড়লাম দাদা। ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ইফতার সম্ভারকে যেভাবে তুলে ধরলে এই লেখায়, আমি বিমোহিত। আবারো তোমার দাওয়াত থাকলো আমাদের ঢাকাতে।❤️

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *