আমরা এর আগে বাংলালাইভ-এর পাতায় “করোনা পরবর্তী উপসর্গ” নিয়ে লিখেছিলাম। সে লেখার প্রেক্ষিতে কিছু অসুখের কথা এসেছিল। সাধারণ পাঠকদের জন্য সেগুলোর খানিকটা বিস্তৃত ব্যাখ্যার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয়। 


গোড়াতেই করোনাভাইরাস বা সার্স-কোভ-২ কীভাবে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে এবং তারপরে বিচিত্র সব উপসর্গ তৈরি করে, তার একটি সংক্ষিপ্ত রেখাচিত্র রাখি। এতে সমগ্র বিষয়টি বুঝতে সুবিধে হবে। সার্স-কোভ-২ তথা করোনাভাইরাসের গায়ে থাকে “স্পাইক প্রোটিন” – বুটের নীচের স্পাইকের মতো দেখতে বলে এরকম নাম হয়েছে। আমাদের শরীরের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রায় সমস্ত অঙ্গে কোষের বাইরের আবরণে ACE2 নামের এক ধরনের রিসেপ্টর থাকে।

আগে আমাদের ধারণা ছিল রিসেপ্টর মূলত কিডনি এবং ফুসফুসে থাকে। সাধারণভাবে এদের প্রধান কাজ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ। এজন্য পৃথিবী জুড়ে কোটি কোটি রোগী ACE2 রিসেপ্টর ব্লকার বা এদের কাজ আটকে দিতে পারে এরকম উচ্চ রক্তচাপ কমানোর ওষুধ খেয়ে থাকেন। আবার ফুসফুসে এই রিসেপ্টর থাকে বলে এই গ্রুপের ওষুধ খেলে একটি জটিল প্রক্রিয়ায় রোগীর অনেক সময় শুকনো কাশি হয়। এই রিসেপ্টরকে ঘিরেই করোনা-তাণ্ডবের প্রকাশ হিসেবে বড় সংখ্যক উপসর্গ তৈরি হয়। নীচের ছবি দেখলে বোঝা যাবে কীভাবে ACE এবং ACE2 রিসেপ্টর কাজ করে।

post covid health complications diagram



post covid complications ACE2 receptors



এ ছবি থেকে বোঝা যায় ACE2 রিসেপ্টরের সর্বময় অস্তিত্ব শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে কিভাবে ছড়িয়ে আছে। এদের উপস্থিতির জন্যই কোভিড-১৯ রোগে এত বেশি রকমের উপসর্গ দেখা যায় – যা আমরা বাংলালাইভ-এর পাতায় এর আগে আলোচনা করেছি।

lung fibrosis diagram

 

লাং ফাইব্রোসিস – এটা ফুসুফুসের এক বিশেষ অবস্থা, যেখানে ফুসফুস যে টিস্যুগুলো তৈরি করে সেগুলো শরীরে ইনফ্লামেশন বা প্রদাহের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং স্থিতিস্থাপকতা নষ্ট হয়ে শক্ত হয়ে যায়। এর ফলে ফুসফুসের স্বাভাবিক সংকোচন-প্রসারণ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়। ফলে দমের কষ্ট, অল্প পরিশ্রমে বুকে চাপ ধরা ইত্যাদি উপসর্গ দেখা যায়। নীচের ছবিটি স্বাভাবিক এবং ফাইব্রোসিস হয়ে যাওয়া ফুসফুসের পার্থক্য বুঝতে সাহায্য করবে। কোভিড-১৯ রোগে শরীরে তীব্র প্রদাহ হয়। যার ফলশ্রুতিতে লাং ফাইব্রোসিস ঘটে।

pulmonary fibrosis diagram



টাকোসুবো কার্ডিওমায়োপ্যাথি
– কার্যত এটা হার্টের একটি সাময়িক অসুখ। জাপানি শব্দ Tako-Tsubo থেকে এর নাম। এরও কারণ কোভিড-১৯ জনিত প্রদাহ। কোভিড-১৯-এর জন্য শরীরে এক তীব্র জৈবরাসায়নিক প্রক্রিয়া চলে, যার অনেকটাই একবছর কেটে গেলেও শ্রেষ্ঠ মেধার বিজ্ঞানী এবং চিকিৎসককুল এখনো সম্যক বুঝে উঠতে পারেননি। টাকোসুবো কার্ডিওমায়োপ্যাথিতে আমাদের হৃদয়ের বাঁ দিকের নিলয় বা ভেন্ট্রিকল ফুলে যায় এবং দেখতে অনেকটা জাপানিদের অক্টোপাস ধরার ফাঁদের মতো দেখতে হয় (Tako – অক্টোপাস, Tsubo – ফাঁদ)। তবে নির্দিষ্ট চিকিৎসায় এবং সময়ের নিয়মে এ রোগ সেরে যায়। নীচের ছবি থেকে এটা বোঝা যাবে।

normal heart and Takotsubo



কাওয়াসাকি ধরনের রোগ
– কোভিড-১৯ রোগীদের ক্ষেত্রে এ রোগটি প্রথম ইতালিতে দেখা যায়। পরে পৃথিবীর সবদেশেই লক্ষ্য করা যায়, এমনকি ভারতেও। যদিও এ রোগটি সাধারণত পাঁচ বছরের কম বাচ্চাদের ক্ষেত্রে হয়, কিন্তু কোভিড-১৯ রোগীদের ক্ষেত্রে বয়স্কদের মধ্যেও দেখা যায় – বমি, ডায়ারিয়া, পেটের ব্যথা। এসবের সঙ্গে জ্বর থাকে। এছাড়া গায়ে র‍্যাশ বেরতে পারে, হাতে পায়ের জ্বলুনিভাব থাকতে পারে।

গুলেইন-বেরি সিন্ড্রোম – এটা স্নায়ুতন্ত্রের অসুখ। বিরল রোগ বলা যায়। ১৩৫ কোটির দেশ ভারতে বছরে ১ লক্ষেরও কম কেস পাওয়া যায়। এখানেও সেই ইনফ্লেমেশনের কাহিনি। কোভিড-১৯ রোগে যে তীব্র প্রদাহ হয় তাতে স্নায়ুতন্তুর বাইরে যে মায়ালিন আবরণ থাকে সেটা নষ্ট হয়ে যায়। স্নায়ুতন্তু নগ্ন হয়ে পড়ে। এর ফলে হাত পা ঝিমঝিম করা, পেশির ও শারীরিক দুর্বলতা এবং বেশি হলে বিশেষ ধরনের পক্ষাঘাত পর্যন্ত হতে পারে। নীচের ছবি থেকে এটা বোঝা যাবে।

gullain barre syndrome



কিটোসিস
– এটা এক ধরনের শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়ার সমস্যা, যেখানে রক্তে খাদ্য বিপাকের ফলে তৈরি হওয়া কিটোন বডির পরিমাণ বেড়ে যায়। পরিণতিতে, বিভিন্ন ধরনের উপসর্গ দেখা যায়। স্বাভাবিকভাবে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস এবং দীর্ঘ অনশনে কিংবা আরও কিছু অসুখে এ রোগ দেখা যায়। কিন্তু কোভিড-১৯ দু’দিক ধারাল তরোয়ালের মতো। যাদের আগের থেকেই ডায়াবেটিস আছে তারা বেশি করে বিপদে পড়ে, ইনসুলিনের ডোজ বাড়াতে হয়। আবার যাদের ডায়াবেটিস নেই তাদের নতুন করে ডায়াবেটিস হতে পারে। এবং এর ফলে কিটোসিস বহুক্ষেত্রেই হয়ে থাকে। এর জেরে রোগীর বমি হতে পারে, খিদে ও ঘুম কমে যেতে পারে, মাথাব্যথা হতে পারে, হার্টের সমস্যা হতে পারে, হতে পারে খিঁচুনি। এমনকি শ্বাসকষ্ট হয়ে জ্ঞান হারিয়েও যেতে পারে। সবমিলিয়ে কিটোসিসের সমস্যা সুখকর নয়। নীচের ছবিটি থেকে এ বিষয়টি ভালভাবে বোঝা যাবে।

acidosis diagram



সুতরাং কোভিড-পরবর্তী সময়ে শরীরের বিশেষ যত্ন নেবার দরকার। সুষম আহার এবং সঠিক পরিমাণে ঘুমের একান্ত প্রয়োজন। তাছাড়া চিকিত্‍সকের পরামর্শ অনুযায়ী চললে শরীর শীঘ্রই আগের অবস্থায় ফিরতে পারবে। 

পেশায় ডাক্তার। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি বিষয়ে গবেষণায় নিযুক্ত। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করেন। বর্তমান ঠিকানা রায়গঞ্জ।

2 Responses

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *